মেদিনীপুরের ইতিহাস (প্রথম ভাগ)/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়।

প্রাকৃতিক বিবরণ ও ভূ-বৃত্তান্ত।


 ভূতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণ স্থির করিয়াছেন, একসময় রাজমহল-পর্ব্বতমালা বঙ্গোপসাগরের উত্তরসীমা ছিল। পরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রেরপ্রাকৃতিক বিপর্য্যয়। মুখানীত কর্দ্দমে পুষ্ট হইয়া বর্ত্তমান নিম্ন-বঙ্গের সৃষ্টি হইয়াছে। সে সুদূর অতীতকালের কথা। সে যুগের কথা ছাড়িয়া দিলেও ঐতিহাসিক যুগের যে সময় হইতে এইপ্রদেশের বিবরণ সংগ্রহ করিতে পারা যায়, সেই সময় হইতে ইহার ভূমি-প্রকৃতির আলোচনা করিলে পরিলক্ষিত হয় যে, যুগে যুগে এই প্রদেশের কিছু কিছু পরিবর্ত্তন সংঘটিত হইয়াছে।

 এই জেলার পূর্ব্বপ্রান্তে রূপনারায়ণ নদীর তীরে এক্ষণে তমলুক নামে যে নগরটি বর্ত্তমান, পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, উহাই প্রাচীন কালের তাম্রলিপ্তনাম্নী মহানগরী। মহাভারত, পুরাণ, সংহিতা প্রভৃতি পাঠে জানা যায়, তৎকালে এই নগরটি সমুদ্রতীরে অবস্থিত ছিল; এই জন্য ইহার একটি নাম “বেলাকূল”। শব্দকল্পদ্রুমে এই বেলাকূল শব্দের অর্থে লিখিত আছে—“বেলাকূলং (ক্লীং) তাম্রলিপ্তদেশঃ।” বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ ও গ্রীক রাজদূত মেগাস্থিনিসের ভ্রমণবৃত্তান্ত হইতেও জানা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তাম্রলিপ্ত নগর সমুদ্রকুলবর্ত্তী বন্দর বলিয়া বিখ্যাত ছিল। মহাসমুদ্র তখন তাম্রলিপ্তের পাদমূল ধৌত করিয়া প্রবাহিত হইত। পরবর্ত্তিকালে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে লিখিত সুবিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ইউয়ান চোয়াঙের ভ্রমণবৃত্তান্তেও তাম্রলিপ্ত উপসাগরের তীরবর্ত্তী একটি সমৃদ্ধিশালী বন্দর বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। সমুদ্র তখন তাম্রলিপ্তের প্রায় আট ক্রোশ দূরে সরিয়া গিয়াছিল। এক্ষণে ষাট ক্রোশ অন্তরে গিয়াছে। সুতরাং ইহা অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে, যে সময় সমুদ্র তাম্রলিপ্তের পাদমূল ধৌত করিয়া প্রবাহিত হইত, সে সময় বর্ত্তমান তমলুকের দক্ষিণে ও দক্ষিণ পূর্ব্বে অবস্থিত সূতাহাটা, নন্দীগ্রাম, খাজুরী প্রভৃতি থানার কোনটির সম্পূর্ণ, কোনটির বা অধিকাংশ ভূমিরই অস্তিত্ব ছিল না। ক্রমশঃ নদীর মোহানায় পলি পড়িয়া ঐ সকল স্থানের উৎপত্তি হইয়াছে। ঐ সকল স্থানের ভূমিপ্রকৃতিও বর্ত্তমানে সেই কথার সাক্ষ্য দিতেছে।

 কাল যুগে যুগে মেদিনীপুর জেলার সীমায় এইরূপে অনেক পরিবর্ত্তন সংঘটিত করিয়া দিয়াছে। বর্ত্তমান মেদিনীপুর জেলার ভূমি-পরিমাণ উত্তর-দক্ষিণে এবং পূর্ব্ব-পশ্চিমে সমান—কিঞ্চিদূন প্রায় এক শত মাইল। ভূমি-প্রকৃতি। এই জেলার দক্ষিণে সাগরতট হইতে যতই উত্তরে যাওয়া যায়, ভূমি ক্রমশঃ ততই প্রাচীন, উন্নত, অনুর্ব্বর এবং প্রস্তরময় পরিলক্ষিত হয়। মেদিনীপুর জেলার ভূমি-প্রকৃতি সাধারণতঃ দুই ভাগে বিভক্ত। এই জেলার উত্তরে হুগলী জেলার সীমা হইতে চন্দ্রকোণ ও কেশপুর থানার মধ্য দিয়া বর্দ্ধমান রাস্তা নামে পরিচিত যে পথটি মেদিনীপুর সহর পর্য্যন্ত আসিয়া জগন্নাথ রাস্তার সহিত মিলিত হইয়া বালেশ্বর জেলার মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক এই জেলাকে উত্তর-দক্ষিণে দ্বিধা বিভক্ত করিয়া গিয়াছে, সেই রাজপথটি এই জেলার দ্বিবিধ ভূমি-প্রকৃতি নির্দ্দেশ করিয়া দেয়। শ্রীযুক্ত ওম্যালী সাহেব (Mr. L.S.S. O’malley I.C.S.) মেদিনীপুরের গেজেটিয়ারে লিখিয়াছেন যে, রাণীগঞ্জ হইতে বাঁকুড়া জেলার মধ্য দিয়া যে রাস্তাটি মেদিনীপুর সহরে জগন্নাথ রাস্তার সহিত মিলিত হইয়া, মেদিনীপুর জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া দক্ষিণাভিমুখে চলিয়া গিয়াছে, সেই রাস্তাটির দ্বারাই এই জেলার দ্বিবিধ ভূমি-প্রকৃতি নির্দ্দেশিত হইয়া থাকে। কিন্তু জগন্নাথ রাস্তার দুই পার্শ্বের ভূমি-প্রকৃতির পার্থক্য পরিলক্ষিত হইলেও রাণীগঞ্জ রাস্তা সম্বন্ধে তাঁহার মন্তব্য ঠিক নহে। মেদিনীপুর সেটেলমেণ্টের ফাইনেল রিপোর্টে মেদিনীপুরের ভূতপূর্ব্ব সেটেলমেণ্ট অফিসার শ্রীযুক্ত জেম‍্শন সাহেব (Mr. A. K. Jameson M.A., I.C.S.) ওম্যালীসাহেবের ভ্রমপ্রদর্শন করিয়া দিয়াছেন। আমরাও দেখিয়াছি, রাণীগঞ্জ রাস্তার পশ্চিমপার্শ্বের ভূমির ন্যায় পূর্ব্বপার্শ্বের ভূমিও বহুদূর পর্য্যন্ত (প্রায় বর্দ্ধমান রাস্তার সীমা পর্য্যন্ত) একইরূপ প্রকৃতিসম্পন্ন। কিন্তু বর্দ্ধমান রাস্তার দুই পার্শ্বের ভূমি-প্রকৃতিতে বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণতঃ দেখা যায়, এই বর্দ্ধমান-জগন্নাথ রাস্তার পশ্চিমদিক‍্স্থ ভূমি প্রস্তরময় এবং পূর্ব্বদিক‍্স্থ ভূমি মৃত্তিকাময়। এই ভূমিখণ্ডদ্বয় আবার দুই দুই ভাগে বিভক্ত দেখিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমপার্শ্বের প্রদেশটির উত্তরাংশ নাতিক্ষুদ্র শৈলমালায় এবং নিবিড় অরণ্যে পূর্ণ। উক্ত প্রদেশটির দক্ষিণাংশের ভূমি কঙ্করময়, স্তরমণ্ডিত, কঠিন ও রক্তবর্ণ। দক্ষিণপশ্চিম প্রদেশের অধিকাংশ ভূমি অনুর্ব্বর।

 পূর্ব্বোক্ত পশ্চিমপার্শ্বস্থ প্রদেশটির ন্যায় রাজপথটির পূর্ব্বপার্শ্ববর্ত্তী প্রদেশটির ভূমি-প্রকৃতিও দ্বিবিদ্ব লক্ষণবিশিষ্ট। এই প্রদেশের উত্তরাংশ মধ্যপ্রদেশ এবং দক্ষিণাংশ নামাল বা নিম্নভূমি। পশ্চিমাংশের ভূমি অপেক্ষা এই অংশের ভূমি অধিকতর উর্ব্বরা ও শস্যশালিনী। এই জেলার পূর্ব্বদক্ষিণভাগের কতক অংশ নদীরমোহানাগত লোণা মৃত্তিকায় ও সমুদ্রের বালুকায় পূর্ণ। এই অংশের ভূমি এই জেলার মধ্যে উর্ব্বরতম।

 মেদিনীপুর জেলার প্রাকৃতিক দৃশ্য অতিশয় নয়নপ্রীতিকর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সকল নিদর্শন এই জেলায় দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।একদিকে যেমন নানাবিধ বৃক্ষলতাদি-শোভিত শৈলমালা ও বনজঙ্গলাদি বিরাজিত, তেমনি আবার অন্যদিকে সুনীলসিন্ধু চঞ্চল তরঙ্গ তুলিয়া সফেন উচ্ছ্বাসে ইহার পাদমূল ধৌত করিয়া দিতেছে। কংসাবতী, শিলাবতী, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদী সকল দুগ্ধস্রোতের ন্যায় এই জেলার বক্ষের উপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া ইহার সৌন্দর্য্যকে আরও বৃদ্ধি করিয়াছে।

নদ-নদী।মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়া যে কয়েকটি নদী প্রবাহিত, তন্মধ্যে নিম্নলিখিত পাঁচটি প্রধান।

 এই পাঁচটি নদীর বিবিধ শাখা এই জেলার মধ্য-ভূমিতে প্রবিষ্ট হইয় আপনাপন কূলসন্নিহিত প্রদেশকে শস্যশালী করিয়াছে।

 (১) শিলাবতী বা শিলাই:―বুড়ি, গোপ, পুরন্দর ও কুবাই নদী মিলিত হইয়া শিলাবতী আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। এই নদীটি রামগড় পাহাড় হইতে বহির্গমনপূর্ব্বক মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বগড়ী পরগণায় প্রবিষ্ট হইয়া ঘাটাল মহকুমার মধ্যে দ্বারকেশ্বর নদের সহিত মিলিত হইয়াছে। পরে এই উভয় নদী স্ব স্ব নাম পরিত্যাগপূর্ব্বক রূপনারায়ণ নদ নাম গ্রহণ করিয়া তমলুক মহকুমার অন্তর্গত গেঁওখালী নামক স্থানে হুগলী নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে।

