পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/২১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হইতেই বিজয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল যে, ইনি যেই হোন যথেষ্ট সুশিক্ষিত, এবং পল্লীগ্রাম জন্মস্থান হইলেও অনাত্মীয় ভদ্রমহিলার সহিত অসঙ্কোচে আলাপ করিবার শিক্ষা এবং অভ্যাস ইঁহার আছে। ব্রাহ্মসমাজভুক্ত না হইয়াও এ শিক্ষা যে তিনি কি করিয়া কোথায় পাইলেন, ভাবিতে ভাবিতে বাড়িতে পা দিতেই, পরেশের মা আসিয়া জানাইল যে, বহুক্ষণ পর্যন্ত বিলাসবাবু বাহিরের বসিবার ঘরে অপেক্ষা করিতেছেন। শুনিবামাত্রই তাহার মন ক্লান্তি ও বিরক্তিতে ভরিয়া উঠিল। এই লোকটি সেই যে সেদিন রাগ করিয়া গিয়াছিল, আর আসে নাই, কিন্তু আজ যে-কারণেই আসিয়া থাক, যে লোকটির চিন্তায় তাহার অন্তঃকরণ পরিপূর্ণ হইয়াছিল, তাহার কিছুই না জানিয়াও, উভয়ের মধ্যে অকস্মাৎ ব্যবধান সৃষ্টি না করিয়া বিজয়া পারিল না। শ্রান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আমি বাড়ি এসেছি—তাঁকে জানান হয়েছে পরেশের মা?

পরেশের মা কহিল, না দিদিমণি, আমি এক্ষুনি পরেশকে খবর দিতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তিনি চা খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল?

ও মা, তা আর হয়নি? তিনি যে বলেছিলেন, তুমি ফিরে এলেই একসঙ্গে হবে।

বিলাসবাবুই যে এ বাটীর ভবিষ্যৎ কর্তৃপক্ষ, এ সংবাদ আত্মীয়-পরিজন কাহারও অবিদিত ছিল না, এবং সেই হিসাবে আদর-যত্নেরও ত্রুটি হইত না। বিজয়া আর কোন কথা না বলিয়া উপরে তাহার ঘরে চলিয়া গেল। প্রায় মিনিট-কুড়ি পরে সে নীচে আসিয়া খোলা দরজার বাহির হইতে দেখিতে পাইল, বিলাস বাতির সম্মুখে টেবিলের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি কতকগুলা কাগজপত্র দেখিতেছে। তাহার পদশব্দে সে মুখ তুলিয়া ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিয়া একেবারেই গম্ভীর হইয়া উঠিল। কহিল, তুমি নিশ্চয় ভেবেচ আমি রাগ করে এতদিন আসিনি। যদিও রাগ আমি করিনি, কিন্তু করলেও যে সেটা আমার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় হতো না, সে আজ আমি তোমার কাছে প্রমাণ করবো।

বিলাস এতদিন পর্যন্ত বিজয়াকে ‘আপনি’ বলিয়া ডাকিত। আজিকার এই আকস্মিক ‘তুমি’ সম্বোধনের কারণ কিছুমাত্র উপলব্ধি করিতে না পারিলেও, যে বিজয়া আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল না, তাহা তাহার মুখ দেখিয়া অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু সে কোন কথা না কহিয়া ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিয়া অনতিদূরে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল। বিলাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করিয়া কহিল, আমি সমস্ত ঠিকঠাক করে এইমাত্র কলকাতা থেকে আসচি, এখন