বিপ্রদাস • পাথরের জলচৌকি, একদিকে গোটা-তিনেক প্রকাও তাবার ছাড়া, বোধ হয় গঙ্গাজল রাখার জন্য—নিত্য মাজা-ঘষায় বক্ কক্ করিতেছে—তিনি কবে আসিয়াছিলেন এবং আবার কবে আসিবেন নিশ্চিত কেহ জানে না, তথাপি অবহেলার চিহ্নমাত্র কোথাও চোখে পড়িবার জো নাই। যেন এইখানেই বাস করিয়া আছেন এমনি সযত্ন-সতর্ক ব্যবস্থা। এ যে কেবল হুকুম করিয়া, শাসন চালাইয়াই হয় না, তাহার চেয়েও বড় কিছু একটা সমস্ত নিয়ন্ত্রিত করিতেছে, এ কথা বন্দন চাহিবামাত্রই অনুভব করিল। এবং এই মা, স্ত্রীলোকটি যে এ-সংসারে সর্বসাধারণের কতখানি উদ্ধে অবস্থিত এই কথাটা সে বহুক্ষণ পৰ্য্যন্ত নিজের মনে স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া ভাবিতে লাগিল। গল্পে, প্রবন্ধে, পুস্তকে ভারতীয় নারীজাতির বহু দুঃখের কাহিনী সে পড়িয়াছে, তাহাদের হীনতার লজ্জায় নিজে নারী হইয়া সে মৰ্ম্মে মরিয়া গিয়াছে— ইহা মিথ্যাও নয়, কিন্তু এই ঘরের মধ্যে আজ একাকী দাড়াইয়া সে সকল সত্য বলিয়া মানিয়া লইতেও তাহার বাধিল । বাহিরে আসিতে অন্নদা হাসিমুখে কহিল, বড্ড দেরি হয়ে গেল দিদি, প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক, ওঁরা সব নীচে খাবার-ঘরে অপেক্ষ করে আছেন। চলুন। তোমাদের বড়বাবু কাছারি-ঘর থেকে বেরিয়েচেন ? ই, তিনিও নীচে আছেন। আমাদের সঙ্গে বোধকরি খাবেন না ? অন্নদা সহাস্তে কহিল, খেলেও ত সেই দুপুরের পরে দিদি । আজ আবার তাও নেই। একাদশী, সন্ধ্যের পর বোধ হয় কিছু ফল-মূল খাবেন। বন্দন কি করিয়া যেন বুঝিয়াছিল এ-গৃহে এ স্ত্রীলোকটি ঠিক দাসী জাতীয় নয়। কহিল, তিনি ত আর বামুনের ঘরের বিধবা নন, একাদশীর উপোস করবেন কোন দুঃখে ? কাল গাড়িতে একাদশী না হোক দশমীর উপবাস ত ওঁর এমনি হয়ে গেছে। অন্নদা বলিল, তা হোক, উপোস ওঁর গায়ে লাগে না । মা বলেন, আর জন্মে তপস্যা করে বিপিন এ জন্মে উপোস-সিদ্ধির বর পেয়েচে । ওঁর খাওয়া দেখলে অবাক হতে হয় । বন্দন নীচে আসিয়া দেখিল, তাহাদের অভ্যস্ত চ রুটি ডিম প্রভৃতি টেবিলে স্থসজ্জিত, এবং পিতা ও সস্ত্রীক পাঞ্জাবের ব্যারিস্টার ক্ষুধায় চঞ্চল। ধৈর্য্য তাহাজের প্রায় শেষ সীমায় উপনীত, মুহূর্তে খবরের কাগজ ফেলিয়া দিয়া সাহেব অনুযোগের কণ্ঠে কহিলেন, ইং—এত দেরি মা, সকাল বেলাটায় আর ত কোন কাজ হবে না দেখচি । বিপ্লাস অদূরে বসিয়াছিল; বদন জিজ্ঞাসা করিল, মুখুয্যেমশাই, আপনি খাবেন না ? ●减
