পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ Գ ՕԳ এই-যে নিত্যানিত্য-কলাকাল-বিবেক, ইহাই আমাদের হয় নাই । কেবল সেইজন্যই ইংরেজের কাছ হইতে আমরা ভালোরাপ আদায় করিতে পারিতেছি না, ভারতবর্ষের কাছ হইতেও পারিতেছি না । কিন্তু আমার এ কথার মধ্যে অত্যুক্তি আছে। কালের সমস্ত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া চক্ষে পড়ে না । যে-শক্তি কাজ করিতেছে, তাহা অলক্ষ্যে সমাজ গড়িয়া তোলে বলিয়া তাহাকে প্রতিদিন দেখিতে পাওয়া যায় না । বিশ-পঞ্চাশ বৎসরে ভাগ করিয়া দেখিলে তবেই তাহার কাজের পরিচয় পাওয়া যায় । আমরা যখন হতাশের আক্ষেপ গাহিতেছি, তখনো সে বিনা-জবাবদিহিতে কাজ করিয়া যাইতেছে । আমরা পরী-শিক্ষাবলেই পার-শিক্ষাপাশি হইতে নিজেকে কিরূপে ধীরে ধীরে এক-এক পাক করিয়া মুক্ত করিতেছি তাহা পঞ্চাশ-বৎসর-পরবতী বঙ্গদর্শনের সম্পাদক অনেকটা পরিষ্কার করিয়া দেখিতে পাইবেন । তখনাে যে সমস্তটা সম্পাদকের সম্পূর্ণ মনােমতই হইবে, তাহা নহে; কারণ, সংসারে হতাশের আক্ষেপ অমর— কিন্তু ত্ৰিবেদীমহাশয়ের পুস্তিকার সহিত মিলাইয়া সুসময়ের আলোচনা করিলে তিনি অনেকটা পরিমাণে সাত্ত্বনা পাইবেন, এ কথা তাহার পূর্ববতী সম্পাদক জোর করিয়া বলিতে পারেন। S \Dobr আলোচনা সমস্ত জাতি ও সমাজের মধ্যে চিরকাল অনুকরণশক্তি কাজ করিয়া আসিতেছে। খ্যাতনামা ইংরেজ লেখক ব্যােজট সাহেব তাহার ‘ফিজিকস অ্যান্ড পলিটিকস গ্রন্থে জাতিনির্মাণ কার্যে এই অনুকরণশক্তির ক্রিয়া বর্ণনা করিয়াছেন । -- গোড়ায় একটা জাতি কী করিয়া বিশেষ একটা প্রকৃতি লাভ করে, তাহা নির্ণয় করা শক্ত । কিন্তু তাহার পরে কালে কালে তাহার যে পরিবর্তনের ধারা চলিয়া আসে, প্রধানত অনুকরণই তাহার মূল । ইংলন্ডে রাজ্ঞী অ্যানের রাজত্বকালে ইংরেজসমাজ সাহিত্য আচার ব্যবহার যেরূপ ছিল, জর্জ-রাজগণের সময় তাহার অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল। অথচ জ্ঞানবিজ্ঞানের নূতন প্রসার এমন-কিছু হয় নাই, যাহাতে অবস্থাপরিবর্তনের গুরুতর কারণ কিছু পাওয়া যায়। ব্যাজটু সাহেব বলেন এই সকল পরিবর্তন তুচ্ছ অনুকরণের দ্বারা সাধিত হয় । একজন কিছু-একটা বদল করে, হঠাৎ কী কারণে সেটা আর-পাঁচজনের লাগিয়া যায়, অবশেষে সেটা ছড়াইয়া পড়ে । হয়তো সেই বদলটা কোনো কাজের নহে ; হয়তো তাহাতে সৌন্দৰ্যও নাই ; কিন্তু যে-লোক বদল করিয়াছে, তাহার প্রতিপত্তিবশত বা কী কারণবশত সেটা অনুকরণবৃত্তিকে উত্তেজিত করিতে পারে। এইরূপে পরিবর্তনের বৃহৎ কারণ না থাকিলেও, ছোটােখাটাে অনুকরণের বিস্তারে কালে কালে জাতির চেহারা বদল হইয়া যায় । ব্যােজটু সাহেবের এ কথা স্বীকার্য। কিন্তু সেইসঙ্গে ইহাও বলা আবশ্যক যে, যেমন সবল সুস্থ শরীয় করিতে পারে, তেমনই সবলপ্রকৃতি জাতি স্বভাবতই এমন-কিছুই গ্ৰহণ করে না বা দীর্ঘকাল রক্ষা করে না, যাহা তাহার জাতীয় প্রকৃতিকে আঘাত করিতে পারে। দুর্বল জাতির পক্ষে ঠিক উলটা । ব্যাধি তাহাকে চট করিয়া চাপিয়া ধরে এবং তাহা সে শীঘ্ৰ বাড়িয়া ফেলিতে পারে না । বাহিরের প্রভাব তাহাকে অনেক সময় বিকারের দিকে লইয়া যায়, এইজন্য তাহাকে অতিশয় সাবধানে থাকিতে হয়। সবল লোকের পক্ষে যাহা বলকারক স্বাস্থ্যজনক, রোগা লোকের পক্ষে তাহাও অনিষ্টকর হইতে পারে ।