মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্‌যোগপর্ব/সেনোদ্‌যোগপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

উদ্‌যোগপর্ব

॥ সেনোদ্‌যোগপর্বাধ্যায়॥

১। রাজ্যোদ্ধারের মন্ত্রণা

 অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহের পর রাত্রিতে বিশ্রাম ক’রে পাণ্ডবগণ প্রভাতকালে বিরাট রাজার সভায়[১] এলেন। এই সভায় বিরাট দ্রুপদ বসুদেব বলরাম কৃষ্ণ সাত্যকি প্রদ্যুম্ন শাম্ব বিরাটপুত্রগণ অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ নানাপ্রকার আলাপের পর সকলে কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন।

 কৃষ্ণ বললেন, আপনারা জানেন, শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় শঠতার দ্বার যুধিষ্ঠিরকে জয় ক’রে রাজ্য হরণ করেছিলেন। পাণ্ডবগণ বহু কষ্ট ভোগ ক’রে তাঁদের প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন, তাঁদের বার বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হয়েছে। এখন যা যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন দুজনেরই হিতকর এবং কৌরব ও পাণ্ডব উভয়ের পক্ষে ধর্মসম্মত যুক্তিসিদ্ধ ও যশস্কর, তা আপনারা ভেবে দেখুন। যুধিষ্ঠির ধর্মবিরুদ্ধ উপায়ে সুররাজ্যও চান না, বরং তিনি ধর্ম সম্মত উপায়ে একটিমাত্র গ্রামের স্বামিত্বই বাঞ্ছনীয় মনে করেন। দুর্যোধনাদি প্রতারণা ক’রে পাণ্ডবগণের পৈতৃক রাজ্য হরণ করেছেন, তথাপি যুধিষ্ঠির তাঁদের শুভ কামনা করেন। এঁরা সত্যপরায়ণ, নিজেদের প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন, এখন যদি ন্যায্য ব্যবহার না পান তবে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে বধ করবেন। যদি আপনারা মনে করেন যে পাণ্ডবগণ সংখ্যায় অল্প সেজন্য জয়লাভে সমর্থ হবেন না, তবে আপনারা মিলিত হয়ে এমন চেষ্টা করুন যাতে এঁদের শত্রুরা বিনষ্ট হয়। কিন্তু আমরা এখনও জানি না দুর্যোধনের অভিপ্রায় কি, তা না জেনেই আমরা কর্তব্য স্থির করতে পারি না। অতএব কোনও ধার্মিক সৎস্বভাব সদ্‌বংশীর সতর্ক দূতকে পাঠানো হ’ক, যাঁর কথায় দুর্যোধন প্রশমিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে অর্ধরাজ্য দিতে সম্মত হবেন।

 বলরাম বললেন, কৃষ্ণের বাক্য যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন উভয়েরই হিতকর। শান্তির উদ্দেশ্যে কোনও লোককে দুর্যোধনের কাছে পাঠানোই ভাল। তিনি গিয়ে ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণ অশ্বত্থামা বিদুর কৃপ শকুনি কর্ণ ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে প্রণিপাত ক’রে যুধিষ্ঠিরের সপক্ষে বলবেন। দুর্যোধনাদি যেন কোনও মতেই ক্রুদ্ধ না হন, কারণ তাঁরা বলবান, যুধিষ্ঠিরের রাজ্য তাঁদের গ্রাসে রয়েছে। যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয় কিন্তু অজ্ঞ, সুহৃদ্‌গণের বারণ না শুনে দ্যূতনিপুণ শকুনিকে আহ্বান করেছিলেন। দ্যূতসভায় বহু লোক ছিল যাদের ইনি হারাতে পারতেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে না খেলে ইনি সুবলপুত্র শকুনির সঙ্গেই খেলতে গেলেন এবং প্রমত্ত হয়ে রাজ্য হারালেন। খেলবার সময় যুধিষ্ঠিরের পাশা প্রতিকূল হয়ে পড়ছিল, বার বার হেরে গিয়ে ইনি ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। শকুনি নিজের শক্তিতেই এঁকে পরাস্ত করেছিলেন, তাতে তাঁর কোনও অপরাধ হয় নি। যদি আপনারা শান্তি চান তবে মিষ্টবাক্যে দুর্যোধনকে প্রসন্ন করুন। সাম নীতিতে যা পাওয়া যায় তাই অর্থকর, যুদ্ধ অন্যায় ও অনর্থকর।

