মহাভারত (রাজশেখর বসু)/মহাপ্রস্থানিকপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

মহাপ্রস্থানিকপর্ব

১। মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠিরাদি

 অর্জুনের মুখে যাদবগণের ধ্বংসের বিবরণ শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, কালই সকল প্রাণীকে বিনষ্ট করেন, তিনি আমাকেও আকর্ষণ করছেন; এখন তোমরা নিজ কর্তব্য স্থির কর। ভীমার্জুন নকুল-সহদেব সকলেই বললেন, আমরাও কালের প্রভাব অতিক্রম করতে চাই না।

 পরীক্ষিৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত ক’রে এবং যুযুৎসুর উপর রাজ্যপালনের ভার দিয়ে যুধিষ্ঠির সুভদ্রাকে বললেন, তোমার পৌত্র কুরুরাজ রূপে হস্তিনাপুরে থাকবেন। যাদবগণের একমাত্র বংশধর কৃষ্ণপৌত্র বজ্রকে আমি ইন্দ্রপ্রস্থে অভিষিক্ত করেছি, তিনি অবশিষ্ট যাদবগণকে পালন করবেন। তুমি এদের রক্ষা ক’রো, যেন অধর্ম না হয়। অনন্তর যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা বসুদেব ও কৃষ্ণ-বলরাম প্রভৃতির যথাবিধি শ্রাদ্ধ করলেন এবং কৃষ্ণের উদ্দেশে ব্যাস নারদ মার্কণ্ডেয় ভরদ্বাজ ও যাজ্ঞবল্ক্যকে ভোজন করিয়ে ব্রাহ্মণগণকে বহু ধনরত্ন দান করলেন। যুধিষ্ঠির কৃপাচার্যকে পরীক্ষিতের শিক্ষার ভার দিলেন এবং প্রজাগণকে আহ্বান ক’রে মহাপ্রস্থানের অভিপ্রায় জানালেন। প্রজারা উদ্‌বিগ্ন হয়ে বারণ করতে লাগল, কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁর সংকল্প ত্যাগ করলেন না।

 যুধিষ্ঠির, তাঁর ভ্রাতৃগণ, এবং দ্রৌপদী সমস্ত আভরণ ত্যাগ ক’রে বল্কল পরিধান করলেন এবং যজ্ঞ ক’রে তার অগ্নি জলে নিক্ষেপ করলেন। তার পর তাঁরা হস্তিনাপুর থেকে যাত্রা করলেন। নারীগণ উচ্চকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। পুরবাসী ও অন্তঃপুরবাসিনীগণ বহু দূর পর্যন্ত অনুগমন করলেন, কিন্তু কেউ পাণ্ডবগণকে নিবৃত্ত হ’তে বললেন না। নাগকন্যা উলূপী গঙ্গায় প্রবেশ করলেন, চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে গেলেন, অন্যান্য পাণ্ডবপত্নীগণ পরীক্ষিতের কাছে রইলেন।

 পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী উপবাস ক’রে পূর্ব দিকে চললেন, একটি কুকুর তাঁদের পিছনে যেতে লাগল। তাঁরা বহু দেশ অতিক্রম ক’রে লোহিত্য সাগরের তীরে উপস্থিত হলেন। আসক্তিবশত অর্জুন এপর্যন্ত তাঁর গাণ্ডীব ধনু ও দুই অক্ষয় তুণ ত্যাগ করেন নি। এখন অগ্নি মূর্তিমান হয়ে পথরোধ ক’রে বললেন, পাণ্ডবগণ, আমার কথা শোন, আমি অগ্নি, পূর্বে অর্জুন ও নারায়ণের প্রভাবে খাণ্ডব দগ্ধ করেছিলাম। অর্জুনের আর গাণ্ডীবের প্রয়োজন নেই; আমি বরুণের কাছ থেকে এই ধনু এনে দিয়েছিলাম, এখন ইনি বরুণকে প্রত্যর্পণ করুন। কৃষ্ণের চক্রও এখন প্রস্থান করেছে, যথাকালে আবার তাঁর কাছে যাবে। এই কথা শুনে অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব ধনু ও দুই তূণ জলে নিক্ষেপ করলেন, অগ্নিও অন্তর্হিত হলেন। পাণ্ডবগণ পৃথিবী প্রদক্ষিণের ইচ্ছায় প্রথমে দক্ষিণ দিকে চললেন, তার পর লবণসমুদ্রের উত্তর তীর দিয়ে পশ্চিম দিকে এলেন, এবং সাগর গ্লাবিত দ্বারকাপুরী দেখে উত্তর দিকে যাত্রা করলেন।

