মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/অনুদ্যূতপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥অনুদ্যূতপর্বাধ্যায়॥

১৭। পুনর্বার দ্যূতক্রীড়া

 পাণ্ডবগণ চ’লে গেলে দুঃশাসন বললেন, আমরা অতি কষ্টে যা হস্তগত করেছিলাম বৃদ্ধ তা নষ্ট করলেন। তার পর কর্ণ আর শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা ক’রে দুর্যোধন তাঁর পিতার কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, বৃহস্পতি বলেছেন, যে শত্রুরা যুদ্ধে বা যুদ্ধ না করেই অনিষ্ট করে তাদের সকল উপায়ে বিনষ্ট করবে। দংশনে উদ্যত সর্পকে কণ্ঠে ও পৃষ্ঠে ধারণ ক’রে কে পরিত্যাগ করে? পিতা, ক্রুদ্ধ পাণ্ডবরা আমাদের নিঃশেষ করবে, আমরা তাদের নিগৃহীত করেছি, তারা ক্ষমা করবে না। আমরা আবার তাদের সঙ্গে খেলতে চাই। এবারে দ্যূতক্রীড়ায় এই পণ হবে—পরাজিত পক্ষ মৃগচর্ম ধারণ ক’রে বার বৎসর মহারণ্যে বাস এবং তার পর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। আমরা দ্যূত জয়ী হয়ে বার বৎসরে রাজ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হব, মিত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করব, তের বৎসর পরে পাণ্ডবরা ফিরে এলে আমরা তাদের পরাজিত করব। ধৃতরাষ্ট্র সম্মত হয়ে বললেন, পাণ্ডবদের শীঘ্র ফিরিয়ে আন।

 জ্ঞানবতী গান্ধারী তাঁর পতিকে বললেন, দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলে বিদুর সেই কুলাঙ্গারকে পরলোকে পাঠাতে বলেছিলেন। মহারাজ, তুমি নিজের দোষে দুঃখসাগরে মগ্ন হয়ো না, নির্বোধ অশিষ্ট পুত্রদের কথা শুনো না। পাণ্ডবরা শান্ত হয়েছে, আবার কেন তাদের ক্রুদ্ধ করছ? তুমি স্নেহবশে দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে পার নি, এখন তার ফলে বংশনাশ হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমাদের বংশ নষ্টই হবে, আমি তা নিবারণ করতে পারছি না। আমার পুত্রেরা যা ইচ্ছা হয় করুক।

 দুর্যোধনের দূত প্রাতিকামী যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে জানালে যে ধৃতরাষ্ট্র আবার তাঁকে দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, বিধাতার নিয়োগ অনুসারেই জীবের শুভাশুভ ঘটে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র যখন ডেকেছেন তখন বিপদ হবে জেনেও আমাকে যেতে হবে। রাম জানতেন যে স্বর্ণময় জন্তু অসম্ভব, তথাপি তিনি স্বর্ণমৃগ দেখে লুব্ধ হয়েছিলেন। বিপদ আসন্ন হ’লে লোকের বুদ্ধির বিপর্যয় হয়।

 যুধিষ্ঠির দ্যূতসভায় উপস্থিত হ’লে শকুনি বললেন, বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তোমাদের ধন ফিরিয়ে দিয়ে মহৎ কার্য করেছেন। এখন যে পণ রেখে আমরা খেলব তা শোন।—আমরা যদি হারি তবে মৃগচর্ম পরিধান ক’রে দ্বাদশ বর্ষ মহারণ্যে বাস করব, তার পর এক বৎসর স্বজনবর্গের অজ্ঞাত হয়ে থাকব। যদি অজ্ঞাতবাসকালে কেউ আমাদের সন্ধান পায় তবে আবার দ্বাদশ বর্ষ বনবাস করব। যদি তোমরা হেরে যাও তবে তোমরাও এই নিয়মে বনবাস ও অজ্ঞাতবাস করবে, এবং ত্রয়োদশ বৎসরের শেষে স্বরাজ্য পাবে। এখন খেলবে এস।

 সভাস্থ সকলে উদ্‌বিগ্ন হয়ে হাত তুলে বললেন, আত্মীয়দের ধিক, তাঁরা পাণ্ডবদের সাবধান করে দিচ্ছেন না, পাণ্ডবরাও তাঁদের বিপদ বুঝছেন না। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি স্বধর্মনিষ্ঠ, দ্যূক্রীড়ায় আহূত হ’লে নিবৃত্ত হই না। শকুনি, আমি আপনার সঙ্গে খেলব। শকুনি তাঁর পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

