8So রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী করিয়া বলিয়ো না- ওটাতে যা-কিছু পদার্থ ছিল, সে তোমাদের আওয়াজের চোটে অনেক কাল হইল নিকাশ হইয়া গিয়াছে। আমাদের এই ক্ষুদ্র সাহিত্যের ডোঙাটা একটুখানি হাল্কা করিয়া দাও, বাজে উপদেশ ও বাঁধি পরামর্শ ইহার উপর আর চাপাইয়ো না- বস্তার উপর বস্তা জমিয়াছে, নৌকাডুবি হইতে আর বিস্তর বিলম্ব নাই- কাতর অনুরোধে কৰ্ণপাত করো, ওগুলো নিতান্তই অনাবশ্যক। তুমি তো বলিলে অনাবশ্যক! কিন্তু ওগুলো যে সস্তা! মাথার খোলটার মধ্যে একটা সিকি পয়সা ও আধুলি বৈ আর কিছু নাই, মাথা নাড়িলে সেই দুটােই ঝমােঝমা করিতে থাকে, মনের মধ্যে আনন্দ বোধ হয়- সেই দুটাে লইয়াই কারবার করিতে হইবে- সুতরাং দুটাে-চারটে অতি জীর্ণ উপদেশ পুরোনো তেঁতুলের সহিত শিকেয় তোলা থাকে- বুদ্ধির ডোবা হইতে এক ঘটি জল তুলিয়া তাহাতে ঢালিয়া দিলে তাঁহাই অনেকটা হইয়া ওঠে এবং তাঁহাতেই গুজরান চলিয়া যায়। একটা ভালো জিনিস সস্তা হইলে এই প্রকার খুচরা দোকানদার মহলে অত্যন্ত আনন্দ পড়িয়া যায়। দেখিতেছেন না, আজকাল ইহাদের মধ্যে ভারি স্মৃৰ্তি দেখা যাইতেছে! সাহিত্যের ক্ষুদে পিপড়েগণ ছোটাে ছোটাে টুকরো মুখে লইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া ও অত্যন্ত গর্বের সহিত সার বাঁধিয়া চলিয়াছে! এখানে একটা কাগজ, ওখানে একটা কাগজ, সেখানে একটা কাগজ, এক রাত্রের মধ্যে হুস করিয়া মাটি ফুড়িয়া উঠিতেছে। ইহা হইতে স্পষ্টই প্ৰমাণ হইতেছে যে, আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা যখন ইংরিজি বিদ্যাটাকে কলা দিয়ে চটকাইয়া ফলার করিতেছিলেন, তখন তাঁহাদের পাতের চার দিকে পোলিটিকল ইকনমি ও কনস্টিটুৰ্দশনাল হিস্ট্রির, বর্কিলের ও মিলের এবং এ-ও-তার কিছু কিছু গুড়া পড়িয়াছিলসাহিত্যের ক্ষুধিত উচ্ছিষ্ঠপ্ৰত্যাশী এক দল জীববিশেষ তাহাদের অসাধারণ দ্রাণশক্তি প্রভাবে শুকিয়া শুকিয়া তাহা বাহির করিয়াছে। বড়ো বড়ো ভাবের আধখানা শিকিখানা টুকরা পথের ধুলার মধ্যে পড়িয়া সরকারি সম্পত্তি হইয়া উঠিয়াছে, ছােটাে ছােটাে মুদি ও কাসারিকুলতিলকগণ করিয়াছে। এত ছড়াছড়ি ভালো কি না সে বিষয়ে কিছু সন্দেহ আছে- কারণ, এরাপ অবস্থায় উপযোগী দ্রব্যসকলও নিতান্ত আবর্জনার সামিল হইয়া দাঁড়ায়- অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে এবং সমালোচকদিগকে বড়ো বড়ো বঁটা হাতে করিয়া মুনিসিপলিটির শকট বোঝাই করিতে হয়। এমন কেহ বলিতে পারেন বটে যে, ভালো কথা মুখে মুখে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িলে তাহাতে হানি যে কেন হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। হানি হইবার একটা কারণ এই দেখিতেছি- যে কথা সকলেই বলে, সে কথা কেহই ভাবে না। সকলেই মনে করে, আমার হইয়া আর পাঁচশো জন এ কথাটা ভাবিয়াছে ও ভাবিতেছে, অতএব আমি নিৰ্ভাবনায় ফাকি দিয়া কথাটা কেবল বলিয়া লাই-না কেন? কিন্তু ফাকি দিবার জো নাই- ফার্কি নিজেকেই দেওয়া হয়। তুমি যদি মনে করে একটা ঘোড়াকে স্থায়ীরূপে নিজের অধিকারে রাখিতে হইলে আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল রাশারশি দিয়া খুব শক্ত করিয়া বঁধিয়া রাখিলেই হইল, তাহাকে দানা ছোলা দিবার কোনো দরকার নাই- এবং সেইমতো আচরণ কর, তাহা হইলে কিছুদিনের মধ্যে দেখিবে দাঁড়িতে একটা জিনিস খুব শক্তরূপে বাধা আছে বটে। কিন্তু সেটাকে ঘোড়া না বলিলেও চলে। তেমনি ভাষরাপ দড়িদড়া দিয়া ভাবটাকে জিহবার আস্তাবলে দাঁতের খুঁটিতে খুব শক্ত করিয়া বঁধিয়া রাখিলেই যে সে তোমার অধিকারে চিরকাল থাকিবে তাহা মনে করিয়ো না- তিন সন্ধ্যা তাহার খোরাক জোগাইতে হইবে। যে ভাবনার মাটি ফুড়িয়া যে কথাটি উদ্ভিদের মতো বাড়িয়ে উঠিয়াছে, সেই মাটি হইতে সেই কথাটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইলে সে আর বেশিদিন বঁচিতে পারে না। দিন দুইচার সবুজ থাকে বটে ও গৃহশোভার কাজে লাগিতে পারে। কিন্তু তার পর যখন মরিয়া যায় ও পচিয়া উঠে তখন তাহার ফল শুভকরী নহে। একটা গল্প আছে, একজন অতিশয় বুদ্ধিমান লোক বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনের উদ্দেশে একটা পরীক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন, তিনি দেখিতেছিলেন ঘোড়াকে