২। দ্রৌপদী সহদেব নকুল অর্জুন ও ভীমের মৃত্যু

 পাণ্ডবগণ হিমালয় পার হয়ে বালুকার্ণব ও মেরুপর্বত দর্শন ক’রে যোগযুক্ত হয়ে শীঘ্র চলতে লাগলেন। যেতে যেতে সহসা দ্রৌপদী যোগভ্রষ্ট হয়ে ভূপতিত হলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কোনও অধর্মাচরণ করেন নি, তবে কেন ভূপতিত হলেন? যুধিষ্ঠির বললেন, ধনঞ্জয়ের উপর এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল, এখন তারই ফল পেয়েছেন। এই বলে যুধিষ্ঠির সমাহিতমনে চলতে লাগলেন, দ্রৌপদীর দিকে আর দৃষ্টিপাত করলেন না।

 কিছুক্ষণ পরে সহদেব প’ড়ে গেলেন। ভীম বললেন, এই মাদ্রীপুত্র নিরহংকার ছিলেন এবং সর্বদা আমাদের সেবা করতেন, তবে ভূপতিত হলেন কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, সহদের মনে করতেন ওঁর চেয়ে বিজ্ঞ আর কেউ নেই। এই বলে যুধিষ্ঠির অগ্রসর হলেন।

 তার পর নকুল প’ড়ে গেলেন! ভীম বললেন, আমাদের এই অতুলনীয় রূপবান ভ্রাতা ধর্ম থেকে কখনও চ্যুত হন নি এবং সর্বদা আমাদের আজ্ঞাবহ ছিলেন; ইনি ভূপতিত হলেন কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, নল মনে করতেন তাঁর তুল্য রূপবান কেউ নেই। বৃকোদর, তুমি আমার সঙ্গে এস, নকুল তাঁর কর্মের বিধিনির্দিষ্ট ফল পেয়েছেন।

 দ্রৌপদী ও নকুল-সহদেবের পরিণাম দেখে অর্জুন শোকার্ত হয়ে চলছিলেন, কিছু দূর গিয়ে তিনি ও প’ড়ে গেলেন। ভীম বললেন, ইনি পরিহাস ক’রেও কখনও মিথ্যা বলেন নি, তবে কেন এঁর এমন দশা হ’ল? যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুন সর্বদা গর্ব করতেন যে এক দিনেই সকল শত্রু বিনষ্ট করবেন, কিন্তু তা পারেন নি; তা ছাড়া ইনি অন্য ধনুর্ধরদের অবজ্ঞা করতেন; ঐশ্বর্যকামী পুরুষের এমন করা উচিত নয়। এই ব’লে যুধিষ্ঠির চলতে লাগলেন। অনন্তর ভীম ভূপতিত হয়ে বললেন, মহারাজ মহারাজ, দেখুন, আমিও প’ড়ে গেছি; আমি আপনার প্রিয়, তবে আমার পতন হ’ল কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি অত্যন্ত ভোজন করতে এবং অন্যের বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতে। এই ব’লে যুধিষ্ঠির ভীমের প্রতি দৃষ্টিপাত না ক’রে অগ্রসর হলেন। কুকুর তাঁর পিছনে চলল।

৩। যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গর্যাত্রা

 ভূমি ও আকাশ নিনাদিত ক’রে ইন্দ্র রথারোহণে অবতীর্ণ হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি এই রথে ওঠ। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শোকসন্তপ্ত হয়ে বললেন, সুরেশ্বর, আমার ভ্রাতারা এবং সকুমারী দ্রুপদরাজপুত্রী এখানে পড়ে আছেন, তাঁদের ফেলে আমি যেতে পারি না, আপনি তাঁদেরও নিয়ে চলুন। ইন্দ্র বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, তাঁরা দেহত্যাগ ক’রে আগেই স্বর্গে গেছেন; শোক ক’রো না, তুমি সশরীরে সেখানে গিয়ে তাঁদের দেখতে পাবে। যুধিষ্ঠির বললেন, এই কুকুর আমার ভক্ত, একেও আমার সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করি, নতুবা আমার পক্ষে নির্দয়তা হবে।

 ইন্দ্র বললেন, মহারাজ, তুমি আমার তুল্য অমরত্ব ঐশ্বর্য সিদ্ধি ও স্বর্গসুখের অধিকারী হয়েছ, এই কুকুরকে ত্যাগ কর, তাতে তোমার নির্দয়তা হবে না। যুধিষ্ঠির বললেন, সহস্রলোচন, আমি আর্য হয়ে অনার্যের আচরণ করতে পারব না; এই ভক্ত কুকুরকে ত্যাগ ক’রে আমি দিব্য ঐশ্বর্যও চাই না। ইন্দ্র বললেন, যার কুকুর থাকে সে স্বর্গে যেতে পারে না, ক্রোধবশ নামক দেবগণ তার যজ্ঞাদির ফল বিনষ্ট করেন। ধর্মরাজ, তুমি এই কুকুরকে ত্যাগ কর।

