পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম ( O Ꮼ করিতে থাকে ; নহিলে তাহা বিকৃতিতে গিয়া পৌঁছে এবং বিকৃতি বিনাশে গিয়া উপনীত হইবেই। স্বাতন্ত্র্য যেখানে মঙ্গলের অনুসরণ করিয়া প্রেমের দিকে না গেছে, সেখানে সে বিনাশের দিকে চলিতেছে। অতিবৃদ্ধিদ্বারা সে বিকৃতি প্রাপ্ত হইলে বিশ্বপ্রকৃতি তাহার বিরুদ্ধ হইয়া উঠে ; কিছুদিনের মতো উপদ্রব করিয়া তাহাকে মরিতেই হয় । অতএব মানুষের স্বাতন্ত্র্য যখন মঙ্গলের সহায়তায় সমস্ত দ্বন্দ্বকে নিরস্ত করিয়া দিয়া সুন্দর হইয়া উঠে, তখনই বিশ্বাত্মার সহিত মিলনে সম্পূৰ্ণ আত্মবিসর্জনের জন্য সে প্রস্তুত হয় । বস্তুত আমাদের দুন্দর্যন্ত স্বাতন্ত্র্য মঙ্গলসোপান হইতে প্রেমে উত্তীর্ণ হইয়া। তবেই সম্পূর্ণ হয়, সমাপ্ত হয়। >○>○ \O\O2 কিম আহারসংগ্রহ ও আত্মরক্ষা করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে শিখিলেই পশুপাখির শেখা সম্পূর্ণ হয় ; সে জীবলীলা সম্পন্ন করিবার জন্যই প্ৰস্তুত হয় । মানুষ শুধু জীব নহে, মানুষ সামাজিক জীব । সুতরাং জীবনধারণ করা এবং সমাজের যোগ্য হওয়া, এই উভয়ের জন্যই মানুষকে প্রস্তুত হইতে হয় । কিন্তু সামাজিক জীব বলিলেই মানুষের সব কথা ফুরায় না । মানুষকে আত্মারূপে দেখিলে সমাজে তাহার অন্ত পাওয়া যায় না । যাহারা মানুষকে সেইভাবে দেখিয়াছে, তাহারা বলিয়াছে, আত্মানং বিদ্ধি— আত্মাকে জানো । আত্মাকে উপলব্ধি করাই তাহারা মানুষের চরমসিদ্ধি বলিয়া গণ্য করিয়াছে। নীচের ধাপ বরাবর উপরের ধাপেরই অনুগত । সামাজিক জীবের পক্ষে শুদ্ধমাত্র জীবলীলা সমাজ মাির অনুবতী । ক্ষুধা পাইলেই খাওয়া জীবের প্রবৃত্তি— কিন্তু সামাজিক জীবকে সেই আদিমপ্রবৃত্তি খর্ব করিয়া চলিতে হয়। সমাজের দিকে তাকাইয়া অনেক সময় ক্ষুধাতৃষ্ণকে উপেক্ষা করাই আমরা ধর্ম বলি । এমন-কি, সমাজের জন্য প্ৰাণ দেওয়া অর্থাৎ জীবধর্ম ত্যাগ করাও শ্রেয় বলিয়া গণ্য হয়। তবেই দেখা যাইতেছে, জীবধর্মকে সংযত করিয়া সমাজধর্মের অনুকূল করাই সামাজিক জীবের শিক্ষার প্রধান কাজ । কিন্তু মানুষের সত্যকে যাহারা এইখানেই সীমাবদ্ধ না করিয়া পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করিতে ইচ্ছা! করে, তাহারা জীবধর্ম ও সমাজধৰ্ম উভয়কেই সেই আত্ম-উপলব্ধির অনুগত করিবার সাধনাকেই শিক্ষা বলিয়া জানে। এক কথায়, মানবাত্মার মুক্তিই তাঁহাদের কাছে মানবজীবনের চরমলক্ষ্য— জীবনধারণ ও সমাজরক্ষার সমস্ত লক্ষ্যই ইহার অনুবতী । তবেই দেখা যাইতেছে, মানুষ বলিতে যে যেমন বুঝিয়াছে, সে সেই অনুসারেই মানুষের শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তন করিতে চাহিয়াছে— কারণ, মানুষ করিয়া তোলাই শিক্ষা | আমরা প্রাচীন সংহিতায় ছাত্রশিক্ষার যে আদর্শ দেখিতে পাই, তাহা কবে হইতে এবং কতদূর পর্যন্ত দেশে চলিয়াছিল, তাহার ঐতিহাসিক বিচার করিতে আমি অক্ষম। অন্তত এইটুকু নিঃসংশয়ে বলা মানুষকে কী বলিয়া জানিতেন এবং সেই মানুষকে গড়িয়া তুলিবার জন্য কোন উপায়কে সকলের চেয়ে উপযুক্ত বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। সংসারে কিছুই নিত্য নয়, অতএব সংসার অসার অপবিত্র এবং তাহাকে ত্যাগ করাই শ্রেয়, এইরূপ বৈরাগ্যধর্মের শ্রেষ্ঠতা যুরোপে সাধুগণ মধ্যযুগে প্রচার করিতেন। তখন সন্ন্যাসিন্দলের যথেষ্ট প্ৰাদূৰ্ভাব ছিল। য়ুরোপের এখনকার ভাবখানা এই যে, সংসারটা কিছুই নয় বলিয়া মানুষের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যে একটা চিরস্থায়ী দেবাসুরের ঝগড়া বাধাইয়া রাখিলে মনুষ্যত্বকে খর্ব করা হয়। সংসারের