পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳԵ রবীন্দ্র-রচনাবলী ন্যায় ক্ষণকালের ভাবোচ্ছােসও তাহার গোয়। তাহা ছাড়া- জীবনের গতিস্রোত তাহার বর্ণনীয় বিষয়! ভাব হইতে ভাবান্তরে তাহাকে গমন করিতে হয়। ভাবের গঙ্গোত্রী হইতে ভাবের সাগরসংগম পর্যন্ত তঁহাকে অনুসরণ করিতে হয়। কেবলমাত্র স্থির আকৃতি তিনি চিত্র করেন না, এক সময়ের স্থায়ী ভাব মাত্র তিনি বর্ণনা করেন না, গম্যমান শরীর, প্রবহমান ভাব, পরিবর্তমান অবস্থা তাহার কবিতার বিষয়।- অতএব ম্যাথিউ আর্নলডের মতে চলনশীল ভাবের প্রত্যেক ছায়ালোক সংগীতে প্ৰতিবিম্বিত হইতে পারে না। সংগীত একটি স্থায়ী স্থির ভাবের ব্যাখ্যা করে মাত্র। কিন্তু আমরা এই বলি যে, গতিশীল ভাব যে সংগীতের পক্ষে একেবারে অননুসরণীয় তাহা নহে, তবে এখনো সংগীতের সে বয়স হয় নাই। সংগীত ও কবিতায় আমরা আর কিছু প্ৰভেদ দেখি না, কেবল উন্নতির তারতম্য। উভয়ে যমজ ভ্ৰাতা, এক মায়ের সম্ভান; কেবল উভয়ের শিক্ষার বৈলক্ষণ্য হইয়াছে মাত্র। দেখা গেল সংগীত ও কবিতা এক শ্রেণীর। কিন্তু উভয়ের সহিত আমরা কতখানি ভিন্ন আচরণ করি। তাহা মনোযোগ দিয়া দেখিলেই প্ৰতীতি হইবে। এখন সংগীত যেরূপ হইয়াছে কবিতা যদি সেইরূপ হইত। তাহা হইলে কি হইত ? মনে করো এমন যদি নিয়ম হইত যে, যে কবিতায় চতুর্দশ ছত্রের মধ্যে, বসন্ত, মলয়ানিল, কোকিল, সুধাকর, রজনীগন্ধা, টগর ও দুরন্ত এই কয়েকটি শব্দ বিশেষ শৃঙ্খলা অনুসারে পােচ বার করিয়া বসিবে, তাহারই নাম হইবে কবিতা বসন্ত- ও যদি কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ কবিদিগকে ফরমাস করিতেন, “ওহে চণ্ডিদাস, একটা কবিতা বসন্ত, ছন্দ ত্ৰিপদী আওড়াও তো!" অমনি যদি চণ্ডিদাস আওড়াইতেন দুরন্ত টগর সুধাকরমলয়ানিল বসন্ত, রজনীগন্ধা দুরন্ত, সুধাকর কোকিল টগর। ও চারি দিক হইতে “আহা আহাঁ” পডিয়া যাইত, কারণ কথাগুলি ঠিক নিয়মানুসারে বসানো হইয়াছে- তাহা হইলে কবিতা কতকটা আধুনিক গানের মতো হইত। ঐ কয়েকটি কথা ব্যতীত আর-একটি কথা যদি বিদ্যাপতি বসাইতে চেষ্টা করিতেন, তাহা হইলে কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ “ধিক ধিক” করিতেন ও তাহার কবিতার নাম হইত “কবিতা জংলা বসন্ত।” এরূপ হইলে আমাদের কবিতার কী দ্রুত উন্নতিই হইত। কবিতার ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী বাহির হইত, বিদেশবিদ্বেষী জাতীয়ভাবােন্মত্ত আর্যপুরুষগণ গর্ব করিয়া বলিতেন, উঃ, আমাদেব কবিতায় কতগুলা রাগ-রাগিণী আছে, আর অসভ্য স্লেচ্ছদের কবিতায় রাগ-রাগিণীর লেশ মাত্র নাই। আমরা যেমন আজকাল নবরসের মধ্যেই মারামারি করিয়া কবিতাকে বন্ধ কবিয়া বাখি না, অলংকারশাস্ত্রোক্ত আডম্বরপূর্ণ নামের প্রতি দৃষ্টি করি না— তেমনি সংগীতে কতকগুলা নাম ও নিয়মের মধ্যেই যেন বদ্ধ হইয়া না থাকি। কবিতারও যে স্বাধীনতা আছে সংগীতেরও সেই স্বাধীনতা হউক, কারণ সংগীত কবিতার ভাই। যেমন সন্ধ্যার বিষয়ে কবিতা রচনা করিতে গেলে কবি সন্ধ্যার ভােব কল্পনা করিতে থাকেন ও তােহর প্রতি কথায় সন্ধ্যা মূর্তিমতী হইয়া উঠে, তেমনি সন্ধার বিষয়ে গান রচনা করিতে গেলে রচয়িতা যেন চোখ কান বুজিয়া পূরবী না গাহিয়া যান, যেন সন্ধ্যার ভাব কল্পনা করেন, তাহা হইলে অবসান দিবসের ন্যায় তাহার সুরও আপনা-আপনি নামিয়া আসিবে, থাকিবে। তাহা হইলে গানের বাল্মীকি গানের কালিদাস জন্মগ্রহণ করিবেন।