মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/বকবধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥বকবধপর্বাধ্যায়॥

২৮। একচক্রা—বকরাক্ষস

 পাণ্ডবগণ একচক্রা নগরে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে বাস করতে লাগলেন। তাঁরা ভিক্ষা ক’রে যা আনতেন, কুন্তী সেই সমস্ত খাদ্য দু ভাগ করতেন, এক ভাগ ভীম একাই খেতেন, অন্য ভাগ অপর চার ভ্রাতা ও কুন্তী খেতেন। এইরূপে বহু দিন গত হ’ল। একদিন যুধিষ্টিরাদি ভিক্ষা করতে গেছেন, কেবল ভীম আর কুন্তী গৃহে আছেন, এমন সময় তাঁরা তাঁদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আর্তনাদ শুনতে পেলেন। কুন্তী অন্তঃপুরে গিয়ে দেখলেন, ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী পুত্র ও কন্যার সঙ্গে বিষণ্ণমুখে রয়েছেন। ব্রাহ্মণ বলছিলেন, ধিক মানুষের জীবন যা নল-তৃণের ন্যায় অসার, পরাধীন ও সকল দঃখের মূল। ব্রাহ্মণী, আমি নিরাপদ স্থানে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দুর্বুদ্ধিবশত তোমার স্বর্গস্থ পিতামাতার এই গৃহ ছেড়ে যেতে চাও নি, তার ফলে এখন এই আত্মীয়নাশ হবে। যিনি আমার নিত্যসঙ্গিনী পতিব্রতা ধর্মপত্নী তাঁকে আমি ত্যাগ করতে পারি না, আমার বালিকা কন্যা বা পুত্রকেও ছাড়তে পারি না। যদি আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিই তবে তোমরাও মরবে। হায়, আমাদের গতি কি হবে, সকলের এক সঙ্গে মরাই ভাল।

 ব্রাহ্মণী বললেন, তুমি প্রাকৃত জনের ন্যায় বিলাপ করছ কেন? লোকে নিজের জন্যই পত্নী ও পুত্রকন্যা চায়। তুমি থাক, আমি যাব, তাতে আমার ইহলোকে যশ এবং পরলোকে অক্ষয় পুণ্য হবে। লোকে ভার্যার কাছে যা চায় সেই পুত্রকন্যা তুমি পেয়েছ, তোমার অভাবে আমি তাদের ভরণপোষণ করতে পারব না। ভূমিতে মাংস প’ড়ে থাকলে যেমন পাখিরা লোলুপ হয় তেমনই পতিহীনা নারীকে সকলে কামনা করে, দুরাত্মা পুরুষেরা হয়তো আমাকে সৎপথ থেকে বিচলিত করবে। এই কন্যার বিবাহ এবং পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা আমি কি ক’রে করব? আমার অভাবে তুমি অন্য পত্নী পাবে, কিন্তু আমার পক্ষে অন্য পতি গ্রহণ ঘোর অধর্ম। অতএব আমাকে যেতে দাও।

 এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীকে আলিঙ্গন করে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। তখন তাঁদের কন্যাটি বললে, একদিন আমাকে তো ছাড়তেই হবে, বরং এখনই আমাকে যেতে দাও, তাতে তোমরা সকলে নিস্তার পাবে, আমিও অমৃতলোক লাভ করব। বালক পুত্রটি উৎফুল্লনয়নে কলকণ্ঠে বললে, তোমরা কেঁদো না, আমি এই তৃণ দিয়ে সেই রাক্ষসকে বধ করব।

 কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের দুঃখের কারণ কি বলনে, যদি পারি তো দূর করতে চেষ্টা করব। ব্রাহ্মণ বললেন, এই নগরের নিকট বক নামে এক মহাবল রাক্ষস বাস করে, সেই এদেশের প্রভু। আমাদের রাজা তাঁর রাজধানী বেত্রকীয়গৃহে থাকেন, তিনি নির্বোধ ও দুর্বল, প্রজারক্ষার উপায় জানেন না। বক রাক্ষস এই দেশ রক্ষা করে, তার মূল্যস্বরূপ আমাদের প্রতিদিন একজন লোককে পাঠাতে হয়, সে প্রচুর অন্ন ও দুই মহিষ সঙ্গে নিয়ে যায়। বক সেই মানুষ মহিষ আর অন্ন ভোজন করে। আজ আমার পালা, আমার এমন ধন নেই যে অন্য কোনও মানুষকে কিনে নিয়ে রাক্ষসের কাছে পাঠাই। অগত্যা আমি স্ত্রী পুত্র কন্যাকে নিয়ে তার কাছে যাব, আমাদের সকলকেই সে খেয়ে ফেলুক।