 পরাজিত পাণ্ডবগণ মৃগচর্মের উত্তরীয় ধারণ ক’রে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুঃশাসন বললেন, এখন দুর্যোধন রাজচক্রবর্তী হলেন, পাণ্ডবগণ সুদীর্ঘকালের জন্য নরকে পতিত হ’ল। ক্লীব পাণ্ডবদের কন্যাদান ক’রে দ্রুপদ ভাল করেন নি। দ্রৌপদী, এই পতিত স্বামীদের সেবা ক’রে তোমার আর লাভ কি? ভীম বললেন, নিষ্ঠুর, তুমি এখন বাক্যবাণে আমাদের মর্মভেদ করছ, এই কথা যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার মর্মস্থান ছিন্ন ক’রে মনে করিয়ে দেব। নির্লজ্জ দুঃশাসন ‘গরু, গরু’ ব’লে ভীমের চারিদিকে নাচতে লাগলেন।

 পাণ্ডবগণ সভা থেকে নির্গত হলেন। দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন হর্ষে অধীর হয়ে ভীমের সিংহগতির অনুকরণ করতে লাগলেন। ভীম পিছন ফিরে বললেন, মূঢ় দুর্যোধন, দুঃশাসনের বিদীর্ণ বক্ষের শোণিত পান করলেই আমার কর্তব্য শেষ হবে না, তোমাকে সদলে নিহত ক’রে প্রতিশোধ নেব। আমি গদাঘাতে তোমাকে মারব, পদাঘাতে তোমার মস্তক ভূলুণ্ঠিত করব। অর্জুন কর্ণকে আর সহদেব ধূর্ত শকুনিকে মারবেন, আর এই বাক্যবীর দুরাত্মা দুঃশাসনের রক্ত আমি সিংহের ন্যায় পান করব।

 অর্জুন বললেন, কেবল বাক্য দ্বারা সংকল্প ব্যক্ত করা যায় না, চতুর্দশ বৎসরে যা হবে তা সকলেই দেখতে পাবেন। ভীমসেন, আপনার প্রিয়কামনায় আমি প্রতিজ্ঞা করছি— এই ঈর্ষাকারী কটূভাষী অহংকৃত কর্ণকে আমি যুদ্ধে শরাঘাতে বধ করব। যদি এই সত্য পালন করতে না পারি তবে হিমালয় বিচলিত হবে, দিবাকর নিষ্প্রভ হবে, চন্দ্রের শৈত্য নষ্ট হবে। সহদেব বললেন, গান্ধার-কুলাঙ্গার শকুনি, তোমার সম্বন্ধে ভীম যা বলেছেন তা আমি করব। নকুল বললেন, দুর্যোধনকে তুষ্ট করবার জন্য যারা এই সভায় দ্রৌপদীকে কটুকথা শুনিয়েছে সেই দুর্বৃত্তদের আমি যমালয়ে পাঠাব, ধর্মরাজ আর দ্রৌপদীর নির্দেশ অনুসারে আমি পৃথিবী থেকে ধার্তরাষ্ট্রগণকে লুপ্ত করব।

১৮। পাণ্ডবগণের বনযাত্রা

 বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর পুত্রগণ, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, সোমদত্ত, বাহ্ণীকরাজ, বিদুর, যুযুৎসু, সঞ্জয় প্রভৃতিকে সম্বোধন ক’রে যুধিষ্ঠির বললেন, আমি বনগমনের অনুমতি চাচ্ছি, ফিরে এসে আবার আপনাদের দর্শনলাভ করব। সভাসদ্‌গণ লজ্জায় কিছু বলতে পারলেন না, কেবল মনে মনে যুধিষ্ঠিরের কল্যাণ কামনা করলেন। বিদুর বললেন, আর্যা কুন্তী বৃদ্ধা এবং সুখভোগে অভ্যস্তা, তিনি সসম্মানে আমার গৃহেই বাস করবেন। পাণ্ডবগণ, তোমাদের সর্ববিষয়ে মঙ্গল হ’ক। যুধিষ্ঠিরাদি বললেন, নিষ্পাপ পিতৃব্য, আপনি আমাদের পিতার সমান, যা আজ্ঞা করবেন তাই পালন করব।

 বিদুর বললেন, যুধিষ্ঠির, অধর্ম দ্বারা বিজিত হ’লে পরাজয়ের দুঃখ হয় না। তুমি ধর্মজ্ঞ, অর্জুন যুদ্ধজ্ঞ, ভীম শত্রুহন্তা, নকুল অর্থ সংগ্রহী, সহদেব নিয়মপালক, ধৌম্য শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ, দ্রৌপদী ধর্মচারিণী। তোমরা পরস্পরের প্রিয়, প্রিয়ভাষী, তোমাদের মধ্যে কেউ ভেদ জন্মাতে পারবে না। আপৎকালে এবং সর্ব কার্যে তোমরা বিবেচনা করে চ’লো। তোমাদের মঙ্গল হ’ক, নির্বিঘ্নে ফিরে এস, আবার তোমাদের দেখব।