 (২) কংসাবতী বা কাঁসাই:―এই নদীটি ছোট-নাগপুরের পাহাড় হইতে উৎপন্ন হইয়া এই জেলার উত্তরপশ্চিম কোণে রামগড় পরগণায় প্রবিষ্ট হয়, পরে মেদিনীপুর সহরের নিম্নভাগ দিয়া পূর্ব্বতিমুখে চলিয়া আবার দক্ষিণাভিমুখে প্রবাহিত হইয়া কেলেঘাই নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে।

 (৩) কেলেঘাই বা কালীঘাই:—ইহা এই জেলার পশ্চিমপ্রান্তে জন্মিয়া উত্তরে নারায়ণগড়, সবঙ্গ ও ময়না এবং দক্ষিণে খট‍্নগর, পটাশপুর ও অমর্শি প্রভৃতি পরগণার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। পরে টেঙ্গরাখালী নামক স্থানে দক্ষিণবাহিনী কংসাবতীর জলপ্রবাহ প্রাপ্ত হইয়া হল‍্দিনদী নাম গ্রহণ পূর্ব্বক উত্তরে মহিষাদল ও সূতাহাটা এবং দক্ষিণে নন্দীগ্রাম থানার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বৃহৎকলেবরে হুগলী নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে।

 (৪) বাগদা রশুলপুর:—এই নদীটি এই জেলার দক্ষিণপশ্চিম ভূভাগে বাগদা নদী নামে জন্মিয়া কালিনগর নামক স্থানে বোরোজ নদীর (এক্ষণে সদরখাল নামে পরিচিত) সহিত মিলিত হইয়া রশুলপুর নদী নামগ্রহণ পূর্ব্বক হুগলী নদীতে আত্মসমর্পণ করিয়াছে।

 (৫) সুবর্ণরেখা:—ইহা পশ্চিমে ধলভূম প্রদেশে জন্মিয়া এই জেলার অন্তর্গত নয়াবসান নামক পরগণার পশ্চিমপ্রান্তে প্রবিষ্ট হইয়া বঙ্গোপসাগরে পতিত হইয়াছে।

 এই প্রদেশ গঙ্গার মোহানায় সমুদ্রতীরে অবস্থিত থাকায় এবং এই নদ-নদীর গতি-পরিবর্ত্তন।প্রদেশের নদী সকল উত্তর ও পশ্চিমদিক্ হইতে আসিয়া দক্ষিণে ও পূর্ব্বদিকে প্রবাহিত হইয়া সাগরগর্ভে প্রবিষ্ট হওয়ায় এই জেলার দক্ষিণ ও পূর্ব্বাংশেই বেশী পরিবর্ত্তন সংসাধিত হইয়াছে দেখা যায়। পর্টুগীজ ও ওলন্দাজ প্রভৃতি ইউরোপীয়ান নাবিকদিগের খৃষ্টীয় ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে অঙ্কিত বাঙ্গালার কয়েকখানি পুরাতন মানচিত্র আছে। সেগুলি দেখিলে জানা যায় যে, এই কয়েক শতাব্দীর মধ্যেও এই জেলার দক্ষিণ-পূর্ব্বপ্রান্তের পূর্ব্বোক্ত নদী কয়েকটির গতির অনেক পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে। রূপনারায়ণ নদীর দক্ষিণাংশে সর্ব্বাপেক্ষা বেশী পরিবর্ত্তন সংসাধিত হইয়াছে দেখা যায়। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে অঙ্কিত রেনেলের মানচিত্রে রূপনারায়ণ নদীর নাম আছে; কিন্তু তৎপূর্ব্বে এই নদী ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। গাশতল্ডির ১৫৬১ খৃষ্টাব্দের মানচিত্রে ও ১৫৫৩ হইতে ১৬১৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে অঙ্কিত ডিব্যারোর মানচিত্রে এই নদী গঙ্গানামে উল্লিখিত হইয়াছে।[১] ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্রে ভাগীরথীর পশ্চিমদিকের কোন নদীর নাম লিখিত হয় নাই। ঐ সকল নদী পর্য্যায়ক্রমে ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ইত্যাদি সংখ্যাদ্বারা চিহ্নিত করা হইয়াছে। সেই নির্দ্দেশমত রূপনারায়ণ ও সুবর্ণরেখা যথাক্রমে ৩য় ও ৪র্থ নদী নামে উল্লিখিত হইয়াছে।[২] তৎপরে এই নদীটি ১৬৭০ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত ভ্যালেণ্টিনের মানচিত্রে পাথর-ঘাটা, ১৬৮৭ খৃষ্টাব্দের বাউরীর মানচিত্রে তমালী এবং ১৭০০ খৃষ্টাব্দের অঙ্কিত নাবিকদিগের মানচিত্রে তাম্বলী, তাম্বরলী, তাম্বরলীণ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল দেখা যায়।[৩] ভ্যালেণ্টিনের মানচিত্রে দেখা যায় যে, তৎকালে দামোদরনদের দুইটি শাখার একটি তমলুকের দক্ষিণে রূপনারায়ণ নদের সহিত মিলিত ছিল এবং অন্যটি পূর্ব্বাভিমুখীন হইয়া কালনার নিকট ভাগীরথীর সহিত সংযুক্ত হইয়াছিল। আমাদের মনে হয়, এই সংযোগ থাকার দরুণই বৈদেশিক নাবিকগণের নিকট তৎকালে এই নদীটি ভাগীরথীর শাখানদী বলিয়া অনুমিত হওয়াতে তাঁহারা ইহাকেও গঙ্গানামে অভিহিত করিয়াছিলেন। পরবর্ত্তিকালের নাবিকগণ এই নদীর তীরবর্ত্তী তাম্রলিপ্ত বা তমলুক নগরের নামানুসারে এই নদীকে তমালী, তাম্বলী প্রভৃতি নামে অভিহিত করিয়া থাকিবেন। রেনেল সাহেবই সর্ব্বপ্রথম তাঁহার মানচিত্রে ইহাকে রূপনারায়ণ নামে উল্লেখ করিয়াছেন। প্রাচীন নাবিকগণ এই নদীকে ভ্রমক্রমে “পুরাতন-গঙ্গা” নামে উল্লেখ করিয়াছিলেন, একথাও তিনি বলিয়া গিয়াছেন।[৪]

 ডিব্যারোর ও গাশতল্ডির মানচিত্রে দেখা যায় যে, তৎকালে রূপনারায়ণ নদী দুইটি প্রশস্ত শাখায় বিভক্ত হইয়া ভাগীরথীর সহিত মিলিত হইয়াছিল। ঐ দুইটি শাখার মধ্যবর্ত্তী ভূমিখণ্ড একটি দ্বীপের ন্যায় পরিলক্ষিত হয়। পরবর্ত্তিকালে অঙ্কিত ভ্যালেন‍্টীন ও বাউরীর মানচিত্রে পশ্চিম-দক্ষিণের শাখাটির অস্তিত্ব নাই। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর রেনেলের মানচিত্রে তমলুক হইতে টেঙ্গরাখালী পর্য্যন্ত একটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হইত দেখা যায়। ভ্যালেন‍্টীনের মানচিত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীগুলি চিত্রিত হয় নাই। বর্ত্তমান হল‍্দী নদী এই টেঙ্গরাখালী হইতে আরম্ভ হইয়া হুগলী নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে। তৎকালে ইহার যে অংশটি তমলুকের নিকট হইতে টেঙ্গরাখালী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, পরবর্ত্তিকালে উহা বিলুপ্ত হইয়া যাওয়ায় পূর্ব্বোক্ত দ্বীপটি মেদিনীপুর জেলার ভূমিখণ্ডের সহিত মিলিত হইয়া গিয়াছে। ঐ দ্বীপটি এখনকার সুতাহাটা ও মহিষাদল থানা।[৫]

 সুতাহাটা ও মহিষাদল থানার ন্যায় খাজুরী থানারও নৈসর্গিক সীমার অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে। ডিব্যারোর ষোড়শ শতাব্দীর মানচিত্রে ভাগীরথীর মোহানায় একটি নূতন দ্বীপ গঠিত হইতেছিল দেখা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর ভ্যালেন‍্টীনের মানচিত্রে সেই স্থানে—একটির দক্ষিণে আর একটি—দুইটি দ্বীপ অঙ্কিত আছে। এই দুইটি দ্বীপ যথাক্রমে খাজুরী দ্বীপ ও হিজলী দ্বীপ নামে অভিহিত হইয়াছিল। ইহাদের কথা কোম্পানীর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক কাগজপত্রে উল্লিখিত আছে। তৎকালে এই দুইটি দ্বীপের মধ্য দিয়া কাউখালী নদী নামে একটি নদী প্রবাহিত হইত। এক্ষণে উহার অস্তিত্ব নাই। ঐ নদীটি বিলুপ্ত হইয়া যাওয়ায় খাজুরী ও হিজলী দ্বীপ দুইটি একসঙ্গে মিলিয়া গিয়া এক্ষণে মেদিনীপুর জেলার ভূখণ্ডের সহিত সংযুক্ত হইয়া রহিয়াছে।[৬]

 মেদিনীপুর জেলার ভূমি-প্রকৃতি যেরূপ দ্বিবিধ, ইহার জল-বায়ুও সেইরূপ দুইপ্রকার। সাধারণতঃ দেখা যায় যে, ঘাটাল মহকুমার এবং জল-বায়ু ও স্বাস্থ্য।মেদিনীপুর সদর মহকুমার কতকাংশের জল-বায়ু বিশেষ অস্বাস্থ্যকর; কিন্তু তমলুক ও কাঁথি-মহকুমার এবং সদর মহকুমার অন্তর্গত জঙ্গল-মহালের জল-বায়ু বিশেষ স্বাস্থ্যকর। পরন্তু চিরদিন এরূপ ছিল না। প্রায় অর্দ্ধ-শতাব্দী পূর্ব্বে তমলুক ও কাঁথি মহকুমার অধিকাংশ স্থানের জল-বায়ু মন্দ ছিল এবং অন্যপক্ষে ঘাটাল ও মেদিনীপুর সদর মহকুমার জল-বায়ু বিশেষ স্বাস্থ্যকর ছিল। ম্যালেরিয়ার প্রবল প্রকোপে একদিকে যেমন এই অঞ্চল ভয়ানক অস্বাস্থ্যকর হইয়াছে, সেইরূপ কাঁথি ও তমলুকের লবণ-ব্যবসা উঠিয়া যাওয়ায় ঐ অঞ্চলের জল-বায়ুরও হীনাবস্থা তিরোহিত হইয়াছে। লবণ-ব্যবসা দ্বারা জল ও বায়ু উভয়ই বিদূষিত হইত।

