বিষয়বস্তুতে চলুন

বত্রিশ সিংহাসন/৩

উইকিসংকলন থেকে

রবিবামা তৃতীয় পুত্তলিকা

বলিল মহারাজ এই সিংহাসনােপবেশন করা তােমার উচিত নহে। তুমি প্রথমতঃ আমার স্থানে রাজা বিক্রমাদিত্যের এক গুণের কথা শ্রবণ কর।  অবন্তী নগরে এক বিচক্ষণ রাজপুরােহিত ছিলেন। তাহার এক পুত্র ছিল, সে বিদ্যাভ্যাস করিত না, দিবারাত্র কেবল সুখাভিলাষে মত্ত থাকিত, তাহাতে ব্রাহ্মণ সতত অসুখী থাকিতেন। এক দিবস তিনি পুত্রকে নিকটে ডাকিয়া কহিতে লাগিলেন, হে পুত্র মনুষ্য হইলে মনুষ্যের উপকার করিতে হয়, পরমেশ্বর এই জন্য মনুষ্যকে জ্ঞান দান করিয়াছেন, এই জ্ঞানের নিমিত্তই মনুষ্যজাতি পশুজাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এই জ্ঞান বিদ্যা দ্বারা উজ্জ্বল হয়। বিদ্যা না থাকিলে মনুষ্যে ও বন্য পশুতে কিছুমাত্র প্রভেদ থাকে না। বিদ্যা মনুষ্যের ভূষণ, বিদ্বান ব্যক্তি রাজা অপেক্ষাও অধিক সমাদর ও সম্মানের পাত্র, কেননা রাজা কেবল স্বদেশে পূজনীয়, বিদ্বান কি স্বদেশে কি বিদেশে সর্বত্রই পূজনীয়। বিদ্যা অর্থ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট পদার্থ, যেহেতু অর্থের অরি আছে, তাহা তস্কর কর্তৃক অপহৃত ও অগ্নি দ্বারা নষ্ট হইতে পারে। বিদ্যা সেপ্রকার নষ্ট হইতে পারেনা, বিদ্যা অক্ষয় ধন, বিতরণে বৃদ্ধি হয়। অপর ধন চিরস্থায়ী ও একত্র-স্থায়ী নহে, কিন্তু বিদ্যাধন কখন স্থান-ভ্রষ্ট হয় না। বিদ্যা সকল ভূষণ হইতে অধিক শােভাকর। রত্নাদি ভূষণ শৈশব ও যৌবন কালে শােভা-কারী বটে, কিন্তু বৃদ্ধাবস্থায় শােভা-জনক নহে। বিদ্যা সকল অবস্থায় সমান শােভাকারী, বিশেষতঃ বৃদ্ধাবস্থায় আরাে সুখ-দায়ক হয়, এবং সকল সময়ে পরম বন্ধুর কর্ম্ম করে। বিদ্যার তুল্য অমূল্য রত্ন পৃথি-

8

বীতে আর নাই, বিদ্যাহীন মনুষ্য পৃথিবীর হেয়। বিদ্যা বিনা মনুষ্য, রূপ যৌবন বা উচ্চ কুল কিছুতেই মান্য হইতে পারে না। পলাশ পুষ্প সুবাস বিনা যেমন অনাদরণীয় ও অশ্রদ্ধেয়, মনুষ্য বিদ্যা-বিহীন হইলে সেই প্রকার সকলের অগ্রাহ্য হয়। অতএব হে নন্দন বিদ্যা যে এমত বস্তু তাহাকে তুমি তাচ্ছল্য করিয়া কেন আর বৃথা বাৎসল্য বৃদ্ধি করিতেছ। শুন তােমাকে এক সার কথা বলিতেছি, মনুষ্যের পুত্র না হওয়া বরং ভাল, কিংবা হইয়াই মরিয়া যাওয়া ভাল, কিন্তু মূখ পুত্র হওয়া কোন রূপেই ভাল নহে। কেননা মূখ। পুত্র পিতা মাতার অতিশয় লজ্জা ও অসীম অসুখের কারণ, পুত্র না থাকিলে সেরূপ অসুখ হয় না। পুত্র হইয়া মরিলে পিতা মাতা শােক পান বটে, কিন্তু সে শােক বহুকালীন নহে, পুত্র মূখ হইলে যাবজ্জীবন দুঃখ পাইতে হয়। অতএব মূখ পুত্র জীবিত থাকা অপেক্ষা মরিয়া যাওয়াই মঙ্গল।

 এই সকল ভৎসনায় ব্রাহ্মণ-কুমারের অন্তঃকরণে অতিশয় ঘৃণা জন্মিল। অতএব তিনি দেশত্যাগী হইয়া এই প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, যে পর্যন্ত বিদ্যা শিক্ষা করিতে না পারিব সে পর্যন্ত আর গৃহে আসিব না। এই সংকল্প করিয়া ব্রাহ্মণ-তনয় বিদ্যা উপার্জন জন্য নানা দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে কাশ্মীর দেশে উপস্থিত হইয়া সর্ব্বশাস্ত্র-বিশারদ এক ব্রাহ্মণের নিকটে বিদ্যাভ্যাস করিতে লাগিলেন। ঐ ব্রাহ্মণ তাহার ভক্তি ও মনােযােগ দেখিয়া তাহার প্রতি সদয় হইয়া তাহাকে বিদ্যা শিক্ষা করাইতে লাগিলেন। বিপ্র-তনয় অতি অল্প কালের মধ্যে সকল শাস্ত্রে অতি বিচক্ষণ হইয়া উঠিলেন।