 সাত্যকি বললেন, তোমার যেমন স্বভাব তেমন কথা বলছ। বীর ও কাপুরুষ দুইপ্রকার লোকই দেখা যায়, একই বংশে ক্লীব ও বলশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে। হলধর, তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, যাঁরা তোমার বাক্য শোনেন তাঁরাই দোষী। আশ্চর্যের বিষয়, এই সভায় কেউ ধর্মরাজের অল্পমাত্র দোষের কথাও বলতে পারে! অক্ষনিপুণ কৌরবগণ অনভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে ডেকে এনে পরাজিত করেছিল, এমন জয়কে কোন্ যুক্তিতে ধর্মসঙ্গত বলা যেতে পারে? যুধিষ্ঠির যদি নিজের ভবনে ভ্রাতাদের সঙ্গে খেলতেন এবং দুর্যোধনাদি সেই খেলায় যোগ দিয়ে জয়লাভ করতেন তবেই তা ধর্মসঙ্গত হ’ত। যুধিষ্ঠির কপট দ্যূতে পরাজিত হয়েছিলেন, তথাপি ইনি পণ রক্ষা করেছেন। এখন বনবাস থেকে ফিরে এসে ন্যায়ানুসারে পিতৃরাজ্যের অধিকার চান, তার জন্য প্রণিপাত করবেন কেন? এঁরা যথাযথ প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন তথাপি কৌরবরা বলে যে এঁরা অজ্ঞাতবাসকালে ধরা পড়েছিলেন। ভীষ্ম দ্রোণ ও বিদুর অনুনয় করেছেন তথাপি ধার্তরাষ্ট্রগণ রাজ্য ফিরে দিতে চায় না। আমি তাদের যুদ্ধে জয় ক’রে মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের চরণে নিপাতিত করব, যদি তারা প্রণিপাত না করে তবে তাদের যমালয়ে পাঠাব। আততায়ী শত্রুকে হত্যা করলে অধর্ম হয় না, তাদের কাছে অনুনয় করলেই অধর্ম ও অপযশ হয়। তারা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য ফিরিয়ে দিক, নতুবা নিহত হয়ে রণভূমিতে শয়ন করুক।

 দ্রুপদ বললেন, মহাবাহু সাত্যকি, দুর্যোধন ভাল কথায় রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন না। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্রের বশেই চলবেন, ভীষ্ম ও দ্রোণ দীনতার জন্য এবং কর্ণ ও শকুনি মূর্খতার জন্য দুর্যোধনের অনুবর্তী হবেন। বলদেব যা বললেন তা যুক্তিসম্মত মনে করি না, যাঁরা ন্যায়পরায়ণ তাঁদের কাছেই অনুনয় করা চলে। দুর্যোধন পাপবুদ্ধি, মৃদুবাক্যে তাঁকে বশ করা যাবে না, মৃদুভাষীকে তিনি শক্তিহীন মনে করবেন। অতএব সৈন্যসংগ্রহের জন্য মিত্রগণের নিকট দূত পাঠানো হ’ক। দুর্যোধনও দূত পাঠাবেন, রাজারা যে পক্ষের আমন্ত্রণ আগে পাবেন সেই পক্ষেই যাবেন, এই কারণে আমাদের ত্বরান্বিত হ’তে হবে। বিরাটরাজ, আমার পুরোহিত এই ব্রাহ্মণ শীঘ্র হস্তিনাপুরে যান, ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন ভীষ্ম ও দ্রোণকে ইনি কি বলবেন তা আপনি শিখিয়ে দিন।

 কৃষ্ণ বললেন, কৌরব আর পাণ্ডবদের সঙ্গে আমাদের সমান সম্বন্ধ। আমরা এখানে বিবাহের নিমন্ত্রণে এসেছি; বিবাহ হয়ে গেছে, এখন আমরা সানন্দে নিজ গৃহে ফিরে যাব। দ্রুপদরাজ, আপনি বয়সে ও জ্ঞানে বৃদ্ধতম, ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে সম্মান করেন, আপনি আচার্য দ্রোণ ও কৃপের সখা অতএব পাণ্ডবগণের হিতকর হয় এমন বার্তা আপনিই পুরোহিত দ্বারা পাঠিয়ে দিন। দুর্যোধন যদি ন্যায়পথে চলেন তা হ’লে কুরুপাণ্ডবের সৌভ্রাত্র নষ্ট হবে না। তিনি যদি দর্প ও মোহের বশে শান্তিকামনা না করেন তবে আপনি সকল রাজার কাছে দ্ত পাঠাবার পর আমাদের আহ্বান করবেন।

 তার পর বিরাটের নিকট সসম্মানে বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ সবান্ধবে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন। যুধিষ্ঠির বিরাট ও দ্রুপদ প্রভৃতি যুদ্ধের আয়োজন করতে লাগলেন এবং নানা দেশের রাজাদের নিকট দূত পাঠালেন। আমন্ত্রণ পেয়ে রাজারা সানন্দে আসতে লাগলেন। পাণ্ডবগণ বলসংগ্রহ করছেন শুনে দুর্যোধনও তাঁর মিত্রগণকে আহ্বান করলেন।

 যুধিষ্ঠিরের মত নিয়ে দ্রুপদ তাঁর পুরোহিতকে বললেন, আপনি সৎকুলজাত বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী, দুর্যোধনের আচরণ সবই জানেন। আপনি যদি ধৃতরাষ্ট্রকে ধর্মসম্মত বাক্যে বোঝাতে পারেন তবে দুর্যোধনাদিরও মনের পরিবর্তন হবে। বিদুর আপনার সমর্থন করবেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতিরও ভেদবুদ্ধি হবে। অমাত্যগণ যদি ভিন্ন মত অবলম্বন করেন এবং যোদ্ধারা যদি বিমুখ হন তবে তাঁদের পুনর্বার স্বমতে আনা দুর্যোধনের পক্ষে দুরূহ হবে, তাঁর সৈন্যসংগ্রহে বাধা পড়বে। সেই অবকাশে পাণ্ডবগণের যুদ্ধায়োজন অগ্রসর হবে। আমাদের এখন প্রধান প্রয়োজন এই, যে আপনি ধর্মসংগত যুক্তির দ্বারা ধৃতরাষ্ট্রকে স্বমতে আনবেন। অতএব পাণ্ডবগণের হিতের নিমিত্ত আপনি পুষ্যা নক্ষত্রের যোগে জয়সূচক শুভ মুহূর্তে সত্বর যাত্রা করুন। দ্রুপদ কর্তৃক এইরূপে উপদিষ্ট হয়ে পুরোহিত তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।