 মেদিনীপুর জেলায় শৈল-মালা নিবিড় অরণ্য, সুবৃহৎ নদ-নদীপশু, পক্ষী, সরীসৃপাদি। ও মহাসমুদ্র প্রভৃতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সকল নিদর্শনই বর্ত্তমান থাকায় এই জেলায় নানাপ্রকার পশু, পক্ষী, সরীসৃপ ও মৎস্যাদি দেখিতে পাওয়া যায়। এই জেলার জঙ্গল-মহালে কেঁদো, নেক‍্ড়ে প্রভৃতি জাতীয় ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বন্যবরাহ, বন্যবিড়াল, কুক, শৃগাল, বানর, হনুমান‍্, খরগোস, সজারু, উদ‍্, খাট্টাশ প্রভৃতি বন্যজন্তু দেখিতে পাওয়া যায়। সময় সময় বন্যহস্তীও ময়ূরভঞ্জের জঙ্গল হইতে আসিয়া থাকে। বিভিন্ন প্রকারের মৃগ ও ময়ুর এই জেলার জঙ্গল-মহালে ও অন্যান্য অনেক স্থানে আছে। টীয়া, চন্দনা, ময়না, বুলবুল, দোয়েল, শ্যামা, নীলকণ্ঠ প্রভৃতি নানাপ্রকারের বন্য ও সামুদ্রিক পক্ষীও এই জেলায় দেখিতে পাওয়া যায়। অসংখ্য প্রকারের সুস্বাদু সামুদ্রিক মৎস্য ও কাঁকড়া এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। কেলেঘাই নদীর চিংড়ী মৎস্য সুপ্রসিদ্ধ। রশুলপুর, হলদী, রূপনারায়ণ প্রভৃতি নদীতে কুম্ভীর ও শিশুকও যথেষ্ট আছে এবং সময় সময় ঐ সকল নদীর মোহানায় হাঙ্গর দেখা যায়। এই জেলা নানা প্রকার বিষাক্ত সর্প, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গোধিকা ও কচ্ছপেরও বাসভূমি। মেদিনীপুর জেলার লোকালয়ে গো, মেষ, ছাগল, কুকুর, বিড়াল ও অশ্ব গৃহপালিত পশু; হাঁস, কপোত ও কুক্কুট গৃহপালিত পক্ষী। কেহ কেহ ময়ূর, হরিণ, শালিক, টীয়া, চন্দনা, ময়না, বুলবুল, প্রভৃতি পুষিয়া থাকে।

 মেদিনীপুর জেলার বিগত সেটেলমেণ্টের কার্য্য-বিবরণী হইতে জানা যায় যে, এই জেলায় নদীগর্ভ ছাড়া মোট ৫,০৫৬ বর্গমাইল বাআবাদী ও অনাবাদী ভূমি। ৩২,৩৫,৬৩৫ একার ভূমি আছে। তন্মধ্যে আবাদী ভূমি ৩,১১৬ বর্গ-মাইল বা ১৯,৯৪,৩৭৫ একার, আবাদের উপযোগী পতিত ১,১০৭ বর্গমাইল বা ৭,০৮,১৭৫ একার এবং আবাদের অনুপযোগী পতিত, ৮৩৩ বর্গ-মাইল বা ৫,৩৩,৭৮৫ একার (বাস্তুবাটী ৬৪,১৩৮ একার, জলাশয় ২,২৭,২৭১ একার, রাস্তা, বাঁধ, শ্মশান, গোচারণ-ভূমি ইত্যাদি ২,৪৮,৬৭৮ একর) ভূমি আছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, মোট ভূমির শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ আবাদী, ২২ ভাগ আবাদের যোগ্য পতিত এবং অবশিষ্ট ১৬ ভাগ আবাদের অনুপযুক্ত পতিত ভূমি। উপরি উক্ত ১৯,৯৪,৩৭৫ একার বা ৩,১১৬ বর্গ-মাইল ভূমির মধ্য হইতে ৪৭,১৭৪ একার বা ৭৪ বর্গ-মাইল মাত্র ভূমি সংবৎসরের মধ্যে দুইবার চাষ হয়। অর্থাৎ মোট ২০,৪১,৫৫১ একার বা ৩,১৯০ বর্গমাইল জমি এক্ষণে প্রতি বৎসর চাষ হইয়া থাকে।[৭]

 ধান্যই এই জেলার প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য। পূর্ব্বে এ দেশে তুলা, নীল ও তুঁতের চাষ প্রচুর পরিমাণে হইত। এক সময় এই সকলকৃষিজ দ্রব্য। দ্রব্য বাণিজ্যার্থে এ প্রদেশ হইতে দেশ-দেশন্তরে প্রেরিত হইয়াছে।[৮] এক্ষণে নীলের ব্যবসা নাই বলিলেই চলে, তুলার চাষ প্রায় কেহই করে না, তুঁতও পূর্ব্বের তুলনায় সামান্যই উৎপন্ন হইয়া থাকে। এক সময় এতদ্দেশে রেশম-ব্যবসায়েরও যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল। এরূপ গ্রাম ছিল না, যেখানে রেশম-ব্যবসা সম্বন্ধীয় দু’একজন অভিজ্ঞ লোক দৃষ্ট না হইত। এক্ষণে এই ব্যবসাটিও হ্রাস হইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বে এতদঞ্চলে কফি ও গোল আলুর চাষ বড় একটা কেহই করিত না। কিন্তু আজকাল ঘাটাল ও তমলুক মহকুমায় কফি ও গোল আলুর চাষ যথেষ্ট পরিমাণে হইতেছে। নারিকেল, সুপারি, আনারস, কদলী প্রভৃতি এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। নানা প্রকার সুস্বাদু ও সদ্‌গন্ধযুক্ত পান, সুস্বাদু ও সুবৃহৎ মূলা, সার কচু, মান ও তরমুজের চাষও এই জেলার স্থানে স্থানে হইয়া থাকে।

 বাঙ্গালার শস্যের মধ্যে ধান্যই প্রধান। এই জেলার দোফসলী জমী সমেত মোট আবাদী ২০,৪১,৫৫১ একার জমির মধ্যে ১৮,১৯,৮৯৪ একার জমিতে কেবল ধান্যই উৎপন্ন হইয়া থাকে। অন্যান্য ফসল অবশিষ্ট ২,১২,৬৫৭ একর জমিতে উৎপন্ন হয়। ধান্যোৎপত্তির পরিমান হিসাবে বাঙ্গালার জেলাগুলি বিন্যাস করিলে মেদিনীপুর প্রথম স্থান অধিকার করে। ময়মনসিংহ ও বাখরগঞ্জের স্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়।[৯] কিন্তু তাহা হইলেও পৃথিবীর অন্যান্য যে সকল দেশে ধান্য উৎপন্ন হইয়া থাকে, ঐ সকল দেশের উৎপন্ন ফসলের সহিত তুলনা করিলে দেখা যায় যে, মেদিনীপুরে অতি সামান্য ধান্যই উৎপন্ন হয়। প্রতি একারে স্পেন দেশে ৭১ / মণ, ইটালীতে ৪১ / মণ, মিসর দেশে ৪১ মণ, জাপানে ২৬ / মণ এবং আমেরিকার যুক্তরাজ্যে ২৫ মণ করিয়া ধান্য উৎপন্ন হয়।[১০] কিন্তু মেদিনীপুরে মাত্র ১৬ মণ। সমগ্র ভারতবর্ষে ধান্যোৎপত্তির গড়পরতা পরিমাণ প্রতি একারে প্রায় ২০ মণ। সমগ্র ভারতে অনূন্য দশ হাজার রকম আমন ধান্য আছে। বাঙ্গালা দেশেই প্রায় চারি হাজার প্রকার দৃষ্ট হয়। আউশ ধান্য যে কত প্রকার আছে, তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন।[১১] মেদিনীপুর জেলায় নিম্নলিখিত নামে ৩০।৩২ রকমের আমন ধান্য এবং ১৫।১৬ রকমের আউশ ধান্য সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়।

 আমন ধান্য:—গেরিকাজল, লোন, হেমতা, রামশাল, দ্রৌপদীশাল, কলমকাঠি, কালিন্দী, রঙ্গিকয়াল, জামাইগাড়ু, গয়াবালি, হলুদগুঁড়ি, সোনাতার, সিতাহার, বাঁশকুলি, দাউদখানি, কামিনীকুঞ্জ, বকুলকুঞ্জ, রূপশাল, পাণ্ডুলই, পশীনাদন, চেঙ্গা, গুয়াখুরী, বাঁকুই, মহিষমূড়ি, পিঙ্গাশোল, মহীপাল, ভূতাশোল, কর্ণশাল, মেটে আকড়া, কাশিফুল, গাঁজাকলি প্রভৃতি।

 আউশ ধান্য:—মন্দিরকণা, বেড়ানতি, আসলভূমনি, ঋঞ্জি, ভুতমুড়ি, শাটী, পিপড়েশার, সূর্য্যমণি, চন্দ্রমণি, মধুমালতী, খুক‍্নি, কাজলা, দলকচু, লোহাগজাল, তুলসীমঞ্জুরী, সৌরভি, কালামাণিক প্রভৃতি।

 এই জেলায় যেযে ফসল যে পরিমাণ জমিতে উপন্ন হইয়া থাকে, নিম্নে তাহার একটি তালিকা প্রদত্ত হইল।[১২]

ফসলের নাম ও জমির পরিমাণ(একার)  ফসলের নাম ও জমির পরিমাণ(একার)
খাদ্য শস্য ও কলাই:—  তৈলবীজ:—
 ধান্য ১৮,১৯,৮৯৪   তিল ১৪,১৪৭
 বজরা, জনার ১২,৩৫৯   সরিষা ১৩,২৩৬
 কোদো ২১,৬৫৪   তিসি ৪,৮৫৫
 বিরি ও মুগ ১৮,৪৬৯   জাড়া ১,৬৬৪
 অড়হর ৭,৮৮৬   গুন্দলী ৭,৪৩১
 গম ৮০১   শূরগুজা ৪,১৯৮
 যব ৫৩৪   সূক্ষ্ম তন্তু:—
 বুট ৭৫৪   পাট ১২,৬৪৮
 খেসারি,মসুর ১৪,০৬৫   তুলা ২,৫৫৯
মসলা:—  মাদক দ্রব্য:—
 লঙ্কা, হলুদ ইত্যাদি ৩,২৬২   তামাক ৭৩৯
রং:—  বাগান ও বরোজ:—
 নীল ৯৫   আম বাগান ১২,০১৮
 কুসুম ৩৮   কলা-বাগান
চিনি:—   ২৭,৮৯৩
 ইক্ষুদণ্ড ৬,৬৩৮   পান বরোজ
 গাজর, বীট ইত্যাদি ৩,৮৪৪   তুঁত ১০,১৭০
তরি-তরকারী:—  বিবিধ:—
 গোল আলু ৩,১২৪   জুন ও বাবই ৫৩২
 শাক-সবজি ১৪,২৯১   দলঘাস ১১৮
 সার কচু ৩৯৭   মাদুরকাঠি ১,৬৭৮

