মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/আদিবংশাবতরণপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ আদিবংশাবতরণপর্বাধ্যায়॥

১০। উপরিচর বসু—পরাশর-সত্যবতী—কৃষ্ণদ্বৈপায়ন

 শৌনক বললেন, বৎস সৌতি, সর্পসত্রে কর্মের অবকাশে ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন প্রতিদিন যে মহাভারত পাঠ করতেন তাই আমরা এখন শুনতে ইচ্ছা করি। সৌতি বললেন, জনমেজয়ের অনুরোধে ব্যাসদেবের আদেশে তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়ন যে মহাভারতকথা বলেছিলেন তা আপনারা শুনুন।—

 [১]চেদি দেশে উপরিচর বসু নামে পুরুবংশজাত এক রাজা ছিলেন। ইন্দ্র তাঁকে সখা গণ্য ক’রে স্ফটিকময় বিমান, অম্লান পঙ্কজের বৈজয়ন্তী মালা এবং একটি বংশনির্মিত যষ্টি দিয়েছিলেন। উপরিচর অগ্রহায়ণ মাসে উৎসব ক’রে সেই যষ্টি রাজপুরীতে এনে ইন্দ্রপূজা করতেন। পরদিন তিনি গন্ধমাল্যাদির দ্বারা অলংকৃত এবং কুসম্ভ পুষ্পে রঞ্জিত বস্ত্রে বেষ্টিত ক’রে ইন্দ্রধ্বজ উত্তোলন করতেন। সেই অবধি অন্যান্য রাজারাও এইপ্রকার উৎসব ক’রে থাকেন। উপরিচর ইন্দ্রদত্ত বিমানে আকাশে বিচরণ করতেন সেই কারণেই তাঁর এই নাম। তাঁর পাঁচ পুত্র ছিল, তাঁরা বিভিন্ন দেশে রাজবংশ স্থাপন করেন।

 উপরিচরের রাজধানীর নিকট শক্তিমতী নদী ছিল। কোলাহল নামক পর্বত এই নদীর গর্ভে এক পুত্র এবং এক কন্যা উৎপাদন করে। রাজা সেই পুত্রকে সেনাপতি এবং কন্যাকে মহিষী করলেন। একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা তাঁর ঋতুস্নাতা রূপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ ক’রে কামাবিষ্ট হলেন এবং স্খলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষীকে দিয়ে বললেন, তুমি শীঘ্র গিরিকাকে দিয়ে এস। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণের ফলে শুক্র যমুনার জলে প’ড়ে গেল। অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্রহ্মশাপে মৎসী হয়ে ছিল, সে শুক্র গ্রহণ ক’রে গর্ভিণী হ’ল এবং দশম মাসে ধীবরের জালে ধৃত হ’ল। ধীবর সেই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী সন্তান পেয়ে রাজার কাছে নিয়ে এল। অপ্সরা তখনই শাপমুক্ত হয়ে আকাশপথে চ’লে গেল। উপরিচর ধীবরকে বললেন, এই কন্যা তোমারই হ’ক। পুরুষ সন্তানটি পরে মৎস্য নামে এক ধার্মিক রাজা হয়েছিলেন।

 সেই রূপগুণবতী কন্যার নাম সত্যবতী, কিন্তু সে মৎস্যজীবীদের কাছে থাকত সেজন্য তার অন্য নাম মৎস্যগন্ধা। একদিন সে যমুনায় নৌকা চালাচ্ছিল এমন সময় পরাশর মুনি তীর্থপর্যটন করতে করতে সেখানে এলেন। অতীব রূপবতী চারুহাসিনী মৎস্যগন্ধাকে দেখে মোহিত হয়ে পরাশর বললেন, সুন্দরী, এই নৌকার কর্ণধার কোথায়? সে বললে, যে ধীবরের এই নৌকা তাঁর পুত্র না থাকায় আমিই সকলকে পার করি। পরাশর নৌকায় উঠে যেতে যেতে বললেন, আমি তোমার জন্মবৃত্তান্ত জানি; কল্যাণী, তোমার কাছে বংশধর পুত্র চাচ্ছি, তুমি আমার কামনা পূর্ণ কর। সত্যবতী বললে, ভগবান, পরপারের ঋষিরা আমাদের দেখতে পাবেন। পরাশর তখন কুজ্‌ঝটিকা সৃষ্টি করলেন, সর্বদিক তমসাচ্ছন্ন হ’ল। সত্যবতী লজ্জিত হয়ে বললে, আমি কুমারী, পিতার বশে চলি, আমার কন্যাভাব দূষিত হ’লে কি ক’রে গৃহে ফিরে যাব? পরাশর বললেন, আমার প্রিয়কার্য ক’রে তুমি কুমারীই থাকবে। পরাশরের বরে মৎস্যগন্ধার দেহ সুগন্ধময় হল, সে গন্ধবতী নামে খ্যাত হ’ল। এক যোজন দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত সেজন্য লোকে তাকে যোজনগন্ধাও বলত।

 সত্যবতী সদ্য গর্ভধারণ ক’রে পুত্র প্রসব করলেন। যমুনার দ্বীপে জাত এই পরাশরপুত্রের নাম দ্বৈপায়ন[২], ইনি মাতার আদেশ নিয়ে তপস্যায় রত হলেন। পরে ইনি বেদ বিভক্ত ক’রে ব্যাস নামে বিখ্যাত হন এবং পুত্র শুক ও বৈশম্পায়নাদি শিষ্যকে চতুর্বেদ ও মহাভারত অধ্যয়ন করান। তাঁরাই মহাভারতের সংহিতাগুলি পৃথক পৃথক প্রকাশিত করেন।

॥সম্ভবপর্বাধ্যায়॥

১১। কচ ও দেবযানী

 জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশম্পায়ন কুরুবংশের বৃত্তান্ত আদি থেকে বললেন।— ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতি তাঁর পঞ্চাশটি কন্যাকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা অদিতি থেকে বংশানুক্রমে বিবস্বান (সূর্য), মনু, ইলা, পুরুরবা, আয়ু, নহুষ ও যযাতি উৎপন্ন হন। যযাতি দেবযানীশর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করেন।

 ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্য যখন দেবাসুরের বিরোধ হয় তখন দেবতারা বৃহস্পতিকে এবং অসুররা শুক্রাচার্যকে পৌরোহিত্যে বরণ করেন। এই দুই ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, দেবগণ যে সকল দানবকে যুদ্ধে মারতেন শুক্র বিদ্যাবলে তাদের পুনর্জীবিত করতেন। বৃহস্পতি এই বিদ্যা জানতেন না, সেজন্য দেবপক্ষের মৃত সৈন্য বাঁচাতে পারতেন না। দেবতারা বৃহস্পতির পুত্র কচকে বললেন, তুমি অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে যাও, সেখানে শুক্রাচার্যকে দেখতে পাবে। শুক্রের প্রিয়কন্যা দেবযানীকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তবে তুমি নিশ্চয় মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করবে। কচ শুক্রের কাছে গিয়ে বললেন, আমি অঙ্গিরা ঋষির পৌত্র,, বৃহস্পতির পুত্র, আমাকে শিষ্য করুন, সহস্র বৎসর আমি আপনার কাছে থাকব। শুক্র সম্মত হলেন। গুরু ও গুরুকন্যার সেবা ক’রে কচ ব্রহচর্য পালন করতে লাগলেন। তিনি গীত নৃত্য বাদ্য ক’রে এবং পুষ্প ফল উপহার দিয়ে প্রাপ্তযৌবনা দেবযানীকে তুষ্ট করতেন। সুগায়ক সুবেশ প্রিয়বাদী রূপবান মাল্যধারী পুরুষকে নারীরা স্বভাবত কামনা করে, সেজন্য দেবযানীও নির্জন স্থানে কচের কাছে গান গাইতেন এবং তাঁর পরিচর্যা করতেন।

 এইরূপে পাঁচ শ বৎসর গত হ’লে দানবরা কচের অভিসন্ধি বুঝতে পারলে। একদিন কচ যখন বনে গরু চরাচ্ছিলেন তখন তারা তাঁর দেহ খণ্ড খণ্ড ক’রে কুকুরকে দিলে। কচ ফিরে এলেন না দেখে দেবযানী বললেন, পিতা, আপনার হোম শেষ হয়েছে, সূর্য অস্ত গেছে, গরুর পালও ফিরেছে, কিন্তু কচকে দেখছি না। নিশ্চয় তিনি হত হয়েছেন। আমি সত্য বলছি, কচ বিনা আমি বাঁচব না। শুক্র তখন সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ ক’রে কচকে আহ্বান করলেন। কচ তখনই কুকুরদের শরীর ভেদ ক’রে হষ্টচিত্তে উপস্থিত হলেন এবং দেবযানীকে জানালেন যে দানবরা তাঁকে বধ করেছিল। তার পর আবার একদিন দানবরা কচকে হত্যা করলে এবং শুক্র তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন।

 তৃতীয় বারে দানবরা কচকে দগ্ধ ক’রে তাঁর ভস্ম সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রকে খাওয়ালে। কচকে না দেখে দেবযানী বিলাপ করতে লাগলেন। শুক্র বললেন, অসুরেরা তাকে বার বার বধ করছে, আমরা কি করব। তুমি শোক ক’রো না। দেবযানী সরোদনে বললেন, পিতা, বৃহস্পতিপুত্র ব্রহ্মচারী কর্মদক্ষ কচ আমার প্রিয়, আমি তাঁকেই অনুসরণ করব। তখন শুক্র পূর্বের ন্যায় কচকে আহ্বান করলেন। গুরুর জঠরের ভিতর থেকে কচ বললেন, ভগবান, প্রসন্ন হন, আমি অভিবাদন করছি, আমাকে পুত্র জ্ঞান করুন। অসুররা আমাকে ভস্ম ক’রে সুরার সঙ্গে মিশিয়ে আপনাকে খাইয়েছে। শুক্র দেবযানীকে বললেন, তুমি কিসে সুখী হবে বল, আমার উদর বিদীর্ণ না হ’লে কচকে দেখতে পাবে না, আমি না মরলে কচ বাঁচবে না। দেবযানী বললেন, আপনার আর কচের মৃত্যু দুইই আমার পক্ষে সমান, আপনাদের কারও মৃত্যু হ’লে আমি বাঁচব না। তখন শুক্র বললেন, বৃহস্পতির পুত্র, তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ, দেবযানী তোমাকে স্নেহ করে। যদি তুমি কচরূপী ইন্দ্র না হও তবে আমার সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ কর। বৎস, তুমি পুত্ররূপে আমার উদর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিও, গুরুর নিকট বিদ্যা লাভ ক’রে তোমার যেন ধর্মবুদ্ধি হয়।

 শুক্রের দেহ বিদীর্ণ ক’রে কচ বেরিয়ে এলেন এবং নবলব্ধ বিদ্যার দ্বারা তাঁকে পুনর্জীবিত করে বললেন, আপনি বিদ্যাহীন শিষ্যের কর্ণে বিদ্যামৃত দান করেছেন, আপনাকে আমি পিতা ও মাতা জ্ঞান করি। শুক্র গাত্রোত্থান ক’রে সুরাপানের প্রতি এই অভিশাপ দিলেন—যে মন্দমতি ব্রাহ্মণ মোহবশে সুরাপান করবে সে ধর্মহীন ও ব্রহ্মহত্যাকারীর তুল্য পাপী হবে। তার পর দানবগণকে বললেন, তোমরা নির্বোধ, কচ সঞ্জীবনী বিদ্যায় সিদ্ধ হয়ে আমার তুল্য প্রভাবশালী হয়েছেন, তিনি আমার কাছেই বাস করবেন।

 সহস্র বৎসর অতীত হ’লে কচ স্বর্গলোকে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দেবযানী তাঁকে বললেন, অঙ্গিরার পৌত্র, তুমি বিদ্যা কুলশীল তপস্যা ও সংযমে অলংকৃত, তোমার পিতা আমার মাননীয়। তোমার ব্রতপালনকালে আমি তোমার পরিচর্যা করেছি। এখন তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, আমি তোমার প্রতি অনুরক্ত, তুমি আমাকে বিবাহ কর। কচ উত্তর দিলেন, ভদ্রে, তুমি আমার গুরুপুত্রী, তোমার পিতার তুল্যই আমার পূজনীয়, অতএব ও কথা ব’লো না। দেবযানী বললেন, কচ, তুমি আমার পিতার গুরুপুত্রের পুত্র, আমার পিতার পুত্র নও। তুমিও আমার পূজ্য ও মান্য। অসুররা তোমাকে বার বার বধ করেছিল, তখন থেকে তোমার উপর আমার প্রীতি জন্মেছে। তুমি জান তোমার প্রতি আমার সৌহার্দ্য অনুরাগ আর ভক্তি আছে, তুমি আমাকে বিনা দোষে প্রত্যাখ্যান করতে পার না।

 কচ বললেন, দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। চন্দ্রনিভাননী, তোমার যেখানে উৎপত্তি, শত্রুাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী, অতএব আর ওরূপ কথা ব’লো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ কর যেন পথে আমার মঙ্গল হয়। মধ্যে মধ্যে ধর্মের অবিরোধে[৩] আমাকে স্মরণ ক’রো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা ক’রো।

 দেবযানী বললেন, কচ, যদি আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান কর তবে তোমার বিদ্যা ফলবতী হবে না। কচ উত্তর দিলেন, তুমি আমার গুরুপুত্রী, গুরুও সম্মতি দেন নি, সেজন্যই প্রত্যাখ্যান করছি। আমি ধর্মসংগত কথাই বলেছি, তথাপি তুমি কামের বশে আমাকে অভিশাপ দিলে। তোমার যে কামনা তাও সিদ্ধ হবে না, কোনও ঋষিপুত্র তোমাকে বিবাহ করবেন না। তুমি বলেছ, আমার বিদ্যা নিষ্ফল হবে; তাই হ’ক। আমি যাকে শেখাব তার বিদ্যা ফলবতী হবে। এই কথা ব’লে কচ ইন্দ্রলোকে প্রস্থান করলেন।

১২। দেবযানী, শর্মিষ্ঠা ও যযাতি

 কচ ফিরে এলে দেবতারা আনন্দিত হয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখলেন, তার পর ইন্দ্র অসুরগণের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন। এক রমণীয় বনে কতকগুলি কন্যা জলকেলি করছে দেখে ইন্দ্র বায়ুর রূপ ধ’রে তাদের বস্ত্রগুলি মিশিয়ে দিলেন। সেই কন্যাদের মধ্যে অসুরপতি বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিলেন, তিনি ভ্রমক্রমে দেবযানীর বস্ত্র পরলেন।

 দেবযানী বললেন, অসুরী, আমার শিষ্যা হয়ে তুই আমার কাপড় নিলি কেন? তুই সদাচারহীনা, তোর ভাল হবে না। শর্মিষ্ঠা বললেন, তোর পিতা বিনীত হয়ে নীচে বসে স্তুতিপাঠকের ন্যায় আমার পিতার স্তব করেন। তুই যাচকের কন্যা, আমি দাতার কন্যা।—

আদুন্বস্ব বিদুন্বস্ব দ্রুহ্য কুপ্যস্ব যাচকি।
অনায়ুধা সায়ুধায়া রিক্তা ক্ষুভ্যসি ভিক্ষুকি।
লপ্স্যসে প্রতিযোদ্ধারং ন হি ত্বাং গণয়াম্যহম,॥[৪]

—যাচকী, যতই বিলাপ কর, গড়াগড়ি দে, বিবাদ কর বা রাগ দেখা, তোর অস্ত্র নেই আমার অস্ত্র আছে। ভিক্ষুকী, তুই নিঃস্ব হয়ে ক্ষোভ করছিস। আমি তোকে গ্রাহ্য করি না, ঝগড়া করবার জন্য তুই নিজের সমান লোক পাবি।

 দেবযানী নিজের বস্ত্র নেবার জন্য টানতে লাগলেন, তখন শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে তাঁকে এক কূপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলেন এবং ম’রে গেছে মনে ক’রে নিজের ভবনে চলে গেলেন। সেই সময়ে মৃগয়ায় শ্রান্ত ও পিপাসিত হয়ে রাজা যযাতি অশ্বারোহণে সেই কূপের কাছে এলেন। তিনি দেখলেন, কূপের মধ্যে অগ্নিশিখার ন্যায় এক কন্যা রয়েছে। রাজা তাঁকে আশ্বস্ত করলে দেবযানী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাকে সৎকুলোদ্‌ভব শান্ত বীর্যবান দেখছি, আমার দক্ষিণ হস্ত ধ’রে আপনি আমাকে তুলুন। যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার ক’রে রাজধানীতে চ’লে গেলেন।

