বিবিধ সমালোচন/আর্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প

উইকিসংকলন থেকে

আর্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প।[১]

 একদল মনুষ্য বলেন, যে এ সংসারে সুখ নাই, বনে চল, ভোগাভোগ সমাপ্ত করিয়া মুক্তি বা নির্ব্বাণ লাভ কর। আর একদল বলেন, সংসার সুখময়, বঞ্চকের বঞ্চনা অগ্রাহ করিয়া, খাও, দাও, ঘুমাও। যাঁহারা সুখাভিলাষী তাঁহাদিগের মধ্যে নানা মত। কেহ বলেন ধনে সুখ, কেহ বলেন মনে সুখ; কেহ বলেন ধর্ম্মে, কেহ বলেন অধর্ম্মে; কাহার সুখ কার্য্যে, কাহারও সুখ জ্ঞানে। কিন্তু প্রায় এমন মনুষ্য দেখা যায় না, যে সৌন্দর্য্যে সুখী নহে। তুমি সুন্দরী স্ত্রীর কামনা কর; সুন্দরী কন্যার মুখ দেখিয়া প্রীত হও; সুন্দর শিশুর প্রতি চাহিয়া বিমুগ্ধ হও, সুন্দরী পুত্ত্রবধূর জন্য দেশ মাথায় কর। সুন্দর ফুলগুলি বাছিয়া শয্যায় রাখ, ঘর্ম্মাক্ত ললাটে যে অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছ, সুন্দর গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া, সুন্দর উপকরণে সাজাইতে, তাহা ব্যয়িত করিয়া ঋণী হও; আপনি সুন্দর সাজিবে বলিয়া, সর্ব্বস্ব পণ করিয়া, সুন্দর সজ্জা খুঁজিয়া বেড়াও—ঘটী বাটী পিত্তল কাঁশাও যাহাতে সুন্দর হয়, তাহার যত্ন কর। সুন্দর দেখিয়া পাখী পোষ, সুন্দর বৃক্ষে সুন্দর উদ্যান রচনা কর, সুন্দর মুখে সুন্দর হাসি দেখিবার জন্য, সুন্দর কাঞ্চন রত্নে সুন্দরীকে সাজাও। সকলেই অহরহ সৌন্দর্য্যতৃষায় পীড়িত কিন্তু কেহ কখন এ কথা মনে করে না বলিয়াই এত বিস্তারে বলিতেছি।

 এই সৌন্দর্য্য তৃষা যেরূপ বলবতী, সেইরূপ প্রশংসনীয়া এবং পরিপোষণীয়া। মনুষ্যের যত প্রকার সুখ আছে তন্মধ্যে এই সুখ সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, কেন না, প্রথমতঃ ইহা পবিত্র, নির্ম্মল, পাপ সংস্পর্শশূন্য; সৌন্দর্য্যের উপভোগ কেবল মানসিক সুখ, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ইহার সংস্পর্শ নাই। সত্য বটে, সুন্দর বস্তু অনেক সময়ে ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট; কিন্তু সৌন্দর্য্য জনিত সুখ ইন্দ্রিয়তৃপ্তি হইতে ভিন্ন। রত্নখচিত সুবর্ণ জলপাত্রে জলপানে তোমার যেরূপ তৃষা নিবারণ হইরে কুগঠন মৃৎপাত্রেও তৃষ্ণা নিবারণ সেইরূপ হইবে। স্বর্ণপাত্রে জলপান করায় যে টুকু অতিরিক্ত সুখ, তাহা সৌন্দর্য্যজনিত মানসিক সুখ। আপনার স্বর্ণপাত্রে জল খাইলে অহঙ্কারজনিত সুখ তাহার সঙ্গে মিশে বটে, কিন্তু পরের স্বর্ণপাত্রে জলপান করিয়া তৃষা নিবারণাতিরিক্ত যে সুখ, তাহা সৌন্দর্য্যজনিত মাত্র বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ, তীব্রতায় এই সুখ সর্ব্বসুখাপেক্ষা গুরুতর; যাঁহারা নৈসর্গিক শোভাদর্শন প্রিয়, বা কাব্যামোদী, তাঁহারা ইহার অনেক উদাহরণ মনে করিতে পারিবেন; সৌন্দর্য্যের উপভোগজনিত সুখ, অনেক সময়ে তীব্রতায় অসহ্য হইয়া উঠে। তৃতীয়তঃ, অন্যান্য সুখ, পৌনঃপুন্যে অপ্রীতিকর হইয়া উঠে, সৌন্দর্য্যজনিত সুখ, চির নুতন, এবং চিরপ্রীতিকর।