২। কৃষ্ণ-সকাশে দুর্যোধন ও অর্জুন ― বলরাম ও দুর্যোধন

 অন্যান্য দেশে দূত পাঠাবার পর অর্জুন স্বয়ং দ্বারকায় যাত্রা করলেন। পাণ্ডবগণ কি করছেন তার সমস্ত সংবাদ দুর্যোধন তাঁর গুপ্তচরদের কাছে পেতেন। কৃষ্ণ-বলরাম প্রভৃতি স্বভবনে ফিরে গেছেন শুনে দুর্যোধন অল্প সৈন্য নিয়ে অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে দ্বারকায় এলেন। অর্জুনও সেই দিন সেখানে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ নিদ্রিত আছেন জেনে দুর্যোধন ও অর্জুন তাঁর শয়নকক্ষে গেলেন। প্রথমে দুর্যোধন এসে কৃষ্ণের মস্তকের নিকটে একটি উৎকৃষ্ট আসনে বসলেন, তার পর অর্জুন এসে কৃষ্ণের পাদদেশে বিনীতভাবে কৃতাঞ্জলি হয়ে রইলেন।

 জাগরিত হয়ে কৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে দেখলেন, তার পর পিছন দিকে দৃষ্টিপাত ক’রে সিংহাসনে উপবিষ্ট দুর্যোধনকে দেখলেন। তিনি স্বাগত সম্ভাষণ ক’রে দুজনের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে দুর্যোধন সহাস্যে বললেন, মাধব, আসন্ন যুদ্ধে তুমি আমার সহায় হও। আমার আর অর্জুনের সঙ্গে তোমার সমান সখ্য, সমান সম্বন্ধ[২]। আমি আগে তোমার কাছে এসেছি, সাধুজন প্রথমাগতকেই বরণ করেন, তুমি সজ্জনশ্রেষ্ঠ, অতএব সদাচার রক্ষা কর।

 কৃষ্ণ বললেন, রাজা, তুমি প্রথমে এসেছ তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি ধনঞ্জয়কেই প্রথমে দেখেছি, অতএব দুজনকেই সাহায্য করব। যারা বয়ঃকনিষ্ঠ তাদের অভীষ্টপুরণ আগে করা উচিত, সেজন্য প্রথমে অর্জুনকে বলছি।— নারায়ণ নামে খ্যাত আমার দশ কোটি গোপ যোদ্ধা আছে, তাদের দৈহিক বল আমারই তুল্য। পার্থ, তুমি সেই দুর্ধর্ষ নারায়ণী সেনা চাও, না যুদ্ধবিমুখ নিরস্ত্র আমাকে চাও? তুমি বার বার ভেবে দেখ— যুদ্ধে সাহায্যের জন্য দশ কোটি যোদ্ধা নেবে, কিংবা কেবল সচিবরূপে আমাকে নেবে?

 কৃষ্ণ যুদ্ধ করবেন না জেনেও অর্জুন তাঁকেই বরণ করলেন। দুর্যোধন দশ কোটি যোদ্ধা নিলেন এবং পরম আনন্দে মনে করলেন যেন কৃষ্ণকেই পেয়েছেন। তার পর বলরামের কাছে গিয়ে দুর্যোধন তাঁর আসবার কারণ জানালেন। বলরাম বললেন, বিরাটভবনে বিবাহের পর আমি যা বলেছিলাম তা বোধ হয় তুমি জান। তোমার জন্যই আমি বার বার কৃষ্ণকে বাধা দিয়ে বলেছিলাম যে দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের সমান সম্বন্ধ। কিন্তু তিনি আমার মত গ্রহণ করেন নি, আমিও তাঁকে ছেড়ে ক্ষণকালও থাকতে পারি না। কৃষ্ণের মতিগতি দেখে আমি স্থির করেছি যে আমি পার্থের সহায় হব না, তোমারও সহায় হব না। পুরুষশ্রেষ্ঠ, তুমি মহামান্য ভরতবংশে জন্মেছ, যাও, ক্ষত্রধর্ম অনুসারে যুদ্ধ কর। দুর্যোধন বলরামকে আলিঙ্গন ক’রে বিদায় নিলেন। তিনি মনে করলেন যে কৃষ্ণ তাঁর বশে এসেছেন, যুদ্ধেও তাঁর জয় হয়েছে। তার পর তিনি কৃতবর্মা[৩]র সঙ্গে দেখা করলেন এবং তাঁর কাছে এক অক্ষৌহিণী সৈন্য লাভ করলেন।

