পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GS by রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্রদ্ধা করিতেন, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কোনো কাজই করিতেন না | এত সৌভাগ্য আমার সহিবে কেন ? কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে এবং স্বামী মারা গেলেন । যে দুঃখ কল্পনা করিলেও অসহ্য বোধ হয় তাহাও যে মানুষের সয় ইহাই জানাইবার জন্য ঈশ্বর আমাকে বাচাইয়া রাখিলেন । ক্রমেই জামাইয়ের পরিচয় পাইতে লাগিলাম। সুন্দর ফুলের মধ্যে যে এমন কাল-সাপ লুকাইয়া থাকে তাহা কে মনে করিতে পারে ? সে যে কুসংসর্গে পড়িয়া নেশা ধরিয়াছিল তাহা আমার মেয়েও কোনোদিন আমাকে বলে নাই। জামাই যখন-তখন আসিয়া নানা অভাব জানাইয়া আমার কাছে টাকা চাহিয়া লইয়া যাইত । সংসারে আমার তো আর-কাহারও জন্য টাকা জমাইবার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তাই জামাই যখন আবদার করিয়া আমার কাছ হইতে কিছু চাহিত সে আমার ভালোই লাগিতা। মাঝে মাঝে আমার মেয়ে আমাকে বারণ করিত, আমাকে ভৎসনা করিয়া বলিত- তুমি অমনি করিয়া উহাকে টাকা দিয়া উহার অভ্যাস খারাপ করিয়া দিতেছ, টাকা হাতে পাইলে উনি কোথায় যে কেমন করিয়া উড়াইয়া দেন তাহার ঠিকানা নাই । আমি ভাবিতাম, তাহার স্বামী আমার কাছে এমন করিয়া টাকা লইলে তাহার শ্বশুরকুলের আগীেরব হইবে এই ভয়েই বুঝি মনোরম আমাকে টাকা দিতে নিষেধ করে। তখন আমার এমন বুদ্ধি হইল আমি আমার মেয়েকে লুকাইয়া জামাইকে নেশার কড়ি জোগাইতে লাগিলাম । মনোরমা যখন তাহা জানিতে পারিল তখন সে একদিন আমার কাছে আসিয়া কাদিয়া তাহার স্বামীর কলঙ্কের কথা সমস্ত জানাইয়া দিল । তখন আমি কপাল চাপড়াইয়া মরি। দুঃখের কথা কী আর বলিব, আমার একজন দেওরই কুসঙ্গ এবং কুবুদ্ধি দিয়া আমার জামাইয়ের মাথা খাইয়াছে । টাকা দেওয়া যখন বন্ধ করিলাম এবং জামাই যখন সন্দেহ করিল যে, আমার মেয়েই আমাকে নিষেধ করিয়াছে তখন তাহার। আর কোনো আবরণ রহিল না । তখন সে এত অত্যাচার আরম্ভ করিল, আমার মেয়েকে পৃথিবীর লোকের সামনে এমন করিয়া অপমান করিতে লাগিল যে, তাহাই নিবারণ করিবার জন্য আবার আমি আমার মেয়েকে লুকাইয়া তাহাকে টাকা দিতে লাগিলাম । জানিতাম আমি তাহাকে রসাতলে দিতেছি, কিন্তু মনোরমাকে সে অসহ্য পীড়ন করিতেছে। এ সংবাদ পাইলে আমি কোনোমতে স্থির থাকিতে পারিতাম না । অবশেষে একদিন- সে দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে | মাঘ মাসের শেষাশেষি, সে বছর সকাল সকাল গরম পড়িয়াছে, আমরা বলাবলি করিতেছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের খিড়কির বাগানের গাছগুলি আমের বোলে ভরিয়া গেছে। সেই মাঘের অপরাহুে আমাদের দরজার কাছে পালকি আসিয়া থামিল । দেখি, মনোরমা হাসিতে হাসিতে আসিয়া আমাকে প্ৰণাম করিল। আমি বলিলাম, কী মনু, তোদের খবর কী ? মনোরমা হাসিমুখে বলিল, খবর না থাকলে বুঝি মা'র বাড়িতে শুধু শুধু আসতে নেই ? আমার বেয়ান মন্দ লোক ছিলেন না। তিনি আমাকে বলিয়া পাঠাইলেন, বউমা পুত্ৰসম্ভাবিতা, সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাহার মা'র কাছে থাকিলেই ভালো। আমি ভাবিলাম, সেই কথাটাই বুঝি সত্য। কিন্তু জামাই যে এই অবস্থাতেই মনােরমাকে মারধাের করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বিপৎপাতের আশঙ্কাতেই বেয়ান তাহার পুত্রবধূকে আমার কাছে পঠাইয়া দিয়াছেন তাহা আমি জানিতেও পারি নাই। মনু এবং তাহার শাশুড়িতে মিলিয়া আমাকে এমনি করিয়া ভুলইয়া রাখিল । মেয়েকে আমি নিজের হাতে তেল মাখাইয়া স্নান করাইতে চাহিলে মনোরমা নানা ছুতায় কাটাইয়া দিত ; তাহার কোমল অঙ্গে যে-সব আঘাতের দাগ পড়িয়ছিল সে তাহা তাহার মায়ের দৃষ্টির কাছেও প্রকাশ করিতে চাহে নাই। জামাই মাঝে মাঝে আসিয়া মনোরমাকে বাড়ি ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য গোলমাল করিত । মেয়ে আমার কাছে থাকতে টাকার আবদার করিতে তাহার ব্যাঘাত ঘটিত । ক্রমে সে