 অতএব যাঁহারা মনুষ্যজাতির এই সুখবর্দ্ধন করেন, তাঁহারা মনুষ্যজাতির উপকারকদিগের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ পদ প্রাপ্তির যোগ্য। যে ভিখারী খঞ্জনী বাজাইয়া নেড়ার গীত গাইয়া মুষ্টিভিক্ষা লইয়া যায়, তাহাকে কেহ মনুষ্যজাতির মহোপকারী বলিয়া স্বীকার করিবে না বটে, কিন্তু যে বাল্মীকি, চিরকালের লক্ষ কোটি কোটি মনুষ্যের অক্ষয় সুখ এবং চিত্তোৎকর্ষের উপায় বিধান করিয়াছেন, তিনি যশের মন্দিরে নিউটন, হার্বি, ওয়াট্ বা জেনরের অপেক্ষা নিম্ন স্থান পাইবার যোগ্য নহেন। অনেকে লেকি, মেক্‌লে, প্রভৃতি অসারগ্রাহী লেখকদিগের অনুবর্ত্তী হইয়া কবির অপেক্ষা পাদুকাকারকে উপকারী বলিয়া উচ্চাসনে বসান। এই গণ্ডমুর্খ দলের মধ্যে আধুনিক অর্দ্ধশিক্ষিত বাঙ্গালি বাবু অগ্রগণ্য। পক্ষান্তরে ইংলণ্ডের রাজপুরুষ চূড়ামণি গ্লাডষ্টোন, স্কটলণ্ডজাত মনুষ্যদিগের মধ্যে, হিউম্‌ আদম স্মিথ হণ্টর, কর্লাইল থাকিতে ওয়ল্টর স্কটকে সর্ব্বোপরি স্থান দিয়াছেন।

 যেমন মনুষ্যের অন্যান্য অভাব পূরণার্থ এক একটি শিল্প বিদ্যা আছে, সৌন্দর্য্যাকাঙ্ক্ষা পূরণার্থও বিদ্যা আছে। সৌন্দর্য্য সৃজনের বিবিধ উপায় আছে। উপায় ভেদে, সেই বিদ্যা পৃথক্ পৃথক্ রূপ ধারণ করিয়াছে।

 আমরা যে সকল সুন্দর বস্তু দেখিয়া থাক, তন্মধ্যে কতকগুলির, কেবল বর্ণ মাত্র আছে—আর কিছু নাই। যথা আকাশ।

 আর কতকগুলির বর্ণ ভিন্ন, আকারও আছে, যথা পুষ্প।

 কতক গুলির, বর্ণ, ও আকার ভিন্ন, গতিও আছে, যথা উরগ।

 কতকগুলির বর্ণ, আকার, গতি ভিন্ন, রব আছে; যথা কোকিল।

 মনুষ্যের, বর্ণ, আকার, গতি, ও রব ব্যতীত অর্থযুক্ত বাক্য আছে।

 অতএব সৌন্দর্য্য সৃজনের জন্য, এই কয়টি সামগ্রী, বর্ণ, আকার, গতি, রব, ও অর্থযুক্ত বাক্য।

 যে সৌন্দর্য্যজননী বিদ্যার বর্ণ মাত্র অবলম্বন, তাহাকে চিত্র বিদ্যা কহে।

 যে বিদ্যার অবলম্বন, আকার তাহা বিবিধ। জড়ের আকৃতিসৌন্দর্য্য যে বিদ্যার উদ্দেশ্য, তাহার নাম স্থাপত্য। চেতন বা উদ্ভিদের সৌন্দর্য্য যে বিদ্যার উদ্দেশ্য, তাহার নাম ভাস্কর্য্য।

 যে সৌন্দর্য্যজনিকা বিদ্যার সিদ্ধি গতির দ্বারা, তাহার নাম নৃত্য।

রব, যাহার অবলম্বন, সে বিদ্যার নাম সঙ্গীত।
বাক্য যাহার অবলম্বন, তাহার নাম কাব্য।

 কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য, ভাস্কর্য্য, স্থাপত্য, এবং চিত্র, এই ছয়টি সৌন্দর্য্যজনিকা বিদ্যা। ইউরোপে এই সকল বিদ্যার যে জাতিবাচক নাম প্রচলিত আছে, শ্রীমাণি বাবু তাহার অনুবাদ করিয়া “সূক্ষ্মশিল্প” নাম দিয়াছেন। নামটি আমাদের প্রীতিকর হয় নাই। যদি কালিদাস প্রেতাবস্থায় শুনিতে পান যে কুমারসম্ভব, শকুন্তলা রচনা, “শিল্প” বিদ্যা মাত্র, তবে তিনি রাগ করিবেন সন্দেহ নাই, এবং যে শিল্পবিদ্যার প্রভাবে ইলোরার প্রকাণ্ড গুহাট্টালিকা খোদিত হইয়াছিল, তাহাকে “সুক্ষ্ম” বলা একটু অসঙ্গত হয়। যাহা হউক, নামে কিছু আসিয়া যায় না।