 ব্রাহ্মণ-তনয় বিদ্যাভ্যাস করণানন্তর গুরুস্থানে বিদায় লইয়া কাঞ্চীপুর নগরে আসিলেন। ঐ স্থানে এক নরক্ষক নরমােহিনী নামী এক ভুবনমােহিনী কামিনীকে আনিয়া রাখিয়াছিল, যে ব্যক্তি তাহার অলৌকিক রূপ লাবণ্য দর্শনে মােহিত হইয়া প্রণয়- কাঙ্ক্ষা, অথবা তাহাকে স্থানান্তরে লইয়া যাইবার বাসনা, করিত নরভক্ষক তৎক্ষণাৎ তাহাকে ধরিয়া ভক্ষণ করিত। এই প্রকারে সহস্র সহস্র লােক তাহার উদরে গিয়াছিল। বিএ-নন্দন এই বৃত্তান্ত শুনিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক প্রথমতঃ রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় উপস্থিত হইলেন এবং রাজাকে সেই বিবরণ বলিলেন, পরে ইহাও প্রকাশ করিলেন যদি তিনি ঐ নরমােহিনীকে নরভক্ষকের হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া তাহার কামিনী করিয়া দেন তবে তিনি চির-কৃতার্থ হয়েন। রাজা তাহাতে সম্মত হইয়া তাহার সমভিব্যাহারে কাঞ্চীপুরে যাত্রা করিলেন।

 তথায় উপনীত হইয়া যখন রাজা ঐ নরমােহিনীকে দর্শন করিলেন তখন তাহার মনােহর রূপ লাবণ্যে একবারে বিমােহিত হইলেন, এবং যদিও তিনি জ্ঞান দ্বারা সকল ইন্দ্রিয় জয় করিয়া ছিলেন তথাপি, কর্পের প্রখর শরাঘাতে ক্ষণেক কাল তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। অনন্তর রজনী আগত হইলে নরক্ষক আসিয়া রাজাকে দেখিয়া অতিশয় কুপিত হইল, এবং তাঁহার সংহার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহাতে ঘােরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। পরিশেষে বীর বিক্রমাদিত্য তাহাকে বিনাশ করিলেন। তখন নরমােহিনী রাজার সম্মুখে গললগ্নবসনা হইয়া কহিল মহারাজ আপনকার বল-প্রভাবে আমি এই দুরন্ত দস্ত হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলাম, ইহা না হইলে আমি এই প্রকারচির-বন্দিনী থাকিতাম, অতএব আমি মদীয় শরীর ভবদীয় চরণে সমর্পণ করিলাম, আপনকার যাহা বাসনা করুন। রাজা বলিলেন যদি তুমি আপন ইচ্ছায় পাণি-দান স্বীকার করিলে তবে আমার এই বাসনা তুমি এই ব্রাহ্মণ-কুমারকে পাণিদান কর। ইনি যদিও ধনবান্, নহেন, কিন্তু অতি বিদ্বান এবং আপন গুণে আমার পরম প্রিয় পাত্র হইয়াছেন। বিশেষতঃ ইনিই ভােমার পরিত্রাণের মূল, কেননা ইহার স্থানে সংবাদ পাইয়া আমি তােমাকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছি। নরমােহিনী এই কথা শুনিয়া তখনি ব্রাহ্মণ-কুমারকে পাণিদান করিতে সম্মতা হইল। তৎপরে রাজা বিপ্রকুমারের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া রাজধানীতে আসিলেন। ব্রাহ্মণনন্দন সস্ত্রীক মহা আনন্দে বৃদ্ধ পিতার সদনে উপস্থিত হইলেন। তাহার পিতা তাহার সৌভাগ্যে অতিশয় আনন্দিত হইলেন।  পুত্তলিকা কহিল হে ভােজরাজ দেখ, রাজা বিক্রমাদিত্য কেমন পরােপকারী ছিলেন। যে প্রাণকে সতত রক্ষা করা কত্ত সে প্রাণের কিছু মাত্র আশঙ্কা করিয়া তিনি কেবল পরের উপকার জন্য আপনাকে দৈত্যের মুখে দিয়াছিলেন। আর দেখ তাহার কেমন জিতেন্দ্রিয়তা, যে নারীর প্রেমে তাহার চিত্ত ক্ষণ কালের নিমিত্ত বিচলিত হইয়াছিল তাহাকে পাইয়াও অনায়াসে ত্যাগ করিলেন। হে ভােজরাজ যদি তােমার এমত গুণ থাকে তবে সিংহাসনে উপবেশন কর, নতুবা এ দুরাশা পরিত্যাগ করাই সৎপরামর্শ।

 ইহা শুনিয়া ভােজরাজ সে দিবস সিংহাসনে আরােহণ করিলেন না। পর দিবস পুনর্ব্বার সিংহাসনের নিকটে আসিলে,