 এতদ‍্ভিন্ন এই জেলায় কাঁঠাল, বেল, কুল, পেয়ারা, আতা, লোনা, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কামরাঙ্গা, জলপাই, তেঁতুল, আমড়া, বৃক্ষ, লতা ও ফল, মূল, ইত্যাদি।চালতা, পেঁপে, কত‍্‍বেল, জামির, কাগজি, বাতাপি নেবু, তাল ও খেজুর প্রভৃতি ফল, যজ্ঞডুম্বুর, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, রক্ত এরণ্ড, শিরীষ, ঘৃতকুমারী, ধুতুরা, শতমূল, অনন্তমূল, আমআদা, পিপুল, সজিনা, চিরতা, গুলঞ্চ, কালকাসন্দ, হাতীগুঁড়া প্রভৃতি ভেষজ উদ্ভিদাদি এবং গোলাপ, বেল, যুঁই, চামেলী, কুন্দ, গন্ধরাজ, কামিনী, শেফালি, টগর, করবী, চাঁপা, বকুল, রজনীগন্ধ, কেতকী প্রভৃতি নানাপ্রকার পুষ্প প্রচুর পাওয়া যায়। এই জেলার বালুকা-স্তুপের উপর বাদাম নামক এক প্রকার ফলের বৃক্ষ (Anacordium Occidental) জন্মিয়া থাকে। সাধারণতঃ উহা “হিজলী-বাদাম” আখ্যায় আখ্যাত। ফলগুলি দেখিতে সুন্দর এবং আস্বাদও সুস্বাদু। বাঁশ, বেত, নল, শর, খড়ি, হোগলা প্রভৃতি গৃহনির্ম্মাণোপযোগী শরঞ্জামীও এই জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে। এই জেলার জঙ্গল-মহালে শাল, পিয়াশাল, মহল, কুসুম, পলাশ প্রভৃতি মূল্যবান‍্ বৃক্ষও জন্মিয় থাকে। পূর্ব্বে জঙ্গল-মহালে এই সকল কাষ্ঠ অপর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাইত; কিন্তু বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথ প্রস্তুত হওয়ার পর হইতে বৎসর বৎসর জঙ্গল কাটাইয়া ঐ সকল কাষ্ঠ বিক্রীত হইয়া যাওয়াতে মেদিনীপুরে সেগুলি ক্রমশঃ দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে।

 মেদিনীপুর জেলার মোট পরিমাণ-ফল ৫,১৮৬ বর্গ-মাইল।[১৩] ইহার আয়তন ইংলণ্ডের দশ ভাগের এক ভাগ, স্কটল্যাণ্ড অথবা আর্ল্যাণ্ডের ছয় জেলার আয়তন। অংশের একাংশ, ডেনমার্ক অথবা সুইজারল্যাণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ এবং বেলজিয়ামের অর্দ্ধেকের সমান। ইউরোপের তুরস্ক অথবা ওয়েল‍্স‍্ মেদিনীপুর জেলার চেয়ে অল্পই বড়। মণ্টেনিগ্রোর ও মেদিনীপুর জেলার আয়তন প্রায় সমান। বঙ্গদেশের অন্তর্গত জেলাগুলির তুলনায় ময়মনসিংহ জেলা প্রথম এবং মেদিনীপুর জেলা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছে। ২৪ পরগণা, হুগলী, হাওড়া ও বগুড়া এই চারিটি জেলার মোট আয়তন মেদিনীপুর জেলার আয়তনের প্রায় সমান।

 রাজ্যশাসন ও রাজস্ব সম্পর্কীয় নানাপ্রকার কার্য্যের সুবিধার জন্য মহকুমা ও থানা বিভাগ। এই জেলাকে মেদিনীপুর-সদর, কাঁথি, তমলুক ও ঘাটাল নামে চারিটি উপবিভাগ বা মহকুমায় এবং নিম্নলিখিত ২৬টি থানায় বিভক্ত করা হইয়াছে।  সদর মহকুমা:–(১) মেদিনীপুর, (২) খড়্গপুর, (৩) নারায়ণগড়, (৪) দাঁতন, (৫) গোপীবল্লভপুর, (৬) ঝাড়গ্রাম, (৭) বিনপুর, (৮) গড়বেতা, (৯) শালবনি, (১০) কেশপুর, (১১) ডেবরা, (১২) সবঙ্গ।

 কাঁথি মহকুমা:–(১) কাথি, (২) খাজুরী, (৩) রামনগর, (8) এগরা, (৫) পটাশপুর, (৬) ভগবানপুর।

 তমলুক মহকুমা:–(১) তমলুক, (২) মহিষাদল, (৩) নন্দিগ্রাম, (৪) সূতাহাটা, (৫) পাঁশকুড়া।

 ঘাটাল মহকুমা:–(১) ঘাটাল, (২) চন্দ্রকোণা, (৩) দাসপুর।

 পূর্ব্বোক্ত ২৬টি থানা ব্যতীত এই জেলার (নারায়ণগড় থানায়) কেশিয়াড়ী, (দাঁতন থানায়) মোহনপুর, (সবঙ্গ থানায়) পিঙ্গলা, পুলিশ-ষ্ট্রেশন।(গোপীবল্লভপুর থানায়) নয়াগ্রাম, (কাঁথি থানায়) বাহিরী ও বাসুদেবপুর, (ভগবানপুর থানায়) হেঁড়িয়া, (তমলুক থানায়) ময়না, (মহিষাদল থানায়) গেঁওখালী, এবং (চন্দ্রকোণা থানায়) রামজীবনপুর এই দশটি স্থানে দশটি পুলিশ-ষ্টেশন আছে। বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের খড়্গপুর ষ্টেশনেও একটি পুলিশ-ষ্টেশন আছে।

 মেদিনীপুর সদর মহকুমার পরিমাণ ফল ৩,২৭০ বর্গ-মাইল। ইহা সাধারণতঃ জঙ্গল-মহাল ও বিলাত-মহাল নামে দুই ভাগে বিভক্ত। সদর মহকুমা।বিনপুর, গড়বেত, শালবনি, ঝাড়গ্রাম ও গোপীবল্লভপুর, প্রধানতঃ এই পাঁচটি থানা জঙ্গলমহালের অন্তর্গত। ইহার পরিমাণ ফল ১,৮২৭ বর্গ-মাইল। অবশিষ্ট সাতটি থান। বিলাত-মহাল। জঙ্গল-মহালের সর্বত্র যদিও এক্ষণে জঙ্গল নাই, তথাপি এখনও উহার স্থানে স্থানে নিবিড় শাল-জঙ্গল দেখিতে পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের জঙ্গল মহালে গাল, মধু, ধূনা, তসরগুটী, পশুচর্ম্ম, হরিনের শিং, নানাপ্রকার জন্তুর হাড়, পাখীর পালক ইত্যাদি দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। মেদিনীপুর সদর মহকুমার বিলাত-মহাল জঙ্গলশূন্ত, সমস্তই কৃষ্ট ভূমি।

 মেদিনীপুর জেলার প্রধান নগরের নাম মেদিনীপুর। ১৭৮৩ মেদিনীপুর শহর। খৃষ্টাব্দের ২২ শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর সহর মেদিনীপুর জেলার প্রধান নগর বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। ইহা কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। অক্ষাংশ ২২°২৫'২৩” উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৮৭°২১'৪৫” পূর্ব্ব। মেদিনীপুর নগরীর সীমা-বিবরণ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত কবিতাটি প্রচলিত আছে।—

“আবসবাটী যৎ উত্তরস্তাম্
গোপশ্চ যৎ পশ্চিমদিগ্বিভাগে।
কংসাবতী ধাবতি দক্ষিণে চ
সা মেদিনীনাম পুরী শুভেয়ম্॥”

 মেদিনীপুর কতদিনের নগর, তাহা এক্ষণে সঠিক জানিবার উপায় নাই। আইন-ই-আক‍্‍বরীতে জলেশ্বরের মধ্যে মেদিনীপুর একটি সুবৃহৎ নগর বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। প্রাচীন বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের কড়চা হইতে জানা যায় যে, চৈতন্যদেব ১৫০৯ খৃষ্টাব্দে এই সহরের মধ্য দিয়া শ্রীক্ষেত্রে গমন করিয়াছিলেন।[১৪] ইহার পূর্ব্বের মেদিনীপুর সহরের আর কোন সন্ধান এত দিন পাওয়া যায় নাই। সম্প্রতি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় শিখর ভূমির রাজা রামচন্দ্র-কৃত একখানি প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করিয়াছেন। উহার এক স্থানে আছে:—

“শালি-ধানস্য চোৎপাদ গাণ্ডিচাদেশে প্রজায়তে
কৃষকাণাং ভুরিবাসো যত্র নাস্তি চ কাননম্
প্রাণকরাথ্যো নৃপতিৰ্গণ্ডিচাদেশস্য শাসকঃ
মেদিনীকোষকারশ্চ যস্য পুত্রো মহানভূৎ
বিহায় গাণ্ডিচাদেশং মেদিনীপুরং জগাম সঃ। ৭৫৪”

 বঙ্গদেশে মুসলমানদিগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইলেও এ দেশের স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন হিন্দু রাজা ছিলেন। এ প্রদেশে প্রাণকর নামে ঐরূপ একজন রাজা রাজত্ব করিতেন। প্রাণকরের পুত্র মেদিনীকর কর্তৃক এই মেদিনীপুর নগর স্থাপিত হইয়াছিল এবং তাঁহারই নামানুসারে ইহার নামকরণ হইয়াছে। মেদিনীকরের প্রণীত মেদিনীকোষ একখানি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। শাস্ত্রী মহাশয় অনুমান করেন যে, ১২০০ হইতে ১৪৩১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে মেদিনীকোষ লিখিত হইয়াছিল। সুতরাং অনুমান করা যাইতে পারে যে, উহারই মধ্যে কোন সময়ে মেদিনীপুর নগর স্থাপিত হয়।[১৫]