 দেবযানীর দাসীর মুখে সংবাদ পেয়ে শুক্র তখনই সেখানে এলেন। তিনি কন্যাকে আলিঙ্গন ক’রে বললেন, বোধ হয় তোমার কোনও পাপ ছিল তারই এই প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। দেবযানী বললেন, প্রায়শ্চিত্ত হ’ক বা না হ’ক, শর্মিষ্ঠা ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে আমাকে কি বলেছে শুনুন।—তুই স্তুতিকারী যাচকের কন্যা, আর আমি দাতার কন্যা—তোর পিতা যাঁর স্তুতি করেন। পিতা, শর্মিষ্ঠার কথা যদি সত্য হয় তবে তার কাছে নতি স্বীকার করব এই কথা তার সখীকে আমি বলেছি। শুক্র বললেন, তুমি স্তাবক আর যাচকের কন্যা নও, তুমি যাঁর কন্যা তাঁকেই সকলে স্তব করে, বৃষপর্বা ইন্দ্র আর রাজা যযাতি তা জানেন। যিনি সজ্জন তাঁর পক্ষে নিজের গুণবর্ণনা কষ্টকর, সেজন্য আমি কিছু বলতে চাই না। কন্যা, ওঠ, আমরা ক্ষমা ক’রে নিজের গৃহে যাই, সাধুজনের ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ গুণ। ক্ষমার দ্বারা ক্রোধকে যে নিরস্ত করতে পারে সে সর্ব জগৎ জয় করে। দেবযানী বললেন, পিতা, আমি ও সব কথা জানি, কিন্তু পণ্ডিতরা বলেন নীচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল। অস্ত্রাঘাতে যে ক্ষত হয় তা সারে কিন্তু বাক্‌ক্ষত সারে না।

 তখন শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে দানবরাজ বৃষপর্বার কাছে গিয়ে বললেন, রাজা, পাপের ফল সদ্য দেখা যায় না, কিন্তু যে বার বার পাপ করে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। আমার নিষ্পাপ ধর্মজ্ঞ শিষ্য কচকে তুমি বধ করিয়েছিলে, তোমার কন্যা আমার কন্যাকে বহু কটু কথা ব’লে কূপে ফেলে দিয়েছে। তোমার রাজ্যে আমরা আর বাস করব না। বৃষপর্বা বললেন, যদি আমার প্ররোচনায় কচ নিহত হয়ে থাকে বা দেবযানীকে শর্মিষ্ঠা কটু কথা ব’লে থাকে, তবে আমার যেন অসদ্‌গতি হয়। আপনি প্রসন্ন হ’ন, যদি চলে যান তবে আমরা সমুদ্রে প্রবেশ করব। শুক্র বললেন, দেবযানী আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার দুঃখ আমি সইতে পারি না। তোমরা তাকে প্রসন্ন কর।

 বৃষপর্বা সবান্ধবে দেবযানীর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে প’ড়ে বললেন, দেবযানী প্রসন্ন হও, তুমি যা চাইবে তাই দেব। দেবযানী বললেন, সহস্র কন্যার সহিত শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হ’ক, পিতা আমার বিবাহ দিলে তারা আমার সঙ্গে যাবে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের রোষ নিবারণের জন্য শর্মিষ্ঠা দাসীত্ব স্বীকার করলেন।


 দীর্ঘকাল পরে একদিন বরবর্ণিনী দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও সহস্র দাসীর সঙ্গে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় রাজা যযাতি মৃগের অন্বেষণে পিপাসিত ও শ্রান্ত হয়ে আবার সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, রত্নভূষিত দিব্য আসনে সুহাসিনী দেবযানী ব’সে আছেন, রূপে অতুলনীয়া স্বর্ণালংকারভূষিতা আর একটি কন্যা কিঞ্চিৎ নিম্ন আসনে ব’সে দেবযানীর পদসেবা করছেন। যযাতির প্রশ্নের উত্তরে দেবযানী নিজেদের পরিচয় দিলেন। যযাতি বললেন, অসুররাজকন্যা কি ক’রে আপনার দাসী হলেন জানতে আমার কৌতূহল হচ্ছে, এমন সর্বাঙ্গসন্দরী আমি পূর্বে কখনও দেখি নি। আপনার রূপ এঁর রূপের তুল্য নয়। দেবযানী উত্তর দিলেন, সবই দৈবের বিধানে ঘটে, এঁর দাসীত্বও সেই কারণে হয়েছে। আকার বেশ ও কথাবার্তায় আপনাকে রাজা বোধ হচ্ছে, আপনি কে? যযাতি বললেন, আমি রাজা যযাতি, মৃগয়া করতে এসেছিলাম, এখন অনুমতি দিন ফিরে যাব।

 দেবযানী বললেন, শর্মিষ্ঠা আর এই সমস্ত দাসীর সঙ্গে আমি আপনার অধীন হচ্ছি, আপনি আমার ভর্তা ও সখা হ’ন। যযাতি বললেন, সুন্দরী, আমি আপনার যোগ্য নই, আপনার পিতা ক্ষত্রিয় রাজাকে কন্যাদান করবেন না। দেবযানী বললেন, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পরস্পরের সংসৃষ্ট, আপনি পূর্বেই আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমিও আপনাকে বরণ করেছি। দেবযানী তখন তাঁর পিতাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, পিতা, এই রাজা যযাতি আমার পাণি গ্রহণ ক’রে কূপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আপনাকে প্রণাম করছি, এঁর হস্তে আমাকে সম্প্রদান করুন, আমি অন্য পতি বরণ করব না।

 শুক্র বললেন, প্রণয় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না তাই তুমি যযাতিকে বরণ করেছ। কচের শাপে তোমার স্ববর্ণে বিবাহও হতে পারে না। যযাতি, তোমাকে এই কন্যা দিলাম, এঁকে তোমার মহিষী কর। আমার বরে তোমার বর্ণসংকরজনিত পাপ হবে না। বৃষপর্বার কন্যা এই কুমারী শর্মিষ্ঠাকে তুমি সসম্মানে রেখো, কিন্তু এঁকে শয্যায় ডেকো না।


 দেবযানী শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি তাঁর রাজধানীতে গেলেন। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে তিনি অশোক বনের নিকট শর্মিষ্ঠার জন্য পৃথক গৃহ নির্মাণ করিয়ে দিলেন এবং তাঁর অন্নবস্ত্রাদির উপযুক্ত ব্যবস্থা করলেন। সহস্র দাসীও শর্মিষ্ঠার কাছে রইল।

 কিছুকাল পরে দেবযানীর একটি পুত্র হ’ল। শর্মিষ্ঠা ভাবলেন আমার পতি নেই, বৃথা যৌবনবতী হয়েছি; আমিও দেবযানীর ন্যায় নিজেই পতি বরণ করব। একদা যযাতি বেড়াতে বেড়াতে অশোক বনে এসে পড়লেন। শর্মিষ্ঠা তাঁকে সংবর্ধনা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমার রূপ কুল শীল আপনি জানেন, আমি প্রার্থনা করছি আমার ঋতুরক্ষা করুন। যযাতি বললেন, তুমি সর্ব বিষয়ে অনিন্দিতা তা আমি জানি, কিন্তু তোমাকে শয্যায় আহহ্বান করতে শুক্রাচার্যের নিষেধ আছে। শর্মিষ্ঠা বললেন,

ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি
ন স্ত্রীষু রাজন্ ন বিবাহকালে।
প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে
পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি॥

—মহারাজ, পরিহাসে, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জনে, বিবাহকালে, প্রাণসংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়, এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।[৫]

 যযাতি বললেন, আমি রাজা হয়ে যদি মিথ্যাচরণ করি তবে প্রজারাও আমার অনুসরণ ক’রে মিথ্যাকথনের পাপে বিনষ্ট হবে। শর্মিষ্ঠা বললেন, যিনি সখীর পতি তিনি নিজের পতির তুলা, দেবযানীকে বিবাহ ক’রে আপনি আমারও পতি হয়েছেন। পুত্রহীনার পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনার প্রসাদে পুত্রবতী হয়ে আমি ধর্মাচরণ করতে চাই। তখন যযাতি শর্মিষ্ঠার প্রার্থনা পূরণ করলেন।

১৩। যযাতির জরা

 শর্মিষ্ঠার দেবকুমারতুল্য একটি পুত্র হ’ল। দেবযানী তাঁকে বললেন, তুমি কামের বশে এ কি পাপ করলে? শর্মিষ্ঠা বললেন, একজন ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আমার কাছে এসেছিলেন, তাঁরই বরে আমার পুত্র হয়েছে, আমি অন্যায় কিছ করি নি। দেবযানী প্রশ্ন করলেন, সেই ব্রাহ্মণের নাম গোত্র বংশ কি? শর্মিষ্ঠা বললেন, তিনি তপস্যার তেজে সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান, তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করবার শক্তি আমার ছিল না। দেবযানী বললেন, তুমি যদি বর্ণজ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ থেকেই অপত্যলাভ ক’রে থাক তবে আর আমার ক্রোধ নেই।

 কালক্রমে যদু ও তুর্বসু নামে দেবযানীর দুই পুত্র এবং দ্রুহ্যু অনু ও পুরু নামে শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র হ’ল। একদিন দেবযানী যযাতির সঙ্গে উপবনে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন, দেবকুমারতুল্য কয়েকটি বালক নির্ভয়ে খেলা করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, বৎসগণ, তোমাদের নাম কি, বংশ কি, পিতা কে? বালকরা যযাতি আর শর্মিষ্ঠার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, এই আমাদের পিতা মাতা। এই বলে তারা রাজার কাছে এল, কিন্তু দেবযানী সঙ্গে থাকায় রাজা তাদের আদর করলেন না, তারা কাঁদতে কাঁদতে শর্মিষ্ঠার কাছে এল। দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে বললেন, তুমি আমার অধীন হয়ে অসুর স্বভাবের বশে আমারই অপ্রিয় কার্য করেছ, আমাকে তোমার ভয় নেই। শর্মিষ্ঠা উত্তর দিলেন, আমি ন্যায় আর ধর্ম অনুসারে চলেছি, তোমাকে ভয় করি না। এই রাজর্ষিকে তুমি যখন পতিরূপে বরণ করেছিলে তখন আমিও করেছিলাম। যিনি আমার সখীর পতি, ধর্মানসারে তিনি আমারও পতি।

 তখন দেবযানী বললেন, বাজা, তুমি আমার অপ্রিয় কার্য করেছ, আর আমি এখানে থাকব না। এই ব’লে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে সাশ্রুলোচনে শুক্রাচার্যের কাছে চললেন, রাজাও পিছু পিছু গেলেন। দেবযানী বললেন, অধর্মের কাছে ধর্ম পরাজিত হয়েছে, যে নীচ সে উপরে উঠেছে, শর্মিষ্ঠা আমাকে অতিক্রম করেছে। পিতা, রাজা যযাতি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র উৎপাদন করেছেন আর দুর্ভাগা আমাকে দুই পুত্র দিয়েছেন। ইনি ধর্মজ্ঞ বলে খ্যাত, কিন্তু আমার মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন।

 শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে অধর্ম করেছ আমার উপদেশ গ্রাহ্য কর নি, অতএব দুর্জয় জরা তোমাকে আক্রমণ করবে। শাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি বহু অনুনয় করলে শুক্র বললেন, আমি মিথ্যা বলি না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে তোমার জরা অন্যকে দিতে পারবে। যযাতি বললেন, আপনি অনুমতি দিন, যে পুত্র আমাকে তার যৌবন দেবে সেই বাজ্য পাবে এবং পুণ্যবান কীর্তিমান হবে। শুক্র বললেন, তাই হবে।

 যযাতি রাজধানীতে এসে জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে বললেন, বৎস, আমি শুক্রের শাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু যৌবনভোগে এখনও তৃপ্ত হই নি। আমার জরা নিয়ে তোমার যৌবন আমাকে দাও, সহস্র বৎসর পরে আবার তোমাকে যৌবন দিয়ে নিজের জরা ফিরিয়ে নেব। যদু উত্তর দিলেন, জরায় অনেক কষ্ট, আমি নিরানন্দ শ্বেতশ্মশ্রু লোলচর্ম দুর্বলদেহ অকর্মণ্য হয়ে যাব, যুবক সহচররা আমাকে অবজ্ঞা করবে। আমার চেয়ে প্রিয়তর পুত্র আপনার আরও তো আছে, তাদের বলুন। যযাতি বললেন, আত্মজ হয়েও যখন আমার অনুরোধ রাখলে না তখন তোমার সন্তান রাজ্যের অধিকারী হবে না।

 তার পর যযাতি একে একে তুর্বসু দ্রুহ্যু এবং অনুকে অনুরোধ করলেন কিন্তু কেউ জরা নিয়ে যৌবন দিতে সম্মত হলেন না। যযাতি তাঁদের এইরূপ শাপ দিলেন—তুর্বসুর বংশলোপ হবে, তিনি অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ জাতির রাজা হবেন, দ্রুহ্যু কখনও অভীষ্ট লাভ করবেন না, তিনি অতি দুর্গম দেশে গিয়ে ভোজ উপাধি নিয়ে বাস করবেন; অনু জরান্বিত হবেন, তাঁর সন্তান যৌবনলাভ ক’রেই মরবে, তিনি অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়াহীন হবেন।

 যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার অনুরোধ শুনে তখনই বললেন, মহারাজ আপনার আজ্ঞা পালন করব, আমার যৌবন নিয়ে অভীষ্ট সুখ ভোগ করুন, আপনার জরা আমি নেব। যযাতি প্রীত হয়ে বললেন, বৎস, তোমার রাজ্যে সকল প্রজা সর্ব বিষয়ে সমৃদ্ধি লাভ করবে।

 পুরুর যৌবন পেয়ে যযাতি অভীষ্ট বিষয় ভোগ, প্রজাপালন এবং বহুবিধ ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। সহস্র বৎসর অতীত হ’লে তিনি পুরুকে বললেন, পুত্র, তোমার যৌবন লাভ ক’রে আমি ইচ্ছানুসারে বিষয় ভোগ করেছি।—

ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে॥
যৎ পৃথিব্যাং ব্রীহিযবং হিরণ্যং পশবঃ স্ত্রিয়ঃ।
একস্যাপি ন পর্যাপ্তং তস্মাৎ তৃষ্ণাং পরিত্যজেৎ॥

—কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃতসংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে যত ধান্য যব হিরণ্য পশু ও স্ত্রী আছে তা একজনের পক্ষেও পর্যাপ্ত নয়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করা উচিত।

 তারপর যযাতি বললেন, পুরু আমি প্রীত হয়েছি, তোমার যৌবন ফিরে নাও, আমার রাজ্যও নাও। তখন ব্রাহ্মণাদি প্রজারা বললেন, মহারাজ, যদু আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র, শুক্রের দৌহিত্র এবং দেবযানীর গর্ভজাত, তাঁর পর আরও তিন পুত্র আছেন; এঁদের অতিক্রম ক’রে কনিষ্ঠকে রাজ্য দিতে চান কেন? যযাতি বললেন, যদু প্রভৃতি আমার আজ্ঞা পালন করে নি, পুরু, করেছে; শুক্রাচার্যের বর অনুসারে আমার অনুগত পুত্রই রাজ্য পাবে। প্রজারা রাজার কথার অনুমোদন করলেন।

 পুরুকে রাজ্য দিয়ে যযাতি বনে বাস করতে লাগলেন এবং কিছুকাল পরে সুরলোকে গেলেন। তিনি ইন্দ্রকে বলেছিলেন, দেবতা মানুষ গন্ধর্ব আর ঋষিদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তপস্যায় আমার সমান। এই আত্মপ্রশংসার ফলে তিনি ইন্দ্রের আজ্ঞায় স্বর্গচ্যুত হলেন। যযাতি ভূতলে না প’ড়ে কিছুকাল অন্তরীক্ষে অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমান ও শিবি এই চারজন রাজর্ষির সঙ্গে বিবিধ ধর্মালাপ করলেন। এঁরা যযাতির দৌহিত্র[৬]। অনন্তর যযাতি পুনর্বার স্বর্গলোকে গেলেন।