 দুর্যোধন চ’লে গেলে কৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি যুদ্ধ করব না তথাপি তুমি আমাকে বরণ করলে কেন? অর্জুন বললেন, নরোত্তম, তুমি একাকীই আমাদের সমস্ত শত্রু সংহার করতে পার এবং তোমার যশও লোকবিখ্যাত। আমিও শত্রুসংহারে সমর্থ এবং যশের প্রার্থী, এই কারণেই তোমাকে বরণ করেছি। আমার চিরকালের ইচ্ছা তুমি আমার সারথি হবে, এই কার্যে তুমি সম্মত হও। বাসুদেব বললেন, পার্থ, তুমি যে আমার সঙ্গে স্পর্ধা কর তা তোমারই উপযুক্ত। আমি সারথি হযে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করব। তার পর কৃষ্ণ ও দাশার্হ[৪] বীরগণের সঙ্গে অর্জুন আনন্দিতমনে যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

৩। শল্য, দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠির

 আমন্ত্রণ পেয়ে মদ্ররাজ শল্য[৫] তাঁর বৃহৎ সৈন্যদল ও মহাবীর পুত্রগণকে নিয়ে পাণ্ডবগণের নিকট যাচ্ছিলেন। এই সংবাদ শুনে দুর্যোধন পথিমধ্যে তাঁর সংবর্ধনার উদ্‌যোগ করলেন। তাঁর আদেশে শিল্পিগণ স্থানে স্থানে বিচিত্র সভামণ্ডপ, কূপ, দীর্ঘিকা, পাকশালা প্রভৃতি নির্মাণ করলে। নানাপ্রকার ক্রীড়া এবং খাদ্যপানীয়েরও আয়োজন করা হ’ল। শল্য উপস্থিত হ’লে দুর্যোধনের সচিবগণ তাঁকে দেবতার ন্যায় পূজা করলেন। শল্য বললেন, যুধিষ্ঠিরের কোন্ কর্মচারিগণ এই সকল সভা নির্মাণ করেছে? তাদের ডেকে আন, যুধিষ্ঠিরের সম্মতি নিয়ে আমি তাদের পারিতোষিক দিতে ইচ্ছা করি। দুর্যোধন অন্তরালে ছিলেন, এখন শল্যের কাছে এলেন। দুর্যোধনই সমস্ত আয়োজন করেছেন জেনে শল্য প্রীত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, তোমার কি অভীষ্ট বল, আমি তা পূর্ণ করব।

 দুর্যোধন বললেন, আপনার বাক্য সত্য হ’ক, আপনি আমার সমস্ত সেনার নেতৃত্ব করুন। শল্য বললেন, তাই হবে; আর কি চাও? দুর্যোধন বললেন, আমি কৃতার্থ হয়েছি, আর কিছু চাই না। শল্য বললেন, দুর্যোধন, তুমি এখন নিজ দেশে ফিরে যাও, আমি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, আপনি দেখা ক’রে শীঘ্র আমাদের কাছে আসবেন, আমরা আপনারই অধীন, যে বর দিয়েছেন তা মনে রাখবেন। দুর্যোধনকে আশ্বাস দিয়ে শল্য উপপ্লব্য নগরে যাত্রা করলেন।

 পাণ্ডবগণের শিবিরে এসে শল্য যুধিষ্ঠিরাদিকে আলিঙ্গন ও কুশলপ্রশ্ন করলেন এবং কিছুক্ষণ আলাপের পর দুর্যোধনকে যে বর দিয়েছেন তা জানালেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি দুর্যোধনের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা ভালই। এখন আমার একটি উপকার করুন, যদি অকর্তব্য মনে করেন তথাপি আমাদের মঙ্গলের জন্য তা আপনাকে করতে হবে। আপনি যুদ্ধে বাসুদেবের সমান, কর্ণ আর অর্জুনের যখন দ্বৈরথ যুদ্ধ হবে তখন আপনি নিশ্চয় কর্ণের সারথি হবেন। আপনি অর্জুনকে রক্ষা করবেন, এবং যদি আমার প্রিয়কার্য করতে চান তবে কর্ণের তেজ নষ্ট করবেন। মাতুল, অকর্তব্য হ’লেও এই কর্ম আপনি করবেন।

 শল্য বললেন, আমি নিশ্চয়ই দুরাত্মা কর্ণের সারথি হব। সে আমাকে কৃষ্ণতুল্য মনে করে, যদ্ধকালে আমি তাকে এমন প্রতিকূল ও অহিতকর বাক্য বলব যে তার দর্প ও তেজ নষ্ট হবে এবং অর্জুন তাকে অনায়াসে বধ করতে পারবেন। বৎস, তুমি যা বলেছ তা আমি করব, এবং তোমার প্রিয়কার্য আর যা পারব তাও করব। যুধিষ্ঠির, তুমি ও কৃষ্ণা দ্যূতসভায় যে দুঃখ পেয়েছ, সূতপত্র কর্ণের কাছে যে নিষ্ঠুর বাক্য শুনেছ, জটাসুর ও কীচকের কাছে দ্রৌপদী যে ক্লেশ পেয়েছেন, সে সমস্তের ফল পরিণামে সুখজনক হবে। মহাত্মা ও দেবতারাও দুঃখভোগ করেন, কারণ দৈবই প্রবল। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর ভার্যার সঙ্গে মহৎ দুঃখভোগ করেছিলেন।

