পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় VSS) কাঠের বাের্ড আর খাতাখানা মেজের উপর ফেলে দিয়ে এলা বলল, “থাক পড়ে আমার কাজ । আলোটা জেলে দিই ।” “না থােক- আলো প্ৰত্যক্ষকে প্রমাণ করে, চলো দীপহীন পথে অপ্রত্যক্ষের দিকে । চার বছরের কিছু কম হবে, স্টীমারে খেয়া পার হচ্ছি মােকামার ঘাটে । তখনাে আঁকড়ে ছিলুম পৈতৃক সম্পত্তির ভাঙা কিনারটাকে, সেটা ছিল দেনার গর্তে ভরা । তখনো দেহে মনে শৌখিনতার রঙ লেগে ছিল দেউলে দিনান্তের মেঘের মতো । গায়ে সিস্কের পাঞ্জাবি, পাট-করা মুগার চাদর কাধে, একলা বসে আছি। ফাস্ট ক্লাস ডেক-এ বেতের কেদারায় । ফেলে দেওয়া খবরের কাগজের পাতাগুলো ফরফর করে এধারে ওধারে উড়ে বেড়াচ্ছিল, মজা লাগছিল দেখতে, মনে হচ্ছিল মূর্তিমতী জনশ্রুতির এলোমেলো নৃত্য | তুমি জনসাধারণের দলে, কোমর বেঁধে ডেক-প্যাসেঞ্জার । হঠাৎ আমার পশ্চাদবর্তী অগোচরতার মধ্যে থেকে দ্রুতবেগে এসে পড়লে আমার সামনে । আজও চোখের উপর দেখতে পাচ্ছি। তোমার সেই ব্ৰাউন রঙের শাড়ি ; খোপার সঙ্গে কাটায় বেঁধা তোমার মাথার কাপড় মুখের দুই ধারে হাওয়ায় ফুলে উঠেছে। চেষ্টাকৃত অসংকোচের ভান করেই প্রশ্ন করলে, আপনি খদ্দর পরেন না কেন ?- মনে পড়ছে ?” “খুব স্পষ্ট । তোমার মনের ছবিকে তুমি কথা কওয়াতে পাের, আমার ছবি বোবা।” “আমি আজ সেদিনের পুনরুক্তি করে যাব, তোমাকে শুনতে হবে ।” “শুনব না তো কী । সেদিন যেখানে আমার নূতন জীবনের ধুয়ো, পুনঃপুনঃ সেখানে আমার মন ফিরে আসতে চায় ।” “তোমার গলার সুরটি শুনেই আমার সর্বশরীর চমকে উঠল, সেই সুর আমার মনের মধ্যে এসে লাগল। হঠাৎ আলোর ছটার মতো ; যেন আকাশ থেকে কোন এক অপরূপ পাখি ছো মেরে নিয়ে গেল আমার চিরদিনটাকে । অপরিচিত মেয়েটির অভাবনীয় স্পর্ধায় যদি রাগ করতে পারতুম তা হলে সেদিনকার খেয়াতরী এতবড়ো আঘাটায় পৌঁছিয়ে দিত না— ভদ্রপাড়াতেই শেষ পর্যন্ত দিন কাটত চলতি রাস্তায় । মনটা আদ্ৰ দেশলাইকাঠির মতো, রাগের আগুন জ্বলল না । অহংকার আমার স্বভাবের সর্বপ্রধান সদগুণ, তাই ধী করে মনে হল, মেয়েটি যদি আমাকে বিশেষভাবে পছন্দ না করত। তা হলে এমন বিশেষভাবে ধমক দিতে আসত না, খদ্দর প্রচার- ও একটা ছুতো, সত্যিা কি না। বলো ।” “ওগো, কতবার বলেছি- অনেকক্ষণ ধরে ডেকের কোণে বসে তোমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম। আর-কেউ সেটা লক্ষ্য করছে কি না । জীবনে সেই আমার সব-চেয়ে আশ্চর্য একচমকের চিরপরিচয় | মন বললে, কোথা থেকে এল। এই অতিদূর জাতের মানুষটি, চার দিকের পরিমাপে তৈরি নয়, শেওলার মধ্যে শতদল পদ্ম । তখনই মনে মনে পণ করলুম, এই দুর্লভ মানুষটিকে টেনে আনতে হবে, কেবল আমার নিজের কাছে নয়, আমাদের সকলের কাছে।” “আমার কপালে তোমার একবচনের চাওয়াটা চাপা পড়ল বহুবচনের চাওয়ার তলায় ।” “আমার উপায় ছিল না অস্তু। দ্ৰৌপদীকে দেখবার আগেই কুন্তী বলেছিলেন, তোমরা সবাই মিলে ভাগ করে নিয়াে । তুমি আসবার আগেই শপথ করে দেশের আদেশ স্বীকার করেছি, বলেছি আমার একলার জন্যে কিছুই রাখব না। দেশের কাছে আমি বাগদত্তা ।” ዖ "অধাৰ্মিক তোমার পণগ্রহণ, এ পণিকে রক্ষা করাও প্রতিদিন তোমার স্বধৰ্ম-বিদ্রোহ । পণ যদি ভাঙতে তবে সত্যরক্ষা হত। যে লোভ পবিত্র, যা অন্তর্যামীর আদেশবাণী, তাকে দলের পায়ে দলিত করেছি, এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে ।” “অন্তু, শাস্তির সীমা নেই, দিনরাত মারছে আমাকে । যে আশ্চর্য সৌভাগ্য সকল সাধনার অতীত, যা দৈবের অযাচিত দান তা এল আমার সামনে তবু নিতে পারলুম না । হৃদয়ে হৃদয়ে গাঠ বাধা, তৎসত্ত্বেও এতবড়ো দুঃসহ বৈধব্য কোনাে মেয়ের ভাগ্যে যেন না ঘটে । একটা মন্ত্রপড়া বেড়ার মধ্যে ছিলুম, কিন্তু তোমাকে দেখবামাত্র মন উৎসুক হয়ে উঠল, বললে, ভাঙুক সব বেড়া। এমন বিপ্লব