পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१७२ রবীন্দ্র-রচনাবলী ২৬ সেপ্টেম্বর আজ ক্ষণে ক্ষণে রৌদ্র উকি মারছে, কিন্তু সে যেন তার গারদের গরাদের ভিতর থেকে । তার সংকোচ এখনাে ঘুচল না। বাদল-রাজের কালো-উদ্দীপরা মেঘগুলো দিকে দিকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আচ্ছন্ন সূর্যের আলোয় আমার চৈতন্যের স্রোতস্বিনীতে যেন ভঁটা পড়ে গেছে। জোয়ার আসবে রৌদ্রের সঙ্গে সঙ্গে । পশ্চিমে, বিশেষত আমেরিকায়, দেখেছি বাপমায়ের সঙ্গে অধিকাংশ বয়স্ক ছেলেমেয়ের নাড়ীর টান ঘুচে গেছে। আমাদের দেশে শেষ পর্যন্তই সেটা থাকে। তেমনিই দেখেছি সূর্যের সঙ্গে মানুষের প্রাণের যোগ সে দেশে তেমন যেন অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করে না। সেই বিরলরৌদ্রের দেশে তারা ঘরে সূর্যের আলো ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে যখন পর্দা কখনাে বা অর্ধেক কখনাে বা সম্পূর্ণ নামিয়ে দেয়, তখন সেটাকে আমি ঔদ্ধত্য বলে মনে করি। প্রাণের যোগ নয় তো কী ? সূর্যের আলোর ধারা তো আমাদের নাড়ীতে নাড়ীতে বইছে। আমাদের প্রাণমন আমাদের রূপরস সবই তো উৎসরূপে রয়েছে ঐ মহা জ্যোতিষ্কের মধ্যে । সৌরজগতের সমস্ত ভাবীকােল একদিন তো পরিকীর্ণ হয়ে ছিল ওরই বহিলবাম্পের মধ্যে । আমার দেহের কোষে কোষে ঐ তেজই তো শরীরী, আমার ভাবনার তরঙ্গে তরঙ্গে ঐ আলোই তো প্রবহমান। বাহিরে ঐ আলোরই বর্ণচ্ছটায় মেঘে মেঘে পত্রে পুষ্পে পৃথিবীর রূপ বিচিত্র, অন্তরে ঐ তেজই মানসভােব ধারণ করে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় বেদনায় রাগে অনুরাগে রঞ্জিত | সেই এক জ্যোতিরই এত রঙ এত রূপ এত ভাব এত রস। ঐ যে-জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে এক এক চুমুক মদ হয়ে সঞ্চিত, সেই জ্যোতিই তো আমার গানে গানে সুর হয়ে পুঞ্জিত হল। এখনই আমার চিত্ত হতে এই যে চিন্তা ভাষার ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে সে কি সেই জ্যোতিরই একটি চঞ্চল চিন্ময়স্বরূপ নয়, যে-জ্যোতি বনস্পতির শাখায় শাখায় স্তব্ধ ওঙ্কার-ধ্বনির মতো সংহত হয়ে আছে । হে সূৰ্য, তোমারই তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তৰ্গঢ় প্রার্থনা ঘাস হয়ে গাছ হয়ে আকাশে উঠছে, বলছে, জয় হােক। বলছে অপােবৃণু, ঢাকা খুলে দাও । এই ঢাকা খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা খোলাই তার ফুলফলের বিকাশ। অপবৃণু, এই প্রার্থনারই নির্বরধারা আদিম জীবাণু থেকে যাত্রা করে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত, প্রাণের ঘাট পেরিয়ে চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। আমি তোমার দিকে বাহু তুলে বলছি, হে পৃষণ, হে পরিপূর্ণ অপবৃণু— তোমার হিরন্ময় পাত্রের আবরণ খেলো, আমার মধ্যে যে গুহাহিত সত্য তোমার মধ্যে তার অবারিত জ্যোতিঃস্বরূপ দেখে নিই। আমার পরিচয় আলোকে আলোকে উদঘাটিত হােক | '. ২৬ সেপ্টেম্বর কাল অপরাত্নে আচ্ছন্ন সূর্যের উদ্দেশে একটা কবিতা শুরু করেছি, আজ সকালে শেষ হল। ঘন অশ্রুবাম্পে ঘেরা মেঘের দুর্যোগে খড়গ হানি ফেলো, ফেলো টুটি ৷-“ ‘লিপি' (৪ অক্টোবর ১৯২৪) কবিতা-প্রসঙ্গে পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি'র এই অংশ পঠনীয় : ৫ প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩৩১, পৃ ২০৩