 কাব্যের সঙ্গে, অন্যান্য “সূক্ষ্ম শিল্পের,” এত প্রকৃতিগত বিভেদ, যে এক্ষণে, অনেকেই ইহাকে আর “সূক্ষ্ম শিল্প” মধ্যে গণ্য করেন না; নৃত্য গীত, সামাজিক সামগ্রী, একা বিদ্বানের নহে, সুতরাং উহাও একটু তফাৎ হইয়া পড়িয়াছে এবং “সূক্ষ্ম শিল্প” নাম করিলে, আপাততঃ চিত্র, ভাস্কর্য, এবং স্থাপত্যই মনে পড়ে। বাবু শ্যামাচরণ শ্রীমাণির গ্রন্থের বিষয়, কেবল এই তিন বিদ্যা।

 প্রাচীন ভারতবর্ষে, এই তিন বিদ্যার কিরূপ প্রচার এবং উন্নতি ছিল, তাহার পরিচয় দেওয়াই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। কিন্তু গ্রন্থারম্ভে, সাধারণতঃ সূক্ষ্ম শিল্পের উৎপত্তি বিষয়ক একটি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধটি পাঠযোগ্য।

 তৎপরে গ্রন্থকার, অস্মদ্দেশীর শিল্পকার্য্যের প্রাচীনত্ব সপ্রমাণ করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন। এ দেশের শিল্পকার্য্য যে প্রাচীন, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই, কিন্তু শ্রীমাণি বাবু ইহার যেরূপ প্রাচীনতা প্রতিজ্ঞাত করিয়াছেন, সেরূপ প্রাচীনতা প্রমাণিত করিতে পারেন নাই। অশোকের পূর্ব্বকালিক স্থাপত্য বিদ্যার কোন চিহ্ণ এ দেশে যে বর্ত্তমান নাই, তাহা আপাততঃ স্বীকার করিতে হইবে।

 এই গ্রন্থে প্রাচীন আর্য্যগণের স্থাপত্য বিষয়ে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহাই ইহার উৎকৃষ্টাংশ, তাহা পাঠ করিয়া ভারতবর্ষীয় মাত্রেই প্রীতিলাভ করিবেন। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়ের পৃথিবীর কোন জাতির অপেক্ষায় স্থাপত্য দক্ষতায় ন্যূন ছিলেন না। ভারতবর্ষীয়েরা, কাব্য, দর্শন, গণিত প্রভৃতি নানা বিদ্যায় প্রাধান্যলাভ করিয়া ছিলেন, কিন্তু স্থাপত্যে যেরূপ তাঁহাদিগের প্রাধান্য প্রতিবাদের অতীত,বোধ হয়, সেরূপ আর কোন বিদ্যায় নহে। ফর্গুসন সাহেবের যে কয়টি কথা শ্রীমাণি বাবু উদ্ধৃত করিয়াছেন, আমরাও তাহা পুনরুদ্ধৃত না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। তিনি বলেন, যে—

 “ইহা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও ভূমণ্ডলস্থ অন্যান্য জাতীর স্থাপত্য হইতে এত পৃথক্ যে, মিথ্যা ও ভ্রমাত্মক সংস্কারোৎপত্তির আশঙ্কা না করিয়া ইহার সহিত কোন জাতীয় স্থাপত্যের তুলনা করা যাইতে পারে না। * * * ইহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদির বহ্বায়াস- সাধ্য-গঠননৈপুণ্য ভূমণ্ডলে আদ্বতীয়। ইহার অলঙ্কার প্রাচুর্য্যই আশ্চর্য্য ভাব উদ্দীপক এবং ইহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গঠনগুলির ভিন্ন অংশ সকলের সৌন্দর্য্য ও মাধুরি এবং প্রধান গঠনটীর সহিত সে সকলের উপযোগিতা, সর্ব্বস্থলেই দর্শকের চিত্তবিনোদন করে।

 “ভারতবর্ষীয়েরা স্তম্ভের বিশেষ বিশেষ অংশ ও ভূষণের দীর্ঘতা, হ্রাসতা, স্থূলতা ও সূক্ষ্মতা বিষয়ে ইজিপ্ত এবং গ্রীশীয়দিগের পশ্চাদ্বর্ত্তী বটে, কিন্তু তাঁহাদিগের পিল্পার ভূষণ এবং যে সকল মনুষ্য-মূর্ত্তি ইমারত বহন করে (Caryatides) তৎসম্বন্ধে তাঁহারা উক্ত উভয় জাতিকে পরাজয় করিয়াছেন।”

 শ্রীমাণি বাবু ভারতবর্ষীয় স্থাপত্য তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। প্রথম যে সকল ভূগর্ভ এবং পর্ব্বতাভ্যন্তরে খোদিত হইয়া প্রস্তুত; দ্বিতীয়, যে সকল পর্ব্বতের বাহ্যাভ্যন্তরে উভয়েই খোদিত, এবং তৃতীয়, যে সকল প্রস্তর ও ইষ্টকাদি উপকরণে গঠিত।

