পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(s \ኃ(ሰ (ነ আমার কী উপকার করেছ সে আমি তোমাকে এক মুখে বলতে পারি নে। ভগবান তোমাকে রাজরাজেশ্বর করুন। তোমার কুলমানের যোগ্য একটি লক্ষ্মী মেয়ে ভালো ঘর থেকে বিয়ে করে আনো, তোমার ঘর উজ্জ্বল হােক, ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ হােক ৷” তাহার পরে কথা পাড়িলেন, সুচরিতার বয়স হইয়াছে, বিবাহ করিতে তাহার আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত নয়, হিন্দুঘরে থাকিলে এতদিনে সন্তানের দ্বারা তাহার কোল ভরিয়া উঠিত। বিবাহে বিলম্ব করায় যে কতবড়ো অবৈধ কাজ হইয়াছে সে সম্বন্ধে গোরা নিশ্চয়ই তাহার সঙ্গে একমত হইবেন । হরিমোহিনী দীর্ঘকাল ধরিয়া সুচরিতার বিবাহসমস্যা সম্বন্ধে অসহ্য উদবেগ ভোগ করিয়া অবশেষে বহু সাধ্যসাধনা অনুনয়বিনয়ে তাহার দেবার কৈলাসকে রাজি করিয়া, কলিকাতায় আনিয়াছেন। যে-সমস্ত গুরুতর বাধাবিয়ের আশঙ্কা করিয়াছিলেন তাহা সমস্তই ঈশ্বরেচ্ছায় কাটিয়া গিয়াছে। সমস্তই স্থির, বরপক্ষে এক পয়সা পণ পর্যন্ত লইবে না এবং সুচরিতার পূর্ব-ইতিহাস লইয়াও কোনাে আপত্তি প্রকাশ করিবে না- হরিমোহিনী বিশেষ কৌশলে এই-সমস্ত সমাধান করিয়া দিয়াছেন- এমন সময়, শুনিলে লোকে আশ্চর্য হইবে, সুচরিতা একেবারে বাকিয়া দাড়াইয়াছে। কী তাহার মনের ভােব তিনি জানেন না ; কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইয়াছে কি না, আর-কারও দিকে তাহার মন পড়িয়াছে কি না, তাহা ভগবান 37grd l “কিন্তু বাপু, তোমাকে আমি খুলেই বলি, ও মেয়ে তোমার যোগ্য নয়। পাড়াগায়ে ওর বিয়ে হলে ওর কথা কেউ জানতেই পারবে না ; সে একরকম করে চলে যাবে । কিন্তু তোমরা শহরে থাক, ওকে যদি বিয়ে কর তা হলে শহরের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।” গোরা ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনি এ-সব কথা কী বলছেন ! কে আপনাকে বলেছে যে, আমি তাকে বিবাহ করবার জন্যে তীর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছি!” হরিমোহিনী কহিলেন, “আমি কী করে জানব বাবা ! কাগজে বেরিয়ে গেছে সেই শুনেই তো লজ্জায় মরছি ।” গোরা বুঝিল, হারানবাবু অথবা তাহার দলের কেহ এই কথা লইয়া কাগজে আলোচনা করিয়াছে। গোরা মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা !” হরিমােহিনী তাহার গর্জনশব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আমিও তো তাই জানি। এখন আমার একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতেই হবে। একবার তুমি রাধারানীর কাছে চলো।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?” হরিমোহিনী কহিলেন, “তুমি তাকে একবার বুঝিয়ে বলবে।” গোরার মন এই উপলক্ষটি অবলম্বন করিয়া তখনই সুচরিতার কাছে যাইবার জন্য উদ্যত হইল । তাহার হৃদয় বলিল, “আজ একবার শেষ দেখা দেখিয়া আসিবে চলো। কাল তোমার প্রায়শ্চিত্ততাহার পর হইতেই তুমি তপস্বী । আজ কেবল এই রাত্রিটুকুমাত্র সময় আছে- ইহারই মধ্যে কেবল অতি অল্পক্ষণের জন্য । তাহাতে কোনো অপরাধ হইবে না । যদি হয় তো কাল সমস্ত ভস্ম হইয়া যাইবে ।” গোরা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তঁাকে কী বােঝাতে হবে বলুন।” আর কিছু নয়- হিন্দু আদর্শ অনুসারে সুচরিতার মতো বয়স্থ কন্যার অবিলম্বে বিবাহ করা কর্তব্য এবং হিন্দুসমাজে কৈলাসের মতো সৎপাত্রলাভ সুচরিতার অবস্থার মেয়ের পক্ষে অভাবনীয় সৌভাগ্য। গোরার বুকের মধ্যে শেলের মতো বিধিতে লাগিল। যে লোকটিকে গোরা সুচরিতার বাড়ির দ্বারের কাছে দেখিয়াছিল তাহাকে স্মরণ করিয়া গোরা বৃশ্চিকদংশনে পীড়িত হইল। সুচরিতাকে সে লাভ করিবে এমন কথা কল্পনা করাও গোরার পক্ষে অসহ্য । তাহার মন বৰ্জনাদে বলিয়া উঠিল, “না, এ কখনোই হইতে পারে না। ’ আর-কাহারও সঙ্গে সুচরিতার মিলন হওয়া অসম্ভব ; বুদ্ধি ও ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ সুচরিতার নিস্তব্ধ গভীর হৃদয়টি পৃথিবীতে গোরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনাে মানুষের সামনে এমন করিয়া প্রকাশিত হয়