পাতা:সে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 তুমি ভেবে দেখছ আরো কী হয়ে যেতে পারলে ভালো হয়, হয়তো প্রথম মেঘকরা আষাঢ়ের বৃষ্টিভেজা আকাশ, হয়তো পূজোর ছুটিতে ঘরমুখে। পাল-তোলা পান্সি নেীকোখানি। এই উপলক্ষ্যে আমি তোমাকে আমার জীবনের একটা কথা বলি। তুমি জানো ধীরুকে আমি কত ভালোবাসতুম | হঠাৎ টেলিগ্রামে খবর পেলুম তার টাইফয়েড, সেই বিকেলেই চলে গেলুম মুন্সিগঞ্জে তাদের বাড়িতে। সাতদিন সাতরাত কাটল। সেদিন ছিল অত্যন্ত গরম, রৌদ্র প্রখর। দূরে একটা কুকুর করুণ সুরে আর্ত্তনাদ করে উঠছিল— শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে রোদ পড়ে আসছে, পশ্চিম দিক থেকে ডুমুর গাছের ছায় পড়েছে বারান্দার উপরে। পাড়ার গয়লানী এসে জিগেস করলে, তোমাদের খোকাবাবু কেমন আছে গা। আমি বললুম, মাথার কষ্ট গা জলি আজ কমেছে। যারা সেবা করছিল তারা আজ কেউ কেউ ছুটি নেবার অবকাশ পেলে। দুজন ডাক্তার রুগী দেখে বেরিয়ে এসে ফিস্ ফিস্ ক’রে কী পরামর্শ করলে; বুঝলেম আশার লক্ষণ নয়। চুপ ক’রে বসে রইলুম, মনে হোলো, কী হবে শুনে। সায়াহ্নের ছায়া ঘনিয়ে এল। দেখা গেল সামনের মহানিম গাছের মাথার উপরে সন্ধ্যাতারা দেখা দিয়েছে। দূরের রাস্তায় পাটবোঝাই গোরুর গাড়ির শব্দ আর শোনা যায় না। সমস্ত আকাশটা যেন ঝিমঝিম করছে। কী জানি কেন মনে মনে বলছি, পশ্চিম আকাশ থেকে ঐ আসছে রাত্রিরূপিনী শান্তি, স্নিগ্ধ, কালো, স্তব্ধ। প্রতিদিনই তো আসে কিন্তু আজ এল বিশেষ একটি মূর্ত্তি নিয়ে স্পর্শ নিয়ে, চোখ বুজে সেই ধীরে চলে-আসা রাত্রির আবির্ভাব আমার সমস্ত অঙ্গকে মনকে যেন আবৃত করে দিলে। মনে মনে বললুম, ওগো শান্তি, ওগো রাত্রি, তুমি আমার দিদি, আমার অনাদি কালের দিদি, দিন অবসানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টেনে নাও তোমার বুকের কাছে আমার ধীরুভাইকে, তার সকল জ্বালা যাক্ জড়িয়ে একেবারে।

 দুই পহর পেরিয়ে গেল; একটা কান্নার ধ্বনি উঠল রোগীর শিয়রের

১৪৫

১৯