পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SNCC ԳՀԳ "সর্বানুভূঃ । তাকেই চাই, তিনিই আরম্ভে, তিনিই শেষে। যদি বলে এমন করে দেখলে আমাদের উন্নতি হবে না, তা হলে আমি বলব আমাদের বিনতিই ভালো। যদি বলে এই সাধনায় আমাদের স্বজাতীয়তা দৃঢ় হয়ে উঠবে না, তা হলে আমি বলব স্বজাতি-অভিমানের অতি নিষ্ঠুর মােহ কাটিয়ে ওঠাই যে মানুষের পক্ষে শ্রেয় এই শিক্ষা দেবার জন্যেই ভারতবর্ষ চিরদিন প্রস্তুত হয়েছে। ভারতবর্ষ এই কথাই বলেছে যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুর্যাম'- সমস্ত উদ্ধত সভ্যতার সভাদ্ধারে দাড়িয়ে আবার একবার ভারতবর্ষকে বলতে হবে ; যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন। কুর্যম। প্রবলরা দুর্বল বলে অবজ্ঞা করবে, ধনীরা তাকে দরিদ্র বলে উপহাস করবে, কিন্তু তবু তাকে এই কথা বলতে হবে ; যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুর্যম। এই কথা বলবার শক্তি আমাদের কণ্ঠে তিনিই দিন, য একঃ, যিনি এক ; অবর্ণঃ, যার বর্ণ নেই ; বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদীে, যিনি সমস্তের আরম্ভে এবং সমস্তের শেষে। সনােবুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনত্ত্ব, তিনি আমাদের শুভবুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করুন, শুভবুদ্ধির দ্বারা দূরনিকট আত্মপর সকলের সঙ্গে যুক্ত করুন | হে সর্বানুভু, তোমার যে অমৃতময় অনন্ত অনুভূতির দ্বারা বিশ্বচরাচরের যা-কিছু সমস্তকেই তুমি দাডিয়ে একদিন এখানকার ঋষি তার নিজের নির্মল চেতনার মধ্যে যে কী আশ্চর্য গভীররূপে উপলব্ধি করেছেন তা মনে করলে আমার হৃদয় পুলকিত হয় । মনে হয় যেন তাদের সেই উপলব্ধি এ দেশের এই বাধাহীন নীলাকাশে এই কুহেলিকাহীন উদার আলোকে আজও সঞ্চারিত হচ্ছে। মনে হয় যেন এই আকাশের মধ্যে আজও হৃদয়কে উদঘাটিত করে নিস্তব্ধ করে ধরলে তাদের সেই বৈদ্যুতিময় চেতনার অভিঘাত আমাদের চিত্তকে বিশ্বম্পন্দনের সমান ছন্দে তরঙ্গিত করে তুলবে। কী আশ্চর্য পরিপূর্ণতার মূর্তিতে তুমি তাদের কাছে দেখা দিয়েছিলে— এমন পূর্ণতা যে, কিছুতে তাদের লোভ ছিল না। যতই তারা ত্যাগ করেছেন ততই তুমি পূর্ণ করেছ, এইজন্যে ত্যাগকেই তারা ভোগ বলেছেন। তাদের দৃষ্টি এমন চৈতন্যময় হয়ে উঠেছিল যে, লেশমাত্র শূন্যকে কোথাও তারা দেখতে পান নি, মৃত্যুকেও বিচ্ছেদ রূপে তারা স্বীকার করেন নি । এইজন্যে অমৃতকে যেমন তারা তোমার ছায়া বলেছেন তেমনি মৃত্যুকেও তারা তোমার ছায়া বলেছেন ; যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ । এইজন্যে তারা বলেছেন : প্ৰাণো মৃত্যুঃ প্ৰাণ স্তন্মা | প্ৰাণই মৃত্যু, প্রাণই বেদন । এইজন্যেই তারা ভক্তির সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে বলেছেন : নমস্তে অস্তু আয়তে, নমো অস্তু পরায়তে । যে প্ৰাণ আসছ তোমাকে নমস্কার : যে প্ৰাণ চলে যােচ্ছ তোমাকে নমস্কার। প্ৰাণে হ ভূতং ভব্যাং চ | যা চলে গেছে তা প্ৰাণেই আছে, যা ভবিষ্যতে আসবে তাও প্ৰাণের মধ্যেই রয়েছে। তারা অতি সহজেই এই কথাটি বুঝেছিলেন যে, যোগের বিচ্ছেদ কোনোখানেই নেই। প্ৰাণের যোগ যদি জগতের কোনো এক জায়গাতেও বিচ্ছিন্ন হয় তা হলে জগতে কোথাও একটি প্রাণীও বাঁচতে পারে না । সেই বিরাট প্রাণসমুদ্রই তুমি । যদিদং কিিঞ্চ প্ৰাণ এজাতি নিঃসৃতং। এই যা-কিছু সমস্তই সেই প্রাণ হতে নিঃসৃত হচ্ছে এবং প্রাণের মধ্যেই কম্পিত হচ্ছে। নিজের প্রাণকে তারা অনন্তের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন নি, সেইজন্যেই প্ৰাণকে তারা সমস্ত আকাশে ব্যাপ্ত দেখে বলেছেন : প্ৰাণো বিরাট । সেই প্রাণকেই তারা সূর্যচন্দ্রের মধ্যে অনুসরণ করে বলেছেন : প্ৰাণো হি সূৰ্যশ্চন্দ্ৰমা ! নমস্তে প্ৰাণ ক্ৰন্দায়, নমস্তে স্তনয়িত্ববে। যে প্রাণ ক্ৰন্দন করছ, সেই তােমাকে নমস্কার, যে প্রাণ গৰ্জন করছ, সেই তোমাকে নমস্কার | নমস্তে প্ৰাণ বিদ্যুতে, নমস্তে প্ৰাণ বৰ্ষতে | যে প্রাণ বিদ্যুতে জ্বলে উঠছ সেই তােমাকে নমস্কার, যে প্রাণ বর্ষণে গলে পড়ছ সেই তােমাকে নমস্কার। প্রাণ, প্রাণ, প্ৰাণ, সমস্ত প্ৰাণময়— কোথাও তার রন্ধ নেই, অন্ত নেই। এমনতরো অখণ্ড অনবচ্ছিন্ন উপলব্ধির মধ্যে তোমার যে সাধকেরা একদিন বাস করেছেন তারা এই ভারতবর্ষেই বিচরণ করেছেন। তারা এই আকাশের দিকেই চােখ তুলে একদিন এমন নিঃসংশয় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে উঠেছিলেন ; কোহ্যেবানাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । কেই বা শরীরচেষ্টা করত, কেই বা জীবনধারণ করত, যদি এই আকাশে আনন্দ না থাকতেন । র্যারা নিজের বােধের মধ্যে সমস্ত আকাশকেই আনন্দময় বলে জেনেছিলেন তাদের পদধূলি এই ভারতবর্ষের মাটির মধ্যে রয়েছে। সেই