 প্রথম শ্রেণীর স্থাপত্যের উদাহরণ স্বরূপ ইলোরার গুহার বর্ণনা উদ্ধৃত করিলাম।

 “একটি অর্ধচন্দ্রাকার লোহিত গ্রাণিট পর্ব্বতাভ্যন্তর অর্দ্ধ ক্রোশ ব্যাপিয়া খোদিত হইয়া এই বিখ্যাত গুহা সকল প্রস্তুত হইয়াছে। ঐ অর্দ্ধচন্দ্রাকার স্থানের ব্যাস প্রায় ২৷৷৹ ক্রোশ হইবে। স্থপতি কার্য্যে যত প্রকার গঠন ও অলঙ্কারপারিপাট্য থাকিতে পারে সে সকলই এই গুহা সকল মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়। যথা;—বহু ভূষণে বিভূষিত স্তম্ভ, অলিন্দ, চাঁদনী, সোপানশ্রেণী, সেতু, শিখর, গুম্বজাকার ছাদ, বৃহদাকার প্রতিমূর্ত্তি এবং ভিত্তি সংলগ্ন বহুবিধ খোদিত কারুকার্য্য ইহার কিছুরই অভাব নাই।”

 “অত্রত্য গৃহ সকল প্রায় দ্বিতল। কোন কোনটি তিনতলও আছে। কিন্তু প্রথম তল মৃত্তিকাদিতে প্রায় পরিপূর্ণ হওয়ায় তৎপ্রবেশ দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। এতদ্‌গুহাস্থ ইন্দ্র সভা অতীব বিস্তৃতা ও মনোহারিণী। ইহার অভ্যন্তররস্থ স্তম্ভ সকল ইদানীন্তন কালের ন্যায় নহে—একটী হাঁড়ী বিপরীত ভাবে স্থাপিত করিয়া তাহাকে পদ্ম পাপড়ী দ্বারা বেষ্টন করিলে অত্রস্থ স্তম্ভ বোধিকার গঠন প্রণালী কথঞ্চিৎ বোধগম্য হইতে পারে, কিন্তু উল্টা হাঁড়ী বলিয়া আমাদিগের অনাদর করা উচিত নহে। কারণ, হাঁড়ীর গঠন কিছু বিশ্রী নহে, প্রত্যুতঃ শ্রীসম্পন্ন, তাহাতে ইহার মনোহর ভাস্কর্য; এবং সমুদয় স্তম্ভের বিভূষণসংযুক্ত গঠন দেখিলে হৃদয় যে অপূর্ব্ব ভাবে উচ্ছ্বাসিত হইবে তাহা বিচিত্র নহে। অপরন্তু, এই বোধিকা সকল উৎকল দেশীয় বিমান সকলের চূড়ার নিম্নে আম্লাশিলার (আমলকী ফলের ন্যায় বর্ত্তুলাকার ও পল বিশিষ্ট বলিয়া আম্লাশিলা নামে খ্যাত) আকারে খোদিত। এই গুহার প্রশস্ত গৃহ সকলের বহিঃপ্রকোষ্ঠে শোভনীয় কীলকশ্রেণী বা গরাদিয়া সকল কর্ত্তিত হইয়াছে। অপর, ইহার প্রবেশ দ্বার অতীব মনোহর গঠনে গঠিত—দ্বাদশটী সূক্ষ্ম স্তম্ভোপরি অপূর্ব্ব কারুকার্য্য খচিত ইহার দিবা গুম্বজ অদ্যাপিও সুশোভিত হইয়া রহিয়াছে। তৃতীয় চিত্রপটে ইন্দ্র সভায় যে চিত্র প্রদত্ত হইল তদ্দ্বারা পাঠক ইহার “সুচার রচনাচাতুর্য কিয়ৎপরিমাণে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন।

 “ইন্দ্রসভার অন্তঃপাতী তিনটী গুহা আছে। একটি ৬০ পাদ দীর্ঘ এবং ৪৮ পাদ প্রস্থ; ইহার ভিত্তিতে অনেক বুদ্ধমূর্ত্তি সকল খোদিত আছে; ইহার গর্ভস্থানে ব্যাঘ্রেশ্বরী ভবানী ও বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি বিরাজমান। দ্বিতীয় গুহা-গর্ভের বাম ও দক্ষিণ পার্শ্বের ব্যাঘ্রেশ্বরী ভবানীর মূর্ত্তিদ্বয়ের মধ্যে পরশুরামের মূর্ত্তি খোদিত আছে। তৃতীর গুহার বহিঃপ্রকোষ্ঠে গজারূঢ়-পুরুষ এবং শার্দ্দূলপৃষ্ঠে উপবিষ্ঠা এক স্ত্রীর মূর্ত্তি থাকায়, ইহাদিগঞ্চে ইন্দ্র ও শচী অনুমানে ব্রাহ্মণেরা এই গুহাত্রয়ের নাম ইন্দ্রসভা রাখিয়াছেন। কিন্তু, ইহাও বক্তব্য যে, এই স্ত্রীমূর্ত্তিই প্রথম ও দ্বিতীয় গুহায় ব্যাঘ্রেশ্বরী ভবানী বলিয়া অভিহিত হইয়াছে।


