বিষয়বস্তুতে চলুন

বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/আঠারো

উইকিসংকলন থেকে

আঠারো

 সুভাষচন্দ্রের প্রথম রাষ্ট্রপতিত্বের কাল প্রবল কর্মচাঞ্চল্যের ভিতর দিয়া কাটিয়া যায়। ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিনি কংগ্রেসের মত বিরাট প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব করেন। সেই সময়েই দেশীয় রাজ্যসমূহে গণবিক্ষোভ দেখা দেয়—নিপীড়িত প্রজাগণ চেতনা লাভ করিয়া দলে দলে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হইতে থাকে ও বৃটিশ অনুগ্রহপুষ্ট অত্যাচারী স্বেচ্ছাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রাম শুরু করে। তালচর, ধেনকানল, মহীশূর হিন্দোল, জয়পুর, রণপুর, রাজকোট প্রভৃতি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যে গণজাগরণের প্লাবন বিপুল আকার ধারণ করে এবং বৃটিশ শাসন ও রাজন্যবর্গের যুক্ত দলন নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় জণগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে। সেই সময়ে কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট মুসলমান সম্প্রদায়কেও অধিকতর সংখ্যায় কংগ্রেসের পতাকাতলে আনিবার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে সুভাষচন্দ্র মুসলীম লীগের সভাপতি মিঃ জিন্নার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে মুসলমান জনগণের সহায়তালাভের জন্য কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐক্যসংস্থাপনের উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনা করেন। তাঁহার এই চেষ্টা ফলবতী না হইলেও এই প্রচেষ্টার দ্বারাই তিনি মুসলমান জনগণের হৃদয় অধিকার করিতে সমর্থ হন। সেই সময়েই মহাচীনের মুক্তি সংগ্রামে সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য কংগ্রেসের পক্ষ হইতে চীনে কংগ্রেস মেডিক্যাল মিশন প্রেরিত হয়। চারিজন বিশিষ্ট ভারতীয় চিকিৎসক চীনের বিখ্যাত অষ্টম রুট্ বাহিনীর সহিত থাকিয়া চীনা জনগণের স্বাধীনতার যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। হরিপুরা অভিভাষণে তিনি ভবিষ্যৎ ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা সম্বন্ধে ঘোষণা করেন, “কেবলমাত্র সোস্যালিষ্ট পদ্ধতির দ্বারাই দারিদ্র্য মোচন, নিরক্ষরতা ও ব্যাধি দূরীকরণ এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কিত আমাদের প্রধান প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলির সমাধান হইতে পারে।” ভারতবর্ষে এরূপ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য হরিপুর কংগ্রেসেই তিনি এক কমিশন নিয়োগের প্রস্তাব করেন। এই কমিশন ভারতবর্ষের কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থাকে উৎপাদন ও ব্যবহারের উভয়ক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী পুনর্গঠিত করিতে ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকারকে সুপারিশ করিবে; কারণ,—‘a comprehensive scheme of industrial development under state-ownership and state-control will be indispensable.’ পরে তাঁহারই নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হইয়া “ন্যাশনাল প্লানিং কমিটি” নামে পরিচিত হয়। এই ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠনে সুভাষচন্দ্র যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছেন তাহার তুলনা কংগ্রেসের ইতিহাসে বিরল। এতদ্ভিন্ন, তাঁহারই চেষ্টায় বহুদিনের বাঙালী-বিহারী সমস্যারও সন্তোষজনক সমাধান হয়। রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে ওয়ার্কিং কমিটির বার্দ্দৌলী অধিবেশনে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাহার মর্ম এই—১) ভারতের যে কোন প্রদেশে যে কোন ভারতীয় চাকুরি পাইতে পারিবেন। (২) বিহারী ও বিহারে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে কোন ব্যাপারে কোনরূপ বৈষম্য থাকিবে না। (৩) ডোমিসাইল্ড সার্টিফিকেট্ প্রথা রহিত হইবে। (৪) চাকুরী প্রার্থীরা আবেদনপত্রে অধিবাসী অথবা ডোমিসাইল্ড বলিয়া উল্লেখ করিবেন। (৫) যে কোন ব্যক্তি দশ বৎসর কোন প্রদেশে বাস করিলেই ঐ প্রদেশে ডোমিসাইল্ড বলিয়া গণ্য হইবেন। (৬) যাহাদের মাতৃভাষা স্কুলের প্রচলিত ভাষা হইতে পৃথক, সংখ্যায়, যথোপযুক্ত হইলে তাহাদের জন্য তাহাদের মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বলা বাহুল্য ভারতীয়মাত্রকেই একটি অখণ্ড জাতি হিসাবে গণ্য করিবার যে উদার নীতি এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হইয়াছে, উহা সম্পূর্ণরূপে কংগ্রেসের মূল নীতি ও আদর্শের পরিপোষক ও গণতন্ত্রের অনুকূল। সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বকালে পার্লামেণ্টারী কার্য্যক্ষেত্রে কংগ্রেসী মন্ত্রিবর্ণ অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় প্রদান করেন। জাগ্রত জনমতের নিকট দাম্ভিক ক্ষমতাপ্রিয় গভর্নরগণ অনেকক্ষেত্রে নীতি স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। ভারতের আটটি প্রদেশে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা শাসনভার গ্রহণ করেন। আসামে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সিন্ধু, পাঞ্জাব, বাঙলাদেশেও কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী হয়। পার্লামেণ্টারী কার্য্যকলাপে কংগ্রেসের মর্য্যাদা, শক্তি ও কর্মতৎপরতা অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

 কিন্তু সুভাষচন্দ্রের এই কার্য্যকলাপ দেশের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করিলেও কংগ্রেস নেতৃত্বের একটি অংশের নিকট উহা মোটেই প্রীতিকর হইতেছিল না। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী বিপ্লবী-শ্রেণীর এইরূপ সুসংহত অভিযান মোটেই সুনজরে দেখিতে পারিতেছিলেন না। কংগ্রেসের ঊর্দ্ধতন কর্ত্তৃপক্ষের সুভাষ-বিরোধিতা নির্লজ্জরূপে আত্মপ্রকাশ করিল ত্রিপুরী কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি নির্ব্বাচনের সময়। ইতিপূর্বে নরীম্যান ও খারে কংগ্রেস উচ্চমণ্ডলের রোষদৃষ্টিতে পতিত হইয়াছিলেন, এইবার সুভাষচন্দ্রের উপরেই খড়্গ পড়িল!