 কুন্তী ও অন্যান্য নারীদের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী বিদায় চাইলেন। অন্তঃপুরে ক্রন্দনধ্বনি উঠল। কুন্তী শোকাকুল হয়ে বলেন, বৎসে, তুমি সর্বগুণান্বিতা, আমার কোনও উপদেশ দেওয়া অনাবশ্যক। কৌরবগণ ভাগ্যবান তাই তারা তোমার কোপে দগ্ধ হয় নি। তুমি নির্বিঘ্নে যাত্রা কর, আমি সর্বদাই তোমার শুভচিন্তা করব। আমার পুত্র সহদেবকে দেখো, যেন সে এই বিপদে অবসন্ন না হয়।

 দ্রৌপদী আলুলায়িত কেশে রক্তাক্ত একবস্ত্রে সরোদনে যাত্রা করলেন। নিরাভরণ পুত্রগণকে আলিঙ্গন ক’রে কুন্তী বললেন, তোমরা ধার্মিক সচ্চরিত্র উদারপ্রকৃতি ভগবদ্‌ভক্ত ও যজ্ঞপরায়ণ, তোমাদের ভাগ্যে এই বিপর্যয় কেন হ’ল? তোমাদের পিতা ধন্য, এই বিপদ তাঁকে দেখতে হ’ল না, স্বর্গগতা মাদ্রীও ভাগ্যবতী। আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না, সঙ্গে যাব। হা কৃষ্ণ দ্বারকাবাসী, কোথায় আছ, আমাদের দুঃখ থেকে ত্রাণ করছ না কেন?

 পাণ্ডবগণ কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে যাত্রা করলেন। দুর্যোধনাদির পত্নীরা দ্রৌপদীর অপমানের বিবরণ শুনে কৌরবগণের নিন্দা ক’রে উচ্চকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। পুত্রদের অন্যায়ের কথা ভেবে ধৃতরাষ্ট্র উদ্‌বেগ ও অশান্তি ভোগ করছিলেন। তিনি বিদুরকে ডাকিয়ে বললেন, পাণ্ডবগণ কি ভাবে যাচ্ছেন তা আমি জানতে চাই, তুমি বর্ণনা কর।

 বিদুর বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বস্ত্রে মুখে আবৃত ক’রে চলেছেন। মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কপট উপায়ে রাজ্য হরণ করলেও যুধিষ্ঠিরের ধর্মবুদ্ধি বিচলিত হয় নি। তিনি দয়ালু, তাই ক্রুদ্ধ হয়েও চক্ষু উন্মীলন করছেন না, পাছে আপনার পুত্রগণ দগ্ধ হয়। শত্রুদের উপর বাহুবল প্রয়োগ করবেন তা জানাবার জন্য ভীম তাঁর বাহদ্বয় প্রসারিত করে চলেছেন। বাণবর্ষণের পূর্বাভাষরূপে অর্জুন বালুকা বর্ষণ করতে করতে যাচ্ছেন। সহদেব মুখ ঢেকে এবং নকুল সর্বাঙ্গে ধূলি মেখে বিহ্বলচিত্তে চলেছেন। দ্রৌপদী তাঁর কেশজালে মুখে আচ্ছাদিত ক’রে সরোদনে অনুগমন করছেন। পুরোহিত ধৌম্য হাতে কুশ নিয়ে যমদেবতার সাম মন্ত্র গান ক’রে পরোভাগে চলেছেন। পুরবাসিগণ বিলাপ করছে—হায়, আমাদের রক্ষকগণ চ’লে যাচ্ছেন! মহারাজ, পাণ্ডবগণের যাত্রাকালে বিনা মেঘে বিদ্যুৎ, ভূমিকম্প, অকালে সূর্যগ্রহণ প্রভৃতি দুর্লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

 দেবর্ষি নারদ সভামধ্যে বললেন, দুর্যোধনের অপরাধে এবং ভীমার্জুনের বলে এখন থেকে চতুর্দশ বর্ষে কৌরবগণ বিনষ্ট হবে। এই ব’লে তিনি অন্তর্হিত হলেন। বিপৎসাগরে দ্রোণাচার্যই দ্বীপস্বরূপ এই মনে ক’রে দুর্যোধন কর্ণ ও শকুনি তাঁকেই রাজ্য নিবেদন করলেন। দ্রোণ বললেন, তোমরা আমার শরণাগত তাই তোমাদের ত্যাগ করতে পারব না। পাণ্ডবরা ফিরে এসে তোমাদের উপর প্রতিশোধ নেবে। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের সঙ্গে আমার যুদ্ধ করতে হবে এর চেয়ে অধিক দুঃখ আর কি হ’তে পারে। যে ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার মৃত্যুর কারণ ব’লে প্রসিদ্ধি আছে, সে পাণ্ডবপক্ষেই থাকবে। দুর্যোধন, তোমার সুখ হেমন্তকালে তালচ্ছায়ার ন্যায় ক্ষণস্থায়ী; অতএব যজ্ঞ দান আর ভোগ ক’রে নাও, এখন থেকে চতুর্দশ বৎসরে তোমাদের মহাবিনাশ হবে।