 মেদিনীপুর সহরেই মেদিনীপুর জেলার জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট-কালেক্টার, পুলিশ-সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট, সিভিল সার্জ্জন, একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, পোষ্টেল-সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট প্রভৃতি উচ্চপদস্থ রাজকর্ম্মচারিগণ অবস্থান করেন। মেদিনীপুর সহরে একটি জেলা বোর্ড আফিস এবং একটি সেণ্ট্রাল জেল আছে। এই জেলে সহস্রাধিক কয়েদী রাখিবার স্থান আছে। কয়েদীদের দ্বারা গালিচা, পাপোষ, বিছানার চাদর, বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল প্রভৃতি নানাপ্রকার উৎকৃষ্ট দ্রব্যাদি প্রস্তুত হইয়া থাকে। মেদিনীপুর সহরের গেড়েরীরাও উৎকৃষ্ট কম্বল প্রস্তুত করিয়া থাকে। গেড়েরীর ৪।৫ পুরুষ হইল, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ হইতে আসিয়া এই সহরে বাস করিতেছে। উহাদের নিজেদেরই পালিত মেষ আছে এবং উহা হইতেই তাহার লোম সংগ্রহ করিয়া থাকে।[১৬] মেদিনীপুর সহরের স্বর্ণকারগণও নানা প্রকার বহুমূল্য অলঙ্কার প্রস্তুত করে। আজকাল মেদিনীপুরের চর্ম্মকারগণও উৎকৃষ্ট জুতা প্রস্তুত করিতেছে।

 সদর মহকুমার অন্যান্য প্রসিদ্ধ স্থানগুলির মধ্যে খড়্গপুর সহরের নাম সর্ব্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। মেদিনীপুর সহর এই জেলার প্রধানখড়্গপুর। নগর হইলেও দিন দিন খড়্গপুরের যেরূপ শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহ দেখিয়া মনে হয়, এক সময় খড়্গপুর শুধু এই জেলার নয়, সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ স্থান হইয়া উঠিবে। কিঞ্চিদধিক বিশ বৎসর পূর্ব্বে খড়্গপুর একটা সামান্য পল্লী ছিল; বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথের সংযোগস্থল হওয়ার পর হইতেই ইহার শ্রীবৃদ্ধি আরম্ভ হইয়াছে। খড়্গপুর হইতে মেদিনীপুরের দুরত্ব ৫।৬ মাইল মাত্র।

 মেদিনীপুর নগরীর দক্ষিণে প্রবাহিত, কংসাবতী নদীর পরপার হইতে “জগন্নাথ রাস্তা” নামে পরিচিত যে প্রশস্ত রাজপথটি উড়িষ্যা প্রদেশের মধ্যে চলিয়া গিয়াছে সেই রাজপথটার উপরেই খড়্গপুর সহরটী অবস্থিত। পূর্ব্বে এই স্থানে একখণ্ড তরুলতাবিহীন মরুভূমি তুল্য প্রস্তরময় সু-উচ্চ সুবিস্তৃত ভূমিখণ্ড ছিল। লোকে তাহাকে “খড়্গপুরের দমদমা” বলিত। এই দমদমাটি পার্শ্ববর্ত্তী সমতল ক্ষেত্র হইতে প্রায় ৪০ ফিট উচ্চ ছিল। ইহার উপর দণ্ডায়মান হইলে ৪।৫ মাইলমধ্যে বৃত্তাকারে অবস্থিত জনপদগুলি অতি নিম্নভূমি বলিয়া মনে হইত। খড়্গপুরের এইরূপ স্বাভাবিকী অবস্থা অবলোকন করিয়া বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানী উহার উপরিভাগে তাঁহাদের রেলপথের সংযোগস্থল মনোনীত করিয়াছেন। দমদমা ও তৎসন্নিহিত পাঁচ ছয়খানি গ্রাম-সংবলিত প্রায় চৌদ্দহাজার বিঘা ভূমির উপর বৃহদায়তন খড়্গপুর ষ্টেশন ও অন্যান্য কার্য্যালয়াদি সমন্বিত খড়গপুর সহর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। নানাপ্রকার সুদৃশ্য সুবৃহৎ অট্টালিকা, সুরুচি-সম্পন্ন মনোহর উদ্যান, তরুরাজি বিরাজিত সুপ্রশস্ত পথ, বৈদ্যুতিক আলোক, জলের কল প্রভৃতির দ্বারা সুশোতিত হইয়া খড়্গপুর এক্ষণে একটি সুন্দর নগরে পরিণত হইয়াছে। সাহেব, বাঙ্গলী, পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী, পার্শী, শিখ, নাগপুরী, মারহাট্টি, হিন্দুস্থানী, উড়িয়া, বেহারী, আসামী প্রভৃতি নানাদেশীয় নানাজাতিয় নানাধর্ম্মাবলম্বী জনগণদ্বারা সমাকীর্ণ হওয়ায় ইহার সমধিক শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। খড়্গপুরের জল-বায়ুও বিশেষ স্বাস্থ্যকর। খড়্গপুর বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের প্রধান ষ্ট্রেশন। রেলওয়ে-কোম্পানী এইখানে প্রায় দুই শত বিঘা জমীর উপরে একটি বৈদ্যুতিক গৃহ-বিশিষ্ট প্রকাণ্ড কারখানা স্থাপন করিয়াছেন। ঐ কারখানায় কোম্পানীর যাবতীয় কার্য্যই নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। খড়্গপুরে কোম্পানীর একটি প্রথম শ্রেণীর দাতব্য চিকিৎসালয় ও দুইটি সুপরিচালিত ইংরাজী বিদ্যালয় আছে।

সদর মহকুমার কেশপুর থানার অন্তর্গত আনন্দপুর এবং নারায়ণগড় থানার অন্তর্গত কেশিয়াড়ি ও গগনেশ্বর গ্রাম এক সময় তসর-কাপড়ের আনন্দপুর ও কেশিয়াড়ী।জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। শাদা, নীল, পীত, বেগুনে, ময়ুরকণ্ঠী প্রভৃতি নানা রঙ্গের নানাপ্রকার ধুতি, শাড়ী এই সকল স্থানে প্রস্তুত হইয়া দেশ বিদেশে বিক্রয়ার্থ প্রেরিত হইত। সম্প্রতি বিশ পঁচিশ বৎসর হইল, এই ব্যাবসা এ জেলা হইতে এক প্রকার উঠিয়া যাইতেই বসিয়াছে। কলে প্রস্তুত বিলাতী সিল্কের সহিত প্রতিযোগিতায় দাঁড়াইতে না পারাই এই ব্যাবসালোপের প্রধান কারণ। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে কেশিয়াড়িতে অন্যুন আট নয় শত ঘর তাঁতির বাস ছিল। এক্ষণে পঞ্চাশ ঘরও আছে কি না সন্দেহ। আনন্দপুরও এক সময় বিশেষ বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম বলিয়া অভিহিত হইত। আয়তনে ইহা মেদিনীপুর সহর অপেক্ষাও বড় ছিল। অনেক ধনী মহাজন এই স্থানে বাস করিতেন। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দের চুয়াড়বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীরা এই গ্রামটি দুইবার লুণ্ঠন করিয়া পোড়াইয়া দিয়াছিল।

 ডেবরা থানার অন্তর্গত লোয়াদা গ্রামে উৎকৃষ্ট মিছরী প্রস্তুত হয়। পূর্ব্বে এই স্থানে অনেকগুলি মিছরীর কারখানা ছিল এবং এই স্থানে অনেক সঙ্গতিপন্ন মহাজনও বাস করিতেন। লোয়াদার লোয়াদা।মিছরী অনেক স্থানে বিক্রয়ার্থ প্রেরিত হইত। কিন্তু কয়েক বৎসর হইল, এতদঞ্চলে ভয়ানক ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব হওয়ায় গ্রামবাসী ও ব্যাবসায়িগণ অধিকাংশই দেশত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই কারণে ব্যাবসাটিও দেশ হইতে লোপ পাইতে বসিয়াছে। লোয়াদার সুবৃহৎ অট্টালিকা ও রাস্তাঘাট ক্রমশঃ জঙ্গলাকীর্ণ হইতেছে।

 সবঙ্গ থানার অনেক স্থানে নানা প্রকার উৎকৃষ্ট মাদুর প্রস্তুত হয়। বৎসরে প্রায় চার পাঁচ লক্ষ জোড়া মাদুর এই জেলায় প্রস্তুত হইয়াসবঙ্গ। স্থানান্তরে বিক্রয়ার্থ প্রেরিত হইয়া থাকে। সবঙ্গ থানার মধ্যে চারি পাঁচটি মাদুরের হাট আছে; প্রতি হাটবারে প্রত্যেক হাট হইতেই দেড় হাজার দুই হাজার টাকার মাদুর বিক্রয় হয়। মহাজনগণ ঐ সকল স্থান হইতে মাদুর কিনিয়া লইয়া কলিকাতা এবং অন্যান্য স্থানে বিক্রয় করে।[১৭]

 সদর মহকুমার অন্তর্গত গড়বেতা ও দাঁতনে দুইটি মুন‍্সেফ চৌকী ও দুইটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। নারায়ণগড়ে ও সবঙ্গ থানার সদর মহকুমার অন্যান্য স্থান।অন্তর্গত পিঙ্গলা গ্রামেও এক একটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। খড়্গপুর থানার অন্তর্গত জক্‌পুর ও মালঞ্চ প্রভৃতি গ্রামে, সবঙ্গ থানার পিঙ্গলা, রাজবল্লভ ও গোবৰ্দ্ধনপুর গ্রামে, দাঁতন থানার আগর-আড়া ও নারায়ণচক প্রভৃতি গ্রামে এবং নারায়নগড়, কেশপুর ও ডেবরা থানার স্থানে স্থানে অনেক কায়স্থ ও সৎ ব্রাহ্মণের বাস আছে। জঙ্গল মহালের অন্তর্গত ঝাড়গ্রাম, গিডনী, দহিজুড়ী, শিলদা প্রভৃতি স্থানের জল বায়ু বিশেষ স্বাস্থ্যকর। বায়ু পরিবর্তনের জন্য আজকাল অনেকে এই সকল স্থানে আসিয়া থাকেন।