 “‘দুমার লয়না’ অর্থাৎ বিবাহশালা নামে অপর এক সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ গুহা আছে। ইহা ১২৫ হস্ত দীর্ঘ, এবং ১০০ হস্ত প্রস্থ। এই গুহার গর্ভস্থানে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। ইহাতে অনেক দেব দেবীরও মূর্ত্তি সকল দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু তন্মধ্যে হরপার্ব্বতীর বিবাহ ব্যাপার খোদিত থাকায় এই গুহার নাম বিবাহশালা হইয়াছে।

 “ইলোরার আর একটা প্রসিদ্ধ গুহার নাম ‘কৈলাস;’ ইহা ৩৬৭ হস্ত দীর্ঘ এক বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ মধ্যে নির্ম্মিত। ইহার প্রবেশ দ্বারে এক চমৎকার নহবৎখানা আছে, এবং এতন্মধ্যে এত অধিক সংখ্যক দেবতাদিগের লীলাপ্রকাশক মূর্ত্তি সকল দৃষ্ট হয় যে, তাহার তুলনা পৃথিবীর আর কোথাও প্রাপ্ত হওয়া যায় না। প্রাঙ্গণের তিন দিকে স্তম্ভযুক্ত অলিন্দ এবং তাহার ভিত্তিতে বহুল দেবাদির মূর্ত্তি সকল খোদিত আছে। গোপুরের পশ্চাতে কৈলাসের প্রাসাদ, ইহা পাঁচটা মন্দিরে সম্পূর্ণ। মধ্যস্থ মন্দির সর্ব্বাপেক্ষা উচ্চ; ইহা 88 হস্ত দীর্ঘ, এবং ৩৭ হস্ত প্রস্থ। এই মন্দির সকল খোদিত গজ ও শার্দ্দূলযুক্ত উপানোপরি স্থাপিত। এই গুহার পশ্চাদ্ভাগে একটা চাঁদনীর মধ্যে এত দেব দেবীর মূর্ত্তি আছে যে, ইহাকে হিন্দুদেবতাদিগের প্রদর্শন গৃহ বলিয়া প্রতীয়মান হয়।

 এই গুহার সন্নিকটে অনেক গুহা দেখিতে পাওয়া যায়, এবং তৎসমুদয়ই পর্ব্বত খোদিত হইয়া প্রস্তুত হ‍ইয়াছে। স্তম্ভ, ছাদ, প্রাচীর, অলিন্দ, গুম্বজ এবং অসংখ্য দেব দেবীর মূর্ত্তি—এ সকলই একখণ্ড প্রস্তর, ইহার কোন অংশ গ্রথিত নহে। এই সমস্ত পর্ব্বত খোদিত করিতে কত সময়, কত শ্রম ও কত অর্থ বায়িত হইয়াছে, তাহা মনে করিলে স্তব্ধ হইতে হয়।”

 দ্বিতীয় শ্রেণীর স্থপতি কীর্ত্তি সকলের মধ্যে চিলামব্রুমের মন্দিরের বর্ণনা উদ্ধৃত করিলাম।

 “চিলামব্রুমের মন্দিরগুলি ১৩৩২ পাদ দীর্ঘ, ৯৩৬ পাদ প্রস্থ, এবং ৩০ পাদ উচ্চ ও ৭ পাদ প্রস্থ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণের প্রায় মধ্যস্থলে ও ঈষৎ পূর্ব্বদিকে একটি চমৎকার বৃহদাকার মন্দির আছে। ইহা দীর্ঘে ২২ পাদ এবং প্রস্থে ৬৪ পাদ; ইহার সম্মুখে এক চাঁদনী আছে, উহা সহস্র স্তম্ভে সুশোভিত! উক্ত মন্দিরাভ্যন্তরস্থ মূর্ত্তিসকল ভারতবর্ষীয় যাবতীয় দেব দেবীর আদর্শে খোদিত। কিন্তু ইহার মধ্যে এরূপ একটি অত্যাশ্চর্য্য কীর্ত্তি আছে যে, তাহা ভূমণ্ডলের অন্য কোন স্থানেই দেখিতে পাওয়া যায় না। চতুষ্কোণাকার-স্তম্ভ-শ্রেণী-সংলগ্ন এক প্রস্তর-শৃঙ্খল খোদিত আছে, তাহা দীর্ঘে ১৪৬ পাদ এবং তাহার প্রত্যেক কড়া তিন পাদ দীর্ঘ। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ইহা ভিত্তিসংলগ্ন নহে, কেবল মাত্র স্তম্ভ হইতে স্তম্ভান্তরে সংযোজিত, অবশিষ্টাংশ শূন্যে ঝুলিয়া আছে। অপর এই মন্দিরের প্রবেশদ্বারে এরূপ উৎকৃষ্ট খোদিত মূর্ত্তি সকল এবং এরূপ দুইটী মনোহর শোভাসম্পন্ন পিল্পা আছে যে প্রসিদ্ধ শিল্প-নিপুন গ্রীকজাতিও উক্ত প্রকার গঠনে ঐরূপ অলঙ্কার যোজনা করিতে সমর্থ হয়েন নাই।”