৪। ত্রিশিরা, বৃত্র, ইন্দ্র, নহুষ ও অগস্ত্য

 যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, মহারাজ, ইন্দ্র ও তাঁর ভার্যা কি প্রকারে দুঃখভোগ করেছিলেন? শল্য এই উপাখ্যান বললেন।—

 ত্বষ্টা নামে এক প্রজাপতি ছিলেন, তিনি ইন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হয়ে ত্রিশিরা নামক এক পুত্রের জন্ম দিলেন। ত্রিশিরার তিন মুখ সূর্য চন্দ্র ও অগ্নির ন্যায়; তিনি এক মুখে বেদাধ্যয়ন, আর এক মুখে সুরাপান এবং তৃতীয় মুখে যেন সর্বদিক গ্রাস ক’রে নিরীক্ষণ করতেন। ইন্দ্রত্বলাভের জন্য ত্রিশিরা কঠোর তপস্যায় রত হলেন। তাঁর তপোভঙ্গের জন্য ইন্দ্র বহু অপ্সরা পাঠালেন, কিন্তু ত্রিশিরা বিচলিত হলেন না, তখন তাঁকে মারবার জন্য ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলেন। ত্রিশিরা নিহত হলেন, কিন্তু তাঁর মস্তক জীবিতের ন্যায় রইল। ইন্দ্র ভীত হয়ে একজন বর্ধকী (ছুতোর)কে বললেন, তুমি কুঠার দিয়ে এর মস্তক ছেদন কর। বর্ধকী বললে, এর স্কন্ধ অতি বৃহৎ, আমার কুঠারে কাটা যাবে না, এমন বিগর্হিত কর্মও আমি পারব না। কে আপনি? এই ঋষিপুত্রকে হত্যা করে আপনার ব্রহ্মহত্যার ভয় হচ্ছে না? ইন্দ্র বললেন, আমি দেবরাজ, এই মহাবল পুরুষ আমার শত্রু, সেজন্য বজ্রাঘাতে একে বধ করেছি, পরে আমি কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করব। বর্ধকী, তুমি শীঘ্র এর শিরশ্ছেদ কর, আমি তোমার প্রতি অনুগ্রহ করব; লোকে যখন যজ্ঞ করবে তখন নিহত পশুর মুণ্ড তোমাকে দেবে। বর্ধকী সম্মত হয়ে ত্রিশিরার তিন মুণ্ড কেটে ফেললে। প্রথম মুণ্ডের মুখ থেকে চাতক পক্ষীর দল, দ্বিতীয় মুখ থেকে চটক ও শোন, এবং তৃতীয় মুখ থেকে তিত্তির পক্ষীর দল নির্গত হ’ল। ইন্দ্র হৃষ্ট হয়ে স্বগৃহে চ’লে গেলেন।

 পুত্রের নিধনসংবাদ পেয়ে ত্বষ্টা অত্যন্ত রুদ্ধ হলেন এবং ইন্দ্রের বিনাশের নিমিত্ত অগ্নিতে আহুতি দিয়ে বৃত্রাসুরকে সৃষ্টি করলেন। ত্বষ্টার আজ্ঞায় বৃত্র স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রকে গ্রাস করলেন। দেবতারা উদ্‌বিগ্ন হয়ে জৃম্ভিকা (হাই) সৃষ্টি করলেন, তার প্রভাবে বৃত্র মুখব্যাদান করলেন, ইন্দ্রও দেহ সংকুচিত ক’রে বেরিয়ে এলেন। তার পর ইন্দ্র বৃত্রের সঙ্গে বহুকাল যুদ্ধ করলেন, কিন্তু তাকে দমন করতে না পেরে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু বললেন, দেবতা ঋষি ও গন্ধর্বদের নিয়ে তুমি বৃত্রের কাছে যাও, তার সঙ্গে সন্ধি কর। এই উপায়েই তুমি জয়লাভ করবে। আমি অদৃশ্যভাবে তোমার সঙ্গে অধিষ্ঠান করব।

 ঋষিরা বৃত্রের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি দুর্জয় বীর, তোমার তেজে জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু তুমি ইন্দ্রকে জয় করতে পার নি, দীর্ঘকাল যুদ্ধের ফলে দেবাসুর মানুষ সকলেই পীড়িত হয়েছে। অতএব ইন্দ্রের সহিত সখ্য কর, তাতে তুমি সুখ ও অক্ষয় স্বর্গলোক লাভ করবে। বৃত্র বললেন, আপনারা যদি এই ব্যবস্থা করেন যে শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু দ্বারা, প্রস্তর বা কাঠ বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা, দিবসে বা রাত্রিতে, আমি ইন্দ্রাদি দেবতার বধ্য হব না, তবেই আমি সন্ধি করতে পারি। ঋষিরা বললেন, তাই হবে। বৃত্রের সঙ্গে সন্ধি ক’রে ইন্দ্র চ’লে গেলেন।