১৪। দুষ্মন্ত-শকুন্তলা

 পুরুর বংশে দুষ্মন্ত[৭] নামে এক বীর্যবান রাজা জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পৃথিবীর সর্ব প্রদেশ শাসন করতেন। তাঁর দুই পুত্র হয়, লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় এবং শকুন্তলার গর্ভে ভরত। ভরতবংশের যশোরাশি বহবিস্তৃত। একদা দুষ্মন্ত প্রভূত সৈন্য ও বাহন নিয়ে গহন বনে মৃগয়া করতে গেলেন। বহু পশু বধ ক’রে তিনি একাকী অপর এক বনে ক্ষুৎপিপাসার্ত ও শ্রান্ত হয়ে উপস্থিত হলেন। এই বন অতি রমণীয়, নানাবিধ কুসুমিত বৃক্ষে সমাকীর্ণ এবং ঝিল্লী ভ্রমর ও কোকিলের রবে মুখরিত। রাজা মালিনী নদীর তীরে কণ্ব মুনির মনোহর আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও শান্তভাবে বিচরণ করছে।

 অনুচরদের অপেক্ষা করতে বলে দুষ্মন্ত আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ এবং বহুবিধ শাস্ত্রের আলোচনা করছেন। মহর্ষি কণ্বের দেখা না পেয়ে তাঁর কুটীরের নিকটে এসে দুষ্মন্ত উচ্চকণ্ঠে বললেন, এখানে কে আছেন? রাজার বাক্য শুনে লক্ষ্মীর ন্যায় রূপবতী তাপসবেশধারিণী একটি কন্যা বাইরে এলেন এবং দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে আসন পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তারপর মধর স্বরে কুশলপ্রশ্ন ক’রে বললেন, কি প্রয়োজন বলুন, আমার পিতা ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করুন, তিনি শীঘ্রই আসবেন।

 এই সুনিতম্বিনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে দুষ্মন্ত বললেন, আপনি কে, কার কন্যা, এখানে কোথা থেকে এলেন? কন্যা উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমি ভগবান কণ্বের দুহিতা। রাজা বললেন, তিনি তো ঊর্দ্ধরেতা তপস্বী, আপনি তাঁর কন্যা কিরূপে হলেন? কন্যা বললেন, ভগবান কণ্ব এক ঋষিকে আমার জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন, আমি তা শুনেছিলাম। সেই বিবরণ আপনাকে বলছি, শুনুন।—

 পূর্বকালে বিশ্বামিত্র ঘোর তপস্যা করছেন দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে মেনকাকে পাঠিয়ে দেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে তাঁকে অভিবাদন ক’রে নৃত্য করতে লাগলেন, সেই সময়ে তাঁর সূক্ষ্ম শুভ্র বসন বায়ু হরণ করলেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। মেনকার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’ল, তিনি গর্ভবতী হলেন এবং একটি কন্যা প্রসব ক’রেই তাকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে ইন্দ্রসভায় চ’লে গেলেন। সিংহব্যাঘ্রসমাকুল জনহীন বনে সেই শিশুকে পক্ষীরা রক্ষা করতে লাগল। মহর্ষি কণ্ব স্নান করতে গিয়ে শিশুকে দেখতে পেলেন এবং গৃহে এনে তাকে দুহিতার ন্যায় পালন করলেন। শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষী কর্তৃক রক্ষিত সেজন্য তার নাম শকুন্তলা হ’ল। আমিই সেই শকুন্তলা। শরীরদাতা প্রাণদাতা ও অন্নদাতাকে ধর্মশাস্ত্রে পিতা বলা হয়। মহারাজ, আমাকে মহর্ষি কণ্বের দুহিতা ব’লে জানবেন।

 দুষ্মন্ত বললেন, কল্যাণী, তোমার কথায় জানলাম তুমি রাজপুত্রী, তুমি আমার ভার্যা হও। এই সুবর্ণমালা, বিবিধ বস্ত্র, কুণ্ডল, নানাদেশজাত মণিরত্ন, বক্ষের অলংকার এবং মৃগচর্ম তুমি নাও, আমার সমস্ত রাজ্য তোমারই, তুমি আমার ভার্যা হও। তুমি গান্ধর্বরীতিতে আমাকে বিবাহ কর, এইরূপ বিবাহই শ্রেষ্ঠ।

 শকুন্তলা বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমার পিতা ফিরে এলেই আপনার হাতে আমাকে সম্প্রদান করবেন। তিনিই আমার প্রভু ও পরম দেবতা, তাঁকে অমাননা ক’রে অধর্মানুসারে পতিবরণ করতে পারি না। দুষ্মন্ত বললেন, বরবর্ণিনী, ধর্মানসারে তুমি নিজেই নিজেকে দান করতে পার। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বা রাক্ষস বিবাহ অথবা এই দুইএর মিশ্রিত রীতিতে বিবাহ ধর্মসংগত, অতএব তুমি গান্ধর্ব বিধানে আমার ভার্যা হও। শকুন্তলা বললেন, তাই যদি ধর্ম সংগত হয় তবে আগে এই অঙ্গীকার করুন যে আমার পুত্র যুবরাজ হবে এবং আপনার পরে সেই পুত্রই রাজা হবে।

 কিছুমাত্র বিচার না ক’রে দুষ্মন্ত উত্তর দিলেন, তুমি যা বললে তাই হবে। মনস্কামনা সিদ্ধ হ’লে তিনি শকুন্তলাকে বার বাব বললেন, সুহাসিনী, আমি চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাব, তারা তোমাকে আমার রাজধানীতে নিয়ে যাবে। এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং কণ্ব শুনে কি বলবেন তা ভাবতে ভাবতে দুষ্মন্ত নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।

 কণ্ব আশ্রমে ফিরে এলে শকুন্তলা লজ্জায় তাঁর কাছে গেলেন না, কিন্তু মহর্ষি দিব্যদৃষ্টিতে সমস্ত জেনে প্রীত হয়ে বললেন, ভদ্রে, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আজ যে পুরুষসংসর্গ করেছ তাতে তোমার ধর্মের হানি হয় নি। নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ঠ। শকুন্তলা, তোমার পতি দুষ্মন্ত ধর্মাত্মা এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার যে পুত্র হবে সে সাগরবেষ্টিতা সমগ্র পৃথিবী ভোগ করবে। শকুন্তলা কণ্বের আনীত ফলাদির বোঝা নামিয়ে রেখে তাঁর পা ধুইয়ে দিলেন এবং তাঁর শ্রান্তি দূর হ’লে বললেন, আমি স্বেচ্ছায় দুষ্মন্তকে পতিত্বে বরণ করেছি, আপনি মন্ত্রিসহ সেই রাজার প্রতি অনুগ্রহ করুন। শকুন্তলার প্রার্থনা অনুসারে কণ্ব বর দিলেন, পুরুবংশীয়গণ ধর্মিষ্ঠ হবে, কখনও রাজ্যচ্যুত হবে না।

 তিন বৎসর পরে[৮] শকুন্তলা একটি সুন্দর মহাবলশালী অগ্নিতুল্য দ্যুতিমান পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র কণ্বের আশ্রমে পালিত হতে লাগল এবং ছ বৎসর বয়সেই সিংহ ব্যাঘ্র বরাহ মহিষ হস্তী প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমস্থ বৃক্ষে বেঁধে রাখত। সকল জন্তুকেই সে দমন করত সেজন্য আশ্রমবাসীরা তার নাম দিলেন সর্বদমন। তার অসাধারণ বলবিক্রম দেখে কণ্ব বললেন, এর যুবরাজ হবার সময় হয়েছে। তার পর তিনি শিষ্যদের বললেন, নারীরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে নিন্দা হয়, তাতে সুনাম চরিত্র ও ধর্ম ও নষ্ট হ’তে পারে। অতএব তোমরা শীঘ্র শকুন্তলা আর তার পুত্রকে দুষ্মন্তের কাছে দিয়ে এস।

 শকুন্তলাকে রাজভবনে পৌঁছিয়ে দিয়ে শিষ্যরা ফিরে গেলেন। শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে অভিবাদন ক’রে বললেন, রাজা, এই তোমাব পুত্র, আমার গর্ভে জন্মেছে। কণ্বের আশ্রমে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা স্মরণ কর, একে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত কর। পূর্বকথা স্মরণ হ’লেও রাজা বললেন, আমার কিছু মনে পড়ছে না, দুষ্ট তাপসী, তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার ধর্ম অর্থ বা কামের কোনও সম্বন্ধ হয় নি, তুমি যাও বা থাক বা যা ইচ্ছা করতে পার।

 লজ্জায় ও দুঃখে যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে শকুন্তলা স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হ’ল, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, বক্র কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। তিনি তাঁর ক্রোধ ও তেজ দমন ক’রে বললেন, মহারাজ, তোমার স্মরণ থাকলেও প্রাকৃত জনের ন্যায় কেন বলছ যে মনে নেই? তুমি সত্য বল, মিথ্যা বলে নিজেকে অপমানিত ক’রো না। আমি তোমার কাছে যাচিকা হয়ে এসেছি, যদি আমার কথা না শোন তবে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। আমাকে যদি পরিত্যাগ কর তবে আমি আশ্রমে ফিরে যাব, কিন্তু এই বালক তোমার আত্মজ, একে ত্যাগ করতে পার না।

 দুষ্মন্ত বললেন, তোমার গর্ভে আমার পুত্র হয়েছিল তা আমার মনে নেই। নারীরা মিথ্যা কথাই বলে থাকে। তোমার জননী মেনকা অসতী ও নির্দয়া, ব্রাহ্মণত্বলোভী তোমার পিতা বিশ্বামিত্র কামুক ও নির্দয়। তুমি নিজেও ভ্রষ্টার ন্যায় কথা বলছ। দুষ্ট তাপসী, দূর হও। শকুন্তলা বললেন, মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা। রাজা, তুমি ভূমিতে চল, আমি অন্তরীক্ষে চলি, ইন্দ্রকুবেরাদির গৃহে যেতে পারি। যে নিজে দুর্জন সে সজ্জনকে দুর্জন বলে, এর চেয়ে হাস্যকর কিছু নেই। যদি তুমি মিথ্যারই অনুরক্ত হও তবে আমি চ’লে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত, তোমার সাহায্য না পেলেও আমার পুত্র হিমালয়ভূষিত চতুঃসাগরবেষ্টিত এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। এই বলে শকুন্তলা চ’লে গেলেন।

 তখন দুষ্মন্ত অন্তরীক্ষ থেকে এই দৈববাণী শুনলেন—শকুন্তলা সত্য বলেছেন, তুমিই তাঁর পুত্রের পিতা, তাকে ভরণপোষণ কর, তার নাম ভরত হ’ক। রাজা হৃষ্ট হয়ে পুরোহিত ও অমাত্যদের বললেন, আপনারা দেবদূতের কথা শুনলেন, আমি নিজেও ওই বালককে পুত্র ব’লে জানি, কিন্তু যদি কেবল শকুন্তলার কথায় তাকে নিতাম তবে লোকে দোষ দিত। তার পর দুষ্মন্ত তাঁর পুত্র ও ভার্যা শকুন্তলাকে আনন্দিতমনে গ্রহণ করলেন। তিনি শকুন্তলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দেবী, তোমার সতীত্ব প্রতিপাদনের জন্যই আমি এইরূপ ব্যবহার করেছিলাম, নতুবা লোকে মনে করত তোমার সঙ্গে আমার অসৎ সম্বন্ধ হয়েছিল। এই পত্রকে রাজ্য দেব তা পূর্বেই স্থির করেছি। প্রিয়ে, তুমি ক্রোধবশে আমাকে যেসব অপ্রিয় কথা বলেছ তা আমি ক্ষমা[৯] করলাম।

১৫। মহাভিষ—অষ্টবসু—প্রতীপ—শান্তনু-গঙ্গা

 দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত বহু দেশ জয় এবং বহুশত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ক’রে সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী হয়েছিলেন। তাঁর বংশের এক রাজার নাম হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর নগর স্থাপন করেন। হস্তীর চার পুরুষ পরে কুরু রাজা হন, তাঁর নাম অনুসারে কুরজাঙ্গল দেশ খ্যাত হয়। তিনি যেখানে তপস্যা করেছিলেন সেই স্থানই পবিত্র কুরুক্ষেত্র। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষের নাম প্রতীপ, তাঁর পুত্র শান্তনু

 মহাভিষ নামে ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন, তিনি বহু যজ্ঞ ক’রে স্বর্গে যান। একদিন তিনি দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সহসা বায়ুর প্রভাবে গঙ্গার সূক্ষ্ম বসন অপসৃত হ’ল। দেবগণ অধোমুখ হয়ে রইলেন, কিন্তু মহাভিষ গঙ্গাকে অসংকোচে দেখতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁকে শাপ দিলেন, তুমি মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ কর, পরে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। মহাভিষ স্থির করলেন তিনি মহাতেজস্বী প্রতীপ রাজার পুত্র হবেন।

 গঙ্গা মহাভিষকে ভাবতে ভাবতে মর্ত্যে ফিরে আসছিলেন, পথিমধ্যে দেখলেন বসু নামক দেবগণ মূর্ছিত হয়ে প’ড়ে আছেন। গঙ্গার প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, বশিষ্ঠ আমাদের শাপ দিয়েছেন—তোমরা নরযোনিতে জন্মগ্রহণ কর। আমরা মানুষীর গর্ভে যেতে চাই না, আপনিই আমাদের পুত্ররূপে প্রসব করুন, প্রতীপের পুত্র শান্তনু আমাদের পিতা হবেন। জন্মের পরেই আপনি আমাদের জলে ফেলে দেবেন, যাতে আমরা শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই। গঙ্গা বললেন তাই করব, কিন্তু যেন একটি পুত্র জীবিত থাকে, নতুবা শান্তনুর সঙ্গে আমার সংগম ব্যর্থ হবে। বসুগণ বললেন, আমরা প্রত্যেকে নিজ বীর্যের অষ্টমাংশ দেব, তার ফলে একটি পুত্র জীবিত থাকবে। এই পুত্র বলবান হবে কিন্তু তার সন্তান হবে না।

 রাজা প্রতীপ গঙ্গাতীরে ব’সে জপ করছিলেন এমন সময় মনোহর নারীরূপ ধারণ করে গঙ্গা জল থেকে উঠে প্রতীপের দক্ষিণ ঊরুতে বসলেন। রাজা বললেন, কল্যাণী, কি চাও? গঙ্গা বললেন, কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি তোমাকে চাই। রাজা বললেন, পরস্ত্রী আর অসবর্ণা আমার অগম্যা। গঙ্গা বললেন, আমি দেবকন্যা, অগম্যা নই। রাজা বললেন, তুমি আমার বাম ঊরতে না ব’সে দক্ষিণ ঊরুতে বসেছ, যেখানে পুত্র কন্যা আর পুত্রবধূর স্থান। তুমি আমার পুত্রবধূ হয়ো। গঙ্গা বললেন, তাই হব, কিন্তু আমার কোনও কার্যে আপনার পুত্র আপত্তি করতে পারবেন না। প্রতীপ সম্মত হলেন।

 গঙ্গা অন্তর্হিত হ’লে প্রতীপ ও তাঁর পত্নী পুত্রলাভের জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। রাজা মহাভিষ তাঁদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হ’ল শান্তনু। শান্তনু যৌবন লাভ করলে প্রতীপ তাঁকে বললেন, তোমার নিমিত্ত এক রূপবতী কন্যা পূর্বে আমার কাছে এসেছিল। সে যদি পুত্রকামনায় তোমার কাছে উপস্থিত হয়, তবে তার ইচ্ছা পূর্ণ ক’রো, কিন্তু তার পরিচয় জানতে চেয়ো না, তার কার্যেও বাধা দিও না। তার পর প্রতীপ তাঁর পুত্র শান্তনকে রাজ্যে অভিষিক্ত ক’রে বনে প্রস্থান করলেন।

