পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3 s 3 σΦ. রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রয়োগকালে এক শ্রেণীর ভাষারই ব্যবহার করিয়া থাকেন। যে সামান্য প্রভেদ থাকে, তাহা ব্যক্তিগত। তবে যে র্তাহারা মধ্যে মধ্যে দুই দলে সাজিয়া যুদ্ধার্থ দাড়ান, তাহা প্রকৃত যুদ্ধ নহে, যুদ্ধের অভিনয় মাত্র। সম্প্রতি সংস্কৃত কালেঞ্জের পুরাতন ছাত্র ও বর্তমান অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী মহাশয় তাহার পূর্বগামীদের অপকর্মের প্রায়শ্চিত্তবিধানের জন্যই যেন সাহিত্যের ভাষায় সংস্কৃত-শব্দ প্রয়োগের প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন। শাস্ত্রী মহাশয় তাহার ব্যাকরণসম্বন্ধীয় প্রবন্ধে বলিয়াছেন, খাটি বাঙ্গালা ‘তেল’ শব্দ ব্যবহার করিলে যখন সকলেই বুঝে, এবং লৌকিক প্রয়োগে যখন সৰ্ব্বদা ‘তেল’ শব্দেরই ব্যবহার অাছে, তখন সাহিত্যের ভাষায় তৈল ব্যবহার করিয়া লেখকের ও মুদ্রাকরের পরিশ্রম অকারণে বাড়ানতে লাভ কি ? আমরাও বলি, ঠিক কথা ; অকারণে ভাষাকে দুৰ্ব্বোধ্য করিয়া লাভ কি ? অথবা অকারণে পরিশ্রম বাঙ্গইবারই বা সার্থকতা কি ? ‘তেল’ শব্দ অশ্লীলও নহে ; অশ্রাব্যও নহে ; ভদ্রসমাজে উহার ব্যবহারে কেহ কুষ্ঠিত বা লজ্জিত হয় না ; স্বতরাং আমরা সাহিত্যের ভাষাতেও তেলই ব্যবহার করিব। তবে যদি কেহ স্থলবিশেষে লালিত্যের বা সৌষ্ঠবের অনুরোধে তৈল’ শব্দেরই ব্যবহার করিয়া ফেলেন, তাহাতেও তাহার প্রতি খডগহস্ত হইব না। কেন না, সাহিত্যের মূখ্য উদ্দেশ্য লোকশিক্ষা হইলেও উহার আর একটা উদ্দেশ্য আছে ; উহাকে রসস্থষ্টি বলা যাইতে পারে। সাহিত্যের একটা অংশ আছে, তাহা সৰ্বসাধারণের জন্য নহে ; উহা গুণীর জন্য ও অভিজেব জন্য ও কলাবতের জন্য ও সমজদারের জন্য। শেক্সপীয়রের কাব্য সৰ্ব্বসাধারণের জন্য লিখিত হয় নাই ; সৰ্ব্বসাধারণ উহার রসবত্তা আস্বাদনে অধিকারী নহে। কালিদাস র্তাহার কাব্যগ্রন্থসকল তৎকালে অপ্রচলিত সংস্কৃত ভাষায় লিখিয়াছিলেন ; তাহার উদ্দেশ্য ছিল, সমজদারের জন্য রসস্তষ্টি। কুমারসম্ভবের “ইয়ং মহেন্দ্রপ্রভূতানধিপ্রিয়শ্চতুৰ্দ্দিগীশনিবমত্য মানিনী" ইত্যাদি শ্লোকসপ্তক যত বার পডিয়াছি, কি কারণে জানি না, আমার অন্তরিন্দ্রিয় মোহগ্ৰস্ত ও অবসন্ন হইয়া পডিয়াছে। ঐ কয়েকটি শ্লোকে বিশেষ কোন ভাবগাম্ভীৰ্য্য আছে কি না, তাহা বলিতে পারি না ; কিন্তু ইহার ললিতগম্ভীর পদবিন্যাসজাত ধ্বনি যে এই মোহোংপত্তির একটা প্রধান কারণ, তাহাতে সন্দেহ করি না । সাহিত্যের একাংশের উদেখ রসম্বই ; আধুনিক বাঙ্গালী লেখকগণ মূখ্যতঃ রসস্থটির জন্য সংস্কৃতশব্দসম্পত্তির সাহায্য লইয়া থাকেন। বলা বাহুল্য, স্বনিৰ্ব্বাচিত ও স্ববিন্যস্ত সংস্কৃত শদের যেমন উন্মাদন আছে, তাহ প্রচলিত বাঙ্গাল শব্দের নাই। ইহার মূল অনুসন্ধান বর্তমান ক্ষেত্রে নিম্প্রয়োজন ; সংস্কৃত ভাষার স্বাভাবিক উৎকর্ষ ইহার মুখ্য কারণ হইতে পারে ; কিন্তু আমাদের শিক্ষা দীক্ষা, এমন কি, আমাদের জাতীয় প্রকৃতি ও জাতীয় ইতিহাস প্রভৃতির সহিত অন্যান্য কারণ জড়িত আছে, সন্দেহ নাই। সুতরাং সা হত্যের ভাষার বলবিধানার্থ ও সৌষ্ঠবসাধনাৰ্থ সংস্কৃতশব্দ-সম্পদের গৌরব আছে ও চিরকালই থাকিবে, তজ্জন্য ক্ষুব্ধ কিংবা দুঃখিত হইবার কিছু মাত্র কারণ মাই। সংস্কৃত ভাষার ঐশ্বৰ্য্যভাণ্ডারের দ্বার আমাদের জন্য সৰ্ব্বদা উন্মুক্ত রহিয়াছে।