 ১৮৫২ খৃষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী কাঁথি মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সমগ্র বঙ্গদেশর মহকুমাগুলির মধ্যে কাঁথি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছে। শ্রীরামপুর মহকুমার পরেই কাঁথি মহকুমার নাম করা হইয়া থাকে। কাঁথি মহকুমার পরিমান ফল ৮৪৯ বর্গমাইল। আয়তনে ইহা কাঁথি মহকুমা।হাওড়া জেলার দ্বিগুণ। কাঁথি মহকুমার মধ্যে একটি সুউচ্চ বালুকাস্তুপ-শ্রেণী আছে। কাঁথি মহকুমার প্রধান নগর কাঁথি ধবল-শিখরমালা শোভিত এই বালুকাস্তুপের উপর অবস্থিত। এই বালুকাস্তুপ-শ্রেণী পুর্ব্বদিকে রশুলপুর নদীর মোহান হইতে আরম্ভ হইয়া পশ্চিম দিকে সুবর্ণরেখা নদীর মুখ পর্য্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে। উহা দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৬ মাইল এবং প্রস্থে কোথাও এক, কোথাও অর্দ্ধ মাইলের কমও দেখা যায়। আর কিছু উচ্চ হইলে এই বালুকাস্তুপকে বালুর পাহাড় বলা যাইত। ভূতত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিতগণ এই বালুয়াড়ীর গঠন সম্বন্ধে অনুমান করেন যে, খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর এক ভীষণ বন্যায় যেরূপে উড়িষ্যার চিল্কা উপসাগরের একপার্শ্বে এক সুবিস্তৃত বালুকাময় ভূমিখণ্ড গঠিত হইয়া চিল্কা উপসাগরকে চিল্কা হ্রদে পরিণত করিয়াছে এই বালুয়াড়ীও সেইরূপে সেই একই কারণে একই সময়ে গঠিত হইয়াছে। মেদিনীপুরের ভূতপূর্ব্ব কালেক্টর প্রত্নতত্ববিদ‍্ মাননীয় বেলি সাহেবও (H. W. Bayley) এই মতাবলম্বী[১৮]

 কাঁথি সহরেই কাঁথি মহকুমার দেওয়ানী, ফৌজদারী ও গবর্ণমেণ্টের খাস-মহাল অফিসাদি প্রতিষ্ঠিত আছে। কাঁথিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও আছে। ভাষাতত্ত্ববিদ‍্ সুপণ্ডিত রায় সাহেব যোগেশচন্দ্র কাঁথি সহর। রায় বিদ্যানিধি মহাশয় অনুমান করেন, কাঁথির নিকট বালুয়াড়ী বা বালুর কাঁথ আছে বলিয়া এই স্থানের নাম কাঁথি হইয়াছে।[১৯] ১৬৭০ খৃষ্টাব্দের ভ্যালেণ্টিনের মানচিত্রে যে স্থান কেন্দুয়া নামে উল্লিখিত হইয়াছে পণ্ডিতগণ ঐ স্থানকেই কাঁথি বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।[২০] কাঁথি সহরে সুলভ মূল্যে সাধারণ গৃহস্থের উপযোগী এক প্রকার বেতের চেয়ার প্রস্তুত হইয়া থাকে। উহা দীর্ঘকালস্থায়ী এবং দেখিতেও সুন্দর।

 কাঁথি থানার অন্তর্গত জুনপুট, দৌলতপুর ও দরিয়াপুর এবং রামনগর থানার অন্তর্গত চাঁদপুর, বীরকুল, দীঘা প্রভৃতি সমুদ্রতীরবর্ত্তী স্থানগুলির জল-বায়ু যেরূপ স্বাস্থ্যকর, ঐ সকল স্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্যও সেইরূপ কাঁথি মহকুমার সমুদ্র-তীরবর্ত্তী স্থান-সমূহ।মনোরম। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন দাৰ্জ্জিলিং অনাবিষ্কৃত ও শিমলা-শৈল দুরধিগম্য ছিল, তখন রাজ্যসংস্থাপনের ও দেশব্যাপী অশাস্তি নিবারণের চিন্তায় কাতর হইয়া ভারতের ভাগ্যবিধাতা ইংরাজগণ সময় সময় বিশ্রামলাভের জন্য এই সকল স্থানে আসিতেন। বীরকুল প্রথম গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংসের গ্রীষ্মাবাস ছিল। ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলের অনেক কাগজপত্রেই বীরকুলের উল্লেথ আছে। [২১]

 ওয়ারেন হেষ্টিংস যে বাংলোতে বাস করিতেন, উহা বহুদিন হইল, বঙ্গোপসাগরের গর্ভসাৎ হইয়াছে। রামনগর থানার অন্তর্গত দীঘা গ্রামে এক্ষণে একটি ডাক-বাংলো আছে। রাজপুরুষগণ ঐ অঞ্চলে গেলে এক্ষণে সেই বাংলোতে বাস করিয়া থাকেন। জুনপুট ও দৌলতপুর গ্রামেও এক-একটি ডাক-বাংলো আছে। পৌষ মাসের সংক্রান্তির সময় সমুদ্রতীরবর্ত্তী ঐ সকল স্থানে মেলা বসে; সেই সময় সমুদ্রস্নান উপলক্ষে তথায় বহুলোকের সমাগম হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে দৌলতপুর ও দরিরাপুরের কথা আছে। সাহিত্যসম্রাটের অমর লেখনী-সংস্পর্শে দৌলতপুর ও দরিরাপুরের নাম চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে।

 কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত পটাশপুর, ভগবানপুর, খাজুরী (জনকা) ও রামনগরে এক-একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত আছে। কাজলাগড়ে কাঁথি মহকুমার অন্যান্য স্থান।বৰ্দ্ধমানের মহারাজাধিরাজের প্রতিষ্ঠিত একটি চিকিৎসালয়ও বিদ্যমান। ভগবানপুরে এবং খাজুরী থানার অন্তর্গত কলাগেছিয়া গ্রামে গভর্ণমেণ্টের এক একটি খাস-মহাল কাছারী আছে। পটাশপুর ও রামনগর থানার অনেক স্থানে আজকাল উংকৃষ্ট সূতার কাপড় প্রস্তুত হইতেছে। রামনগর থানার অন্তর্গত চন্দনপুর গ্রামে পিতলের সুদৃশ্য ঘট ও অন্যান্য নানাপ্রকার তৈজস প্রভৃতি প্রস্তুত হয়। ভগবান‍্পুর থানার অন্তর্গত গোপীনাথপুর গ্রামে উৎকৃষ্ট সুদৃশ্য পাল্কী ও কাঠের দ্রব্যাদি প্রস্তুত হইয়া থাকে। এগরা থানার অন্তর্গত বালিঘাই গ্রামের বাজার এবং পটাশপুর থানার অন্তর্গত গোনাড়া গ্রামের মঙ্গলামাড় হাট এতদঞ্চলের মধ্যে বিখ্যাত। এগরা (নেগুঁয়া) গ্রামেই প্রথমে কাঁথি মহকুমার কার্য্যালয়াদি প্রতিষ্ঠিত ছিল, পরে ঐ স্থান হইতে কাঁথিতে উঠিয়া যায়। পটাশপুর থানার অন্তর্গত গোনাড়া, ব্রজলালপুর, পড়িহারপুর, ধুসুৰ্দ্ধা প্রভৃতি গ্রামে অনেক কায়ন্থের বাস আছে।

 তমলুক মহকুমা মেদিনীপুর জেলার পূর্ব্বপ্রান্তে এবং কাঁথি মহকুমার উত্তর-পূর্ব্বে অবস্থিত। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে এই মহকুমাটি তমলুক মহকুমা। গঠিত হয়। ইহার পরিমাণ-ফল ৬৫৩ বর্গ মাইল। তমলুকে আজকাল বাল‍্তি ও ষ্টীলের ট্রাঙ্ক প্রস্তুত হইতেছে। এক সময় এই মহকুমায় রেশম-ব্যবসায়ের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল। কিন্তু বিদেশী সিল্কের সহিত প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিতে না পারায় এক্ষণে সে ব্যবসা এক প্রকার বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে; অনেক মহাজনই ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া কারবার বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; কেহ কেহ সর্ব্বস্বান্ত হইয়া দেশত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। অধিক কি, ওয়াট‍্সন কোম্পানীর মত ধনী মহাজনও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া এ অঞ্চল হইতে ব্যবসা উঠাইয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন। মধ্যে বেঙ্গল সিল্ক কোম্পানীও সামান্তভাবে কারবার আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহাও এক্ষণে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নীলের ব্যবসাও এক সময়ে এ অঞ্চলে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল; কিন্তু তাহাও এক্ষণে সমূলে বিলুপ্ত।[২২]

 এই মহকুমার প্রধান নগর তমলুক রূপনারায়ণ নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত। কলিকাতা হইতে ইহার দূরত্ব প্রায় ৪০ মাইল। ইহার তমলুক সহর। অক্ষাংশ ২২° ১৭' ৫০” উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৮৭° ৫৭' ৩০” পূর্ব্ব। এই মহকুমার দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত প্রভৃতি ও দাতব্য চিকিৎসালয় তমলুক সহরেই প্রতিষ্ঠিত। পূর্ব্বে এই মহকুমার অন্তর্গত মছলন্দপুর গ্রামে একটি মুন্সেফী আদালত ছিল, ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে উহা নিকাশী গ্রামে উঠিয়া যায়। পরে আবার উহা তথা হইতে তমলুকে পুনরানীত হইয়াছে। এই মহকুমার অন্তর্গত প্রতাপপুর গ্রামেও একটি মুন্সেফী আদালত ছিল। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে উহা উঠাইয়। দেওয়া হয়।

 তমলুক মহকুমার অন্তর্গত মহিষাদল গ্রামের নাম উল্লেখ যোগ্য। মহিষাদলে তত্রত্য রাজায় গড়বাড়ী, তাঁহাদের প্রতিষ্ঠিত বহু দেব-দেবীর তমলুক মহকুমার অন্যান্য স্থান। মন্দির, সুবৃহৎ সরোবরাদি এবং একটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। তমলুক মহকুমার অন্তর্গত গোঁওখালী ও নন্দীগ্রামেও এক-একটি দাতব্য চিকিৎসালয় বিদ্যমান। এই অঞ্চলে পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, গেওখালী, হরিখালী, তেরপেখিয়া ও কুঁকড়াহাটীর বাজার প্রসিদ্ধ। এই কয়টী বাজার হইতেই ঐ অঞ্চলে নানাপ্রকার দ্রব্যাদি আমদানী ও রপ্তানী হইয়া থাকে। কুঁকড়াহাটীতে গভর্ণমেণ্টের একটি খাসমহাল কাছারী আছে। তমলুক মহকুমার স্থানে স্থানে উৎকৃষ্ট মাদুর ও বস্ত্রাদি প্রস্তুত হয়। তমলুকের মশারির থান প্রসিদ্ধ। এই মহকুমার অন্তর্গত কেলোমাল, মধ্যহিংলী, পুলসিট প্রভৃতি গ্রামে অনেক কায়স্থের বাস আছে। তমলুক মহকুমার অনেক স্থলে অনেক সংখ্য শিক্ষিত ব্রাহ্মণেরও বাস দৃষ্ট হয়।

