পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী “এই ভাঙা শরীরই তো আমার কপাল ভেঙেছে, ওর জন্যে মমতা কিসের । তার পরে আমার অবিশ্বাস এ দেখা দিল কোথা থেকে। এ যে অক্ষম জীবন নিয়ে আমার নিজেরই উপরে অবিশ্বাস । সেই তার নীরু আজ আছে কোথায়, যাকে তিনি কখনো বলতেন ‘মালিনী’, কখনো বলতেন। “বনলক্ষ্মী’ ! আজি কে নিলে কেড়ে তার উপবন । আমার কি একটাই নাম ছিল । কাজ সেরে আসতে যেদিন তীর দেরি হত আমি বসে থাকতুম তীর খাবার আগলে, তখন আমাকে ডেকেছেন ‘অন্নপূর্ণ । সন্ধ্যাবেলায় তিনি বসতেন দিঘির ঘাটে, ছোটাে রুপোর থালায় বেলফুল রাশ করে তার উপরে পান সাজিয়ে দিতেম তীকে, হেসে আমাকে বলতেন, ‘তাম্বুলকরাঙ্কবাহিনী” । সেদিন সংসারের সব পরামর্শই আমার কাছ থেকে নিয়েছেন তিনি। আমাকে নাম দিয়েছিলেন “গৃহসচিব, কখনো-বা ‘হোম সেক্রেটারি’ । আমি যেন সমুদ্রে এসেছিলেম ভরা নদী, ছড়িয়েছিলেম নানা শাখা নানা দিকে, সব শাখাতেই আজ একাদণ্ডে জল গেল শুকিয়ে, বেরিয়ে পড়ল পাথর ।” “বউদি, আবার তুমি সেরে উঠবে, তোমার আসন আবার অধিকার করবে পূর্ণশক্তি দিয়ে।” “মিছে। আশা দিয়ে না ঠাকুরপো । ডাক্তার কী বলে সে আমার কানে আসে । সেইজন্যেই এতদিনের সুখের সংসারকে এত করে আঁকড়ে ধরতে আমার এই নৈরাশ্যের কাঙালপনা ।” “দরকার কী বউদি। আপনাকে এতদিন তো ঢেলে দিয়েছ তোমার সংসারে । তার চেয়ে বড়ো কথা আর কিছু আছে কি । যেমন দিয়েছ তেমনি পেয়েছ, এত পাওয়াই বা কোন মেয়ে পায়। যদি ডাক্তারের কথা সত্যি হয়, যদি যাবার দিন এসেই থাকে, তা হলে যাকে বড়ো করে পেয়েছ, তাকে বড়ো করে ছেড়ে যাও । এতদিন যে-গৌরবে কাটিয়েছ সে-গৌরবকে খাটাে করে দিয়ে যাবে কেন । এ বাড়িতে তোমার শেষ স্মৃতিকে যাবার সময় নূতন মহিমা দিয়ে ।” “বুক ফেটে যায় ঠাকুরপো, বুক ফেটে যায় । আমার এতদিনের আনন্দকে ফেলে রেখে হাসিমুখেই চলে যেতে পারতুম | কিন্তু কোনোখানে কি এতটুকু ফাক থাকবে না। যেখানে আমার জন্যে একটা বিরহের দীপ টিমটিম করেও জ্বলবে । এ কথা ভাবতে গেলে যে মরতেও ইচ্ছে করে না । ঐ সরলা সমস্তটাই দখল করবে। একেবারে পুরোপুরি, বিধাতার এই কি বিচার ।” “সত্যি কথা বলব বউদি, রাগ কোরো না । তোমার কথা ভালো বুঝতেই পারি নে। যা নিজে ভোগ করতে পারবে না, তাও প্ৰসন্ন মনে দান করতে পার না যাকে এতদিন এত দিয়েছ ? তোমার ভালোবাসার উপর এত বড়ো খোটা থেকে যাবে ? তোমার সংসারে তোমারই শ্রদ্ধার প্রদীপ তুমি আপনিই আজ চুরমার করতে বসেছি। তার ব্যথা তুমি চলে যাবে এড়িয়ে, কিন্তু চিরদিন সে আমাদের বাজবে যে । মিনতি করে বলছি, তোমার সারাজীবনের দক্ষিণ্যকে শেষমূহুর্তে কৃপণ করে যেয়ো না ।” ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। নীরজা। চুপ করে বসে রইল রমেন, সাস্তুনা দেবার চেষ্টমাত্র করলে না, কান্নার বেগ থেমে গেলে নীরজা বিছানায় উঠে বসল। বললে, “আমার একটি ভিক্ষা আছে ঠাকুরপো ।” r “হুকুম করো বউদি।” “বলি শোনো । যখন চােখের জলে ভিতরে ভিতরে বুক ভেসে যায় তখন ঐ পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি । কিন্তু ওঁর বাণী তো হৃদয়ে পৌছয় না । আমার মন বিশ্ৰী ছোটো । যেমন করে পার আমাকে গুরুর সন্ধান দাও । না হলে কাটবে না বন্ধন । আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ব । যে সংসারে সুখের জীবন কাটিয়েছি, মরার পরে সেইখানেই দুঃখের হাওয়ায় যুগযুগান্তর কেঁদে কেঁদে বেড়াতে হবে ; তার থেকে উদ্ধার করো আমাকে, উদ্ধার করো ।” “তুমি তো জান বউদি শাস্ত্রে যাকে বলে পাষণ্ড, আমি তাই। কিছু মানি নে ৷ প্ৰভাস মিত্তির অনেক টানাটানি করে একবার আমাকে তার গুরুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল । বাধা পড়বার আগেই দিলেম দৌড় । জেলখানার মেয়াদ আছে, এ বঁাধন বেমেয়াদি ।” “ঠাকুরপো, তোমার মন জোরালো, তুমি কিছুতে বুঝবে না। আমার বিপদ । বেশ জানি যতই আঁকুৰ্বাকু করছি ততই ডুবছি অগাধ জলে, সামলাতে পারছি নে ৷” ।