 একদিন শান্তনু গঙ্গার তীরে এক দিব্যাভরণভূষিতা পরমা সুন্দরী নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, তুমি দেবী দানবী অপ্সরা না মানুষী? তুমি আমার ভার্যা হও। গঙ্গা উত্তর দিলেন, রাজা, আমি তোমার মহিষী হব, কিন্তু আমি শুভ বা অশভ যাই করি তুমি যদি বারণ বা ভর্ৎসনা কর তবে তোমাকে নিশ্চয় ত্যাগ করব। শান্তনু তাতেই সম্মত হলেন।

 ভার্যার স্বভাবচরিত্র রূপগুণ ও সেবায় পরিতৃপ্ত হয়ে শান্তনু সুখে কালযাপন করতে লাগলেন। তাঁর আটটি দেবকুমার তুল্য পুত্র হয়েছিল। প্রত্যেক পুত্রের জন্মের পরেই গঙ্গা তাকে জলে নিক্ষেপ ক’রে বলতেন, এই তোমার প্রিয়কার্য করলাম। শান্তনু অসন্তুষ্ট হ’লেও কিছু বলতেন না, পাছে গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। অষ্টম পুত্র প্রসবের পর গঙ্গা হাসছেন দেখে শান্তনু বললেন, একে মেরো না, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? গঙ্গা বললেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার কাছে থাকাও আমার শেষ হল। গঙ্গা নিজের পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের এই বৃত্তান্ত বললেন।—

 একদা পৃথু প্রভৃতি বন্ধুগণ নিজ নিজ পত্নীসহ সুমেরু পর্বতের পার্শ্ববর্তী বশিষ্ঠের তপোবনে বিহার করতে এসেছিলেন। বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে দেখে দ্যু-নামক বসুর পত্নী তাঁর স্বামীকে বললেন, আমার সখী রাজকন্যা জিতবতীকে এই ধেনু উপহার দিতে চাই। পত্নীর অনুরোধে দ্যু-বসু নন্দিনীকে হরণ করলেন। বশিষ্ঠ আশ্রমে এসে দেখলেন নন্দিনী নেই। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, যারা আমার ধেনু নিয়েছে তারা মানুষ হয়ে জন্মাবে। বসুগণের অনুনয়ে প্রসন্ন হয়ে বশিষ্ঠ বললেন, তোমরা সকলে এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবে, কিন্তু দ্যু-বসু নিজ কর্মের ফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন। তিনি ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রবিশারদ, পিতার প্রিয়কারী এবং স্ত্রীসম্ভোগত্যাগী হবেন।

 তার পর গঙ্গা বললেন, মহারাজ, অভিশপ্ত বসুগণের অনুরোধে আমি তাদের প্রসব ক’রে জলে নিক্ষেপ করেছি, কেবল দ্যু-বসু—যিনি এই অষ্টম পুত্র—দীর্ঘজীবী হয়ে বহুকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন এবং পুনর্বার স্বর্গলোকে যাবেন। এই ব’লে গঙ্গা নবজাত পুত্রকে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন।

১৬। দেবব্রত-ভীষ্ম—সত্যবতী

 শান্তনু দঃখিত মনে তাঁর রাজধানী হস্তিনাপুরে গেলেন। তিনি সর্বপ্রকার রাজগুণে মণ্ডিত ছিলেন এবং কামরাগবর্জিত হয়ে ধর্মানুসারে রাজ্যশাসন করতেন। ছত্রিশ বৎসর তিনি স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ ক’রে বনবাসী হয়েছিলেন।

 একদিন তিনি মৃগের অনুসরণে গঙ্গাতীরে এসে দেখলেন, দেবকুমারতুল্য চারুদর্শন দীর্ঘকায় এক বালক শরবর্ষণ ক’রে গঙ্গা আচ্ছন্ন করছে। শান্তনুকে মাথায় মোহিত ক’রে সেই বালক অন্তর্হিত হ’ল। তাকে নিজের পুত্র অনুমান ক’রে শান্তনু বললেন, গঙ্গা, আমার পুত্রকে দেখাও। তখন শুভ্রবসনা সালংকারা গঙ্গা পুত্রের হাত ধরে আবির্ভূত হয়ে বললেন, মহারাজ, এই আমার অষ্টমগর্ভজাত পুত্র, একে আমি পালন ক’রে বড় করেছি। এ বশিষ্ঠের কাছে বেদ অধ্যয়ন করেছে। শুক্র ও বৃহস্পতি যত শাস্ত্র জানেন, জামদগ্ন্য যত অস্ত্র জানেন, সে সমস্তই এ জানে। এই মহাধনুর্ধর রাজধর্মজ্ঞ পুত্রকে তুমি গৃহে নিয়ে যাও।

 দেবব্রত নামক এই পুত্রকে শান্তনু রাজভবনে নিয়ে গেলেন এবং তাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। রাজ্যের সকলেই এই গুণবান রাজকুমারের অনুরক্ত হলেন। চার বৎসর পরে শান্তনু একদিন যমুনাতীরবর্তী বনে বেড়াতে বেড়াতে অনির্বচনীয় সুগন্ধ অনুভব করলেন এবং তার অনুসরণ ক’রে দেবাঙ্গনার ন্যায় রূপবতী একটি কন্যার কাছে উপস্থিত হলেন। রাজার প্রশ্নের উত্তরে সেই কন্যা বললেন, আমি দাস[১০] রাজের কন্যা, পিতার আজ্ঞায় নৌকাচালনা করি। শান্তনু দাসরাজের কাছে গিয়ে সেই কন্যা চাইলেন। দাসরাজ বললেন, আপনি যদি একে ধর্মপত্নী করেন এবং এই প্রতিশ্রুতি দেন যে এর গর্ভজাত পুত্রই আপনার পরে রাজা হবে তবে কন্যাদান করতে পারি।

 শান্তনু উত্তপ্রকার প্রতিশ্রুতি দিতে পারলেন না, তিনি সেই রূপবতী কন্যাকে ভাবতে ভাবতে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। পিতাকে চিন্তান্বিত দেখে দেবব্রত বললেন, মহারাজ, রাজ্যের সর্বত্র কুশল, তথাপি আপনি চিন্তাকুল হযে আছেন কেন? আপনি আর অশ্বারোহণে বেড়াতে যান না, আপনার শরীর বিবর্ণ ও কৃশ হয়েছে, আপনার কি রোগ বলুন। শান্তনু বললেন, বৎস, আমার মহান্ বংশে তুমিই একমাত্র সন্তান, তুমি সর্বদা অস্ত্রচর্চা ক’রে থাক, কিন্তু মানুষ অনিত্য তোমার বিপদ ঘটলে আমার বংশলোপ হবে। তুমি শতপুত্রেরও অধিক সেজন্য আমি বংশবৃদ্ধির নিমিত্ত বৃথা পুনর্বার বিবাহ করতে ইচ্ছা করি না, তোমার মঙ্গল হ’ক এই কামনাই করি। কিন্তু বেদজ্ঞগণ বলেন, পুত্র না থাকা আর একটিমাত্র পুত্র দুই সমান। তোমার অবর্তমানে আমার বংশের কি হবে এই চিন্তাই আমার দুঃখের কারণ।

 বুদ্ধিমান দেবব্রত বৃদ্ধ অমাত্যের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পিতার শোকের কারণ কি? অমাত্য জানালেন, রাজা দাসকন্যাকে বিবাহ করতে চান। দেবব্রত বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে নিয়ে দাসরাজের কাছে গেলেন এবং পিতার জন্য কন্যা প্রার্থনা করলেন। দাসরাজ সসম্মানে তাঁকে সংবর্ধনা ক’রে বললেন, এরপ শ্লাঘনীয় বিবাহসম্বন্ধ কে না চায়? যিনি আমার কন্যা সত্যবতীর জন্মদাতা, সেই উপরিচর রাজা বহুবার আমাকে বলেছেন যে শান্তনুই তার উপযুক্ত পতি। কিন্তু এই বিবাহে একটি দোষ আছে—বৈমাত্র ভ্রাতারূপে তুমি যার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে সে কখনও সুখে থাকতে পারবে না।

 গাঙ্গেয় দেবব্রত বললেন, আমি সত্যপ্রতিজ্ঞা করছি শুনুন, এরূপ প্রতিজ্ঞা অন্য কেউ করতে পারে না—আপনার কন্যার গর্ভে যে পুত্র হবে সেই রাজত্ব পাবে। দাসরাজ বললেন, সৌম্য, তুমি রাজা শান্তনুর একমাত্র অবলম্বন, এখন আমার কন্যারও রক্ষক হ’লে, তুমিই একে দান করতে পার। তথাপি কন্যাকর্তার অধিকার অনুসারে আমি আরও কিছু বলছি শোন। হে সত্যবাদী মহাবাহু, তোমার প্রতিজ্ঞা কদাচ মিথ্যা হবে না, কিন্তু তোমার যে পুত্র হবে তাকেই আমার ভয়। দেবব্রত বললেন, আমি পূর্বেই সমগ্র রাজ্য ত্যাগ করেছি, এখন প্রতিজ্ঞা করছি আমার পুত্রও হবে না। আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করব, আমার পুত্র না হ’লেও অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে।

 দেবব্রতের প্রতিজ্ঞা শুনে দাসরাজ রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, আমি সত্যবতীকে দান করব। তখন আকাশ থেকে অপ্সরা দেবগণ ও পিতৃগণ পুষ্পবৃষ্টি করে বললেন, এঁর নাম ভীষ্ম হ’ল। সত্যবতীকে ভীষ্ম বললেন, মাতা, রথে উঠুন, আমরা স্বগৃহে যাব। হস্তিনাপুরে এসে ভীষ্ম পিতাকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। সকলেই তাঁর দুষ্কর কার্যের প্রশংসা করে বললেন, ইনি ভীষ্ম[১১]ই বটেন। শান্তনু পুত্রকে বর দিলেন, হে নিষ্পাপ, তুমি যতদিন বাঁচতে ইচ্ছা করবে তত দিন তোমার মৃত্যু হবে না, তোমার ইচ্ছানসারেই মৃত্যু হবে।

১৭। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য—কাশীরাজের তিন কন্যা

 সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুই পুত্র হ’ল, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবনলাভ করবার পূর্বেই শান্তনু গত হলেন, সত্যবতীর মত নিয়ে ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলশালী ছিলেন এবং মানুষ দেবতা অসুর গন্ধর্ব সকলকেই নিকৃষ্ট মনে করতেন। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাঁকে বললেন, তোমার আর আমার নাম একই, আমার সঙ্গে যদ্ধে কর নতুবা অন্য নাম নাও। কুরুক্ষেত্রে হিরণ্মতী নদীর তীরে দুজনের ঘোর যুদ্ধ হ’ল, তাতে কুরুনন্দন চিত্রাঙ্গদ নিহত হলেন। ভীষ্ম অপ্রাপ্তযৌবন বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে বসালেন।

 বিচিত্রবীর্য যৌবনলাভ করলে ভীষ্ম তাঁর বিবাহ দেওয়া স্থির করলেন। কাশীরাজের তিন পরমা সুন্দরী কন্যার একসঙ্গে স্বয়ংবর হবে শুনে ভীষ্ম বিমাতার অনুমতি নিয়ে রথারোহণে একাকী বারাণসীতে গেলেন। তিনি দেখলেন, নানা দেশ থেকে রাজারা স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছেন। যখন পরিচয় দেবার জন্য রাজাদের নামকীর্তন করা হ’ল তখন কন্যারা ভীষ্মকে বৃদ্ধ ও একাকী দেখে তাঁর কাছ থেকে সরে গেলেন। সভায় যে সকল হীনমতি রাজা ছিলেন তাঁরা হেসে বললেন, এই পরম ধর্মাত্মা পলিতকেশ নির্লজ্জ বৃদ্ধ এখানে কেন এসেছে? যে প্রতিজ্ঞাপালন করে না তাকে লোকে কি বলবে? ভীষ্ম বৃথাই ব্রহ্মচারী খ্যাতি পেয়েছেন।

 উপহাস শুনে ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হয়ে তিনটি কন্যাকে নিজের রথে তুলে নিলেন এবং জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, রাজগণ, বহুপ্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে, কিন্তু ধর্মবাদিগণ বলেন যে স্বয়ংবরসভায় বিপক্ষদের পরাভূত ক’রে কন্যা হরণ করাই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। আমি এই কন্যাদের নিয়ে যাচ্ছি, তোমাদের শক্তি থাকে তো যুদ্ধ কর। রাজারা ক্রোধে ওষ্ঠ দংশন ক’রে সভা থেকে উঠলেন এবং অলংকার খুলে ফেলে বর্ম ধারণ ক’রে নিজ নিজ রথে উঠে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। সর্বশস্ত্রবিশারদ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে রাজারা পরাজিত হলেন, কিন্তু মহারথ শাল্বরাজ তাঁর পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, থাম, থাম। ভীষ্মের শরাঘাতে শাল্বের সারথি ও অশ্ব নিহত হ’ল, শাল্ব ও অন্যান্য রাজারা যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে চ’লে গেলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম তিন কন্যাকে পত্রবধূ, কনিষ্ঠা ভগিনী বা দুহিতার ন্যায় যত্নসহকারে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন।

 ভীষ্ম বিবাহের উদ্‌যোগ করছেন জেনে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা[১২] হাস্য ক’রে তাঁকে বললেন, আমি স্বয়ংবরে শাল্বরাজকেই বরণ করতাম, তিনিও আমাকে চান, আমার পিতারও তাতে সম্মতি আছে। ধর্মজ্ঞ, আপনি ধর্ম পালন করুন। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মন্ত্রণা ক’রে অম্বাকে শাল্বরাজের কাছে পাঠালেন এবং অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন।

 বিচিত্রবীর্য সেই দুই সন্দরী পত্নীকে পেয়ে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। সাত বৎসর পরে তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন। সুহৃৎ ও চিকিৎসকগণ প্রতিকারের বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু আদিত্য যেমন অস্তাচলে যান বিচিত্রবীর্যও সেইরূপ যমসদনে গেলেন।

১৮। দীর্ঘতমা—ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম—অণীমাণ্ডব্য

 পুত্রশোকার্তা সত্যবতী তাঁর দুই বধূকে সান্ত্বনা দিয়ে ভীষ্মকে বললেন, রাজা শান্তনুর পিণ্ড কীর্তি ও বংশ রক্ষার ভার এখন তোমার উপর। তুমি ধর্মের তত্ত্ব ও কুলাচার সবই জান, এখন আমার আদেশে বংশরক্ষার জন্য দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন কর, অথবা স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হও এবং বিবাহ কর, পিতৃপুরুষগণকে নরকে নিমগ্ন ক’রো না।

 ভীষ্ম বললেন, মাতা, আমি ত্রিলোকের সমস্তই ত্যাগ করতে পারি কিন্তু যে সত্যপ্রতিজ্ঞা করেছি তা ভঙ্গ করতে পারি না। শান্তনুর বংশ যাতে রক্ষা হয় তার ক্ষত্রধর্মসম্মত উপায় বলছি শুনুন। পুরাকালে জামদগ্ন্য পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হ’লে ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, কারণ বেদে বলা আছে যে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীরই পুত্র হয়। উতথ্য ঋষির পত্নী মমতা যখন গর্ভিণী ছিলেন তখন তাঁর দেবর বৃহস্পতি সংগম প্রার্থনা করেন। মমতার নিষেধ না শুনে বৃহস্পতি বলপ্রয়োগে উদ্যত হলেন, তখন গর্ভস্থ শিশু তার পা দিয়ে পিতৃব্যের চেষ্টা ব্যর্থ করলে। বৃহস্পতি শিশুকে শাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হবে। ঊতথ্যের পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, তাঁর নাম হ’ল দীর্ঘতমা। তিনি ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু গোধর্ম[১৩] অবলম্বন করায় প্রতিবেশী মুনিগণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে ত্যাগ করলেন। দীর্ঘতমার পুত্রেরা মাতার আদেশে পিতাকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। ধর্মাত্মা বলি রাজা তাঁকে দেখতে পেয়ে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়ে গেলেন এবং মহিষী সুদেষ্ণাকে তাঁর কাছে যেতে বললেন। অন্ধ বৃদ্ধ দীর্ঘতমার কাছে সুদেষ্ণা নিজে গেলেন না, তাঁর ধাত্রীকন্যাকে পাঠালেন। সেই শূদ্রকন্যার গর্ভে কাক্ষীবান প্রভৃতি এগারজন ঋষি উৎপন্ন হন। তারপর রাজার নির্বন্ধে সুদেষ্ণা স্বয়ং গেলেন, দীর্ঘতমা তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করে বললেন, তোমার পাঁচটি তেজস্বী পুত্র হবে—অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ন, তাদের দেশও এই সকল নামে খ্যাত হবে। বলি রাজার বংশ এইরূপে মহর্ষি দীর্ঘতমা থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।