 একদিন ইন্দ্র সমুদ্রতীরে বৃত্রাসরকে দেখতে পেলেন। ইন্দ্র ভাবলেন, এখন সন্ধ্যাকাল, দিনও নয় রাত্রিও নয়; এই পর্বতাকার সমুদ্রফেন শুষ্কও নয় আর্দ্র ও নয়, অস্ত্রও নয়। এই স্থির ক’রে ইন্দ্র বৃত্রের উপরে বজ্রের সহিত সমুদ্রফেন নিক্ষেপ করলেন। বিষ্ণু সেই ফেনে প্রবেশ ক’রে বৃত্রকে বধ করলেন। পূর্বে ত্রিশিরাকে বধ ক’রে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপ করেছিলেন, এখন আবার মিথ্যাচার ক’রে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। মহাদেবের ভূতরা ইন্দ্রকে বার বার ব্রহ্মহত্যাকারী ব’লে লজ্জা দিতে লাগল। অবশেষে ইন্দ্র নিজের দুষ্কৃতির জন্য অচেতনপ্রায় হয়ে জলমধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে বাস করতে লাগলেন। ইন্দ্রের অন্তর্ধানে পৃথিবী বিধ্বস্ত, কানন শুষ্ক এবং নদীর স্রোত রুদ্ধ হ’ল, জলাশয় শুখিয়ে গেল, অনাবৃষ্টি ও অরাজকতার ফলে সকল প্রাণী সংক্ষুব্ধ হ’ল। দেবতা ও মহর্ষিরা ত্রস্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন, কে আমাদের রাজা হবেন। কিন্তু কোনও দেবতা দেবরাজের পদ নিতে চাইলেন না।

 অবশেষে দেবগণ ও মহর্ষিগণ তেজস্বী যশস্বী ধার্মিক নহুষকে বললেন, তুমিই দেবরাজ হও। নহুষ বললেন, আমি দুর্বল, ইন্দ্রের তুল্য নই। দেবতা ও ঋষিরা বললেন, তুমি আমাদের তপঃপ্রভাবে বলশালী হয়ে স্বর্গরাজ্য পালন কর। নহুষ অভিষিক্ত হয়ে ধর্মানুসারে সর্বলোকের আধিপত্য করতে লাগলেন। তিনি প্রথমে ধার্মিক ছিলেন কিন্তু পরে কামপরায়ণ ও বিলাসী হয়ে পড়লেন। একদিন তিনি শচীকে দেখে সভাসদ্‌গণকে বললেন, ইন্দ্রমহিষী আমার সেবা করেন না কেন? উনি সত্বর আমার গৃহে আসুন। শচী উদ্‌বিগ্ন হয়ে বৃহস্পতির কাছে গিয়ে বললেন, আমাকে রক্ষা করুন। বৃহস্পতি তাঁকে আশ্বস্ত ক’রে বললেন, ভয় পেয়ো না, শীঘ্রই তুমি ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হবে।

 শচী বৃহস্পতির শরণ নিয়েছেন জেনে নহুষ ক্রুদ্ধ হলেন। দেবগণ ঋষিগণ তাঁকে বললেন, তুমি ক্রোধ সংবরণ কর, পরস্ত্রীসংসর্গের পাপ থেকে নিবৃত্ত হও; তুমি দেবরাজ, ধর্মানুসারে প্রজাপালন কর। নহুষ বললেন, ইন্দ্র যখন গৌতমপত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন এবং আরও অনেক ধর্মবিরুদ্ধ নৃশংস ও শঠতাময় কার্য করেছিলেন তখন আপনারা বারণ করেন নি কেন? শচী আমার সেবা করুন, তাতে তাঁর ও আপনাদের মঙ্গল হবে। দেবতারা বৃহস্পতির কাছে গিয়ে বললেন, আপনি ইন্দ্রাণীকে নহুষের হস্তে সমর্পণ করুন, তিনি ইন্দ্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বরবর্ণিনী শচী তাঁকেই এখন পতিত্বে বরণ করুন। শচী কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। বৃহস্পতি বললেন, ইন্দ্রাণী, আমি শরণাগতকে ত্যাগ করি না, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। দেবগণ, তোমরা চ’লে যাও।

 দেবতারা বললেন, কি করলে সকলের পক্ষে ভাল হয় আপনি বলুন। বৃহস্পতি বললেন, ইন্দ্রাণী নহুষের কাছে কিছুকাল অবকাশ প্রার্থনা করুন, তাতে সকলের শুভ হবে। কালক্রমে বহু বিঘ্ন ঘটে, নহুষ বলশালী ও দর্পিত হ’লেও কালই তাঁকে কালসদনে পাঠাবে। শচী নহুষের কাছে গেলেন এবং কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলি হ’য়ে বললেন, সুরেশ্বর, আমাকে কিছুকাল অবকাশ দিন। ইন্দ্র কোথায় কি অবস্থায় আছেন আমি জানি না; অনুসন্ধান ক’রেও যদি তাঁর সংবাদ না পাই তবে নিশ্চয় আপনার সেবা করব। নহুষ সম্মত হলেন, শচীও বৃহস্পতির কাছে ফিরে গেলেন।

