পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሰ br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের মুখরিত দিনরাত্রির সব কথা ঝরে পড়ছে তার মাটিতে, তার সঙ্গে মিশিয়ে গিয়ে তার প্রকাশের শক্তিকে করছে উর্বরা । তবু একটা কথা মানতে হবে যে, মানুষের বলবার কথা সবই যে সহজ তা নয় ; এমন কথা আছে যা ভালো করে ঐটে না বললে বলাই হয় না । সেই সব বিচার-করা কথা কিংবা সাজিয়ে-বলা কথা চলে না দিনরাত্রির ব্যবহারে, যেমন চলোনা দরবারি পোশাক কিংবা বেনারসি শাড়ি । আমরা সর্বদা মুখের কথায় বিজ্ঞান আওড়াই নে। তত্ত্বকথাও পণ্ডিতসভার, তার আলোচনায় বিশেষ বিদ্যার দরকার করে। তাই তর্ক ওঠে, এদের জন্যে চলতি ভাষার বাইরে একটা পাকা গাথুনির ভাষা বানানো নেহাত দরকার ; সাধু ভাষায় এরকম মহলের পত্তন' সহজ, কেননা, ও ভাষাটাই বানানো। কথাটা একটু বিচার করে দেখা যাক। আমরা লিখিয়ে-পড়িয়ের দলে চলতি ভাষাকে অনেককাল থেকে জাতে ঠেলেছি। সাহিত্যের আসরে তাকে পা বাড়াতে দেখলেই দরোয়ান এসেছে তাড়া করে। সেইজনেই খিড়কির দরজায় পথ চলার অভ্যাসটাই ওর হয়ে গেছে স্বাভাবিক। অন্দরমহলে যে মেয়েরা অভ্যন্ত তাদের ব্যবহার সহজ হয় পরিচিত আত্মীয়দের মধ্যেই, বাইরের লোকদের সামনে তাদের মুখ দিয়ে কথা সরে না। তার কারণ এ নয় যে তাদের শক্তি নেই, কিন্তু সংকুচিত হয়েছে তাদের শক্তি । পাশ্চাত্য জাতিদের ভাষায় এই সদর-অন্দরের বিচার নেই। তাই সেখানে সাহিত্য পেয়েছে চলনশীল প্ৰাণ, আর চলতি ভাষা পেয়েছে। মননশীলতার ঐশ্বর্য। আমাদের ঘোমটা টানার দেশে সেটা তেমন করে প্রচলিত হয় নি ; কিন্তু হবার বাধা বাইরের শাসন, স্বভাবের মধ্যে নয় ; সে অনেক দিনের কথা । তখন রামচন্দ্ৰ মিত্র ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলার অধ্যাপক ; তার একজন ছাত্রের কাছে শুনেছি, পরীক্ষা দিতে যাবার পূর্বে বাংলা রচনা সম্বন্ধে তিনি উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “বাবা, সুশীতলসমীরণ লিখতে গিয়ে যত্বে ণত্বে কিংবা হ্রস্থ দীর্ঘ স্বরে যদি ধাধা লাগিয়ে দেয় তা হলে লিখে দিয়ে ‘ঠাণ্ডা হাওয়া’ ?” সেদিনকার দিনে এটি সোজা কথা ছিল না । তখনকার সাধু বাংলা ঠাণ্ডা হাওয়া কিছুতেই সইতে পারত না, তখনকার রুগিরা যেমন ঠাণ্ডা জল খেতে পেত না তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলেও । সাধু ভাষার সঙ্গে চলতি ভাষার প্রধান তফাতটা ক্রিয়াপদের চেহারার তফাত নিয়ে। 'হচ্ছে “করছে কে যদি জলচল করে নেওয়া যায় তা হলে জাতঠেলা ঠেলি অনেকটা পরিমাণে ঘোচে উতঙ্কের গুরুদক্ষিণা আনবার সময় তক্ষক বিঘ্ন ঘটিয়েছিল, এইটে থেকেই সর্ববংশধ্বংসের উৎপত্তি । এর ক্রিয়াকাটাকে অল্প একটু মোচড় দিয়ে সাধু ভাষার ভঙ্গী দিলেই কালীসিংহের মহাভারতের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তার কাজে ও কথায় অসংগতি । মুখের ভাষাতেও এটা বলা চলে, আবার এওঁ বলা যায় ‘র্তার কাজে কথায় মিল নেই । ‘বাসুকি ভীমকে আলিঙ্গন করলেন এ কথাটা মুখের ভাষায় অশুচি হয় না, আবার ‘বাসুকি ভীমের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এটাতেও বোধ হয় নিন্দের কারণ ঘটে না। বিজ্ঞানে দুর্বোিধ তথ্য আছে, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের সাধু ভাষায়ও গলদঘর্ম হয়, আবার চলতি ভাষারও চোখে অন্ধকার ঠেকে । বিজ্ঞানের চর্চা আমাদের দেশে যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন উভয় ভাষাতেই তার পথ প্রশস্ত হতে থাকবে। নতুন-বানানো পারিভাবিকে উভয় পক্ষেরই হবে সমান স্বত্ব । •० এইখানে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সংস্কৃতের আশ্রয় না নিলে বাংলাভাষা আচল । কী জ্ঞানের কী ভাবের বিষয়ে বাংলা সাহিত্যের যতই বিস্তার হচ্ছে ততই সংস্কৃতের ভাণ্ডার থেকে শব্দ এবং শব্দ বানাবার উপায় সংগ্ৰহ করতে হচ্ছে। পাশ্চাত্য ভাষাগুলিকেও এমনি করেই গ্ৰীক-লাটিনের বিশ মানতে হয়। তার পরিভাষিক শব্দগুলো গ্ৰীক লাটিন থেকে ধার নেওয়া কিংবা তারই উপাদান নিয়ে তারই ছাচে ঢালা। ইংরেজি ভাষায় দেখা যায়, তার পুরাতন পরিচিত দ্রব্যের নামগুলি স্যাকসন এবং