 তারপর ভীষ্ম বললেন, মাতা, বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য আপনি কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে অর্থ দিয়ে নিয়োগ করুন। সত্যবতী হাস্য ক’রে লজ্জিতভাবে নিজের পূর্ব ইতিহাস জানালেন এবং পরিশেষে বললেন, কন্যাবস্থায় আমার যে পুত্র হয়েছিল তাঁর নাম দ্বৈপায়ন, তিনি মহাযোগী মহর্ষি, চতুর্বেদ বিভক্ত ক’রে ব্যাস উপাধি পেয়েছেন; তিনি কৃষ্ণবর্ণ সেজন্য তাঁর অন্য নাম কৃষ্ণ। আমার এই পুত্র জন্মগ্রহণ ক’রেই পিতা পরাশরের সঙ্গে চ’লে যান এবং যাবার সময় আমাকে বলেছিলেন যে, প্রয়োজন হ’লে আমি ডাকলেই তিনি আসবেন। ভীষ্ম, তুমি আর আমি অনুরোধ করলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।

 ভীষ্ম এই প্রস্তাবের সমর্থন করলে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করলেন। ক্ষণকালমধ্যে ব্যাস আবির্ভুত হলেন, সত্যবতী তাঁকে আলিঙ্গন এবং স্তনদুগ্ধে সিক্ত ক’রে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। মাতাকে অভিবাদন করে ব্যাস বললেন, জাপনার অভিলাষ পূরণ করতে এসেছি, কি করতে হবে আদেশ করুন। সত্যবতী তাঁর প্রার্থনা জানালে ব্যাস বললেন, কেবল ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার অভীষ্ট কার্য করব। আমার নির্দেশ অনুসারে দুই রাজ্ঞী এক বৎসর ব্রতপালন ক’রে শুদ্ধ হ’ন, তবে তাঁরা আমার কাছে আসতে পারবেন। সত্যবতী বললেন, অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতা প্রসন্ন হন না, অতএব যাতে রানীরা সদ্য গর্ভবতী হন তার ব্যবস্থা কর, সন্তান হলে ভীষ্ম তাদের পালন করবেন। ব্যাস বললেন, যদি এখনই পউত্র উৎপাদন করতে হয় তবে রানীরা যেন আমার কুৎসিত রূপ গন্ধ আর বেশ সহ্য করেন।

 সভ্যবতী অনেক প্রবোধ দিয়ে তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকাকে কোনও প্রকারে সম্মত ক’রে শয়নগৃহে পাঠালেন। অম্বিকা উত্তম শয্যায় শুয়ে ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয় বীরগণকে চিন্তা করতে লাগলেন। অনন্তর সেই দীপালোকিত গৃহে ব্যাস প্রবেশ করলেন। তাঁর কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা ভয়ে চক্ষু নিমীলিত ক’রে রইলেন। ব্যাস বাইরে এলে সত্যবতী প্রশ্ন করলেন, এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো? ব্যাস উত্তর দিলেন, এই পুত্র শতহস্তিতুল্য বলবান, বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং শতপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে। সত্যবতী বললেন, অন্ধ ব্যক্তি কুরুকুলের রাজা হবার যোগ্য নয়, তুমি আর একটি পুত্র দাও। সত্যবতীর অনুরোধে তাঁর দ্বিতীয় পুত্রবধূ অম্বালিকা শয়নগৃহে এলেন কিন্তু ব্যাসের মূর্তি দেখে তিনি ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলেন। সত্যবতীকে ব্যাস বললেন, এই পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে গাণ্ডুবর্ণ হবে।

 যথাকালে অম্বিকা একটি অন্ধ পুত্র এবং অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণ পুত্র প্রসব করলেন, তাঁদের নাম ধৃতরাষ্ট্রপাণ্ডু। অম্বিকা পুনর্বার ঋতুমতী হ’লে সত্যবতী তাঁকে আর একবার ব্যাসের কাছে যেতে বললেন, কিন্তু মহর্ষির রূপ আর গন্ধ মনে ক’রে অম্বিকা নিজে গেলেন না, অপ্সরার ন্যায় রূপবতী এক দাসীকে পাঠালেন। দাসীর অভ্যর্থনা ও পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাস বললেন, কল্যাণী, তুমি আর দাসী হ’য়ে থাকবে না, তোমার গর্ভস্থ পুত্র ধর্মাত্মা ও পরম বুদ্ধিমান হবে।

 এই দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মগ্রহণ করেন। মাণ্ডব্য নামে এক মৌনব্রতী ঊর্ধ্ববাহু তপস্বী ছিলেন। একদিন কয়েকজন চোর রাজরক্ষীদের ভয়ে পালিয়ে এসে মাণ্ডব্যের আশ্রমে তাদের অপহৃত ধন লুকিয়ে রাখলে। রক্ষীরা আশ্রমে এসে মাণ্ডব্যকে প্রশ্ন করলে, কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না। অন্বেষণের ফলে চোরের দল অপহৃত ধন সমেত ধরা পড়ল, রক্ষীরা তাদের সঙ্গে মাণ্ডব্যকেও রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজার আদেশে সকলকেই শূলে চড়ানো হ’ল, কিন্তু মাণ্ডব্য তপস্যার প্রভাবে জীবিত রইলেন। অবশেষে তাঁর পরিচয় পেয়ে রাজা ক্ষমা চাইলেন এবং তাঁকে শূল থেকে নামালেন, কিন্তু শূলের ভগ্ন অগ্রভাগ তাঁর দেহে রয়ে গেল। মাণ্ডব্য সেই অবস্থাতেই নানা দেশে বিচরণ ও তপস্যা করতে লাগলেন এবং শূলখণ্ডের জন্য অণী[১৪] মাণ্ডব্য নামে খ্যাত হলেন। একদিন তিনি ধর্মরাজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ কর্মের ফলে আমাকে এই দণ্ড দিয়েছেন? ধর্ম বললেন, আপনি বাল্যকালে একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তারই এই ফল। অণীমাণ্ডব্য বললেন, আপনি লঘু পাপে আমাকে গুরুদণ্ড দিয়েছেন। সর্বপ্রাণিবধের চেয়ে ব্রাহ্মণবধ গুরুতর। আমার শাপে আপনি শূদ্র হ’য়ে জন্মগ্রহণ করবেন। আজ আমি এই বিধান দিচ্ছি—চতুর্দশ[১৫] বৎসর বয়সের মধ্যে কেউ কিছু করলে তা পাপ ব’লে গণ্য হবে না। অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপের ফলেই ধর্ম দাসীর গর্ভে বিদুররূপে জন্মেছিলেন।

১৯। গান্ধারী, কুন্তী ও মাদ্রী—কর্ণ—দুর্যোধনাদির জন্ম

 ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু ও বিদুরকে ভীষ্ম পুত্রবৎ পালন করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান, পাণ্ডু পরাক্রান্ত ধনুর্ধর, এবং বিদুর অদ্বিতীয় ধর্মপরায়ণ হলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, বিদুর শূদ্রার গর্ভজাত, একারণে পাণ্ডুই রাজপদ পেলেন।

 বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দিলেন। অন্ধ পতিকে অতিক্রম করবেন না—এই প্রতিজ্ঞা ক’রে পতিব্রতা গান্ধারী বস্ত্রখণ্ড ভাঁজ ক’রে চোখের উপর বাঁধলেন।

 বসুদেবের পিতা যদুশ্রেষ্ঠ শূরের পৃথা[১৬] নামে একটি কন্যা ছিল। শূর তাঁর পিতৃষ্বসার পুত্র নিঃসন্তান কুন্তিভোজকে সেই কন্যা দান করেন। পালক পিতার নাম অনুসারে পৃথার অপর নাম কুন্তী হ’ল। একদা ঋষি দুর্বাসা অতিথি রূপে গৃহে এলে কুন্তী তাঁর পরিচর্যা করলেন, তাতে দুর্বাসা তুষ্ট হ’য়ে একটি মন্ত্র শিখিয়ে বললেন, এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে যে দেবতাকে আহ্বান করবে তাঁদের প্রসাদে তোমার পুত্রলাভ হবে। কৌতূহলবশে কুন্তী সূর্যকে ডাকলেন। সূর্য আবির্ভূত হয়ে বললেন, অসিতনয়না, তুমি কি চাও? দুর্বাসার বরের কথা জানিয়ে কুন্তী নতমস্তকে ক্ষমা চাইলেন। সূর্য বললেন, তোমার আহ্বান বৃথা হবে না, আমার সঙ্গে মিলনের ফলে তুমি পুত্র লাভ করবে এবং কুমারীই থাকবে। কুন্তীর একটি দেবকুমার তুল্য পত্র হ’ল। এই পুত্র স্বাভাবিক কবচ (বর্ম) ও কুণ্ডল ধারণ ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, ইনিই পরে কর্ণ নামে খ্যাত হন। কলঙ্কের ভয়ে কুন্তী তাঁর পুত্রকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দিলেন। সূতবংশীয় অধিরথ ও তাঁর পত্নী রাধা সেই বালককে দেখতে পেয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন এবং বসুষেণ নাম দিয়ে পুত্রবৎ পালন করলেন। কর্ণ বড় হয়ে সকল প্রকার অস্ত্রের প্রয়োগ শিখলেন। তিনি প্রতিদিন মধ্যাহ্ণকাল পর্যন্ত সূর্যের উপাসনা করতেন। একদিন ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্র কর্ণের কাছে এসে তাঁর কবচ[১৭] প্রার্থনা করলেন। কর্ণ নিজের দেহ থেকে কবচটি কেটে দিলে ইন্দ্র তাঁকে শক্তি অস্ত্র দান ক’রে বললেন, তুমি যার উপর এই অস্ত্র ক্ষেপণ করবে সে মরবে, কিন্তু একজন নিহত হ’লেই অস্ত্রটি আমার কাছে ফিরে আসবে। কবচ কেটে দেওয়ার জন্য বসুষেণের নাম কর্ণ ও বৈকর্তন হয়।

 রাজা কুন্তিভোজ তাঁর পালিতা কন্যার বিবাহের জন্য স্বয়ংবরসভা আহ্বান করলে কুন্তী নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য দিলেন। পাণ্ডুর আর একটি বিবাহ দেবার ইচ্ছায় ভীষ্ম মদ্রদেশের রাজা বাহ্লীকবংশীয় শল্যের কাছে গিয়ে তাঁর ভগিনীকে প্রার্থনা করলেন। শল্য বললেন, আমাদের বংশের একটি নিয়ম নিশ্চয় আপনার জানা আছে। ভালই হ’ক বা মন্দই হ’ক আমি কুলধর্ম— লঙ্ঘন করতে পারি না। ভীষ্ম উত্তর দিলেন, কুলধর্ম পালনে কোনও দোষ নেই। এই ব’লে তিনি স্বর্ণ রত্ন গজ অশ্ব প্রভৃতি ধন বিবাহের পণ রূপে শল্যকে দিলেন। শল্য প্রীত হয়ে তাঁর ভগিনী মাদ্রীকে দান করলেন, ভীষ্ম সেই কন্যাকে হস্তিনাপুরে এনে পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ দিলেন। দেবক রাজার শূদ্রা পত্নীর গর্ভে ব্রাহ্মণ কর্তৃক একটি কন্যা উৎপাদিত হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে বিদ্যুরের বিবাহ হ’ল।

 কিছুকাল পরে মহারাজ পাণ্ডু সসৈন্যে নির্গত হয়ে নানা দেশ জয় ক’রে বহু ধন নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে সেই সমস্ত ধন ভীষ্ম, দুই মাতা ও বিদুরকে উপহার দিলেন। তারপর তিনি দুই পত্নীর সঙ্গে বনে গিয়ে মৃগয়া করতে লাগলেন।

 ব্যাস বর দিয়েছিলেন যে গান্ধারীর শত পুত্র হবে। যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন, কিন্তু দুই বৎসরেও তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হ’ল না এবং কুন্তীর একটি পুত্র (যুধিষ্ঠির) হয়েছে জেনে তিনি অধীর ও ঈর্ষান্বিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে গান্ধারী নিজের গর্ভপাত করলেন, তাতে লৌহের ন্যায় কঠিন একটি মাংসপিণ্ড প্রসূত হ’ল। তিনি সেই পিণ্ড ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাস এসে বললেন, আমার কথা মিথ্যা হবে না। ব্যাসের উপদেশে গান্ধারী শীতল জলে মাংসপিণ্ড ভিজিয়ে রাখলেন, তা থেকে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এক শ এক ভ্রূণ পৃথক হ’ল। সেই ভ্রূণগুলিকে তিনি পৃথক পৃথক ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখলেন। এক বৎসর পরে একটি কলসে দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর পূর্বেই কুন্তীপত্র যুধিষ্ঠির জন্মেছিলেন, সে কারণে যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠ। দুর্যোধন ভীম একই দিনে জন্মগ্রহণ করেন।

 দুর্যোধন জ’ন্মেই গদর্ভের ন্যায় কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার ক’রে উঠালেন, সঙ্গে সঙ্গে গৃধ্র শৃগাল কাক প্রভৃতিও ডাকতে লাগল এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতিকে বললেন, আমাদের বংশের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র যুধিষ্ঠির তো রাজ্য পাবেই, কিন্তু তার পরে আমার এই পুত্র রাজা হবে তো? শৃগালাদি শ্বাপদ জন্তুরা আবার ডেকে উঠল। তখন ব্রাহ্মণগণ ও বিদুর বললেন, আপনার পুত্র নিশ্চয় বংশ নাশ করবে, ওকে পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। পুত্রস্নেহের বশে ধৃতরাষ্ট্র তা করলেন না। এক মাসের মধ্যে তাঁর দুর্যোধন দুঃশাসন দুঃসহ প্রভৃতি একশত পুত্র এবং দুঃশলা নামে একটি কন্যা হ’ল। গান্ধারী যখন গভর্ভারে ক্লিষ্ট ছিলেন তখন এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করত। তার গর্ভে যুযুৎসু নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করে।

২০। যুধিষ্ঠিরাদির জন্ম—পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু

 একদিন পাণ্ডু অরণ্যে বিচরণ করতে করতে একটি হরিণমিথুনকে শরবিদ্ধ করলেন। আহত হরিণ ভূপতিত হয়ে বললে, কামক্রোধের বশবর্তী মূঢ় ও পাপাসক্ত লোকেও এমন নৃশংস কর্ম করে না। কোন্ জ্ঞানবান পুরুষ মৈথুনে রত মৃগদম্পতিকে বধ করে? মহারাজ, আমি কিমিন্দম মুনি, পুত্রকামনায় মৃগরূপ ধারণ করে পত্নীর সহিত সংগত হয়েছিলাম। তুমি জানতে না যে আমি ব্রাহ্মণ, সেজন্য তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হবে না, কিন্তু আমার শাপে তোমারও স্ত্রীসংগমকালে মৃত্যু হবে।

 শাপগ্রস্ত পাণ্ডু বহু বিলাপ করে বললেন, আমি সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষু হব, কঠোর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধন করব। শাপের ফলে আমার সন্তান উৎপাদন অসম্ভব, অতএব গৃহস্থাশ্রমে আর থাকব না। কুন্তী ও মাদ্রী তাঁকে বললেন, আমরা তোমার ধর্মপত্নী, আমাদের সঙ্গে থেকেই তো তপস্যা করতে পার, আমরাও ইন্দ্রিয়দমন করে তপস্যা করব। তার পর পাণ্ডু নিজের এবং দুই পত্নীর সমস্ত অলংকার ব্রাহ্মণদের দান ক’রে হস্তিনাপুরে সংবাদ পাঠালেন যে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ ক’রে অরণ্যবাসী হয়েছেন।

