পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজধর কহিলেন, “হী, বিদ্ধ হইয়াছে। কাছে গেলেই দেখা যাইবে।” যুবরাজ আর কিছু বলিলেন ୩ | তাহার কাছে গিয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “ভাই, আমি অক্ষম— আমার উপর রাগ করা অন্যায়— তুমি যদি আজ লক্ষ্য ভেদ করিতে না পাের, তবে তোমার ভ্ৰষ্টলক্ষ্য তীর আমার হৃদয় বিদীর্ণ করিবে, ইহা নিশ্চয় জানিয়ো ।” ইন্দ্ৰকুমার যুবরাজের পদধূলি লইয়া কহিলেন, “দাদা, তোমার আশীর্বাদে আজ লক্ষ্য ভেদ করিব, ইহার অন্যথা হইবে না ।” ইন্দ্ৰকুমার তীর নিক্ষেপ করিলেন, লক্ষ্য বিদ্ধ হইল। বাজনা বাজিল। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল। যুবরাজ যখন ইন্দ্ৰকুমারকে আলিঙ্গন করিলেন, আনন্দে ইন্দ্ৰকুমারের চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল । ইশা খা পরম স্নেহে কহিলেন, “পুত্র, আল্লার কৃপায় তুমি দীর্ঘজীবী হইয়া থাকে।” মহারাজা যখন ইন্দ্ৰকুমারকে পুরস্কার দিবার উদযোগ করিতেছেন, এমন সময়ে রাজধর গিয়া কহিলেন, “মহারাজ, আপনাদের ভ্রম হইয়াছে। আমার তীর লক্ষ্য ভেদ করিয়াছে।” মহারাজ কহিলেন, “কখনােই না।” রাজধার কহিলেন, “মহারাজ, কাছে গিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখুন।” । সকলে লক্ষ্যের কাছে গেলেন। দেখিলেন যে-ভীর মাটিতে বিদ্ধ তাহার ফলায় ইন্দ্ৰকুমারের নাম খোদিত- আর যে-ভীর লক্ষ্যে বিদ্ধ তাহাতে রাজধরের নাম খোদিত | রাজধার কহিলেন, “বিচার করুন। মহারাজ ।” ইশা খা কহিলেন, “নিশ্চয়ই তৃণ বদল হইয়াছে।” কিন্তু পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল তৃণ বদল হয় নাই। সকলে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিলেন । ፳ ইশা খা বলিলেন, “পুনর্বার পরীক্ষা করা হউক ৷” রাজধর বিষম অভিমান করিয়া কহিলেন, “তাহাতে আমি সম্মত হইতে পারি না । আমার প্রতি এ বড়ো অন্যায় অবিশ্বাস । আমি তো পুরস্কার চাই না, মধ্যমকুমার বাহাদুরকে পুরস্কার দেওয়া হউক ৷” বলিয়া পুরস্কারের তলোয়ার ইন্দ্ৰকুমারের দিকে অগ্রসর করিয়া দিলেন । ইন্দ্ৰকুমার দারুণ ঘূণার সহিত বলিয়া উঠিলেন, “ধিক । তোমার হাত হইতে এ পুরস্কার গ্রাহ্য করে কে । এ তুমি লও।” বলিয়া তলোয়ারখানা ঝনঝন করিয়া রাজধরের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। রাজধর হাসিয়া নমস্কার করিয়া তাহা তুলিয়া লইলেন। তখন ইন্দ্ৰকুমার কম্পিতম্বরে পিতাকে কহিলেন, “মহারাজ, আরাকানপতির সহিত শীঘ্রই যুদ্ধ হইবে। সেই যুদ্ধে গিয়া আমি পুরস্কার আনিব। মহারাজ, আদেশ করুন।” ইশা খাঁ ইন্দ্ৰকুমারের হাত ধরিয়া কঠোরস্বরে কহিলেন, “তুমি আজ মহারাজের অপমান করিয়াছ। বৃদ্ধ ইশা খাঁ সহসা বিষগ্ন হইয়া ক্ষুব্ধস্বরে কহিলেন, “পুত্র, এ কী পুত্র। আমার পরে এই ব্যবহার । তুমি আজ আত্মবিস্মৃত হইয়াছ বৎস।” ইন্দ্ৰকুমারের চোখে জল উথলিয়া উঠিল । তিনি কহিলেন, “সেনাপতি সাহেব, আমাকে মাপ করো, আমি আজ যথার্থই আত্মবিস্মৃত হইয়াছি।” যুবরাজ স্নেহের স্বরে কহিলেন, “শাস্ত হও ভাই— গৃহে ফিরিয়া চলো।” ইন্দ্ৰকুমার পিতার পদধূলি লইয়া কহিলেন, “পিতা, অপরাধ মার্জনা করুন।” গৃহে ফিরিবার সময় যুবরাজকে কহিলেন, “দাদা, আজ আমার যথার্থই পরাজয় হইয়াছে।” রাজধর যে কেমন করিয়া জিতিলেন তাহা কেহ বুঝিতে পারিলেন না।