 মহাবালীপুরের মন্দিরের প্রসঙ্গে লিখিত আছে, যে “এই নগরস্থ প্রধান মন্দিরে সাতিশয় সুন্দর গঠনে সুশোভিত মনুষ্য মূর্ত্তি সকল অদ্যাপিও বিদ্যমান আছে। একজন ইউরোপীয় স্বচক্ষে দেখিয়া লিখিয়াছেন তাহাদের কোন কোন অংশ বিশেষতঃ মুখশ্রী, সুবিখ্যাত ভাস্করবিদ্যা-বিশারদ কানরা কৃত মূর্ত্তি সকলের তুল্য।”

 তৃতীয় শ্রেণীর স্থাপত্যের প্রধান উদাহরণ, ভুবনেশ্বর। আবু পর্ব্বতস্থ জৈন মন্দিরের অভ্যন্তরস্থ অলঙ্কার সম্বন্ধে শ্রীমাণি বাবু লিখিয়াছেন, যে তাহার সাদৃশ্য বোধ হয় ভূমণ্ডলে আর কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না।

 “বিখ্যাত ফরগুসন সাহেব বলিয়াছেন যে, এরূপ বহ্বাসসম্পন্ন এবং বিশুদ্ধ রুচির অনুমোদিত স্থপতি কার্য্য বোধ হয় আর কুত্রাপি নাই এবং উক্ত মহাত্মা ইহার চাঁদনী লক্ষ্য করিয়া কহিয়াছেন যে, সে কৃষ্ণফর রেনের লণ্ডন প্রভৃতির সুবিখ্যাত ধর্ম্মমন্দির সকল এই জৈন চাঁদনীর সহিত সৌসাদৃশ্য সম্পন্ন হইলে আরও উৎকৃষ্ট হইত। এই কীর্ত্তি ১০৩২ খ্রীঃ অব্দে নির্ম্মিত হয়। ইহাতে ১৮০০০০০০০ অষ্টাদশ কোটী টাকা এবং চতুর্দ্দশ বর্ষ সময় বায়িত হইয়াছিল।”

 ভারতবর্ষীয় ভাস্কর্য্যের দুইটা মাত্র দোষের উল্লেখ আছে, বিজনতা এবং আলোকাভাব।

 ভারতবর্ষীয় ভাস্কর্য্যের গৌরব, স্থাপত্য গৌরবের ন্যায় নহে, তথাপি আমাদিগের প্রাচীর ভাস্কর্য্য, আধুনিক দেশী ভাস্কর্য্যাপেক্ষা সহস্র গুণে প্রশংসনীয়।

 শ্রীমাণি বাবু কয়েকটি উদাহরণের বর্ণনা করিয়া লিখিয়াছেন।

 “বর্ত্তমান গবর্ণমেণ্ট শিল্প বিদ্যালয়ের সুদক্ষ অধ্যক শ্রীযুক্ত লক সাহেব মহোদয় ভূবনেশ্বরান্তর্গত এক মন্দিরভিত্তিতে একটী দুর্গাদেবীর মূর্ত্তি দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছেন, তিনি বলেন যে ইহা কোমল ও সুখস্পর্শ রক্ত মাংসে গঠিত বলিয়া প্রতীয়মান হয় না। বাস্তবিক অস্মদ্দেশীয় ভাস্কর্য্যের ইহা একটী প্রধান ধর্ম্ম—সর্ব্বত্রেই ইহার গৌরবের কথা শ্রবণগোচর হয়। পাঠক! বোধ করি আপনি অবগত আছেন যে এইরূপ সুখস্পর্শ ও কোমলগঠন এবং মনোহর অঙ্গ বিশ্বাস প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের লক্ষণ। অতএব আপনি শুনিলে আনন্দিত হইবেন যে আর্য্যগণ এই সকল উৎকষ্ট লক্ষণ দ্বারা অলঙ্কৃত করিয়া অধিকাংশ প্রতিমূর্ত্তাদি বিশেষ নৈপুণ্য সহকারে নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন! এই জাতীয় শিল্পের অপর একটী উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম “প্রয়োজम সিদ্ধি” অর্থাৎ, শিল্পী পুত্তলিকাদিগকে যে যে কার্য্যে নিয়োজিত করিবার কল্পনা করিয়াছেন দৃষ্টিমাত্রে দর্শকের মনে সেই সেই উদ্দেশ্য-সাধন ভাবের উপলব্ধি হয়। আমি আহ্লাদের সহিত ব্যক্ত করিতেছি যে অনেক বিখ্যাত ইউরোপীয় পণ্ডিত অস্মদ্দেশীয় পৌরাণিক ভাস্কর্য্যে এই মহদ গুণের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াছেন!"