 পাণ্ডু তাঁর দুই পত্নীর সঙ্গে নাগশত, চৈত্ররথ, কালকূট, হিমালয়ের উত্তরস্থ গন্ধমাদন পর্বত, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর এবং হংসকূট অতিক্রম ক’রে শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে তপস্যা করতে লাগলেন। বহু ঋষির সঙ্গে তাঁর সখ্য হ’ল। একদিন ঋষিরা বললেন, আজ ব্রহ্মলোকে মহাসভা হবে, আমরা ব্রহ্মাকে দেখতে সেখানে যাচ্ছি। সস্ত্রীক পাণ্ডু তাঁদের সঙ্গে যেতে চাইলে তাঁরা বললেন, সেই দুর্গম দেশে এই রাজপুত্রীরা যেতে পারবেন না, তুমি নিরস্ত হও। পাণ্ডু বললেন, আমি নিঃসন্তান, স্বর্গের দ্বার আমার পক্ষে রুদ্ধ, সেজন্য আপনাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। আমি যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন-তপস্যা আর অনিষ্ঠুরতার দ্বারা দেব, ঋষি ও মনুষ্যের ঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি, কিন্তু পুত্রোৎপাদন ও শ্রাদ্ধদ্বারা পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারি নি। আমি যে ভাবে জন্মেছি সেই ভাবে আমার পত্নীর গর্ভে যাতে সন্তান হ’তে পারে তার উপায় আপনারা বলুন। ঋষিরা বললেন, রাজা, আমরা দিব্য চক্ষুতে দেখছি তোমার দেবতুল্য পুত্র হবে।

 পাণ্ডু নির্জনে কুন্তীকে বললেন, তুমি সন্তান লাভের জন্য চেষ্টা কর, আপৎকালে স্ত্রীলোক উত্তম বর্ণের পুরুষ অথবা দেবর থেকে পুত্রলাভ করতে পারে। কুন্তী বললেন, আমি শুনেছি রাজা ব্যুষিতাশ্ব যক্ষ্মা রোগে প্রাণত্যাগ করলে তাঁর মহিষী ভদ্রা মৃতপতির সহিত সংগমে পুত্রবতী হয়েছিলেন। তুমিও তপস্যার প্রভাবে আমার গর্ভে মানস পুত্র উৎপাদন করতে পার। পাণ্ডু বললেন, ব্যুষিতাশ্ব দেবতুল্য শক্তিমান ছিলেন, আমার তেমন শক্তি নেই। আমি প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব বলছি শোন। পুরাকালে নারীরা স্বাধীন ছিল, তারা স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত, তাতে দোষ হ’ত না, কারণ প্রাচীন ধর্মই এইপ্রকার। উত্তরকুরুদেশবাসী এখনও সেই ধর্মানুসারে চলে। এদেশেও সেই প্রাচীন প্রথা অধিককাল রহিত হয় নি। উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু দেখলেন, তাঁর পিতার সমক্ষেই এক ব্রাহ্মণ তাঁর মাতার হাত ধ’রে টেনে নিয়ে গেলেন। উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বললেন, তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না, সনাতন ধর্মই এই, পৃথিবীতে সকল স্ত্রীলোকই গরুর তুল্য স্বাধীন। শ্বেতকেতু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আজ থেকে যে নারী পরপুরুষগামিনী হবে, যে পুরুষ পতিব্রতা পত্নীকে ত্যাগ ক’রে অন্য নারীর সংসর্গ করবে, এবং যে নারী পতির আজ্ঞা পেয়েও ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনে আপত্তি করবে, তাদের সকলেরই ভ্রূণহত্যার পাপ হবে। কুন্তী; কৃষ্ণদ্বৈপায়ন থেকে আমাদের জন্ম হয়েছে তা তুমি জান। আমি পুত্রপ্রার্থী, মস্তকে অঞ্জলি রেখে অনুনয় করছি, তুমি কোনও তপস্বী ব্রাহ্মণের কাছে গুণবান পুত্র লাভ কর।

 কুন্তী তখন দুর্বাসার বরের বৃত্তান্ত পাণ্ডুকে জানিয়ে বললেন, মহারাজ, তুমি অনুমতি দিলে আমি কোনও দেবতা বা ব্রাহ্মণকে মন্ত্রবলে আহ্বান করতে পারি। দেবতার কাছে সদ্য পুত্রলাভ হবে, ব্রাহ্মণের কাছে বিলম্ব হবে। পাণ্ডু বললেন, আমি ধন্য হয়েছি, অনুগৃহীত হয়েছি, তুমিই আমাদের বংশের রক্ষিত্রী। দেবগণের মধ্যে ধর্মই সর্বাপেক্ষা পুণ্যবান, আজই তুমি তাঁকে আহ্বান কর।

 গান্ধারী যখন এক বৎসর গর্ভধারণ করেছিলেন সেই সময়ে কুন্তী মন্ত্রবলে ধর্মকে আহ্বান করলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতের উপর ধর্মের সহিত সংগমের ফলে কুন্তী পুত্রবতী হলেন। প্রসবকালে দৈববাণী হ’ল—এই বালক ধার্মিকগণের শ্রেষ্ঠ, বিক্রান্ত, সত্যবাদী ও পৃথিবীপতি হবে, এবং যুধিষ্ঠির নামে খ্যাত হবে।

 তার পর পাণ্ডুর ইচ্ছাক্রমে বায়ু ও ইন্দ্রকে আহ্বান করে কুন্তী ভীম ও অর্জুন নামে আরও দুই পুত্র লাভ করলেন। একদিন মাদ্রী পাণ্ডুকে বললেন, মহারাজ কুন্তী আমার সপত্নী, তাঁকে আমি কিছু বলতে সাহস করি না, কিন্তু তুমি বললে তিনি আমাকেও পুত্রবতী করতে পারেন। পাণ্ডু অনুরোধ করলে কুন্তী সম্মত হলেন এবং তাঁর উপদেশে মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্মরণ ক’রে নকুল ও সহদেব নামে যমজ পুত্র লাভ করলেন। মাদ্রীর আরও পুত্রের জন্য পাণ্ডু অনুরোধ করলে কুন্তী বললেন, আমি মাদ্রীকে বলেছিলাম—কোনও এক দেবতাকে স্মরণ কর, কিন্তু সে যুগল দেবতাকে আহ্বান ক’রে আমাকে প্রতারিত করেছে। মহারাজ, আমাকে আর অনুরোধ ক’রো না।

 দেবতার প্রসাদে লব্ধ পাণ্ডুর এই পঞ্চ পুত্র কালক্রমে চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন, সিংহের ন্যায় বলশালী এবং দেবতার ন্যায় তেজস্বী হ’ল। একদিন রমণীয় বসন্তকালে পাণ্ডু নির্জনে মাদ্রীকে দেখে সংযম হারালেন এবং পত্নীর নিযেধ অগ্রাহ্য করে তাঁকে সবলে গ্রহণ করলেন। শাপের ফলে সংগমকালেই পাণ্ডুর প্রাণবিয়োগ হ’ল। মাদ্রীর আর্তনাদ শুনে কুন্তী সেখানে এলেন এবং বিলাপ করে বললেন, আমি রাজাকে সর্বদা সাবধানে রক্ষা করতাম, তুমি এই বিজন স্থানে কেন তাঁকে লোভিত করলে? তুমি আমার চেয়ে ভাগ্যবতী, তাঁকে হৃষ্ট দেখেছ। আমি জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী, সেজন্য ভর্তার সহমৃতা হব। তুমি এই বালকদের পালন কর। মাদ্রী বললেন, আমি কামভোগে তৃপ্ত হই নি, অতএব পতির অনুসরণ করব। তোমার তিন পুত্রকে আমি নিজ পুত্রের ন্যায় দেখতে পারব না, তুমিই আমার দুই পুত্রকে নিজপুত্রবৎ পালন কর। এই বলে মাদ্রী পাণ্ডুর সহগমনকামনায় প্রাণত্যাগ করলেন।

২১। হস্তিনাপুরে পঞ্চপাণ্ডব—ভীমের নাগলোক দর্শন

 পাণ্ডুর আশ্রমের নিকট যে সকল ঋষি বাস করতেন তাঁরা মন্ত্রণা ক’রে পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃতদেহ এবং কুন্তী ও রাজপুত্রদের নিয়ে হস্তিনাপুরে গেলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোল, ভীমের পনর, অর্জুনের চোদ্দ এবং নকুল-সহদেবের তের। ঋষিরা রাজসভায় এলে কৌরবগণ প্রণত হয়ে সংবর্ধনা করলেন। ঋষিদের মধ্যে যিনি বৃদ্ধতম তিনি পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুবিবরণ এবং যুধিষ্ঠিরাদির পরিচয় দিলেন এবং সভাস্থ সকলকে বিস্মিত ক’রে সঙ্গিগণসহ অন্তর্হিত হলেন।

 ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর পাণ্ডু ও মাদ্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করলেন। ত্রয়োদশ দিনে শ্রাদ্ধাদি কৃত্য সম্পন্ন হ’ল, সকলে দুঃখিত মনে রাজপুরীতে ফিরে এলেন। তখন ব্যাস শোকবিহ্বলা সত্যবতীর কাছে এসে বললেন, মাতা, সুখের দিন শেষ হয়েছে, পৃথিবী এখন গতযৌবনা, ক্রমশ পাপের বৃদ্ধি হবে, কৌরবদের দুর্নীতির ফলে ধর্মকর্ম লোপ পাবে। কুরুবংশের ক্ষয় যেন আপনাকে দেখতে না হয়, আপনি তপোবনে গিয়ে যোগ অবলম্বন করুন। সত্যবতী তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে ব্যাসের কথা জানিয়ে বললেন, তোমরাও আমার সঙ্গে চল। তারপর তাঁরা তিনজনে বনে গিয়ে ঘোর তপস্যায় দেহ ত্যাগ ক’রে ইষ্টলোকে গেলেন।

 পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের পিতৃগৃহে সুখে বাস করতে লাগলেন। নানাবিধ ক্রীড়ায় ভীমই সর্বাধিক শক্তি দেখাতেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের মাথা ঠোকাঠুকি করিয়ে, জলে ডুবিয়ে এবং অন্যান্য প্রকারে নিগ্রহ করতেন। বাহুযুদ্ধে, গমনের বেগে বা ব্যায়ামের অভ্যাসে কেউ তাঁকে হারাতে পারত না। ভীমের মনে কোনও বিদ্বেষ ছিল না, তথাপি তিনি বালসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ধার্তরাষ্ট্রগণের অপ্রিয় হলেন।

 দুর্যোধন গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে উদকক্রীড়ন নাম দিয়ে একটি সুসজ্জিত আবাস রচনা করলেন এবং সেখানে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য রাখিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানকার উদ্যানে সকলে খেলাচ্ছলে পরস্পরের মুখে খাদ্য তুলে দিতে লাগলেন, সেই সুযোগে পাপমতি দুর্যোধন ভীমকে কালকূট বিষ মিশ্রিত খাদ্য দিলেন। জলক্রীড়ার পর সকলে বিহারগৃহে বিশ্রাম করতে গেলেন, কিন্তু ভীম অত্যন্ত শ্রান্ত এবং বিষের প্রভাবে অচেতন হয়ে গঙ্গাতীরে প’ড়ে রইলেন, দুর্যোধন তাঁকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দিলেন।

 সংজ্ঞাহীন ভীম জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে উপস্থিত হলেন। মহাবিষ সর্পগণ তাঁকে দংশন করতে লাগল, সেই জঙ্গম সর্পবিষে স্থাবর কালকূট বিষ নষ্ট হ’ল। চেতনা পেয়ে ভীম তাঁর বন্ধন ছিন্ন ক’রে সর্প বধ করতে লাগলেন। তখন কতকগুলি সর্প নাগরাজ বাসুকির কাছে গিয়ে সংবাদ দিলে। বাসুকি ভীমের কাছে গিয়ে তাঁকে নিজের দৌহিত্রের দৌহিত্র, অর্থাৎ কুন্তিভোজের দৌহিত্র ব’লে চিনতে পেরে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন। বাসুকি বললেন, একে ধনরত্ন দিয়ে সুখী কর। একজন নাগ বললে, ধন দিয়ে কি হবে, যদি আপনি তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই কুমারকে রসায়ন পান করতে দিন। বাসুকির আজ্ঞায় নাগগণ ভীমকে রসায়নকুণ্ডের কাছে নিয়ে গেল। ভীম স্বস্ত্যয়ন ক’রে শুচি হয়ে পূর্বমুখে বসলেন এবং এক নিঃশ্বাসে এক-একটি কুণ্ডের রস পান ক’রে আটটি কুণ্ড নিঃশেষ করলেন। তার পর তিনি নাগদত্ত উত্তম শয্যায় শুয়ে সুখে নিদ্রিত হলেন।

জলবিহার শেষ করে কৌরব[১৮]) ও পাণ্ডবগণ ভীমকে দেখতে পেলেন না। ভীম আগেই চলে গেছেন মনে করে তাঁরা রথ গজ ও অশ্বে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন। ভীমকে না দেখে কুন্তী অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হলেন। বিদুর যুধিষ্ঠির প্রভৃতি সমস্ত নগরোদ্যানে অন্বেষণ করেও কোথাও তাঁকে পেলেন না। কুন্তীর ভয় হ’ল, হয়তো ক্রূর দুর্যোধন ভীমকে হত্যা করেছে। বিদুর তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, এমন কথা বলবেন না, মহামুনি ব্যাস বলেছেন আপনার পুত্রেরা দীর্ঘায়ু হবে।

 অষ্টম দিনে ভীমের নিদ্রাভঙ্গ হ’ল। নাগগণ তাঁকে বললে, রসায়ন জীর্ণ ক’রে তুমি অযুত হস্তীর বল পেয়েছ, এখন দিব্য জলে স্নান ক’রে গৃহে যাও। ভীম স্নান ক’রে উত্তম অন্ন ভোজন করলেন এবং নাগদের আশীর্বাদ নিয়ে দিব্য আভরণে ভূষিত হয়ে স্বগৃহে ফিরে গেলেন। সকল বৃত্তান্ত শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, চুপ করে থাক, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা ক’রো না, এখন থেকে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। দুর্যোধন বিফলমনোরথ হয়ে মনস্তাপ ভোগ করতে লাগলেন।

 রাজকুমারদের শিক্ষার জন্য ধৃতরাষ্ট্র গৌতমগোত্রজ কৃপাচার্যকে নিযুক্ত করলেন।

২২। কৃপ—দ্রোণ—অশ্বত্থামা—একলব্য—অর্জুনের পটুতা

 মহর্ষি গৌতমের শরদ্বান নামে এক শিষ্য ছিলেন, তাঁর ধনুর্বেদে যেমন বুদ্ধি ছিল বেদাধ্যয়নে তেমন ছিল না। তাঁর তপস্যায় ভয় পেয়ে ইন্দ্র জানপদী নামে এক অপ্সরা পাঠালেন। তাকে দেখে শরদ্বানের হাত থেকে ধনুর্বাণ প’ড়ে গেল এবং রেতঃপাত হ’ল। সেই রেতঃ একটি শরস্তম্বে প’ড়ে দু ভাগ হ’ল, তা থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করলে। রাজা শান্তনু তাদের দেখতে পেয়ে কৃপা ক’রে গৃহে এনে সন্তানবৎ পালন করলেন এবং বালকের নাম কৃপ ও বালিকার নাম কৃপী রাখলেন। শরদ্বান তপোবলে তাদের বৃত্তান্ত জানতে পেরে রাজভবনে এলেন এবং কৃপকে শিক্ষা দিয়ে ধনুর্বেদে পারদর্শী করলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধন প্রভৃতি এবং বৃষ্ণিবংশীয় ও নানাদেশের রাজপুত্রগণ এই কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে লাগলেন।

 ভরদ্বাজ ঋষি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানকালে ঘৃতাচী অপ্সরাকে দেখে তাঁর শুক্রপাত হয়। সেই শুক্র তিনি কলসের মধ্যে রাখেন তা থেকে দ্রোণ জন্মগ্রহণ করেন। অগ্নিবেশ্য মুনি দ্রোণকে আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষা দেন। পাঞ্চালরাজ পৃষত ভরদ্বাজের সখা ছিলেন, তাঁর পুত্র দ্রুপদ দ্রোণের সঙ্গে খেলা করতেন। পিতার আদেশে দ্রোণ কৃপীকে বিবাহ করলেন। তাঁদের একটি পুত্র হয়, সে ভূমিষ্ঠ হয়েই অশ্বের ন্যায় চিৎকার করেছিল সেজন্য তার নাম অশ্বত্থামা হ’ল।

