মৈমনসিংহ গীতিকা/দেওয়ানা মদিনা

উইকিসংকলন থেকে

দেওয়ানা মদিনা

মনসুর বয়াতি প্রণীত

দেওয়ানা মদিনা

বা

আলাল দুলালের পালা

(১)

“সত্য কর প্রাণপতি সত্য কর রইয়া[১]
আমি নারী মইরা গেলে আর নাই সে করবা বিয়া॥
আমি আভাগী[২] রে পিয়া[৩] কই তোমার কাছে।
শিয়রে খাড়াইয়া[৪] যম বাকি কয়দিন আছে॥
শরীল[৫] অইল মাটি মুখে কালা ধরে[৬]
দুই দিন পরে শুইবাম কুয়ার কয়বরে[৭]
ঘরে রইল আলাল দুলাল তারা দুইটী ভাই।
আভাগী মায়ের আর কোনি[৮] লক্ষ্য নাই॥
শুন শুন ওহে গো পতি—পতি আরে বলি যে তোমারে।
কোলের ছাওয়াল আলাল দুলাল রাখ্যা যাই ঘরে॥
শুন শুন ওহে গো দেওয়ান কইয়া বুঝাই আমি।
দুধের বাচ্ছা দুই-না পুতে[৯] সপলাম[১০] অভাগিনী॥
সাক্ষী থাক্য চান্দসূরুজ্ আরে দুই নয়নের আখি।
তার হাতে সপ্যা[১১] গেলাম আরে আমার পোষা পাখী॥

সাক্ষী থাক্য[১২] কিতাব কোরাণ আরে সাক্ষী যে তোমরা।
আলাল দুলালের লক্ষ্য নাই সে তুমি ছাড়া॥
সাক্ষী অইয়ো[১৩] নদী নালা জঙ্গলা পাহাড়ী[১৪]
বনের না পইখ পাখালী আমি তারে সাক্ষী করি॥
আমিত আভাগী মাও আরে যাইরে ছাড়িয়া।
কোলের ছাওয়াল শিশুরে নেও কোলেতে তুলিয়া॥”

কান্দিতে কান্দিতে মায়ের চক্ষে পড়ে কালি।
টান দিয়া বুকে লইল “পুত্র পুত্র” বলি॥
“সোনার কলি আলাল দুলাল আর তারার দিকে চাইয়া।
আমার মাথা খাও পিয়া আর নাই সে কর বিয়া॥
সতীন বালাই কিয়া কই তোমার কাছে।
এতিম[১৫] ধনেরা মোর দুঃখু পাইব পাছে॥
সতীনের ছাওয়াল কাঁটা সতাই মায়ে লাগে।
সেই না কাঁটা তুলে সতাই সগলের[১৬] আগে॥
শুন শুন পরাণের পতি মোর কথা রইয়া।
সতাইয়ের গল্প এক শুন মন দিয়া॥

‘দীঘির দক্ষিণ পাড়ে আরে দারাক[১৭] গাছের ডালে।
কইতরা কইতরী[১৮] দুই থাকে তার খোরলে[১৯]
চিত্তসুখে নিত্যি তারা প্রেম আলাপনে।
সুখে দিন যায় তারার[২০] দুঃখু নাই সে জানে॥

এই না মতে কতদিন যায়রে চলিয়া।
দুই ডিম রাখ্যা কইতরী গেলরে মরিয়া॥

ডিম লইয়া কইতরা পড়িল ফাঁপরে।
খালি বাসা থইয়া নাইসে নড়িবারে পারে॥
অনাধারে[২১] কইতরা আরে বস্যা দেয় উম[২২]
সারা রাইত পর[২৩] দেয় নাই যে চউখে ঘুম॥
কত কষ্টে উম দিয়া আরে যতন করিয়া।
দুই ডিমে দুই বাচ্ছা আরে লইল খুটিয়া[২৪]
একেলা কইতরার আর অখন নাইসে চলে।
কেবা আধার আনে আর কে থাকে খোরলে॥

