পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বাপরিচয় (S মহাকর্ষ সম্বন্ধে এই যে মতের আলোচনা করা গেল নুটনের সময় থেকে এটা চলে আসছে। এর থেকে আমাদের মনে এই একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, দুই বস্তুর মাঝখানের অবকাশের ভিতর দিয়ে একটা অদৃশ্য শক্তি টানাটানি করছে। কিন্তু এই ছবিটা মনে আনবার কিছু বাধা আছে। মহাকর্থের ক্রিয়া একটুও সময় নেয় না। আকাশ পেরিয়ে আলো আসতে সময় লাগে সে কথা পূর্বে বলেছি। বৈদ্যুতিক শক্তিরাও ঢেউ খেলিয়ে আসে আকাশের ভিতর দিয়ে। কিন্তু অনেক পরীক্ষা করেও মহাকর্ষের বেলায় সেরকম সময় নিয়ে চলার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার প্রভাব তাৎক্ষণিক। আরো একটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আলো বা উত্তাপ পথের বাধা মানে কিন্তু মহাকর্ষতা মানে না। একটা জিনিসকে আকাশে ঝুলিয়ে রেখে পৃথিবী আর তার মাঝখানে যত বাধাই রাখা যাক না তার ওজন কমে না । ব্যবহারে অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে 3 fer ofte R a অবশেষে আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন এটা একটা শক্তিই নয়। আমরা এমন একটা জগতে আছি যার আয়তনের স্বভাব অনুসারেই প্রত্যেক বস্তুই প্রত্যেকের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য। বস্তুমাত্র যে-আকাশে থাকে তার একটা বঁকানো গুণ আছে, মহাকর্ষে তারই প্রকাশ । এটা সৰ্বব্যাপী, এটা অপরিবর্তনীয়। এমনকি, আলোককেও এই বঁকা বিশ্বের ধারা মানতে হয় । তার নানা প্রমাণ পাওয়া গেছে। বোঝার পক্ষে টানের ছবি সহজ ছিল। কিন্তু যে-নৃতন জ্যামিতির সাহায্যে এই বঁকা আকাশের ঝোক হিসেব করে জানা যায়। সে কজন লোকেরই বা আয়ত্তে আছে। যাই হােক ইংরেজিতে যাকে গ্র্যাভিটেশন বলে তাকে মহাকর্ষ না বলে ভারাবর্তন নাম দিলে গোল চুকে যায়। আমাদের এই যে নক্ষত্ৰজগৎ, এ যেন বিরাট শূন্য আকাশের দ্বীপের মতো। এখান থেকে দেখা যায় দূরে দূরে আরো অনেক নাক্ষত্রদ্বীপ। এই দ্বীপগুলির মধ্যে সব চেয়ে আমাদের নিকটের যেটি, তাকে দেখা যায় অ্যাভূমিডা নক্ষত্র দলের কাছে । দেখতে একটা ঝাপসা তারার মতো । সেখান থেকে যে আলো চোখে পড়ছে সে যাত্রা করে বেরিয়েছেন লক্ষ বছর পূর্বে। কুণ্ডলীচক্র-পাকানো নীহারিকা আরো আছে আরো দূরে । তাদের মধ্যে সব চেয়ে দূরবতীর সম্বন্ধে হিসাবে স্থির হয়েছে যে, সে আছে তিন হাজার লক্ষ আলো-বছর দূরত্বের পথে । বহুকোটি নক্ষত্র-জড়ো-করা এই-সব নক্ষত্ৰজগতের সংখ্যা একশো কোটির কম হবে না । একটা আশ্চর্যের কথা উঠেছে এই যে কাছের দুটাে-তিনটে ছাড়া বাকি নক্ষত্ৰজগৎগুলো আমাদের জগতের কাছ থেকে কেবলই সরে চলেছে। যেগুলি যত বেশি দূরে তাদের দৌড়-বেগও তত বেশি। এই-সব নক্ষত্ৰজগতের সমষ্টি নিয়ে যে বিশ্বকে আমরা জানি কোনো কোনো পণ্ডিত ঠিক করেছেন সে ক্রমশই ফুলে উঠছে। সুতরাং যতই ফুলছে ততই নক্ষত্রপুঞ্জের পরস্পরের দূরত্ব যাচ্ছে বেড়ে । যে-বেগে তারা সরছে তাতে আর একশো ত্ৰিশ কোটি বছর পরে তাদের পরস্পরের দূরত্ব এখনকার CSS fୟିତ୍ୱ ଅଶ୍ୱ । অর্থাৎ এই পৃথিবীর ভূগঠনের সময়ের মধ্যে নক্ষত্রবিশ্ব আগেকার চেয়ে দ্বিগুণ ফেপে গিয়েছে। শুধু এই নয়, একদল বিজ্ঞানীর মতে এই বস্তুপুঞ্জসংঘটিত বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে গোলাকরূপী আকাশটাও বিস্ফোরিত হয়ে চলেছে । এদের মতে আকাশের কোনো-এক বিন্দু থেকে সিধে লাইন টানলে সে লাইন অসীমে চলে না গিয়ে ঘুরে এসে এক সময়ে সেই প্রথম বিন্দুতে এসে পৌঁছয় । এই মত-অনুসারে দাড়াচ্ছে এই যে, আকাশগোলকে নক্ষত্ৰজগৎগুলি আছে, যেমন আছে পৃথিবী-গোলককে ঘিরে জীবজন্তু গাছপালা । সুতরাং বিশ্বজগৎটার ফেপে-ওঠা সেই আকাশমণ্ডলেরই বিশ্বফারণের মাপে। কিন্তু মতের স্থিরতা হয় নি। এ কথা মনে রাখা উচিত ; আকাশ অসীম, কালও নিরবধি, এই মতটাও মরে নি। আকাশটাও বুদবুদ কি না। এই প্রসঙ্গ আমাদের শাস্ত্রের মত এই যে সৃষ্টি চলেছে প্রলয়ের দিকে । সেই প্রলয়ের থেকে আবার নূতন সৃষ্টি উদভাসিত হচ্ছে, ঘুম আর জাগার