পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՏԵr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বৈচিত্ৰ্যই জগতের ঐক্যকে প্রমাণ করে, বৈচিত্ৰ্য যতই সুনির্দিষ্ট হয় ঐক্য ততই সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। ধর্মও সেইরূপ নানা সমাজের ইতিহাসকে আশ্রয় করিয়া নানা বিভিন্ন কণ্ঠে নানা বিচিত্র আকারে এক নিত্যসত্যকে চারি দিক হইতে সপ্ৰমাণ করিতে চেষ্টা করিতেছে। ভারতবর্ষ বিশেষ সাধনায় ইতিহাস হইতে উৎপাটিত করিয়া, তাহাকে অন্যদেশীয় আকৃতিপ্রকৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া দিবার চেষ্টা করিলে জগতের ঐক্যমূলক বৈচিত্র্যের ধর্মকে লঙঘন করা হয়। প্রত্যেক লোক যখন আপনার প্রকৃতি-অনুসারে পরিপূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করে তখনই সে মনুষ্যত্ব লাভ করে ; সাধারণ মনুষ্যত্ব ব্যক্তিগত বিশেষত্বের ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। মনুষ্যত্ব হিন্দুর মধ্যে এবং খৃস্টানের মধ্যে বস্তুত একই, তথাপি হিন্দু-বিশেষত্ব মনুষ্যত্বের একটি বিশেষ সম্পদ, এবং খৃস্টান-বিশেষত্বও মনুষ্যত্বের একটি বিশেষ লাভ ; তাহার কোনোটা সম্পূর্ণ বর্জন করিলে মনুষ্যত্ব দৈন্যপ্ৰাপ্ত হয়। ভারতবর্ষের যাহা শ্রেষ্ঠ ধন তাহাও সার্বভৌমিক, য়ুরোপের যাহা শ্রেষ্ঠ ধন তাহাও সার্বভৌমিক ; তথাপি ভারতবর্ষীয়তা এবং যুরোপীয়তা উভয়ের স্বতন্ত্র সার্থকতা আছে বলিয়া, উভয়কে একাকার করিয়া দেওয়া চলে না। মেঘ আকাশ হইতে জলবর্ষণ করে এবং সরোবর ভূতলে থাকিয়া জল দান করে ; যদিও দানের সামগ্ৰী একই তথাপি এই পার্থক্যবশতই মেঘ আপন প্রকৃতি-অনুসারে বিশেষভাবে ধন্য এবং সরোবরও আপন প্রকৃতি-অনুসারে বিশেষভাবে কৃতাৰ্থ। ইহারা উভয়ে এক হইয়া গেলে জলের পরিমাণ মোটের উপর কমে না, কিন্তু জগতে ক্ষতির কারণ ঘটে । তরুণ ব্ৰাহ্মসমাজ যখন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এই কথা ভুলিয়াছিল, যখন ধর্মের স্বদেশীয় রূপ রক্ষা করাকে সে সংকীর্ণতা বলিয়া জ্ঞান করিত— যখন সে মনে করিয়াছিল, বিদেশীয় ইতিহাসের ফল ভারতবর্ষীয় শাখায় ফলাইয়া তোলা সম্ভবপর এবং সেই চেষ্টাতেই যথার্থভাবে ঔদার্য রক্ষা হয়, তখন পিতৃদেব সার্বভৌমিক ধর্মের স্বদেশীয় প্রকৃতিকে একটা বিমিশ্রিত একাকারিত্বের মধ্যে বিসর্জন দিতে অস্বীকার করিলেন। ইহাতে র্তাহার অনুবতী অসামান্যপ্রতিভাশালী ধর্মোৎসাহী অনেক তেজস্ব যুবকের সহিত র্তাহার বিচ্ছেদ ঘটিল। এই বিচ্ছেদ স্বীকার করিতে যে দৃঢ়তা, যে সাহস, যে বলের প্রয়োজন হয়, সমস্ত মতামতের কথা বিস্মৃত হইয়া আজ তাঁহাই যেন আমরা স্মরণ করি। আধুনিক হিন্দুসমাজের প্রচলিত লোকাচারের প্রবল প্রতিকূলতার মুখে আপন অনুবতী সমাজের ক্ষমতাশালী সহায়গণকে পরিত্যাগ করিয়া নিজেকে সকল দিক হইতেই রিক্ত করিতে কে পারে, যাহার অন্তঃকরণ জগতের আদিশক্তির অক্ষয় নিবারধারায় অহরহ পূর্ণ হইয়া না উঠিতেছে। ইহাকে যেমন আমরা সম্পদে-বিপদে অভয় আশ্রয়ে অবিচলিত দেখিয়াছি তেমনি একবার দেখিলাম ; দেখিলাম উপস্থিত গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা তাহাকে টলাইতে পারিল না। হিন্দুসমাজের মধ্যে তিনি পরম দুদিনেও একাকী দাড়াইয়াছিলেন, ব্ৰাহ্মসমাজে তিনি নব আশা নব উৎসাহের অভু্যদয়ের মুখে পুনর্বার সমস্ত ত্যাগ করিয়া একাকী দাড়াইলেন। তাহার কেবল এই প্রার্থনা রহিল : মাহং ব্ৰহ্ম নিরাকুৰ্য্যং মা মা ব্ৰহ্ম নিরাকারোৎ |— আমি ব্ৰহ্মকে ত্যাগ করিলাম না, ব্ৰহ্ম আমাকে ত্যাগ व् ब् | ধনসম্পদের স্বৰ্ণস্তুপরিচিত ঘনান্ধকার ভেদ করিয়া নবযৌবনের অপরিতৃপ্ত প্রবৃত্তির পরিবেষ্টনের মধ্যে দিব্যজ্যোতি র্যাহার ললাট স্পর্শ করিয়াছিল, ঘনীভূত বিপদের ভুকুটিকুটিল রুদ্রচ্ছায়ায় আসন্ন দারিদ্র্যের উদ্যত বজদণ্ডের সম্মুখেও ঈশ্বরের প্রসন্ন মুখচ্ছবি র্যাহার অনিমেষ অন্তদৃষ্টির সম্মুখে আচঞ্চল ছিল, দুর্দিনের সময়েও সমস্ত লোকভয় অতিক্রম করিয়া যাহার কর্ণে ধর্মের “মা ভৈঃ’ বাণী সুস্পষ্ট ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছিল, বলবৃদ্ধি-দলপুষ্টির মুখে যিনি বিশ্বাসের বলে সমস্ত সহায় হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিঃসংকোচে পরমসহায়ের আশ্রয়গ্ৰহণ করিয়াছিলেন অদ্য র্তাহার পুণ্যচেষ্টা ভূয়িষ্ঠ সুদীর্ঘ জীবনদিনের সায়াহ্নকাল সমাগত হইয়াছে। অদ্য র্তাহার ক্লান্তকণ্ঠের স্বর ক্ষীণ, কিন্তু তাহার সম্পূৰ্ণপ্ৰায় জীবনের নিঃশব্দবাণী সুস্পষ্টতর। অদ্য র্তাহার ইহজীবনের কর্ম সমাপ্ত, কিন্তু তাহার জীবনব্যাপী