পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬১৮ রবীন্দ্ররচনাবলী ইতিহাস প্রচ্ছন্ন ছিল। একপ্রকার স্কুলারুচির মানুষ আছে তাহাদিগকে অল্প কিছুতেই স্পর্শ করে নাতাহাদের অচেতনতাই তাহাদিগকে অনেক আঘাত হইতে রক্ষা করে। ভগিনী নিবেদিতা একেবারেই তেমন মানুষ ছিলেন না। সকল দিকেই তঁহার বােধশক্তি সূক্ষ্ম এবং প্রবল ছিল ; রুচির বেদনা ঠাঁহার পক্ষে আৰু বেদনা নহে ; ঘরে বাহিরে আমাদের অসাড়ত, শৈথিল্য অপরিচ্ছন্নতা, আমাদের অব্যবস্থা ও সকল-প্রকার চেষ্টার অভাব, যাহা পদে পদে আমাদের তামসিকতার পরিচয় দেয় তাহা প্রত্যহইষ্ঠাহাকে তীব্ৰ পীড়া দিয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু সেইখানেই তাঁহাকে পরাভূত করিতে পারে নাই। সকলের চেয়ে কঠিন পরীক্ষা এই যে প্রতিমুহূর্তের পরীক্ষা, ইহাতে তিনি জয়ী হইয়াছিলেন। শিবের প্রতি সতীর সত্যকার প্রেম ছিল বলিয়াই তিনি অর্ধশনে অনশনে অগ্নিতাপ সহ্য করিয়া আপনার অত্যন্ত সুকুমার দেহ ও চিত্তকে কঠিন তপস্যায় সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই সতী নিবেদিতাও দিনের পর দিন যে তপস্যা করিয়াছিলেন তাহার কঠোরতা অসহ্য ছিল- তিনিও অনেকদিন অর্ধশন অনশন স্বীকার করিয়াছেন, তিনি গলির মধ্যে যে বাড়ির মধ্যে বাস করিতেন। সেখানে বাতাসের অভাবে গ্ৰীষ্মের তাপে বীতনিদ্র হইয়া রাত কাটাইয়াছেন, তবু ডাক্তার ও বান্ধবদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও সে বাড়ি পরিত্যাগ করেন নাই ; এবং আশৈশব তাহার সমস্ত সংস্কার ও অভ্যাসকে মুহুর্তে মুহুর্তে পীড়িত করিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্তে দিন * যাপন করিয়াছেন- ইহা যে সম্ভব হইয়াছে এবং এই সমস্ত স্বীকার করিয়াও শেষ পর্যন্ত র্তাহার তপস্যা ভঙ্গ হয় নাই তাহার একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষের মঙ্গলের প্রতি তাহার শ্ৰীতি একান্ত সত্য ছিল, তাহা মোহ ছিল না। মানুষের মধ্যে যে শিব আছেন সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। এই মানুষের অন্তর-কৈলাসের শিবকেই যিনি আপনি স্বামীরূপে লাভ করিতে চান তঁহার সাধনার মতো এমন কঠিন সাধনা আর কার আছে ? একদিন স্বয়ং মহেশ্বর ছদ্মবেশে তপঃপরায়ণা সতীর কাছে আসিয়া বলিয়ছিলেন, হে সাধবী, তুমি যাহার জন্য তপস্যা করিতেছ। তিনি কি তোমার মতে রূপসীর এত কৃচ্ছসাধনের যোগ্য ? তিনি যে দরিদ্র, বৃদ্ধ বিরূপ,"র্তাহার যে আচার অদ্ভুত। তপস্বিনী ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়াছিলেন, তুমি যাহা বলিতেছ। সমস্তই সত্য হইতে পারে, তথাপি তঁহারই মধ্যে আমার সমস্ত মন “ভাবৈকরস হইয়া স্থির রহিয়াছে। শিবের মধ্যেই যে সতীর মন ভাবের রস পাইয়াছে তিনি কি বাহিরের ধনযৌবন রূপ ও আচারের মধ্যে তৃপ্তি খুঁজতে পারেন ? ভগিনী নিবেদিতার মন সেই অনন্যদুর্লভ সুগভীর ভাবের রসে চিরদিন পূর্ণ ছিল। এইজন্যই তিনি দরিদ্রের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখিতে পাইয়াছিলেন, এবং বাহির হইতে র্যাহার রূপের অভাব দেখিয়া রুচিবিলাসীরা ঘূণা করিয়া দূরে চলিয়া যায় তিনি তঁহারই রূপে মুগ্ধ হইয়া ঠাঁহারই কণ্ঠে নিজের অমর জীবনের শুভ্র বরমাল্য সমর্পণ করিয়াছিলেন। আমরা আমাদের চোখের সামনে সতীর এই যে তপস্যা দেখিলাম তাহাতে আমাদের বিশ্বাসের জড়ত যেন দূর করিয়া দেয়- যেন এই কথাটিকে নিঃসংশয় সত্যরূপে জানিতে পারি যে মানুষের মধ্যে শি। আছেন, দরিদ্রের জীর্ণকুটীরে এবং হীনবর্ণের উপেক্ষিত পল্লীর মধ্যেও তঁহার দেবলোক প্রসারিত- এবং ;ে ব্যক্তি সমস্ত দারিদ্র্য বিরূপতা ও কদাচারের বাহ আবরণ ভেদ করিয়া এই পরমেশ্বৰ্যময় পরমসুন্দরণে ভাবের দিব্যদৃষ্টিতে একবার দেখিতে পাইয়াছেন তিনি মানুষের এই অন্তরতম আত্মাকে পুত্র হইতে প্রিয় বিী হইতে প্রিয় এবং যাহা কিছু আছে সকল হইতেই প্রিয় বলিয়া বরণ করিয়া লন।’ তিনি ভয়কে অতিক্ৰ করেন, স্বার্থকে জয় করেন, আরামকে তুচ্ছ করেন, সংস্কারবন্ধনকে ছিন্ন করিয়া ফেলেন এবং আপনার দিবে। মুহুর্তকালের জন্য দৃকপাতমাত্র করেন না। yeyv ১ অঙ্গেতং প্রোয়পুত্ৰাৎ প্রেয়োবিজ্ঞাৎ প্রেয়োংন্যস্মাৎ সর্বমাং অভদ্রতর যদয়ামাত্মা।