 যুধিষ্ঠির বললেন, মহেন্দ্র, ভক্তকে ত্যাগ করলে ব্রহ্মহত্যার তুল্য পাপ হয়, নিজের সুখের জন্য আমি এই কুকুরকে ত্যাগ করতে পারি না। প্রাণ বিসর্জন দিয়েও আমি ভীত অসহায় আর্ত দুর্বল ভক্তকে রক্ষা করি, এই আমার ব্রত। ইন্দ্র বললেন, কুকুরের দৃষ্টি পড়লে যজ্ঞ দান হোম প্রভৃতি নষ্ট হয়। ভ্রাতৃগণ প্রিয়া পত্নীকে ত্যাগ ক’রে তুমি নিজ কর্মের প্রভাবে স্বর্গলোক লাভ করেছ, এখন মোহবশে এই কুকুরকে ছাড়তে চাও না কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, মৃত জনকে জীবিত করা যায় না, তাদের সঙ্গে কোনও সম্বন্ধও থাকে না। আমার ভ্রাতৃগণ ও পত্নীকে জীবিত করবার শক্তি নেই সেজন্যই ত্যাগ করেছি, তাঁদের জীবদ্দশায় ত্যাগ করি নি। আমি মনে করি, শরণাগতকে ভয় দেখানো, স্ত্রীবধ, ব্রহ্মস্বহরণ ও মিত্রবধ—এই চার কার্যে যে পাপ হয়, ভক্তকে ত্যাগ করলেও সেইরূপ হয়।

 তখন কুক্কুররূপী ভগবান ধর্ম নিজ মূর্তি গ্রহণ ক’রে বললেন, মহারাজ, তুমি উচ্চ বংশে জন্মেছ, পিতার স্বভাবও পেয়েছ; তোমার মেধা এবং সর্বভূতে দয়া আছে। পুত্র, দ্বৈতবনে আমি একবার তোমাকে পরীক্ষা করেছিলাম, তুমি ভীমার্জুনের পরিবর্তে নকুলের জীবন চেয়েছিলে, যাতে তোমার জননীর ন্যায় মাদ্রীরও একটি পুত্র থাকে[১]। স্বর্গেও তোমার সমান কেউ নেই, কারণ ভক্ত কুকুরের জন্য তুমি দেবরথ ত্যাগ করতে চেয়েছ। ভরতশ্রেষ্ঠ, তুমি সশরীরে স্বর্গারোহণ ক’রে অক্ষয় লোক লাভ করবে।

 তার পর ধর্ম ইন্দ্র মরুদ্‌গণ প্রভৃতি দেবতা এবং দেবর্ষিগণ যুধিষ্ঠিরকে দিব্য রথে তুলে স্বর্গে নিয়ে গেলেন। দেবর্ষি নারদ উচ্চস্বরে বললেন, যে রাজর্ষিগণ এখানে উপস্থিত আছেন তাঁদের সকলের কীর্তি এই কুরুরাজ যুধিষ্ঠির আবৃত ক’রে দিয়েছেন; ইনি যশ তেজ ও সম্পদে সকলকে অতিক্রম করেছেন। আর কেউ সশরীরে স্বর্গে এসেছেন এমন শুনি নি।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমার ভ্রাতারা যে স্থানে গেছেন তা শুভ বা অশভ যাই হ’ক আমি সেখানেই যেতে ইচ্ছা করি। ইন্দ্র বললেন, মহারাজ, এখনও তুমি মানুষের স্নেহ ত্যাগ করছ না কেন? নিজের কর্ম দ্বারা যে শুভলোক জয় করেছ সেখানেই বাস কর। তুমি পরমসিদ্ধি লাভ ক’রে এখানে এসেছ, তোমার ভ্রাতারা এখানে আসবার অধিকার পান নি। এখনও তোমার মানুষ ভাব রয়েছে কেন? এ স্বর্গ, এই দেখ দেবর্ষি ও সিদ্ধগণ এখানে রয়েছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, দেবরাজ, যেখানে আমার ভ্রাতারা আছেন, যেখানে আমার গুণবতী শ্যামাঙ্গিনী নারীশ্রেষ্ঠা পত্নী আছেন, সেখানেই আমি যাব।

  1. বনপর্ব ৫৭-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।