পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

YANG 8S “ভালো করে খুলে বলো তোমার মনের কথাটা ।” “বলছি সব কথা । সম্পূর্ণ বুঝতে পারতে, যদি আদিতদার মুখখানা দেখতে পেতে ।” “আভাসে কিছু দেখেছি।” 游 “আজি বিকেলবেলায় একলা ছিলেম বারান্দায়। আমেরিকা থেকে ফুলগাছের ছবি-দেওয়া ক্যাটালগ এসেছে, দেখছিলেম পাতা উলটিয়ে ; রোজ বিকেলে সাড়ে চারটার মধ্যে চা খাওয়া সেরে দিতদা আমাকে ডেকে নেন বাগানের কাজে । আজ দেখি অন্যমনে বেড়াচ্ছেন ঘুরে ঘুরে ; মালীরা কাজ করে যাচ্ছে, তাকিয়েও দেখছেন না । মনে হল আমার বারান্দার দিকে আসবেন বুঝি, দ্বিধা করে গেলেন ফিরে । অমন শক্ত লম্বা মানুষ, জোরে চলা, জোরে কাজ, সব দিকেই সজাগ দৃষ্টি, কড়া মনিব অথচ মুখে ক্ষমার হাসি ; আজ সেই মানুষের সেই চলন নেই, দৃষ্টি নেই বাইরে, কোথায় তলিয়ে আছেন মনের ভিতরে । অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে এলেন কাছে। অন্যদিন হলে তখনই হাতের ঘড়িটা দেখিয়ে বলতেন, সময় হয়েছে, আমিও উঠে পড়তুম। আজ তা না বলে আস্তে আস্তে পাশে চৌকি টেনে নিয়ে বসলেন । বললেন, “ক্যাটালগ দেখছ বুঝি ?’ আমার হাত থেকে ক্যাটালগ নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন । কিছু যে দেখলেন তা মনে হল না । হঠাৎ একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন, যেন পণ করলেন আর দেরি না করে এখনই কী একটা বলাই চাই। আবার তখনই পাতার দিকে চোখ নামিয়ে বললেন, “দেখেছি সরি, কতবড়ো ন্যাসটাশিয়াম।” কণ্ঠে গভীর ক্লান্তি । তার পর অনেকক্ষণ কথা নেই, চলল পাতা ওলটানো । আর-একবার হঠাৎ আমার মুখের দিকে চাইলেন, চেয়েই ধ্যা করে বই বন্ধ করে আমার কোলের উপর ফেলে দিয়ে উঠে পড়লেন । আমি বললেম, যাবে না বাগানে ?’ আদিতদা বললেন, “না ভাই, বাইরে বেরতে হবে, কাজ আছে বলেই তাড়াতাড়ি নিজেকে যেন ছিড়ে নিয়ে চলে গেলেন । “আদিতদা তোমাকে কী বলতে এসেছিলেন ; কী আন্দাজ কর তুমি।” “বলতে এসেছিলেন, আগেই ভেঙেছে তোমার এক বাগান, এবার হুকুম এল, তোমার কপালে আর-এক বাগান ভাঙবে ।” “তই যদি ঘটে সরি, তা হলে জেলে যাবার স্বাধীনতা যে আমার থাকবে না ।” সরলা স্নান হেসে বললে, “তোমার সে রাস্তা কি আমি বন্ধ করতে পারি। সম্রাটবাহাদুর স্বয়ং খোলসা রাখবেন ।” “তুমি বৃস্তচ্যুত হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়, আর আমি শিকলে ঝংকার দিতে দিতে চমক লাগিয়ে চলিব জেলখানায়, এ কি কখনো হতে পারে । এখন থেকে তা হলে যে আমাকে এই বয়সে ভালোমানুষ হতে শিখতে হবে।” “কী করবে তুমি।” "তোমার অশুভগ্রহের সঙ্গে লড়াই ঘোষণা করে দেব। কুষ্টি থেকে তাকে তাড়াব। তার পরে লম্বা ছুটি পাব, এমন-কি, কালাপানির পার পর্যন্ত !” “তোমার কাছে কোনো কিছুই লুকোতে পারি নে। একটা কথা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিছুদিন থেকে । আর সেটা তোমাকে বলব, কিছু মনে কোরো না।” "না বললে মনে করব ।” "ছেলেবেলা থেকে আদিতদার সঙ্গে একত্রে মানুষ হয়েছি। ভাই বোনের মতো নয়, দুই ভাই-এর মতো। নিজের হাতে দুজনে পাশাপাশি মাটি কুপিয়েছি, গাছ কেটেছি। জেঠাইমা আর মা দু-তিনদিন পরে পরে মারা যান টাইফয়েডে, আমার বয়স তখন ছয় । বাবার মৃত্যু তার দু বছর পরে। জেঠামশাইয়ের মস্ত সাধ ছিল আমিই র্তার বাগানটিকে বাঁচিয়ে রাখব। আমার প্রাণ দিয়ে। তেমনি করেই আমাকে তৈরি করেছিলেন। কাউকে তিনি অবিশ্বাস করতে জানতেন না। যে-বন্ধুদের টাকা ধার দিয়েছিলেন তারা শোধ করে বাগানকে দায়মুক্ত করবে। এতে তীর সন্দেহ ছিল না। শোধ করেছেন কেবল আদিতদা, আর কেউ না । এই ইতিহাস হয়তো তুমি কিছু কিছু জােন কিন্তু তবু আজ