 ঘাটাল মহকুমা মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পূর্ব্বে অবস্থিত। ১৮৫০ খৃঃ অব্দে এই মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে এই মহকুমার কার্য্যলয়াদিঘাটাল মহকুমা।গড়বেতায় প্রতিষ্ঠিত থাকায় ইহা 'গড়বেতা মহকুমা' নামে অভিহিত হইত। পরে হুগলী জেলা হইতে চন্দ্রকোণা পরগণা বিচ্ছিন্ন করিয়া এই জেলার সহিত সংযুক্ত করিয়া দিলে, ঘাটাল সহর এই মহকুমার প্রধান সহর বলিয়া গণ্য হয় এবং গড়বেতা মহকুমার পরিবর্ত্তে এই মহকুমা 'ঘাটাল মহকুমা' নামে অভিহিত হইয়া আসিতেছে। ঘাটাল মহকুমার পরিমাণ-ফল ৩৭২ বর্গ-মাইল। ঘাটাল নগর শিলাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। ঘটালের দেওয়ানী ও ফৌজদারী কার্য্যালয়াদি এই নগরেই প্রতিষ্ঠিত আছে। স্বৰ্গীয় রমেশচন্দ্র দত্ত যখন মেদিনীপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট-কালেক্টার ছিলেন, সেই সময় ঘাটালের ফৌজদারী কার্য্যালয় একবার কিছু দিনের জন্য গড়বেতায় উঠিয়া গিয়াছিল। (১৮৯২) ঘাটালেও একটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে।

 ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত চন্দ্রকোণ, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর, রাধানগর প্রভৃতি স্থানে উৎকৃষ্ট ধুতি, শাড়ী, চাদর ও ছিট-কাপড় ঘাটাল মহকুমার শিল্পাদি। প্রস্তুত হইয়া থাকে। ঐ সকল স্থানে বহুসংখ্যক তাঁঁতির বাস আছে। পূর্ব্বে তাহারা সকলেই কাপড় প্রস্তুত করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। তাহাদের প্রস্তুত কাপড় ভারতের বহুস্থানে নীত হইয়া উচ্চ মূল্যে বিক্রীত হইত;[২৩] কিন্তু পরবর্ত্তিকালে প্রচুর পরিমাণে বিলাতী কাপড়ের আমদানী হওয়ায় দেশীয় কাপড় প্রতিযোগিতায় বিলাতী কাপড়ের সমকক্ষ হইতে না পারাতে ঐ সকল তাঁতির অধিকাংশই এক্ষণে জাতীয় ব্যবসা ত্যাগ করিয়া কৃষিকার্য্য অবলম্বন করিয়াছে। তথাপি এখনও ঐ সকল স্থানের প্রস্তুত কাপড় অনেক স্থানেই প্রেরিত হইয়া থাকে।

 ঘাটাল মহকুমার নানা স্থানে রেশমের বস্ত্রাদিও প্রস্তুত হয়। প্রতি বৎসর ঐ সকল স্থান হইতে অন্যূন ২০,০০০ পাউণ্ড রেশম উৎপন্ন হইয়া থাকে।[২৪] চন্দ্রকোণা, রামজীবনপুর, ঘাটাল ও খড়ারের কাঁসা ও পিত্তলের বাসন প্রসিদ্ধ। মাননীয় কামিং (Hon. Mr. J. G Cumming C.S.I., C.I.E., I.C.S.) সাহেবের রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে, সমস্ত বঙ্গদেশের মধ্যে যে সকল স্থলে কাঁসা ও পিত্তলের বাসন প্রস্তুত হইয়া থাকে, তন্মধ্যে মেদিনীপুর জেলায় এই ব্যবসাটি বিশেষ শৃঙ্খলা ও সুপ্রণালীর সহিত পরিচালিত হইতেছে। এই স্থানের ব্যবসায়িগণ বিশেষ সঙ্গতিপন্ন; তাঁহারা ষ্টেট সেটেলমেণ্ট, জাপান প্রভৃতি স্থান হইতে টীন,তামা, ইত্যাদি ধাতু সম্ভবমত সুলভ দরে প্রচুর পরিমাণে কিনিয়া আনিতে পারেন বলিয়। এই ব্যবসায়ে বিশেষ লাভবান হইতে পারিয়াছেন। বস্তুতঃ তাঁহারা ব্যবসাটিও বিশেষ নিপুণতার সহিত চালাইতেছেন। এক এক জন ব্যবসায়ীর কারখানায় শতাধিক ব্যক্তি কার্য্য করিয়া থাকে। খড়ার সহরের মোট অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় নয় হাজার; তন্মধ্যে প্রায় চারি হাজার লোক এই ব্যবসা দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করে।[২৫] কামিং সাহেব লিখিয়াছেন যে, খড়ার কাঁসার থালা ও ঘাটাল গাড়ুর জন্য বিখ্যাত। ঘাটাল মহকুমায় নানাপ্রকার মাটীর হাঁড়ি-কলসী ইত্যাদিও প্রস্তুত হয় এবং বিক্রয়ের জন্য নানা স্থানেও প্রেরিত হইয়া থাকে।[২৬] চন্দ্রকোণার মট‍্কী ঘৃত এ দেশে প্রসিদ্ধ।

 ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত ক্ষীরপাই সহরে পূর্ব্বে একটি মহকুমার কার্য্যালয় প্রতিষ্ঠিত ছিল। তৎকালে এ জেলার অন্তর্গত চন্দ্রকোণা,ক্ষীরপাই, বীরসিংহ ও অন্যান্য গ্রাম। ঘাটাল প্রভৃতি স্থান হুগলী জেলার অন্তর্গত ছিল।ঐ অংশ ও বর্তমান হুগলী জেলার কিয়দংশ লইয়াই ক্ষীরপাই মহকুমা গঠিত হয়। পরে ক্ষীরপাই হইতে মহকুমার কার্য্যালয় জাহানাবাদে উঠিয়া যায়। জাহানাবাদ মহকুম অধুনা আরামবাগ নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। উহা এক্ষণে হুগলী জেলার অন্যতম মহকুম। ঘাটাল মহকুমায় অন্তর্গত ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, খড়ার, রামজীবনপুর এবং ইড়পালা গ্রামে এক-একটি দাতব্য চিকিৎসালয় আছে।

 ঘাটাল মহকুমার অনেক গ্রামে উচ্চ-শিক্ষিত বহুসংখ্য ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বাস। এই মহকুমার অন্তর্গত চন্দ্রকোণ গ্রামে ভারত-গৌরব লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পূর্ব্বপুরুষগণের আদিবাস ছিল। পরে তাঁহারা ঐ স্থান হইতে উঠিয়া বীরভূম জেলার অন্তর্গত রাইপুর গ্রামে বাস করেন। অদ্যাপি চন্দ্রকোণায় সিংহবংশের প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী প্রভৃতির নিদর্শন আছে। প্রাতঃস্মরণীয় স্বৰ্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এই মহকুমার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই অতুল সৌভাগ্য-সম্পত্তির অধিকারী হইয়াই আজ মেদিনীপুর সমগ্র ভারতের মধ্যে একটি উচ্চ স্থান লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। বীরসিংহ গ্রামে অদ্যাপি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাটী ও তাঁহার প্রতিষ্ঠিত উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়টি বিদ্যমান আছে। বঙ্গবাসী সেদিন মহাসমারোহে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জন্মভূমি রাধানগরে তাঁহার স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছেন; এইবার তাঁহার বীরসিংহের এই সিংহ-শিশুটির জন্মভূমিতে তাঁহার স্মৃতিরক্ষা কল্পে একটা কিছু স্থায়ী বন্দোবস্ত করিবেন নাকি?

 পরগণাগুলির উৎপত্তির ইতিহাস প্রথম অধ্যায়ে দিয়াছি। মেদিনীপুর জেলায় এক্ষণে ১১৫টি পরগণা আছে। সেগুলির নাম ও বিগতপরগণবিভাগ। ১৮৭২-৭৮ খৃঃ অব্দের রেভিনিউ সার্ভের সময় উহাদের পরিমাণ-ফল (বর্গ মাইল) যেরূপ নিরূপিত হইয়াছিল, নিয়ে তাহ উদ্ধৃত কয়িয়া দেওয়া হইল:–