 ভরদ্বাজের মৃত্যুর পর দ্রোণ পিতার আশ্রমে থেকে তপস্যা ও ধনুর্বেদ চর্চা করতে লাগলেন। একদিন তিনি শুনলেন যে অস্ত্রজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ ভৃগুনন্দন পরশুরাম তাঁর সমস্ত ধন ব্রাহ্মণদের দিতে ইচ্ছা করেছেন। দ্রোণ মহেন্দ্র পর্বতে পরশুরামের কাছে গিয়ে প্রণাম করে ধন চাইলেন। পরশুরাম বললেন, আমার কাছে সুবর্ণাদি যা ছিল সবই ব্রাহ্মণদের দিয়েছি, সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দিয়েছি, এখন কেবল আমার শরীর আর অস্ত্রশস্ত্র অবশিষ্ট আছে, কি চাও বল। দ্রোণ বললেন, আপনি সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাকে দিন এবং তাদের প্রয়োগ ও প্রত্যাহরণের বিধি আমাকে শেখান। পরশুরাম দ্রোণের প্রার্থনা পূরণ করলেন। দ্রোণ কৃতার্থ হয়ে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে গেলেন, কিন্তু ঐশ্বর্যগর্বে দ্রুপদ তাঁর বাল্যসখার অপমান করলেন। দোণ ক্রোধে অভিভূত হয়ে হস্তিনাপুরে গিয়ে কৃপাচার্যের গৃহে গোপনে বাস করতে লাগলেন।

 একদিন রাজকুমারগণ নগরের বাইরে এসে বীটা[১৯] নিয়ে খেলছিলেন। দৈবক্রমে তাঁদের বীটা কুপের মধ্যে প’ড়ে গেল, অনেক চেষ্টা ক’রেও তাঁরা তুলতে পারলেন না। একজন শ্যামবর্ণ পক্ককেশ কৃশকায় ব্রাহ্মণ নিকটে ব’সে হোম করছেন দেখে তাঁরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। এই ব্রাহ্মণ দ্রোণ। তিনি সহাস্যে বললেন, ধিক তোমাদের ক্ষত্রবল আর অস্ত্রশিক্ষা, ভরতবংশে জন্মে একটা বীটা তুলতে পারলে না! তোমাদের বীটা আর আমার এই অঙ্গুরীয় আমি ঈষীকা (কাশ তৃণ) দিয়ে তুলে দেব, কিন্তু আমাকে খাওয়াতে হবে। যুধিষ্ঠির বললেন, কৃপাচার্য অনুমতি দিলে আপনি প্রত্যহ আহার পাবেন। দ্রোণ সেই শুষ্ক কূপে তাঁর আংটি ফেললেন, তার পর একটি ঈষীকা ফেলে বীটা বিদ্ধ করলেন, তার পর আর একটি ঈষীকা দিয়ে প্রথম ঈষীকা বিদ্ধ করলেন। এইরূপে পর পর ঈষীকা ফেলে উপরের ঈষীকা ধ’রে বীটা টেনে তুললেন। রাজপুত্রেরা এই ব্যাপার দেখে উৎফুল্ল নয়নে সবিস্ময়ে বললেন, বিপ্রর্ষি, আপনার আংটিও তুলুন। দ্রোণ তাঁর ধনু থেকে একটি শর কূপের মধ্যে ছূড়লেন, তার পর আরও শর দিয়ে পূর্বের ন্যায় অঙ্গুরীয় উদ্ধার করলেন। বালকরা পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে দ্রোণ বললেন, তোমরা আমার রূপগুণ যেমন দেখলে তা ভীষ্মকে জানাও।

 বিবরণ শুনে ভীষ্ম বুঝলেন যে এই ব্রাহ্মণই দ্রোণ এবং তিনিই রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু হবার যোগ্য। ভীষ্ম তখনই দ্রোণকে সসম্মানে ডেকে আনলেন। দ্রোণ বললেন, পাঞ্চালরাজপুত্র দ্রুপদ আর আমি মহর্ষি অগ্নিবেশ্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলাম, বাল্যকাল থেকে দ্রুপদ আমার সখা ছিলেন। শিক্ষা শেষ হ’লে চ’লে যাবার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, দ্রোণ, আমি পিতার প্রিয়তম পুত্র, আমি পাঞ্চালরাজ্যে অভিষিক্ত হলে আমার রাজ্য তোমারও হবে। তাঁর এই কথা আমি মনে রেখেছিলাম। তার পর আমি পিতার আদেশে এবং পুত্রকামনায় বিবাহ করি। আমার পত্নী অল্পকেশী, কিন্তু তিনি ব্রতপরায়ণা এবং সর্ব কর্মে আমার সহায়। আমার পুত্র অশ্বত্থামা অতিশয় তেজস্বী। একদা বালক অশ্বত্থামা ধনিপুত্রদের দুধ খেতে দেখে আমার কাছে এসে কাঁদতে লাগল, তাতে আমি দুঃখে দিশাহারা হলাম। বহ স্থানে চেষ্টা ক’রেও কোথাও ধর্মসঙ্গত উপায়ে পয়স্বিনী গাভী পেলাম না। অশ্বত্থামার সঙ্গী বালকরা তাকে পিটুলি গোলা খেতে দিলে, দুধ খাচ্ছি মনে করে সে আনন্দে নাচতে লাগল। বালকরা আমাকে উপহাস ক’রে বললে, দরিদ্র দ্রোণকে ধিক, যে ধন উপার্জন করতে পারে না, যার পুত্র পিটুলি গোলা খেয়ে আনন্দে নৃত্য করে। আমার বুদ্ধিভ্রংশ হ’ল, পূর্বের বন্ধুত্বে স্মরণ ক’রে স্ত্রীপুত্র সহ দ্রুপদ রাজার কাছে গেলাম। আমি তাঁকে সখা বলে সম্ভাষণ করতে গেলে দ্রুপদ বললেন, ব্রাহ্মণ, তোমার বুদ্ধি অমার্জিত তাই আমাকে সখা বলছ, সমানে সমানেই বন্ধুত্ব হয়। ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণ, রথী আর অরথী, প্রবলপ্রতাপ রাজা আর শ্রীহীন দরিদ্র —এদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না। তোমাকে এক রাত্রির উপযুক্ত ভোজন দিচ্ছি নিয়ে যাও।

 দ্রোণ বললেন, এই অপমানের পর আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করে কুরুদেশে চ’লে এলাম। ভীষ্ম, এখন বলুন আপনার কোন্ প্রিয়কার্য করব। ভীষ্ম বললেন, আপনার ধনু জ্যামুক্ত করুন, রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দিন, এখানে সসম্মানে বাস করে সমস্ত ঐশ্বর্য ভোগ করুন। এই রাজ্যের আপনিই প্রভু, কৌরবগণ আপনার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। দ্রোণ বললেন, কুমারদের শিক্ষার ভার আমি নিলে কৃপাচার্য দুঃখিত হবেন, অতএব আমাকে কিছু ধন দিন, আমি সন্তুষ্ট হয়ে চ’লে যাই। ভীষ্ম উত্তর দিলেন, কৃপাচার্যও থাকবেন, আমরা তাঁর যথোচিত সম্মান ও ভরণ করব। আপনি আমার পৌত্রদের আচার্য হবেন।

 ভীষ্ম একটি সুপরিচ্ছন্ন ধনধান্যপূর্ণ গৃহে দ্রোণের বাসের ব্যবস্থা করলেন এবং পৌত্রদের শিক্ষার ভার তাঁর হাতে দিলেন। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় এবং নানা দেশের রাজপুত্রগণ দ্রোণের কাছে শিক্ষার জন্য এলেন, সূতপত্র কর্ণও তাঁকে গুরুরূপে বরণ করলেন। সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্জুনই আচার্যের সর্বাপেক্ষা স্নেহপাত্র হলেন।

 নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য দ্রোণের কাছে শিক্ষার জন্য এলেন, কিন্তু নীচজাতি বলে দ্রোণ তাঁকে নিলেন না। একলব্য দ্রোণের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম ক’রে বনে চলে গেলেন এবং দ্রোণের একটি মৃন্ময়ী মূর্তিকে আচার্য কল্পনা ক’রে নিজের চেষ্টায় অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করতে লাগলেন।

 একদিন কুরুপাণ্ডবগণ মৃগয়ায় গেলেন, তাঁদের এক অনুচর মৃগয়ার উপকরণ এবং কুকুর নিয়ে পিছনে পিছনে গেল। কুকুর ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের কাছে উপস্থিত হ’ল এবং তাঁর কৃষ্ণ বর্ণ, মলিন দেহ, মৃগচর্ম পরিধান ও মাথায় জটা দেখে চিৎকার করতে লাগল। একলব্য একসঙ্গে সাতটি বাণ ছড়ে তার মুখের মধ্যে পুরে দিলেন, কুকুর তাই নিয়ে রাজকুমারদের কাছে গেল। তাঁরা বিস্মিত হয়ে একলব্যের কাছে এলেন এবং তাঁর কথা দ্রোণাচার্যকে জানালেন। অজুর্ন দ্রোণকে গোপনে বললেন, আপনি প্রীত হয়ে আমাকে বলেছিলেন যে আপনার কোনও শিষ্য আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে না, কিন্তু একলব্য আমাকে অতিক্রম করলে কেন? দ্রোণ অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে একলব্যের কাছে গেলেন, একলব্য ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রোণ বললেন, বীর, তুমি যদি আমার শিষ্যই হও তবে গুরুদক্ষিণা দাও। একলব্য আনন্দিত হয়ে বললেন, ভগবান, কি দেব আজ্ঞা করুন, গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নেই। দ্রোণ বললেন, তোমার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ আমাকে দাও। এই দারুণ বাক্য শুনে একলব্য প্রফল্লেমুখে অকাতরচিত্তে অঙ্গুষ্ঠ ছেদন ক’রে দ্রোণকে দিলেন। তার পর সেই নিষাদপুত্র অন্য অঙ্গুলি দিয়ে শরাকর্ষণ ক’রে দেখলেন, কিন্তু শর পূর্ববৎ শীঘ্রগামী হ’ল না। অর্জন সন্তুষ্ট হলেন।

 দ্রোণের শিক্ষার ফলে ভীম ও দুর্যোধন গদাযুদ্ধে, অশ্বত্থামা গুপ্ত অস্ত্রের প্রয়োগে, নকুল-সহদেব অসিযুদ্ধে, যুধিষ্ঠির রথচালনায়, এবং অর্জুন বুদ্ধি বল উৎসাহ ও সর্বাস্ত্রের প্রয়োগে শ্রেষ্ঠ হলেন। দুরাত্মা ধার্তরাষ্ট্রগণ ভীম ও অর্জুনের শ্রেষ্ঠতা সইতে পারতেন না।

 একদিন দ্রোণ একটি কৃত্রিম ভাস[২০] পক্ষী গাছের উপর রেখে কুমারদের বললেন, তোমরা ওই পক্ষীকে লক্ষ্য ক’রে স্থির হয়ে থাক, যাকে বলব সে শরাঘাতে ওর মুণ্ডচ্ছেদ ক’রে ভূমিতে ফেলবে। সকলে শরসন্ধান করলে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি গাছের উপর ওই পাখি দেখছ? এই গাছ, আমাকে আর তোমার ভ্রাতাদের দেখছ? যুধিষ্ঠির বললেন যে তিনি সবই দেখতে পাচ্ছেন। দ্রোণ বিরক্ত হয়ে বললেন, সরে যাও, তুমি এই লক্ষ্য বেধ করতে পারবে না। দুর্যোধন ভীম প্রভৃতিও বললেন, আমরা সবই দেখছি। দ্রোণ তাঁদেরও সরিয়ে দিলেন। তার পর অর্জুনকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, আমি কেবল ভাস পক্ষী দেখছি। দ্রোণ বললেন, আবার বল। অর্জুন বললেন, কেবল ভাসের মস্তক দেখছি। আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে দ্রোণ বললেন, এইবারে শর ত্যাগ কর। তৎক্ষণাৎ অর্জুনের ক্ষুরধার শরে ভাসের ছিন্ন মুণ্ড ভূমিতে প’ড়ে গেল।

 একদিন শিষ্যদের সঙ্গে দ্রোণ গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। তিনি জলে নামলে একটা কুম্ভীর[২১] তাঁর জঙ্ঘা কামড়ে ধরলে। দ্রোণ শিষ্যদের বললেন, তোমরা শীঘ্র আমাকে রক্ষা কর। তাঁর বাক্যের সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুন পাঁচ শরে কুম্ভীরকে খণ্ড খণ্ড করলেন, অন্য শিষ্যরা মূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রোণ প্রীত হ’য়ে অর্জুনকে ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র দান ক’রে বললেন, এই অস্ত্র মানুষের প্রতি প্রয়োগ ক’রো না, যদি অন্য শত্রু তোমাকে আক্রমণ করে, তবেই প্রয়োগ করবে।

২৩। অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন

 একদিন ব্যাস কৃপ ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতির সমক্ষে দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, কুমারদের অস্ত্রাভ্যাস সম্পূর্ণ হয়েছে, আপনি অনুমতি দিলে তাঁরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রদর্শন করবেন। ধৃতরাষ্ট্র হষ্ট হ’য়ে বললেন, আপনি মহৎ কর্ম সম্পন্ন করেছেন, আমার ইচ্ছা হচ্ছে চক্ষুষ্মান লোকের ন্যায় আমিও কুমারগণের পরাক্রম দেখি।

 ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায় এবং দ্রোণের নির্দেশ অনুসারে বিদুর সমতল স্থানে বিশাল রঙ্গভূমি নির্মাণ করালেন এবং ঘোষণা ক’রে সাধারণকে জানিয়ে শুভ তিথিনক্ষত্রযোগে দেবপূজা করলেন। নির্দিষ্ট দিনে ভীষ্ম ও কৃপাচার্যকে অগ্রবর্তী ক’রে ধৃতরাষ্ট্র সুসজ্জিত প্রেক্ষাগারে এলেন। গান্ধারী কুন্তী প্রভৃতি রাজপুরনারীগণ উত্তম পরিচ্ছদে ভূষিত হ’য়ে মঞ্চে গিয়ে বসলেন। নানা দেশ থেকে আগত দর্শকদের কোলাহলে ও বাদ্যধ্বনিতে সেই সভা মহাসমুদ্রের ন্যায় বিক্ষুব্ধ হ’ল।

 অনন্তর শুক্লকেশ দ্রোণাচার্য শুক্ল বসন ও মাল্য ধারণ ক’রে পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে রঙ্গভূমিতে এলেন এবং মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের দিয়ে মঙ্গলাচরণ করালেন। দ্রোণ ও কৃপকে ধৃতরাষ্ট্র সুবর্ণরত্নাদি দক্ষিণা দিলেন। তার পর ধনু ও তূণীর ধারণ ক’রে অঙ্গুলিত্র কটিবন্ধ প্রভৃতিতে সুরক্ষিত হ’য়ে রাজপুত্রগণ রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন, এবং যুধিষ্ঠিরকে পুরোবর্তী ক’রে জ্যেষ্ঠানুক্রমে অস্ত্রপ্রয়োগ দেখাতে লাগলেন। তাঁরা অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে নিজ নিজ নামাঙ্কিত বাণ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন, রথ গজ ও অশ্ব চালনার, বাহুযুদ্ধের এবং খড়্গ-চর্ম[২২] প্রয়োগের বিবিধ প্রণালী দেখালেন। তার পর পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত দুর্যোধন ও ভীম গদাহস্তে এসে মত্ত হস্তীর ন্যায় সগর্জনে পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। কুমারগণ রঙ্গভূমিতে কি করছেন তার বিবরণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে এবং কুন্তী গান্ধারীকে জানাতে লাগলেন। দর্শকদের একদল ভীমের এবং আর একদল দুর্যোধনের পক্ষপাতী হওয়ায় জনমণ্ডলী যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল, সভায় কুরুরাজের জয়, ভীমের জয়, এইরূপ কোলাহল উঠল। তখন দ্রোণ তাঁর পুত্র অশ্বত্থামাকে বললেন, তুমি ওই দুই মহাবীরকে নিবারণ কর, যেন রঙ্গস্থলে ক্রোধের উৎপত্তি না হয়। অশ্বত্থামা গদাযুদ্ধে উদ্যত ভীম আর দুর্যোধনকে নিরস্ত করলেন।