 পরে মথুরার বিখ্যাত পুত্তলিকা সকলের বিস্তারিত বর্ণনা করিয়াছেন। অনেকে উহা গ্রীক শিল্পিনির্ম্মিত সাইলেনসের প্রতিমূর্ত্তি বিবেচনা করেন। শ্রীমাণি বাবু এ কথার প্রতিবাদ করিয়াছেন।[২] তিনি বলেন যে উহা হিন্দু শিল্পকরের খোদিত কৃষ্ণলীলা বর্ণন। সাইলেনস নহে— বলরাম। যদি এই ভাস্কর্য্য হিন্দু প্রণীত হয়, তবে সে হিন্দু গ্রীকদিগের নিকট শিল্প শিক্ষা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। তাহার বিশেষ চিহ্ণ আছে। ভারতবর্ষীয় ভাস্কর্য্য মধ্যে ইহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট।

 নশ্বর চিত্রপট, অযত্নে রাখিলে, প্রস্তরাদির ন্যায় অধিককাল স্থায়ী হয় না; এজন্য শ্রীমাণি বাবু অজন্তা ও বাঘের গুহাস্থিত ফ্রেস্কো পেণ্টিং ভিন্ন আর কোন চিত্রের উল্লেখ করিতে পারেন নাই। প্রধানতঃ তাঁহাকে নাটকের সাক্ষিতার উপর নির্ভর করিতে হইয়াছে। সে প্রমাণ আমরা বিশেষ সন্তোষজনক বিবেচনা করি না; কবির স্বভাব এই যে প্রকৃত অনুৎকৃষ্ট হইলেও, তাহাকে উৎকর্ষ প্রদান করেন। উত্তরচরিত ও শকুন্তুলায় যে চিত্র বিদ্যার পরিচয় আছে, ততদূর নৈপুণ্য যে ভারতবর্ষীয়েরা লাভ করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে অন্য প্রমাণ আবশ্যক।

 যাহাহউক, শ্রীমাণি বাবুর এই ক্ষুদ্র গ্রন্থ পাঠে আমরা বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি। এ বিষয়ে বাঙ্গালা ভাষায়, দ্বিতীয় গ্রন্থ নাই; এই প্রথমোদ্যম। গ্রন্থে পরিচয় পাওয়া যায় যে শ্রীমাণি বাবু স্বয়ং সুশিক্ষিত, এবং শিল্প সমালোচনায় সুপটু। এবং গ্রন্থ প্রণয়নে বিশেষ পরিশ্রমও করিয়াছেন। এই গ্রন্থের বিশেষ পরিচয়ে পাঠকগণ সন্তুষ্টিলাভ করিবেন বলিরাই, আমরা এই ক্ষুদ্র গ্রন্থ হইতে এত কথা উদ্ধৃত করিতে সাহস করিয়াছি।

 উপসংহারে, স্বদেশীয় মহাশয়গণকে দুই একটা কথা নিবেদন করিলে ক্ষতি নাই। বাঙ্গালি বাবুদিগের নিকট সুক্ষ্ম শিল্প সম্বন্ধে কোন কথা বলা, দুই চারি জন সুশিক্ষিত ব্যক্তি ভিন্ন অল্পের কাছে, ভস্মে ঘৃত ঢালা হয়। সৌন্দর্য্যানুরাগিণী প্রবৃত্তি বোধ হয় এত অল্প অন্য কোন সভ্যজাতির নাই। বাস্তবিক সৌন্দর্য্যপ্রিয়তাই, সভ্যতার একটি প্রধান লক্ষণ, এবং বাঙ্গালিরা এখনও যে সভ্যপদ বাচ্য নহেন, ইহাই তাহার একটি প্রমাণ। তাঁহারা গৃহিণীর মুখখানি সুন্দর দেখিতে ভাল বাসেন বটে—এবং কতকটা পুত্রবধূর সম্বন্ধেও তাই, কিন্তু অন্যত্র সে সৌন্দর্য্যপ্রিয়তা তত বলবতী নহে। সঙ্গতি থাকিলেও ছেঁড়া মাদুর ছেঁড়া বালিশ, দুর্গন্ধ মসি এবং তৈল চিত্রিত জাজিম, আমরা বড় ভাল বাসি। পরিধেয় সম্বন্ধে রজককে বঞ্চনা করাই বাঙ্গালি জাতির জীবনযাত্রার একটা প্রধান বীরত্ব। গৃহমধ্যে পূতিগন্ধবিশিষ্ট, কদর্য্য কীটসঙ্কুল, দৃষ্টিপীড়ক কতকগুলি স্থান না থাকিলে বাঙ্গালির জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ হয় না। বরং বন্যপশু পরিষ্কৃতাবস্থায় থাকে, তথাপি বাঙ্গালি নহে। ঈদৃশ জাতির সৌন্দর্য্যস্পৃহা কোথায়? এবং যে বিদ্যার একমাত্র উদ্দেশ্য সৌন্দর্য্য, তাহার আদর কি প্রকারে সম্ভবে? সুতরাং বাঙ্গালার সূক্ষ্ম শিল্পের এত দুর্দশা।

