পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিক্ষা ○ b-a দস্তুরমত একটা ইস্কুল ফাদার চেয়ে জ্ঞানদানের উপযুক্ত আশ্রম স্থাপন কঠিন তাহাতে সন্দেহ নাই । কিন্তু এই কঠিনকে সহজ করাই ভারতবর্ষের কাজ হইবে । কারণ, এই আশ্রমের আদর্শ আমাদের কল্পনা হইতে এখনো যায় নাই এবং য়ুরোপের নানাপ্রকার বিদ্যাও আমাদের গোচর হইয়াছে। বিদ্যালাভ ও জ্ঞানলাভের প্রণালীর মধ্যে আমাদিগকে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে হইবে । ইহাই যদি না পরিলাম। তবে কেবলই নকলের দিকে মন রাখিয়া আমরা সর্বপ্রকারে ব্যর্থ হইব । অধিকার লাভ করিতে গেলেই আমরা পরের কাছে হাত পাতি এবং গড়িয়া তুলিতে গেলেই আমরা নকল করিতে বসিয়া যাই- নিজের শক্তি এবং নিজের মনের দিকে, দেশের প্রকৃতির ও দেশের যথার্থ প্রয়োজনের দিকে তাকাই না, তাকাইতে সাহসই হয় না । যে-শিক্ষার ফলে আমাদের এই দশা হইতেছে সেই শিক্ষাকেই নূতন একটা নাম দিয়া স্থাপন করিলেই যে তাঁহা নূতন ফল প্রসব করিতে থাকিবে এইরূপ আশা করিয়া নূতন আর-একটা নৈরাশ্যের মুখে অগ্রসর হইতে প্রবৃত্তি হয় না। এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, যেখানে মুষলধারায় চাদার টাকা আসিয়া পড়ে সেইখানেই যে শিক্ষা বেশি করিয়া জমা হইতে থাকে তাহা নহে, মনুষ্যত্ব টাকায় কেনা যায় না ; যেখানে কমিটির নিয়মধারা অহরহ বৰ্ষিত হয়, সেইখানেই যে শিক্ষাকল্পলতা তাড়াতাড়ি বাড়িয়া উঠে তাহাও নহে, শুদ্ধমাত্র নিয়মাবলী অতি উত্তম হইলেও তাহা মানুষের মনকে খাদ্য দান করে না ; বহুবিধ বিষয়-পাঠনার ব্যবস্থা করিলেই যে শিক্ষায় লাভের অঙ্ক অগ্রসর হয় তাহা নহে, মানুষ যে বাড়ে সে “ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন” । যেখানে নিভৃতে তপস্যা হয়। সেইখানেই আমরা শিখিতে পারি ; যেখানে গোপনে ত্যাগ, যেখানে একান্তে সাধনা সেইখানেই আমরা শক্তিলাভ করি, যেখানে সম্পূর্ণভাবে দান সেইখানেই সম্পূর্ণভাবে গ্ৰহণ সম্ভবপর ; যেখানে অধ্যাপকগণ জ্ঞানের চর্চায় স্বয়ং প্রবৃত্ত সেইখানেই ছাত্ৰগণ বিদ্যাকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পায় ; বাহিরে বিশ্বপ্রকৃতির আবির্ভাব যেখানে বাধাহীন, অন্তরে সেইখানেই মন সম্পূর্ণ বিকশিত ; ব্ৰহ্মচর্যের সাধনায় চরিত্র যেখানে সুস্থ এবং আত্মবিশ, ধর্মশিক্ষা সেইখানেই সরল ও স্বাভাবিক ; আর যেখানে কেবল পুঁথি ও মাস্টার, সেনেট ও সিন্ডিকেট, ইটের কোঠা ও কাঠের আসবাব, সেখানে আজও আমরা যত বড়ো হইয়া উঠিয়াছি। কালও আমরা তত বড়োটা হইয়াই বাহির হইব । - ১৩১৩ যুক্তির অভাবে পৃথিবীতে খুব অল্প জিনিসই ঠেকিয়াছে। প্রয়োজন আছে। এ কথা বুঝাইয়া দিলেই প্রয়োজন সিদ্ধি হয়, অন্তত আমাদের দেশে তাহার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমাদের অভাব তো অনেক আছে, অভাব আছে। এ কথা বুঝাইবার লোকও অনেক আছে এবং এ কথা মানিবার লোকেরও অভাব নাই, তবু ইহাতে ইতার-বিশেষ কিছুই ঘটে না । আসল কথা, যুক্তি কোনো বড়ো জিনিসের সৃষ্টি করিতে পারে না। স্ট্যাটিসটিক্সের তালিকাযোগে লাভ, সুবিধা, প্রয়োজনের কথা বুঝাপড়া করিতে করিতে কেবল গলা ভাঙে, তাহাতে কিছু গড়ে না। শ্ৰোতারা গবেষণার প্রশংসা করে, আর-কিছু করা আবশ্যক বোধ করে না। আমাদের দেশের একটা মুশকিল। এই হইয়াছে, শিক্ষা বল, স্বাস্থ্য বল, সম্পদ বল, আমাদের উপরে - যে কিছু নির্ভর করিতেছে, এ কথা আমরা একরকম ভুলিয়াছিলাম। অতএব এ-সকল বিষয়ে আমাদের বােঝা না-বােঝা দুই-ই প্রায় সমান ছিল। আমরা জানি, দেশের সমস্ত মঙ্গলসাধনের দায়িত্ব গবর্মেন্টের ; অতএব আমাদের অভাব কী আছে না আছে তাঁহা বোঝার দরুন কোনো কাজ অগ্রসর