পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSO রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি বঁচিব কী করে। তারা যে বাঁচবার জিনিস নয় তা বেশ জানি, তবু চিরজীবনের সংস্কার তাদের প্ৰাণপণে আঁকড়ে ধরে বলতে থাকে। এদের না হলে আমার চলবে না যে। ধনকে আপনার বলে জানা যে নিতান্তই অভ্যাস হয়ে গেছে। সেই ধনের ঠিক ওজনটি যে আজ বুঝব সে শক্তি কোথায় পাই। । বহুদীর্ঘকাল ধরে আমির ভরে সেই ধন যে পর্বতসমান ভারী হয়ে উঠেছে, তাকে একটুও নড়াতে গেলে যে বুকের পাজরে বেদন ধরে । এইজন্যেই ভগবান যিশু বলেছেন যে-ব্যক্তি ধনী তার পক্ষে মুক্তি অত্যন্ত কঠিন । ধন এখানে শুধু টাকা নয়, জীবন যা-কিছুকেই দিনে দিনে আপনার বলে সঞ্চয় করে তোলে, যাকেই সে নিজের বলে মনে করে এবং নিজের দিকেই আঁকড়ে রাখে- সে ধনই হােক আর খ্যাতিই হােক, এমন-কি, পুণাই হোক | এমন-কি, ঐ পুণ্যের সঞ্চয়টা কম ঠকায় না। ওর একটি ভাব আছে যেন ও যা নিচ্ছে তা সব ঈশ্বরকেই দিচ্ছে | লোকের হিত করছি, ত্যাগ করছি, কষ্টস্বীকার করছি, অতএব আর ভাবনা নেই। আমার সমস্ত উৎসাহ ঈশ্বরের উৎসাহ, সমস্ত কর্ম ঈশ্বরের কর্ম। কিন্তু এর মধ্যে যে অনেকখানি নিজের দিকেই জন্মাচ্ছি। সে খেয়ালমাত্র নেই । যেমন মনে করো আমাদের এই বিদ্যালয় । যেহেতু এটা মঙ্গলকােজ সেই হেতু এর যেন আর হিসেব দেখবার দরকার নেই, যেন এর সমস্তই ঈশ্বরের খাতাতেই জমা হচ্ছে। আমরা যে প্রতিদিন তহবিল ভাঙছি তার খোজ ও রাখি নে । এ বিদ্যালয় আমাদের বিদ্যালয়, এর সফলতা আমাদের সফলতা, এর দ্বারা আমরাই হিত করছি, এমনি করে এ বিদ্যালয় থেকে আমার দিকে কিছু কিছু করে জমা হচ্ছে । সেই সংগ্ৰহ আমার অবলম্বন হয়ে উঠছে, সেটা একটা বিষয়সম্পত্তির মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই কারণে তার জন্যে রাগারগি টানাটানি হতে পারে, তার জন্যে মিথ্যে সাক্ষী সাজাতেও ইচ্ছা করে | পাছে কেউ কোনো ত্রুটি ধরে ফেলে এই ভয় হয়— লোকের কাছে এর অনিন্দনীয়তা প্রমাণ করে তোেলবার জন্যে একটু বিশেষভাবে ঢাকাটুকি দেবার আগ্রহ জন্মে । কেননা এ-সব যে আমার অভ্যাস, আমার নেশা, আমার খাদ্য হয়ে উঠছে। এর থেকে যদি ঈশ্বর আমাকে একটু বঞ্চিত করতে চান আমার সমস্ত প্ৰাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের অভ্যাসে বিদ্যালয় থেকে এই যে-অংশটুকু নিজের ভাগেই সঞ্চয় করে তুলছি সেইটে সরিয়ে দাও দেখি, মনে হবে এর কোথাও যেন আর আশ্রয় পাচ্ছি নে । তখন ঈশ্বরকে আর আশ্রয় বলে মনে হবে না । এইজন্যে সঞ্চয়ীর পক্ষে বড়ো শক্ত সমস্যা । সে ঐ সঞ্চয়কেই চরম আশ্রয় বলে একেবারে অভ্যাস করে বসে আছে, ঈশ্বরকে তাই সে চারি দিকে সত্য করে অনুভব করতে পারে না, শেষ পর্যন্তই সে নিজের সঞ্চয়কে আঁকড়ে বসে থাকে । অনেকদিন থেকে অনেক সঞ্চয় করে যে বসেছি— সে-সমস্তর কিছু বাদ দিতে মন সরে না । সেইজন্যে মনের মধ্যে যে চতুর হিসাবি কানে কলম গুজে বসে আছে সে কেবলই পরামর্শ দিচ্ছে— কিছু বাদ দেবার দরকার নেই, এরই মধ্যে কোনোরকম করে ঈশ্বরকে একটুখানি জায়গা করে দিলেই হবে | না, তা হবে না- তার চেয়ে অসাধ্য আর কিছুই হতে পারে না । তবে কী করা কর্তব্য ? একবার সম্পূর্ণ মরতে হবে- তবেই নতুন করে ভগবানে জন্মানো যাবে। একেবারে গোড়াগুড়ি মরতে হবে । এটা বেশ করে জানতে হবে, যো-জীবন আমার ছিল, সেটা সম্বন্ধে আমি মরে গেছি। আমি সে-লোক নই, আমার যা ছিল তার কিছুই নেই। আমি ধনে মরেছি, খ্যাতিতে মরেছি, আরামে মরেছি, আমি কেবলমাত্রই ভগবানে বেঁচেছি। নিতান্ত সদ্যোজাত শিশুটির মতো নিরুপায় অসহায় অনাবৃত হয়ে তার কোলে জন্মগ্রহণ করেছি। তিনি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। তার পরে তার সন্তানজন্ম সম্পূর্ণভাবে শুরু করে দাও, কিছুর পরে কোনো মমতা রেখো না । পুনর্জন্মের পূর্বে এখন সেই মৃত্যুবেদনা। যাকে নিশ্চিত চরম বলে অত্যন্ত সত্য বলে জেনেছিলুম