 মেঘমন্দ্রতুল্য বাদ্যধ্বনি থামিয়ে দিয়ে দ্রোণ বললেন, যিনি আমার পুত্রের চেয়ে প্রিয়, সর্বাস্ত্রবিশারদ, উপেন্দ্রতুল্য, সেই অর্জুনের শিক্ষা আপনারা দেখুন। দর্শকগণ উৎসকে হ’য়ে অর্জুনের নানাপ্রকার প্রশংসা করতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, ক্ষুব্ধ সমুদ্রের ন্যায় হঠাৎ এই মহাশব্দ হচ্ছে কেন? বিদুর বললেন, পাণ্ডুনন্দন অর্জুন অবতীর্ণ হয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কুন্তীর তিন পুত্রের গৌরবে আমি ধন্য হয়েছি, অনুগৃহীত হয়েছি, রক্ষিত হয়েছি। অর্জন আগ্নেয় বারুণ বায়ব্য প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ দেখালেন। তার পর একটি ঘূর্ণমান লৌহবরাহের মুখে এককালে পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করলেন, রজ্জুলম্বিত গোশৃঙ্গের ভিতরে একুশটি বাণ প্রবিষ্ট করলেন, খড়্গ আর গদা হস্তে বিবিধ কৌশল দেখালেন।

 অর্জুনের কৌশলপ্রদর্শন শেষ হয়ে এসেছে এবং বাদ্যরবও মন্দীভূত হয়েছে এমন সময় দ্বারদেশে সহসা বজ্রধ্বনির ন্যায় বাহ্বাস্ফোট (তাল ঠোকার শব্দ) শোনা গেল। দ্বারপালরা পথ ছেড়ে দিলে কবচকুণ্ডলশোভিত মহাবিক্রমশালী কর্ণ পাদচারী পর্বতের ন্যায় রঙ্গভূমিতে এলেন এবং অধিক সম্মান না দেখিয়ে দ্রোণ ও কৃপকে প্রণাম করলেন। অর্জন যে তাঁর ভ্রাতা তা না জেনে কর্ণ বললেন, পার্থ, তুমি যা দেখিয়েছ তার সবই আমি দেখাব। এই ব’লে তিনি দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন যা যা করেছিলেন তাই ক’রে দেখালেন। দুর্যোধন আনন্দিত হ’য়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, মহাবাহু, তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, তুমি এই কুরুরাজ্য ইচ্ছামত ভোগ কর। কর্ণ বললেন, আমি তোমার সখ্য চাই, আর অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে চাই। দুর্যোধন বললেন, তুমি সখা হ’য়ে আমার সঙ্গে সমস্ত ভোগ কর আর শত্রুদের মাথায় পা রাখ।

 অর্জুন নিজেকে অপমানিত জ্ঞান ক’রে বললেন, কর্ণ, যারা অনাহূত হয়ে আসে আর অনাহূত হ’য়ে কথা বলে, তারা যে নরকে যায় আমি তোমাকে সেখানে পাঠাব। কর্ণ বললেন, এই রঙ্গভূমিতে সকলেরই আসবার অধিকার আছে। দুর্বলের ন্যায় আমার নিন্দা করছ কেন, যা বলবার শর দিয়েই বল। আজ গুরুর সমক্ষেই শরাঘাতে তোমার শিরশ্ছেদ করব। তার পর দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে কর্ণের সম্মুখীন হলেন, দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা কর্ণের পক্ষে গেলেন। ইন্দ্র ও সূর্য নিজ নিজ পুত্রকে দেখতে এলেন, অর্জুনের উপর মেঘের ছায়া এবং কর্ণের উপর সূর্যের কিরণ পড়ল। দ্রোণ কৃপ ও ভীষ্ম অর্জুনের কাছে গেলেন। রঙ্গভূমি দুই পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় স্ত্রীদের মধ্যেও দ্বৈধভাব উৎপন্ন হ’ল।

 কর্ণকে চিনতে পেরে কুন্তী মূর্ছিত হলেন, বিদুরের আজ্ঞায় দাসীরা চন্দনজল সেচন ক’রে তাঁকে প্রবুদ্ধ করলে। দুই পুত্রকে সশস্ত্র দেখে কুন্তী বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য কর্ণকে বললেন, এই অজর্ন কুরুবংশজাত, পাণ্ডুকুন্তীর পুত্র, ইনি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবেন। মহাবাহু কর্ণ, তুমি তোমার মাতা পিতার কুল বল, কোন রাজবংশের তুমি ভূষণ? তোমার পরিচয় পেলে অর্জুন যুদ্ধ করা বা না করা স্থির করবেন, রাজপুত্রেরা তুচ্ছকুলশীল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। কৃপের কথায় কর্ণ বর্ষাজলসিক্ত পদ্মের ন্যায় লজ্জায় মস্তক নত করলেন। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, অর্জুন যদি রাজা ভিন্ন অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চান তবে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করছি। দুর্যোধন তখনই কর্ণকে স্বর্ণময় পীঠে বসালেন, মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ লাজ পুষ্প স্বর্ণঘটের জল প্রভৃতি উপকরণে তাঁকে অভিষিক্ত করলেন।

 এমন সময় কর্ণের পালকপিতা অধিরথ ঘর্মাক্ত ও কম্পিত দেহে যষ্টিহস্তে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে কর্ণ ধনু ত্যাগ ক’রে নতমস্তকে প্রণাম করলেন, অধিরথ সসম্ভ্রমে তাঁর চরণ আবৃত[২৩] ক’রে পুত্রকে সস্নেহে আলিঙ্গন এবং তাঁর মস্তক অশ্রুজলে অভিষিক্ত করলেন। ভীম সহাস্যে বললেন, সূতপত্র, তুমি অর্জুনের হাতে মরবার যোগ্য নও, তুমি কশা হাতে নিয়ে কুলধর্ম পালন কর। কুকুর যজ্ঞের পুরোডাশ খেতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্য ভোগ করতে পার না। ক্রোধে কর্ণের ওষ্ঠ কম্পিত হ’তে লাগল। দুর্যোধন বললেন, ভীম, এমন কথা বলা তোমার উচিত হয় নি। দ্রোণাচার্য কলস থেকে এবং কৃপাচার্য শরস্তম্ব থেকে জন্মেছিলেন, আর তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে। কবচকুণ্ডলধারী সর্বলক্ষণযুক্ত কর্ণ নীচ বংশে জন্মাতে পারেন না। কেবল অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীই ইনি ভোগ করবার যোগ্য। যারা অন্যরূপ মনে করে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ক।

 এই সময়ে সূর্যাস্ত হ’ল। দুর্যোধন কর্ণের হাত ধ’রে রঙ্গভূমি থেকে প্রস্থান করলেন। পাণ্ডবগণ, দ্রোণ, কৃপ, ভীষ্ম প্রভৃতিও নিজ নিজ ভবনে চ’লে গেলেন। কর্ণ অঙ্গরাজ্য পেলেন দেখে কুন্তী আনন্দিত হলেন। যুধিষ্ঠিরের এই বিশ্বাস হ’ল যে কর্ণের তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে নেই।

২৪। দ্রুপদের পরাজয়—দ্রোণের প্রতিশোধ

 দ্রোণাচার্য শিষ্যগণকে বললেন, তোমাদের শিক্ষা শেষ হয়েছে, এখন আমার দক্ষিণা চাই। তোমরা যুদ্ধ করে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে নিয়ে এস, তাই শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা। রাজকুমারগণ সম্মত হলেন এবং দ্রোণকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্যে পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করলেন।

 দ্রুপদ রাজা ও তাঁর ভ্রাতৃগণ রথারোহণে এসে কৌরবগণের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। দুর্যোধন প্রভৃতির দর্প দেখে অর্জুন দ্রোণকে বললেন, ওরা দ্রুপদকে বন্দী করতে পারবে না। ওরা আগে নিজেদের বিক্রম দেখাক তার পর আমরা যুদ্ধে নামর। এই ব’লে তিনি নগর থেকে অর্ধ ক্রোশ দূরে ভ্রাতাদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 দ্রুপদের বাণবর্ষণে দুর্যোধনাদি ব্যতিব্যস্ত হলেন, তাঁদের সৈন্যের উপর নগরবাসী বালক বৃদ্ধ সকলে মিলে মূষল ও বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগল। কৌরবদের আর্তরব শুনে যুধিষ্ঠিরকে তাঁর ভ্রাতারা বললেন, আপনি যুদ্ধ করবেন না। এই ব’লে তাঁরা রথারোহণে অগ্রসর হলেন। ভীম কৃতান্তের ন্যায় গদাহস্তে ধাবিত হ’য়ে পাঞ্চালরাজের গজসৈন্য অশ্ব রথ প্রভৃতি ধ্বংস করতে লাগলেন। তার পর অর্জুনের সঙ্গে দ্রুপদ ও তাঁর ভ্রাতা সত্যজিতের ভীষণ যুদ্ধ হ’ল। অর্জুনের শরাঘাতে সত্যজিতের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হ’ল, সত্যজিৎ পলায়ন করলেন। তখন অর্জুন দ্রুপদের ধনু ও রথধ্বজ ছিন্ন এবং অশ্ব ও সারথিকে শরবিদ্ধ ক’রে খড়্গহস্তে লম্ফ দিয়ে তাঁর রথে উঠলেন। পাঞ্চাল সৈন্য দশ দিকে পালাতে লাগল। দ্রুপদকে ধ’রে অর্জুন ভীমকে বললেন, দ্রুপদ রাজা কুরবীরগণের আত্মীয়, তাঁর সৈন্য বধ করবেন না, আসুন, আমরা গুরুদক্ষিণা দেব।

 কুমারগণ দ্রুপদ আর তাঁর অমাত্যকে ধরে এনে দ্রোণকে দক্ষিণাস্বরূপ উপহার দিলেন। দ্রোণ বললেন, দ্রুপদ, আমি তোমার রাষ্ট্র দলিত ক’রে রাজপুরী অধিকার করেছি, তোমার জীবনও শত্রুর অধীন, এখন পূর্বের বন্ধুত্ব স্মরণ ক’রে কি চাও তা বল। তার পর দ্রোণ সহাস্যে বললেন, বীর প্রাণের ভয় ক’রো না, আমরা ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। তুমি বাল্যকালে আমার সঙ্গে খেলেছিলে, সেজন্য তোমার প্রতি আমার স্নেহ আছে। অরাজা রাজার সখা হ’তে পারে না, তোমাকে আমি অর্ধ রাজ্য দিচ্ছি, যদি ইচ্ছা কর তবে আমাকে সখা মনে করতে পার। দ্রুপদ বললেন, শক্তিমান মহাত্মার পক্ষে এমন আচরণ আশ্চর্য নয়, আমি প্রীত হয়েছি, আপনার চিরস্থায়ী প্রণয় কামনা করি। তখন দ্রোণাচার্য তুষ্ট হয়ে দ্রুপদকে মুক্তি দিলেন।

 গঙ্গার দক্ষিণে চর্মস্বতী নদী পর্যন্ত দেশ দ্রুপদের অধিকারে রইল, দ্রোণাচার্য গঙ্গার উত্তরে অহিচ্ছত্র দেশ পেলেন। মনঃক্ষুণ্ণ দ্রুপদ পুত্রলাভের জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।

২৫। ধৃতরাষ্ট্রের ঈর্ষা

 এক বৎসর পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ধৈর্য স্থৈর্য অনিষ্ঠুরতা সরলতা প্রভৃতি গুণে যুধিষ্ঠির তাঁর পিতা পাণ্ডুর কীর্তিও অতিক্রম করলেন। বৃকোদর[২৪] ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখতে লাগলেন। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়োগে পটুতা লাভ করলেন। সহদেব সর্বপ্রকার নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলেন। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও অতিরথ (যিনি অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন) এবং চিত্রযোধী (বিচিত্র যুদ্ধকারী) নামে খ্যাত হলেন। অর্জুন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ বহু দেশ জয় ক’রে নিজেদের রাজ্য বিস্তার করলেন।

 পাণ্ডবদের বিক্রমের খ্যাতি অতিশয় বৃদ্ধি পাচ্ছে শুনে ধৃতরাষ্ট্রের মন দূষিত হ’ল, দুশ্চিন্তার জন্য তাঁর নিদ্রার ব্যাঘাত হ’তে লাগল। তিনি মন্ত্রিশ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ কণিককে বললেন, দ্বিজোত্তম, পাণ্ডবদের খ্যাতি শুনে আমার অসূয়া হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সন্ধি বা বিগ্রহ কি কর্তব্য তা বলুন, আমি আপনার উপদেশ পালন করব।

 রাজনীতি বিষয়ক বিবিধ উপদেশের প্রসঙ্গে কণিক বললেন, মহারাজ, উপযুক্ত কাল না আসা পর্যন্ত অমিত্রকে কলসের ন্যায় কাঁধে বইবেন, তার পর সুযোগ এলেই তাকে পাথরের উপর আছড়ে ফেলবেন। যাঁকে দারুণ কর্ম করতে হবে তিনি বিনীত হয়ে হাস্যমুখে কথা বলবেন, কিন্তু হৃদয়ে ক্ষুরধার থাকবেন। মৎস্যজীবী যেমন বিনা অপরাধে মৎস্য হত্যা করে, সেইরূপ পরের মর্মচ্ছেদ ও নিষ্ঠুর কর্ম না ক’রে বিপুল ঐশ্বর্যলাভ হয় না। কুরুরাজ, আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ; নিজেকে রক্ষা করুন, যেন পাণ্ডবরা আপনার অনিষ্ট না করে; এমন উপায় করুন যাতে শেষে অনুতাপ করতে না হয়।

  1. এইখানে মহাভারতের মূল আখ্যানের আরম্ভ।
  2. এঁর প্রকৃত নাম কৃষ্ণ, দ্বীপে জাত এজন্য উপনাম দ্বৈপায়ন।
  3. অর্থাৎ প্রণয়িভাবে নয়, ভ্রাতৃভাবে।
  4. বহু আর্য প্রয়োগ আছে।
  5. কর্ণপর্ব ১৬-পরিচ্ছেদে অনুরূপ শ্লোক আছে।
  6. এঁদের কথা উদ্‌যোপর্ব ১৫-পরিচ্ছেদে আছে। সেখানে বসুমানকে বসুমনা বলা হয়েছে।
  7. বা দুষ্যন্ত।
  8. টীকাকার বলেন, মহাপুরুষগণ দীর্ঘকাল গর্ভে বাস করেন।
  9. দুষ্মন্ত নিজের কটূক্তির জন্য ক্ষমা চাইলেন না।
  10. ধীবরজাতি বিশেষ।
  11. যিনি ভীষণ অর্থাৎ দুঃসাধ্য কর্ম করেন।
  12. অম্বার পরবর্তী ইতিহাস উদ্‌যোগপর্ব ২৭-পরিচ্ছেদে আছে।
  13. পশুর তুল্য যত্র তত্র সংগম।
  14. অণী-শূলাদির অগ্রভাগ।
  15. আর একটি শ্লোকে দ্বাদশ আছে।
  16. ইনি কৃষ্ণের পিসী।
  17. কর্ণের কবচ-কুণ্ডল-দানের কথা বনপর্ব ৫৬-পরিচ্ছেদে বিবৃত হয়েছে।
  18. ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুজনেই কুরুবংশজাত সেজন্য কৌরব। তথাপি সাধারণত দুর্যোধনাদিকেই কৌরব এবং তাঁদের পক্ষকে কুরু বলা হয়।
  19. পুলির আকার কাষ্ঠখণ্ড, গুলিডাণ্ডা খেলার গুলি।
  20. মোরগ অথবা শকুন।
  21. মূলে ‘গ্রাহ’ আছে, তার অর্থ কুম্ভীর হাঙ্গর দুইই হয়।
  22. চর্ম—ঢাল।
  23. কর্ণ উচ্চজাতীয় এই সম্ভাবনায়।
  24. যাঁর উদরে বৃক বা জঠরাগ্নি আছে, বহুভোজী।