পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী উভয়ে প্রায় বিশ মিনিট ধরিয়া যে কথাবার্তা কহিয়াছিল তাহার সারমর্মটুকু এই দাঁড়ায় । তাহারা হিন্দু কি ব্ৰাহ্ম এ কথা তাহারা ভুলিল, তাহারা যে দুই মানবাত্মা এই কথাই তাঁহাদের মধ্যে নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো জ্বলিতে লাগিল । &ỳ পরেশবাবু উপাসনার পর তাহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিলেন । সূর্য সদ্য অস্ত গিয়াছে। এমন সময় ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় সেখানে প্রবেশ করিল ও ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিয়া পরেশের পদধূলি লইল । পরেশ উভয়কে এভাবে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন । কাছে বসিতে দিবার চৌকি ছিল না, তাই বলিলেন, “চলো, ঘরে চলো ৷” বিনয় কহিল, “না, আপনি উঠবেন না ।” বলিয়া সেইখানে ভূমিতলেই বসিল । ললিতাও একটু সরিয়া পরেশের পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল । বিনয় কহিল, “আমরা দুজনে একত্রে আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি। সেই আমাদের পরেশবাবু বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন । বিনয় কহিল, “বাধা নিয়মে বাধা কথায় সমাজে প্ৰতিজ্ঞাগ্ৰহণ আমি করব না । যে দীক্ষায় আমাদের দুজনের জীবন নত হয়ে সত্যবন্ধনে বদ্ধ হবে সেই দীক্ষা আপনার আশীর্বাদ । আমাদের দুজনেরই হৃদয় ভক্তিতে আপনারই পায়ের কাছে প্ৰণত হয়েছে-— আমাদের যা মঙ্গল তা ঈশ্বর আপনার হাত দিয়েই দেবেন ।” A পরেশবাবু কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া রহিলেন । পরে কহিলেন, “বিনয়, তুমি তা হলে ব্ৰাহ্ম হবে না ?” বিনয় কহিল, “না।” পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি হিন্দুসমাজেই থাকতে চাও ?” বিনয় কহিল, “ই ।” পরেশবাবু ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন । ললিতা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “বাবা, আমার যা ধর্ম তা আমার আছে এবং বরাবর থাকবে । আমার অসুবিধা হতে পারে, কষ্টও হতে পারে ; কিন্তু যাদের সঙ্গে আমার মতের, এমন-কি, আচরণের অমিল আছে, তাদের পর করে দিয়ে তফাতে না সরিয়ে রাখলে আমার ধর্মে বাধবে এ কথা আমি কোনোমতেই মনে করতে পারি। নে ৷” পরেশবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। ললিত কহিল, “আগে আমার মনে হত ব্ৰাহ্মসমাজই যেন একমাত্র জগৎ, এর বাইরে যেন সব ছায়া । ব্ৰাহ্মসমাজ থেকে বিচ্ছেদ যেন সমস্ত সত্য থেকে বিচ্ছেদ । কিন্তু এই কয় দিনে সে ভােব আমার একেবারে চলে গেছে।” পরেশবাবু স্নানভাবে একটু হাসিলেন । ললিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে জানাতে পারি। নে আমার কতবড়ো একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে | ব্ৰাহ্মসমাজের মধ্যে আমি যে-সব লোক দেখছি তাদের অনেকের সঙ্গে আমার ধর্মমত এক হলেও তাদের সঙ্গে তো আমি কোনোমতেই এক নই- তবু ব্ৰাহ্মসমাজ বলে একটা নামের আশ্রয় নিয়ে তাদেরই আমি বিশেষ করে আপনি বলব, আর পৃথিবীর অন্য সব লোককেই দূরে রেখে দেব, আজকাল আমি এর কোনো মানে বুঝতে পারি। নে ৷” পরেশবাবু তাহার বিদ্রোহী কন্যার পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “ব্যক্তিগত কারণে মন যখন উত্তেজিত থাকে তখন কি বিচার ঠিক হয় ? পূর্বপুরুষ থেকে সস্তানসন্ততি পর্যন্ত মানুষের যে একটা পূর্বাপরতা আছে তার মঙ্গল দেখতে গেলে সমাজের প্রয়ােজন হয়— সে প্রয়ােজন তো কৃত্রিম