পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vbro রবীন্দ্র-রচনাবলী করে ; তাহার বেশি সে যাহা-কিছু অবলম্বন করে তাহাতে তাহার নিজের অবমাননা হয়। ইহা বলা বাহুল্য, নাট্যোক্ত কথাগুলি অভিনেতার পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক । কবি তাহাকে যে হাসির কথাটি জোগান তাহা লইয়াই তাহাকে হাসিতে হয় ; কবি তাহাকে যে কান্নার অবসর দেন তাহা লইয়াই কঁদিয়া সে দর্শকের চোখে জল টানিয়া আনে । কিন্তু ছবিটা কেন ? তাহা অভিনেতার পশ্চাতে বুলিতে থাকে, অভিনেতা তাহাকে সৃষ্টি করিয়া তোলে না ; তাহা আঁকামাত্র ; আমার মতে তাহাতে অভিনেতার অক্ষমতা, কাপুরুষতা প্রকাশ পায়। এইরূপে যে উপায়ে দর্শকদের মনে বিভ্ৰম উৎপাদন করিয়া সে নিজের কাজকে সহজ করিয়া তোলে তাহা চিত্রকারের কাছা হইতে ভিক্ষা করিয়া আনা । তা ছাড়া, যে দর্শক তোমার অভিনয় দেখিতে আসিয়াছে তাহার কি নিজের সম্বল কানা-কড়াও নাই ? সে কি শিশু ? বিশ্বাস করিয়া তাহার উপরে কি কোনো বিষয়েই নির্ভর করিবার জো নাই ? যদি তাহা সত্য হয়, তবে ডবল দাম দিলেও এমন-সকল লোককে টিকিট বেচিতে নাই । এ তো আদালতের কাছে সাক্ষ্য দেওয়া নয় যে, প্রত্যেক কথাটাকে হলফ করিয়া প্ৰমাণ করিতে হইবে । যাহারা বিশ্বাস করিবার জন্য, আনন্দ করিবার জন্য আসিয়াছে, তাহাদিগকে এত ঠকাইবার আয়োজন কেন ? তাহারা নিজের কল্পনাশক্তি বাড়িতে চাবিবন্ধ করিয়া আসে নাই। কতক তুমি বোঝাইবে, কতক তাহারা বুঝিবে, তোমার সহিত তাঁহাদের এইরূপ আপসের সম্বন্ধ । দুষ্যন্ত গাছের গুড়ির আড়ালে দাড়াইয়া সখীদের সহিত শকুন্তলার কথাবার্তা শুনিতেছেন। অতি উত্তম । কথাবার্তা বেশ রসে জমাইয়া বলিয়া যাও । আস্ত গাছের গুড়িটা আমার সম্মুখে উপস্থিত না থাকিলেও সেটা আমি ধরিয়া লইতে পারি— এতটুকু সৃজনশক্তি আমার আছে। দুষ্যস্ত-শকুন্তলা অনসূয়া-প্রিয়ংবদা’র চরিত্রানুরূপ প্রত্যেক হাবভাব এবং কণ্ঠস্বরের প্রত্যেক ভঙ্গি একেবারে প্রত্যক্ষবৎ অনুমান করিয়া লওয়া শক্ত, সুতরাং সেগুলি যখন প্রত্যক্ষ বর্তমান দেখিতে পাই তখন হৃদয় রসে অভিষিক্ত হয় ; কিন্তু দুটাে গাছ বা একটা ঘর বা একটা নদী কল্পনা করিয়া লওয়া কিছুই শক্ত নয়— সেটাও আমাদের হাতে না রাখিয়া চিত্রের দ্বারা উপস্থিত করিলে আমাদের প্রতি ঘোরতর অবিশ্বাস প্ৰকাশ করা হয় । আমাদের দেশের যাত্রা আমার ঐজন্য ভালো লাগে । যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটা গুরুতর ব্যবধান নাই। পরস্পরের বিশ্বাস ও আনুকূল্যের প্রতি নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ ফোয়ারার মতো চারি দিকে দর্শকদের পুলকিত চিত্তের উপর ছড়াইয়া পড়ে। মালিনী যখন তাহার পুষ্পবিরল বাগানে ফুল খুঁজিয়া বেলা করিয়া দিতেছে তখন সেটাকে সপ্রমাণ করিবার জন্য আসরের মধ্যে আস্ত আস্ত গাছ আনিয়া ফেলিবার কী দরকার আছে- এক মালিনীর মধ্যে সমস্ত বাগান আপনি জাগিয়া উঠে। তাই যদি না হইবে তবে মালিনীরই বা কী গুণ, আর দর্শকগুলোই বা কাঠের মূর্তির মতো কী করিতে বসিয়া আছে ? * শকুন্তলার কবিকে যদি রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপটের কথা ভাবিতে হইত, তবে তিনি গোড়াতেই মৃগের পশ্চাতে রথ ছোটানো বন্ধ করিতেন। অবশ্য, তিনি বড়ো কবি- রথ বন্ধ হইলেও যে তাহার কলম বন্ধ হইত। তাহা নহে; কিন্তু আমি বলিতেছি, যেটা তুচ্ছ তাহার জন্য যাহা বড়ো তাহা কেন নিজেকে কোনো অংশে খর্ব করিতে যাইবে ? ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চে স্থানাভাব নাই। সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল, কোনো কৃত্রিম মঞ্চ ও কৃত্রিম পট কবিকল্পনার উপযুক্ত হইতে পারে না। অতএব, যখন দুষ্যন্ত ও সারথি একই স্থানে স্থির দাড়াইয়া বৰ্ণনা ও অভিনয়ের দ্বারা রথবেগের আলোচনা করেন, সেখানে দর্শক এই অতি সামান্য কথাটুকু অনায়াসেই। ধরিয়া লন যে, মঞ্চ ছোটাে, কিন্তু কাব্য ছোটো নয় ; অতএব কাব্যের খাতিরে মঞ্চের এই অনিবাৰ্য ক্রটিকে প্ৰসন্নচিত্তে তাহারা মার্জনা করেন এবং নিজের চিত্তক্ষেত্ৰকে সেই ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে প্রসারিত করিয়া দিয়া মঞ্চকেই মহীয়ান করিয়া তােলেন। কিন্তু মঞ্চের খাতিরে কাব্যকে যদি খাটাে হইতে হইত, তবে ঐ কয়েকটা