 তার পর দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, আপনার বীর্যেই বৃত্র নিহত হয়েছে এবং তার ফলে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপে পড়েছেন। এখন তাঁর মুক্তির উপায় বলুন। বিষ্ণু বললেন, ইন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞে আমার পূজা করুন, তাতে তিনি পাপমুক্ত হ’য়ে দেবরাজত্ব ফিরে পাবেন, দুর্মতি নহুষও বিনষ্ট হবে। দেবগণ ও বৃহস্পতি প্রভৃতি ঋষিগণ ইন্দ্রের কাছে গিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন এবং তার ফলে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হলেন। তাঁর পাপ বিভক্ত হ’য়ে বৃক্ষ নদী পর্বত ভূমি স্ত্রী ও প্রাণিগণে সংক্রামিত হ’ল।

 দেবরাজপদে নহুষকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত দেখে ইন্দ্র পুনর্বার আত্মগোপন ক’রে কালপ্রতীক্ষা করতে লাগলেন। শোকার্তা শচী তখন উপশ্রুতি নাম্নী রাত্রিদেবীর উপাসনা করলেন। উপশ্রুতি মূর্তিমতী হ’য়ে দর্শন দিলেন এবং শচীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রমধ্যে এক মহাদ্বীপে উপস্থিত হলেন। সেই দ্বীপের মধ্যে শত যোজন বিস্তীর্ণ সরোবরে উন্নত বৃন্তের উপরে একটি শ্বেতবর্ণ বৃহৎ পদ্ম ছিল। উপশ্রুতির সঙ্গে শচী সেই পদ্মের নাল ভেদ ক’রে ভিতরে গিয়ে দেখলেন, মৃণালসূত্রের মধ্যে ইন্দ্র অতি সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করছেন। শচী তাঁকে বললেন, প্রভু, তুমি যদি আমাকে রক্ষা না কর, তবে নহুষ আমাকে বশে আনবে। তুমি স্বমূর্তিতে প্রকাশিত হও এবং নিজ বলে পাপিষ্ঠ নহুষকে বধ ক’রে দেবরাজ্য শাসন কর।

 ইন্দ্র বললেন, বিক্রম প্রকাশের সময় এখনও আসেনি, নহুষ আমার চেয়ে বলবান, ঋষিরাও হব্য কব্য দিয়ে তার শক্তি বাড়িয়েছেন। তুমি নির্জনে নহুষকে এই কথা বল—জগৎপতি, আপনি ঋষিবাহিত যানে আমার নিকট আসুন, তা হ’লে আমি সানন্দে আপনার বশীভূত হব। শচী নহুষের কাছে গিয়ে বললেন, দেবরাজ, আপনি যদি আমার একটি ইচ্ছা পূর্ণ করেন তবে আপনার বশগামিনী হব। আপনি এমন বাহনে চড়ুন যা বিষ্ণু রুদ্র বা কোনও দেবতা বা রাক্ষসের নেই। আমার ইচ্ছা, মহাত্মা ঋষিগণ মিলিত হয়ে আপনার শিবিকা বহন করুন। নহুষ বললেন, বরবর্ণিনী, তুমি অপূর্ব বাহনের কথা বলেছ, আমি তোমার কথা রাখব।

 ঐরাবত প্রভৃতি দিব্য হস্তী, হংসযুক্ত বিমান ও দিব্যাশ্বযোজিত রথ ত্যাগ ক’রে নহুষ মহর্ষিগণকে তাঁর শিবিকাবহনে নিযুক্ত করলেন। তখন বৃহস্পতি অগ্নিকে বললেন, তুমি ইন্দ্রের অন্বেষণ কর। অগ্নি সর্বত্র অন্বেষণ ক’রে বললেন, ইন্দ্রকে কোথাও দেখলাম না, কেবল জল অবশিষ্ট আছে, কিন্তু তাতে প্রবেশ করলে আমি নির্বাপিত হব। অগ্নির স্তুতি ক’রে বৃহস্পতি বললেন, নিঃশঙ্কে জলে প্রবেশ কর, তোমাকে আমি সনাতন ব্রাহ্ম মন্ত্রে বর্ধিত করব। অগ্নি সর্বপ্রকার জলে অন্বেষণ ক’রে অবশেষে পদ্মের মৃণালমধ্যে ইন্দ্রকে দেখতে পেলেন এবং ফিরে এসে বৃহস্পতিকে জানালেন। তখন দেবতা ঋষি ও গন্ধর্বদের সঙ্গে বৃহস্পতি ইন্দ্রের কাছে গিয়ে স্তব ক’রে বললেন, মহেন্দ্র, তুমি দেবতা ও মনুষ্যকে রক্ষা কর, বল লাভ কর। স্তুত হ’য়ে ইন্দ্র ধীরে ধীরে বৃদ্ধিলাভ করলেন।

