পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ԳÇÇ যায়। ইহাদের উদ্যম-আলোচনা-আন্দােলনের ফলে চাই কি আমাদের অনেক অভাব-অবিচার দূর হইতে পারে, কিন্তু রাজার নিকট সুবিচারপ্রাপ্তি কিংবা দুই-এক স্থলে রাজার সহিত সমান অধিকার -প্রাপ্তিই যদি কনগ্রেসের লক্ষ্য হয় তাহা হইলে কনগ্রেসের উদ্দেশ্য যে অতি ক্ষুদ্র সংকীর্ণ ও অদূরদর্শী তাহা বলিতে বাধ্য হইব । কনগ্রেসওয়ালারা যদি সুসজ্জিত পট্টবাসের পরিবর্তে । হােগলার চালা, চেয়ারের পরিবর্তে কেবলমাত্র মাদুর, পেন্টুলুনের পরিবর্তে ধুতি, এবং ইংরাজির পরিবর্তে ভারতবষীয় ভাষার ব্যবহার করিতে সংকুচিত হয়েন তাহা হইলে বর্তমান কনগ্রেস দ্বারা দেশের কোনো স্থায়ী উপকার সম্ভবপর নহে ।” মুখে মুখে কথা বিকৃত হয় এবং ভূদেববাবু ঠিক কী কথাটা বলিয়াছিলেন তাহা জানি না। আমাদের মনে উদ্দেশ্য যাহাই থােক, তাহা যতই সংকীর্ণ হউক, কিন্তু অনুষ্ঠান যদি বৃহৎ হয় তবে উদ্দেশ্যও আপনি বাড়িয়া চলে। সূচির মুখে সুতা পরাইতেও যদি বাতি জ্বলি তবে সেই বাতিতে সমস্ত ঘর আলোকিত হইয়া উঠে । তেমনি যে উদ্দেশ্যেই কনগ্রেস হউক, তাহা স্বভাবতই আপনি উদ্দেশ্যকে বহুদূরে ছাড়াইয়া গিয়া দেশের বৃহৎ মঙ্গলের অবতারণা করিবে ইহা আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। কিন্তু জনসভা ও জনসভাপতিদের মধ্যে ভূদেববাবু যে-সকল দুলক্ষণ লক্ষ্য করিয়াছেন তাহাও আমাদের ভাবিবার কথা । আমরা মাছ ধরিতে চাই, কিন্তু জলের সহিত সংস্রব রাখিতে চাই না ; আমরা দেশের হিত করিব, কিন্তু দেশকে আমরা সম্পর্শ করিব না ! দেশকে কেমন করিয়া স্পর্শ করিতে হয় ? দেশের ভাষা বলিয়া, দেশের বস্ত্র পরিয়া। ইংরাজের প্রবল আদর্শ যদি মাতার ভাষা এবং ভ্রাতার বস্ত্ৰ হইতে আমাদিগকে দূরে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া যায় তবে জননায়কের পদ গ্ৰহণ করিতে যাওয়া নিতান্তই অসংগত । f কিন্তু ভিন্নভাষী ভারতকে এক করিবার জন্য কনগ্রেসের ভাষা ইংরাজি হওয়া উচিত এমন তর্ক র্যাহারা এ স্থলে উত্থাপন করিবেন তাহারা আমার কথা সম্পূর্ণ বুঝিতে পারেন নাই। যেখানে ইংরাজি বলা দরকার সেখানে অবশ্য ইংরাজি বলিবে । কিন্তু তোমার ভাষাটা কী ? তোমার লেখাপড়া ধ্যানধারণা মন্ত্রতন্ত্র সমস্তই ইংরাজিতে কি না ? জনসভার বাহিরে দেশের সহিত তুমি কিরূপ সংস্রব রাখিয়া চল ? ইংরাজি ভাষায় যেটুকু কর্তব্য তাহা যেন সাধন করিলে, কিন্তু দেশী ভাষায় যে কর্তব্যপুঞ্জ পড়িয়া আছে, যাহা কাগজে রিপাের্টের জন্য নহে, যাহা সমুদ্রপারে উদবেলিত হইবার জন্য নহে, যাহার ফলাফল যাহার ধ্বনিপ্ৰতিধ্বনি সুদ্ধমাত্র আমাদের দেশীমণ্ডলীর মধ্যে বদ্ধ, তাহাতে হাত দিতে তোমার মন উঠে ? গবর্মেন্টের সম্মান র্যাহাদের কর্তব্য বুদ্ধির আশ্রয়দণ্ড তাহাদিগকে তোমরা নিন্দা কর, কিন্তু ইংরাজ-করতালির এলাকার বাহিরে র্যাহাদের কর্তব্য বুদ্ধি পদনিক্ষেপ করে না তঁহারাই কি প্রচুর সম্মানের অধিকারী ! কনগ্রেস যেমন সমস্ত ভারতবর্ষের মিলন-সভা, কনফারেন্স তেমনি সমস্ত বাংলার । সেই সমগ্র বাংলার মিলনক্ষেত্রে বাঙালির কী অভাব, বাঙালির কী কর্তব্য, সেও যদি আমরা ইংরাজি ভাষায় বলিবার প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারি। তবে তাহা হইতে কী প্ৰমাণ হয় । এই প্ৰমাণ হয় যে, দেশকে যাহারা চালনা করিতে চাহেন তাহারা, হয় দেশী ভাষা জানেন না, নয়, কর্তব্যের ক্ষতি করিয়াও ইংরাজি ভাষা ব্যবহার না করিলে তঁহাদের অভিমান চরিতার্থ হয় না । অতএব ভালো করিয়া দেখিলে দেখা যায়, জমিদারের চরিত্রে যে ঘুণ ঢুকিয়াছে আমাদের জননায়কদের চরিত্রেও সেই ঘুণ। ইংরাজের কৈশিকাকর্ষণ আমাদের দুই পক্ষেরই মস্তকের উপরে। ইংরাজকে বাদ দিলে আমাদের কর্তব্যে স্বাদ থাকে না, সম্মানে গৌরব থাকে না, বেশভূষায় মর্যাদা থাকে না ; আমাদের দেশের লোকের খ্যাতি অপেক্ষা গবর্মেন্টের খেতাব, আমাদের দেশের লোকের আশীৰ্বাদ অপেক্ষা বিলাতি কাগজের রিপোর্ট আমাদের কাছে শ্ৰেয় । ইংরাজের সহিত সমান অধিকার ভিক্ষা করিয়া লইবার জন্য ইংরাজি ভাষা আবশ্যক হইতে পারে, কিন্তু স্বদেশকে উচ্চতর অধিকারের উপযোগী করিয়া তুলিবার জন্য দেশীয় ভাষা, দেশীয় সাহিত্য, দেশীয় সমাজের মধ্যে থাকিয়া সমাজের উন্নতিসাধন একমাত্র উপায় । যাহারা স্বদেশ অপেক্ষা