পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত-কথা : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় * ●● সমাজতন্ত্রের সহিত এক নহে, তখন ইয়ুরোপীয়দের ধৰ্ম্ম আমাদের পক্ষে পরধৰ্ম্ম । উহাদের খ্ৰীষ্টানির কথা বলিতেছি না, উহাদের আইন-কানুন, আহারবিহার, চাল-চলন, আদব-কায়দা, সমস্তই আমাদের নিকট পরধৰ্ম্ম ; আমাদের ধৰ্ম্মও তেমনি উহাদের নিকট পরধৰ্ম্ম ; এবং বিনা বিচারে ও বিনা কারণে একের পক্ষে অন্য ধৰ্ম্ম গ্রহণ প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ। সৌভাগ্যক্রমে এই পবধৰ্ম্মবাৎসল্যের মোহ শীঘ্রই কাটিয়া গিয়াছিল, এবং বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাহার স্বজাতিকে আপন ঘরে ফিরিবার জন্য ডাক দিলেন, তখন আমরা আগ্রহের সহিত সেই নিমন্ত্রণ, গ্রহণ করিলাম। আজি আমরা যে আপন ঘরে প্রত্যাবৰ্ত্তনের জন্য ব্যাকুল হইয়াছি, বিশ বৎসর পূৰ্ব্বেহ সেই প্রত্যাবর্তনের ডাক পডিয়াছিল ; এবং বঙ্কিমচন্দ্রের পথভ্রষ্ট স্বদেশবাসী সেই ডাকে সাড়া দিতে ঔদাসীন্য দেখায় নাই । আজ সেই ডাক আরও উচ্চৈঃস্বরে পড়িয়াছে, এবং তপস্বী বঙ্কিমচন্দ্র মর্ত্যলোকের তপস্যার সমাধান করিয়া অদৃষ্ঠা তপোলোক হইতে আমাদিগকে সেই পরিচিত স্বরে আবার ডাকিতেছেন । বঙ্কিমচন্দ্রকে কেহ কেহ apostle of culture বলিয়া থাকেন। ধৰ্ম্মের সাৰ্ব্বভৌমিক অংশের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া বঙ্কিমচন্দ্র সমুদয় বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্য বিধানকে ধৰ্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন । আমব ধৰ্ম্মের এই সংজ্ঞ স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারি। পূর্বেই বলিয়াছি, বহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির অবিরত সামঞ্জস্য-সাধন -চেষ্টার নাম জীবন, এবং যখন সমুদয় বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্য-বিধান না ঘটিলে বহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির পূর্ণ সামঞ্জস্য ঘটিবাব সম্ভাবনা নাই, তখন ধৰ্ম্মই জীবন রক্ষার এক মাত্র উপায়—“ধৰ্ম্মে রক্ষতি রক্ষিত;" । ধৰ্ম্মই মানব-জীবনকে রক্ষা করে, কেবল ব্যক্তির জীবন বা বংশের জীবন কেন, সমাজের জীবন ও ধৰ্ম্মই রক্ষা করে ; এবং যদি কেহ ঐহিক জীবনের উপর পারত্রিক জীবনের রক্ষাকেও ধর্মের উদ্দেশ্য বলিতে চাহেন, তাহারও সহিত আজ বিধাদ করিতে প্রস্তুত নহি । বঙ্কিমচন্দ্রের-প্রযুক্ত ধৰ্ম্মের এই বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা গ্রহণ করিলে উহা culture অপেক্ষা ব্যাপক হইয় উঠে । এই ধর্মের অন্বেষণের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র আপন ঘরে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া গীতাশাস্ত্রের আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই ব্যাপক অর্থে ধৰ্ম্ম শব্দ প্রয়োগ করিলে সাৰ্ব্বভৌমিক ও প্রাদেশিক. উভয় ধৰ্ম্ম উহার অস্তনিবিষ্ট হইয়া পড়ে ; এবং বঙ্কিমচন্দ্র দেখাইতে চাহিয়াছিলেন, সেই সাৰ্ব্বভৌমিক ধৰ্ম্মের বা প্রাদেশিক যুগধর্মের অন্বেষণের জন্যও আমাদিগকে পরের দ্বারে ভিক্ষার্থী হইয়া দাড়াইতে হইবে না। আজ গীতার সুলভ সংস্করণ লোকের পকেটে-পকেটে বিরাজ করিতেছে, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র যে সময়ে গীতার ব্যাখ্যা করিতে প্রবৃত্ত হন, তখন ইংরেজী-শিক্ষিত লোকের মধ্যে উহা বিরলপ্রচার ছিল। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র যাহার মূলে, বাঙ্গালা দেশে সে জিনিষ অচল থাকে না, তাহ প্রচলিত হয় ; তাই বঙ্কিমচন্দ্র যে দিন ‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার আশ্রয় করিয়া বঙ্গবাসীকে তাহার আপন শাস্ত্রের সহিত পরিচিত করিলেন, সেই দিন হইতে সেই শাস্ত্রকথ। বাঙ্গল দেশের শিক্ষিত সমাজে চলিতে লাগিল। তদবধি উহ। আর থামে নাই। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথমে শিক্ষিত বাঙ্গালীর সন্মুখে স্বদেশের শাস্ত্র স্থাপন করিয়াছিলেন, এ কথা বলিলে ভুল হইবে। তাহার অনেক পূৰ্ব্বে বঙ্গজননীর আর এক সস্তান বিশ্বজগতে পুরাণকবির চতুর্মুখনিঃস্থত এবং ভারতের প্রাচীন ঋষিগণের শ্রতিপ্রবিষ্ট বাণীর মধ্যে