 দেবতারা নহুষবধের উপায় চিন্তা করছিলেন এমন সময় ভগবান অগস্ত্য ঋষি সেখানে এলেন। তিনি বললেন, পুরন্দর, ভাগ্যক্রমে তুমি শত্রুহীন হয়েছ, নহুষ দেবরাজ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ যখন নহুষকে শিবিকায় বহন করছিলেন, তখন এক সময়ে তাঁরা শ্রান্ত হয়ে নহুষকে প্রশ্ন করলেন, বিজয়িশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মা যে গোপ্রোক্ষণ (যজ্ঞে গোবধ) সম্বন্ধে মন্ত্র বলেছেন, তা তুমি প্রামাণিক মনে কর কি না? নহুষ মোহবশে উত্তর দিলেন না, ও মন্ত্র প্রামাণিক নয়। ঋষিরা বললেন, তুমি অধর্মে নিরত তাই ধর্ম বোঝ না। প্রাচীন মহর্ষিগণ এই মন্ত্র প্রামাণিক মনে করেন, আমরাও করি। ঋষিদের সঙ্গে বিবাদ করতে করতে নহুষ তাঁর পা দিয়ে আমার মাথা স্পর্শ করলেন। তখন আমি এই শাপ দিলাম মূঢ় তুমি ব্রহ্মর্ষিগণের অনুষ্ঠিত কর্মের দোষ দিচ্ছ, চরণ দিয়ে আমার মস্তক স্পর্শ করেছ, ব্রহ্মার তুল্য ঋষিগণকে বাহন করেছ, তুমি ক্ষীণপুণ্য[৬] হ’য়ে মহীতলে পতিত হও। সেখানে তুমি মহাকায় সর্প[৭] রূপে দশ সহস্র বৎসর বিচরণ করবে, তার পর তোমার বংশজাত যুধিষ্ঠিরকে দেখলে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। শচীপতি, দুরাত্মা নহুষ এইরূপে স্বর্গচ্যুত হয়েছে, এখন তুমি স্বর্গে গিয়ে ত্রিলোক পালন কর। তার পর ইন্দ্র শচীর সঙ্গে মিলিত হ’য়ে পরমানন্দে দেবরাজ্য পালন করতে লাগলেন।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে শল্য বললেন, যুধিষ্ঠির, ইন্দ্রের ন্যায় তুমিও শত্রু বধ ক’রে রাজ্যলাভ করবে। আমি যে বেদতুল্য ইন্দ্রবিজয় নামক উপাখ্যান বললাম, তা জয়াভিলাষী রাজার শোনা উচিত। এই উপাখ্যান পাঠ করলে ইহলোকে ও পরলোকে আনন্দলাভ এবং পুত্র, দীর্ঘ আয়, ও সর্বত্র জয় লাভ হয়।

 যথাবিধি পূজিত হ’য়ে শল্য বিদায় নিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, আপনি অবশ্যই কর্ণের সারথি হবেন এবং অর্জুনের প্রশংসা ক’রে কর্ণের তেজ নষ্ট করবেন। শল্য বললেন, তুমি যা বললে তাই করব এবং আর যা পারব তাও করব।

৫। সেনাসংগ্রহ

 নানা দেশের রাজারা বিশাল সৈন্যদল নিয়ে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিতে এলেন। ক্ষুদ্র নদী যেমন সাগরে এসে লীন হয়, সেইরূপ বিভিন্ন দেশের অক্ষৌহিণী সেনা যুধিষ্ঠিরের বাহিনীতে প্রবেশ ক’রে লীন হতে লাগল। সাত্বতবংশীয় মহারথ সাত্যকি, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, জরাসন্ধপুত্র মগধরাজ জয়ৎসেন, সাগরতটবাসী বহু যোদ্ধা সহ পাণ্ড্যরাজ, কেকয়রাজবংশীয় পঞ্চ সহোদর, পুত্রগণসহ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, পার্বতীয় রাজগণ সহ মৎস্যরাজ বিরাট এবং আরও বহু দেশের রাজারা সসৈন্যে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবপক্ষে সাত অক্ষৌহিণী সেনা সংগৃহীত হ’ল।

 দুর্যোধনের পক্ষেও বহু রাজা বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে যোগ দিলেন। কাঞ্চনবর্ণ চীন ও কিরাত সৈন্য সহ ভগদত্ত, সোমদত্তপত্র ভূরিশ্রবা, মদ্ররাজ শল্য, ভোজ ও অন্ধক সৈন্য সহ হৃদিকপত্র কৃতবর্মা, সিন্ধুসৌবীরবাসী জয়দ্রথ প্রভৃতি রাজারা, শক ও যবন সৈন্য সহ কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, দাক্ষিণাত্য সৈন্য সহ মাহিষ্মতীরাজ নীল, অবন্তী দেশের দুই রাজা এবং অন্যান্য রাজারা সসৈন্যে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের পক্ষে এগার অক্ষৌহিণী সেনা সংগৃহীত হ’ল। হস্তিনাপুরে তাদের স্থান হ’ল না; পঞ্চনদ, কুরুজাঙ্গল, রোহিতকারণ্য, মরুপ্রদেশ, অহিচ্ছত্র, কালকূট, গঙ্গাতীর, বারণ, বাটধান, যমুনাতীরস্থ পার্বত দেশ, সমস্তই কৌরবসৈন্যে ব্যাপ্ত হ’ল।

  1. উপপ্লব্যনগরস্থ বিরাটরাজসভায়।
  2. কৃষ্ণ অর্জুনের মামাতো ভাই, কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা অর্জুনের পত্নী; কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা।
  3. ভোজবংশীয় প্রধান বিশেষ। ইনি কৌরবদের পক্ষে ছিলেন।
  4. সাত্যকি প্রভৃতি।
  5. নকুল সহদেবের মাতুল।
  6. যার পুণ্যজনিত স্বর্গভোগ শেষ হয়েছে।
  7. বনপর্ব ৩৭-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।