 কুন্তী বললেন, আপনি দুঃখ করবেন না, আমার পাঁচ পুত্রের একজন রাক্ষসের কাছে যাবে। ব্রাহ্মণ বললেন, আপনারা আমার শরণাগত ব্রাহ্মণ অতিথি আমাদের জন্য আপনার পুত্রের প্রাণনাশ হ’তে পারে না। কুন্তী বললেন, আমার পুত্র বীর্যবান মন্ত্রসিদ্ধ ও তেজস্বী, সে রাক্ষসের খাদ্য পৌঁছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু আপনি কারও কাছে প্রকাশ করবেন না, কারণ মন্ত্রশিক্ষার জন্য লোকে আমার পুত্রের উপর উপদ্রব করবে। কুন্তীর কথা শুনে ব্রাহ্মণ অতিশয় হৃষ্ট হলেন। এমন সময় যুধিষ্ঠিরাদি ভিক্ষা নিয়ে ফিরে এলেন। ভীম রাক্ষসের কাছে যাবেন শুনে যুধিষ্ঠির মাতাকে বললেন, যাঁর বাহুবলের ভরসায় আমরা সুখে নিদ্রা যাই, যাঁর ভয়ে দুর্যোধন প্রভৃতি বিনিদ্র থাকে যিনি জতুগৃহ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন, সেই ভীমসেনকে আপনি কোন্ বুদ্ধিতে ত্যাগ করছেন? কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠির, ভীমের বল অযুত হস্তীর সমান, তার তুল্য বলবান কেউ নেই। এই ব্রাহ্মণের গৃহে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করছি, এঁর প্রত্যুপকার করা আমাদের কর্তব্য।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে ভীম অন্ন নিয়ে বক রাক্ষস যেখানে থাকে সেই বনে গেলেন এবং তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মহাবেগে ভীমের কাছে এসে দেখলে, ভীম অন্ন ভোজন করছেন। বক বললে, আমার অন্ন আমার সম্মুখেই কে খাচ্ছে, কোন্ দুর্বদ্ধির যমালয়ে যেতে ইচ্ছা হয়েছে? ভীম মুখ ফিরিয়ে হাসতে হাসতে খেতে লাগলেন। রাক্ষস দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করলে, কিন্তু ভীম গ্রাহ্য করলেন না। রাক্ষস একটা গাছ নিয়ে আক্রমণ করতে এল। ভীম ভোজন শেষ ক’রে আচমন ক’রে বাঁ হাতে রাক্ষসের নিক্ষিপ্ত গাছ ধ’রে ফেললেন। তখন দুজনে বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল, ভীম বক রাক্ষসকে ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট ক’রে বধ করলেন। রাক্ষসের চিৎকার শুনে তার আত্মীয় পরিজন ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভীম তাদের বললেন, তোমরা আর কখনও মানুষের হিংসা করবে না, যদি কর তবে তোমাদেরও প্রাণ যাবে। রাক্ষসরা ভীমের আদেশ মেনে নিলে। তারপর ভীম রাক্ষসের মৃতদেহ নগরের দ্বারদেশে ফেলে দিয়ে অন্যের অজ্ঞাতসারে ব্রাহ্মণের গৃহে ফিরে এলেন। নগরবাসীরা আশ্চর্য হয়ে ব্রাহ্মণের কাছে সংবাদ নিতে গেল। ব্রাহ্মণ বললেন, একজন মন্ত্রসিদ্ধ মহাত্মা আমাদের রোদনে দয়ার্দ্র হয়ে আমার পরিবর্তে রাক্ষসদের কাছে অন্ন নিয়ে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তিনিই তাকে বধ ক’রে সকলের হিতসাধন করেছেন।