 (১) অমর্শী ৪০.৯৫ (২) আমিরাবাদ ৩.৫৫ (৩) অরঙ্গানগর ১৮.৬৯ (৪) বাহাদুরপুর ৮৫.৬১ (৫) বাহিরীমুঠা ৪৬.০৫ (৬) বজরপুর ৬.১০ (৭) বলরামপুর ৫৯.৭০ (৮) বালিজোড় ১৩.৭৩ (৯) বালিসিতা ৫.৮৫ (১০) বালিসাই ১১.৮৯ (১১) বরদা ৭৯১ (১২) বোড়ইচোর ২২.৩২ (১৩) বারাজিত ৬.৪৩ (১৪) বাটিটাকী ১১.৪৫ (১৫) বাইন্দাবাজার ১.০০ (১৬) বেলাবেড়া ২০.৬০ (১৭) ভাইটগড় ২.০৬ (১৮) ভোগরাই ১৯.৫৩ (১৯) ভুয়ামুঠা ১৬.০৫ (২০) ভুরশুট ১.৭৪ (২১) বীরকুল ২৭.২৮ (২২) বিশওয়ান ৩৮.৩০ (২৩) বগড়ী ৪৪৫.৮৩ (২৪) ব্রাহ্মণভূম ৯৩.৬৬ (২৫) চন্দ্রকোণা ১২৪.০৪ (২৬) চিতুয়। ১০৪.১৯ (২৭) চিয়াড়া ৩৩.৮৩ (২৮) দক্ষিণমাল ৪.৫৪ (২৯) দাঁতনচোর ৪০.৩০ (৩০) দণ্টখড়ই ৪.১২ (৩১) দত্তমুঠা ১৬.৯১ (৩২) ধারেন্দা ৩৬.১৬ (৩৩) ঢেকিয়াবাজার ২৫.৫৩ (৩৪) দিগপারই ২৯.৩৫ (৩৫) দ্বিপাকিয়ারচাঁদ ৩৩.৪৫ (৩৬) দোরো দুবনান ৭১.৩০ (৩৭) এগরাচোর ৩০.৪৭ (৩৮) ইড়িঞ্চি ৬৯.২৬ (৩৯) গগনেশ্বর বা বাগভূম ৪৫.১৪ (৪০) গাগনাপুর ৩০.৯৬ (৪১) গওমেশ ১.৪২ (৪২) গুমাই ১৩.৪৯ (৪৩) গুমগড় ৯৯.৭৯ (৪৪) হাভেলীজলেশ্বর ০.৮২ (৪৫) কশবা হিজলী ১৮.৫০ (৪৬) চক ইসমাইলপুর ১৬.৮১ (৪৭) জলামুঠা ৫২.১৭ (৪৮) জামবণী ১০৩.৯৬ (৪৯) জামিরাপাল ৮.৯১ (৫০) জামনা তপ‍্পা ৩.০৪ (৫১) জাহানাবাদ ৩.৯৭ (৫২) ঝাড়গ্রাম ১৭৫.২৬ (৫৩) ঝাটীবনী বা শিলদা ২৪৩.৮৩ (৫৪) জুলকাপুর ৫.৬৮ (৫৫) কালরুইতপ্পা ২.৫৯ (৫৬) কালিন্দিবালিসাই ৩২.৩৫ (৫৭) কাকরাজিত ৪.১৪ (৫৮) কাকরাচোর ২.০১২ (৫৯) কাশীজোড়া ১১৯.০৪ (৬০) কাশীজোড়া কিসমৎ ০.৪৭ (৬১) কাশিমনগর ৬.৫৬ (৬২) কেদারকুণ্ড ৪৭.০৪ (৬৩) কেশিয়াড়ী ৮.০৯ (৬৪) কেশিয়াড়া কিসমৎ ০.৪৭ (৬৫) খালিসা ভোগরাই ০.৮৫ (৬৬) খান্দার ১৪৭.৫২ (৬৭) খড়্গপুর ৪৩.৬৬ (৬৮) খড়্গপুর কিসমৎ ৪.১২ (৬৯) খটনগর ৬৭.৮২ (৭০) খেলাড় নয়াগ্রাম ১৮৮.৯৫ (৭১) কুড়ুলচোর ৪৩.৫৬ (৭২) কুতবপুর ৪৫.০৩ (৭৩) লাটশাল ২.৭০ (৭৪) মাজনামুঠা ৮৩.৫৯ (৭৫) মল্লভূম বা ঘাটশিলা ১৩.৪৪ (৭৬) মণ্ডলঘাট ৩৬.২১ (৭৭) খারিজা মণ্ডলঘাট ১৩.৯২ (৭৮) মনোহরগড় ৩.৮৩ (৭৯) মাৎকদাবাদ ৩.১৯ (৮০) মাৎকন্দপুর বা কল্যাণপুর ৩৯.৮৮ (৮১) ময়নাচোর ৭৫.৫৭ (৮২) মেদিনীপুর ৩৭১.৫৩ (৮৩) মিরগোদা ২২.২৬ (৮৪) মহিষাদল ৬২.৯৯ (৮৫) নাড়াজোল ১১.৯৬ (৮৬) মেদিনীপুর কিসমৎ ১৫.২০ (৮৭) নারাঙ্গাচোর ১৪.০২ (৮৮) নারায়ণগড় ১৫.৬৮ (৮৯) নারায়ণগড় কিসমৎ ৮.৪৪ (৯০) নাড়ুয়ামুঠা ৫৫.৭৬ (৯১) কেওড়ামাল নয়াবাদ ৪.৪৭ (৯২) মাজনা নয়াবাদ ০.৫১ (৯৩) নয়াবসান ১৫১.৫৬ (৯৪) পাহাড়পুর ২৩.৩২ (৯৫) পটাশপুর ৬৩.৫৩ (৯৬) পটাশপুর কিসমৎ ১০.৫৩ (৯৭) প্রতাপভান ১৫.৫২ (৯৮) পুরুষোত্তমপুর ১৩.৬৬ (৯৯) রাজগড় ১৭.৯০ (১০০) রামগড় ৪৩.৭৩ (১০১) রোহিনী মৌভাণ্ডার ৪২.২১ (১০২) সবঙ্গ ৮৫.৬৩ (১০৩) সাহাপুর ৫৭.৫০ (১০৪) সাহাপুর কিসমৎ ২.১৫ (১০৫) সেক পাটনা ০.৪০ (১০৬) সাঁকাকুল্যা বা লালগড় ৫২.৫৩ (১০৭) সরিফাবাদ ২.২২ (১০৮) শীপুর ৬৫.০৫ (১০৯) শীপুর কিসমৎ ২.৭০ (১১০) সুজামুঠা ৪৫.২৭ (১১১) তমলুক ৯৯.৭৭ (১১২) তেরপাড়া ৯.৪৯ (১১১) তুরকাচোর ৪৪.৪৯ (১১৪) উত্তর বিহার ২৫.০০ (১১৫) ওলমারা (ময়ূরভঞ্জের রাজ্যভুক্ত গড়জাত মহাল) ১২.০৯।

 বিগত ১৯৯১ খৃঃ অব্দের আদম সুমারীর সময় এই জেলায় ১১,৩১৬টি গ্রাম ও নিম্নলিখিত ৮টি মিউনিসিপ্যাল সহর ছিল।– (১) মেদিনীপুর গ্রাম ও নগর।(২) খড়্গপুর, (৩) ঘাটাল, (8) খড়ার, (৫) রামজীবনপুর, (৬) চন্দ্রকোণা, (৭) তমলুক, (৮) ক্ষীরপাই। এই আটটি সহরের মধ্যে তমলুক মিউনিসিপ্যালিটী সর্ব্ব-পুরাতন, ১৮৬৪ খৃঃ অব্দে এই মিউনিসিপ্যালিটী স্থাপিত হয়। ইহার পর ১৮৬৫ খৃঃ অব্দে মেদিনীপুর, ১৮৬৯ খৃঃ অব্দে ঘাটাল ও চন্দ্রকোণা, ১৮৭৬ খৃঃ অব্দে ক্ষীরপাই ও রামজীবনপুর এবং ১৮৮৮ খৃঃ অব্দে খড়ার মিউনিসিপ্যালিটী গঠিত হইয়াছে। খড়্গপুর সহর বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথ প্রস্তুত হইবার পর অল্পদিন হইল স্থাপিত। কাঁথিতে মিউনিসিপ্যালিটী নাই।



  1. Midnapore District Gazetteer—O'Malley. p. 8.
  2. Hunter's Statistical Account vol. 1. p. 375
  3. District Gazetteer p. 8.
  4. District Gazetteer p. 8
  5. District Gazetteer pp. 8—9, 221
  6. District Gazetteer p. 9.
  7. Final Report of the Midnapore District Settlement by Mr. A. K. Jameson M. A., I. C. 8.
  8. Hunter's Orissa Vol. I. p. 313.
  9. Agricultural Statistics of Bengal 1914-15. p. 6.
  10. Bulletin of Agricultural Statistics of the International Institute of Agriculture, Rome, March 1914.
  11. কৃষক, ফাল্গুন ও চৈত্র ১৩২৩।
  12. Mr. Jameson's Final Report of the Midnapore District Settlement.
  13. ১৯১১ খৃ: অব্দের সেন্সাস রিপোট হইতে এই সংখ্যা গ্রহণ করা হইয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি মেদিনী জেলার জরিপ, জমাবন্দি হইবার পর ইহার কিছু কিছু পরিবর্ত্তন হইয়াছে দেখা যায়।
  14. জয়গোপাল গোস্বামি-সম্পাদিত গোবিন্দ দাসের কড়চা পৃঃ ২৮-২৯।
  15. মেদিনীপুর শাখা সাহিত্য-পরিষদের ৪র্থ অধিবেশনের সভাপত্তি মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী মহাশয়ের অতিভাষণ।
  16. Review of the Industrial Position and Prospects in Benga in 1908. Special Report by Mr. J. G. Cumming I. C. S., p. 13. part II.
  17. Review of the Industrial Position and Prospects in Bunga in 1908, part II. p. 17.
  18. “The innundation which is mentioned in Starling's Orissa to have caused the formation of the Chilka Lake and to have occurred in the 3rd century of our era is supposed to have reached this part of the country and formed this range and others to the west in the direction of Midnapore.”
    Selections from the Records of the Board of Revenue L. P.Report on the Settlement of the Jallamutha Estates in the District of Midnapore p. 89.
  19. প্রবাসী, আশ্বিন ১৩১৭—“গ্রামের নাম।”
  20. W. Hedge's Diary Vol. II. р, з.
    Blochman's Notes in Hunter's St. Account Vol. І. р. 377.
  21. Sydney Grier in the “Letters of Warren Hastings to his wife”:—“Beercool was the sanatorium—the Brighton—of Calcutta, and the newspapers and Council records mention constantly that So-and-So is ‘gone to Beercool for his health.” Coursing, deerstalking, hunting and fishing are mentioned as being obtainable in the neighbourhood, and in May of this year (1781) the “Bengal Gazette” gives publicity to a scheme for developing the place quite in the modern style. It has already the advantage of a beach which provides perhaps the best-road in the world for carriages and is totally free from all noxious animals except crabs, and there is a proposal to erect convenient appartments for the reception of mobility and gentry and organise entertainments.” The scheme appears to have been partially carried out, for in 1796 Charles Chapman wrote:—“We passed part of the last Hot season at Beercool, to which place I believe you and Messrs. Hastings once projected an Excursion. The Terrace of the Bunglow intended for you, is still pointed out by the People, but that is all that remains of it. The Beach is certainly the finest in the World and the Air such as to preclude any Inconvenience being felt from the Heat. Mrs. Chapman found the Bathing agree with her so well, that, if here and alive next year, we shall make another Trip"
    —District Gazetteer—p. 169.
  22. “Indigo, mulbery and sik the costly products of Bengal and Orissa form the traditional articles of export from ancient Tamłuk.”

    Hunter's Orissa Vol. I. p. 313.

  23. District Gazetteer p. 126.
  24. Review of the Industrial Position and Prospects in Bengal in 1908 part II. p. I4.
  25. Industrial Position and Prospects in Bengal p. 25.
  26. Industrial Position and Prospects in Bengal p. 14.