 স্বীকার করি, সকল দোষ টুকু বাঙ্গালির নিজের নহে। কতকটা বাঙ্গালির সামাজিক রীতির দোষ;—পূর্ব্বপুরুষের ভদ্রাসন পরিত্যাগ করা হইবে না, তাতেই অসংখ্য সন্তান সন্ততি লইয়া গর্ত্তমধ্যে পিপীলিকার ন্যায়, পিল্‌ পিল্‌ করিতে হইবে— সুতরাং স্থানাভাববশতঃ পরিষ্কৃতি এবং সৌন্দর্য্যসাধন সম্ভবে না। কতকটা, বাঙ্গালির দারিদ্র জন্য। সৌন্দর্য্য অর্থসাধ্য—অনেকের সংসার চলে না। তাহার উপর সামাজিক রীত্যনুসারে, আগে পৌরস্ত্রীগণের অলঙ্কার, দোলদুর্গোৎসবের ব্যয় পিতৃশ্রাদ্ধ মাতৃশ্রাদ্ধ, পুত্র কন্যার বিবাহ দিতে, অবস্থার অতিরিক্ত ব্যয় করিতে হইবে—সে সকল ব্যয় সম্পন্ন করিয়া, শূকরশালা তুল্য কদর্য স্থানে বাস করিতে হইবে, ইহাই সামাজিক রীতি! ইচ্ছা করিলেও, সমাজশৃঙ্খলে বদ্ধ বাঙ্গালি, সে রীতির বিপরীতাচরণ করিতে পারেন না। কতকটা হিন্দুধর্ম্মের দোষ, যে ধর্ম্মানুসারে, উৎকৃষ্ট মর্ম্মরপ্রস্তুত হর্ম্ম্যও গোময় লেপনে পরিষ্কৃত করিতে হইবে, তাহার প্রসাদে সুক্ষ্ম শিল্পের দুর্দ্দশারই সম্ভাবনা।

 এ সকল স্বীকার করিলেও, দোষক্ষালন হয় না। যে ফিরিঙ্গি কেরাণীগিরি করিয়া শত মুদ্রায়, কোন মতে দিনপাত করে, তাহার সঙ্গে বৎসরে বিংশতি সহস্র মুদ্রার অধিকারী গ্রাম্য ভূস্বামীর গৃহপারিপাট্য বিষয়ে তুলনা কর। দেখিবে, এ প্রভেদটি অনেকটাই স্বাভাবিক। দুই চারি জন ধনাঢ্য বাবু, ইংরেজদিগের অনুকরণ করিয়া, ইংরেজের ন্যায় গৃহাদির পারিপাট্য বিধান করিয়া থাকেন এবং ভাস্কর্য্য, ও চিত্রাদির দ্বারা গৃহ সজ্জিত করিয়া থাকেন। বাঙ্গালি নকল নবিশ ভাল, নকলে শৈথিল্য নাই। কিন্তু তাঁহাদিগের ভাস্কর্য্য এবং চিত্র সংগ্রহ দেখিলেই বোধ হয় যে অনুকরণ স্পৃহাতেই ঐ সকল সংগ্রহ ঘটিয়াছে—নচেৎ সৌন্দর্য্যে তাঁহাদিগের আন্তরিক অনুরাগ নাই। এখানে ভাল মন্দের বিচার নাই, মহার্ঘ্য হইলেই হইল; সন্নিবেশের পারিপাট্য নাই, সংখ্যায় অধিক হইলেই হইল। ভাস্কর্য্য চিত্র দূরে থাকুক, কাব্য সম্বন্ধেও বাঙ্গালির উত্তমাধম বিচারশক্তি দেখা যায় না। এ বিষয়ে সুশিক্ষিত অশিক্ষিত সমান—প্রভেদ অতি অল্প। সৌন্দর্য্যবিচার শক্তি, সৌন্দর্য্য রসাস্বাদন সুখ, বুঝি বিধাতা বাঙ্গালির কপালে লিখেন নাই।


  1. সূক্ষ্ম শিল্পের উৎপত্তি ও আর্য্যজাতির শিল্পচাতুরি, শ্রীশ্যামা চরণ শ্রীমাণি প্রণীত। কলিকাতা। ১৯৩০
  2. গ্রীক্ জাতিরা মথুরা পর্য্যন্ত আসিয়াছিল, একথা অসম্ভব বলিয়া শ্রীমাণি মহাশয় যে আপত্তি করিয়াছেন, তাহা অকিঞ্চিৎকর। হণ্টর সাহেব প্রমাণ করিয়াছেন, যে গ্রীক জাতীয়েরা মধ্য ভারতবর্ষের নানা স্থানে বাস করিত। মহাভাষ্যের বিখ্যাত উদাহরণ অরুণৎ যবনো সাকেতম,” শ্রীমাণি মহাশয় কি বিস্মৃত হইয়াছেন? যখন গ্রীকেরা অযোধ্যা অবরোধ করিয়াছিল তখন মথুরার না আসিবে কেন?