নিরুপায় ভাব্যা কইতরা আরে কোন্ কাম করে।
এক না কইতরী আন্যা তার জোরী[২৫] করে॥
কইতরা কয় “শুন আলো তুমি যে কইতরী।
আমি যাই আধার আন্‌তাম তুমি থাক বাড়ী॥
বাচ্ছায় উম দেও লো তুমি বাড়ীতে থাকিয়া।
বাচ্ছারা মোর অইল ওরে বড় দুঃখু পাইয়া॥
যতন কইরা রাখ্য ওলো যাইতে[২৬] না হয় দুখ।
বড় অইলে তারা পরে পাইবা সুখ॥
চারা গাছ পানি দিয়া আগে বড় কইরে।
বড় অইলে মিঠাফল সুখে খাইবা পরে॥”

এই না কথা বুঝাইয়া আরে গেল চলিয়া।
কইতরী ভাবয়ে মনে বাসাতে বসিয়া॥
“বালাই সতীন্ গেছে রাখ্যা দুই কাঁটা।
বড় অইলে আমার নছিবে কেবল মুড়্যা ঝাঁটা॥
সতীনের বাচ্ছায় কবে বুঝে সতাইর সুখ।
আখেরে আমার কপালে আছে বড় দুখ॥

আমার বাচ্ছার এরা অইব[২৭] দুষ্‌মন্।
সেই না কারণে সদা অইব কেবল দন[২৮]
এমন বালাই আমি উম দেই বইয়া।
দুগ্ধ দিয়া অজাগর রাখ্‌তাম[২৯] পালিয়া॥
দুঃখুরে ডাকিয়া আমি না আনিবাম ঘরে।
বালাই দূর কর্‌বাম আমি মারিয়া এরারে[৩০]
কইতরা গেছে অখন আধারের লাগিয়া।
আধার আনিলে খাইবাম দুইজনে মিলিয়া॥
উইড়া দুষ্‌মন্ আইছে আরে পইড়া কর্‌ত।[৩১]
আমার মুখের গরাস কাড়িয়া লইত॥
এমন বালাইয়ের গলা ঠোঁটে না ছিড়িয়া।
দুষ্‌মনের কাঁটা দেই দূর করিয়া॥”

এই না বলিয়া কইতরী কোন্ কাম করে।
গলাতে ধরিয়া ঠোঁটে আছড়াইয়া মারে॥
মারিয়া দুই বাচ্ছা পরে আরে জঙ্গলায় ফালায়।
আধার লইয়া কইতরা আরে বাসার পানে যায়॥

কইতরায় দেখ্যা কইতরী আরে জুড়িল কান্দন।
কইতরা জিগায়[৩২] “কান্দ কিসের কারণ॥”
কইতরী কহে “শুন আরে খসম আমার।
আধার আনিতে গেলা আরে দিয়া বাচ্ছার ভার॥
এমন সময়ে এক গিরধনী[৩৩] আসিয়া।
আমার বুক অইতে নিল জোরে সে কাড়িয়া॥
গিরধনীর মুখে বাচ্ছারা হারাইল পরাণি।
সেই না কারণে আমি কান্দি আভাগিনী॥”

এই কথা শুন্যা কইতরা কান্দে জার জার।
“মোরে থইয়া কোথায় গেল ছেউরা[৩৪] বাচ্ছারা আমার॥
কত কষ্ট পাইলাম হায়রে তারার লাগিয়া।
কোন পথে গেল তারা বুকে ছেল[৩৫] দিয়া॥
আগুনি জ্বলিল হায়রে আমার অন্তরে।
হায়রে দারুণ বেথা[৩৬] চিত্তে নাই সে ধরে॥”

“এই মতে কইতরা আরে কান্দিল বিস্তর।
মনে মনে কইতরী হাসে বালাই কর্‌লাম দূর॥
সতীন্ বুঝয়ে নাহি সে সতীপুত্রের[৩৭] ব্যথা।
অন্তৃম[৩৮] কালে সোয়ামী গো রাখ মোর কথা॥
রাখ মোর কথা পিয়া আরে মোর মাথা খাও।
ছেউরা পুতেরার[৩৯] পানে আখি মেল্যা চাও॥”

এই না কথা কইয়া পরে সেই তো না নারী।
মায়ার সংসার ছাড়্যা তবে গেলা নিজ বাড়ী[৪০]১—৯৮


(২)

আওরতের লাগ্যা কান্দে দেওয়ান সোনাফর।
আলাল দুলাল কাইন্দা অইল জর্ জর্॥
কান্দিয়া কান্দিয়া তারা ভূমিতে লুটায়।
দানাপানি ছাড়্যা কেবল করে হায় হায়॥
মায়ে জানে পুতের বেদন অন্যে জান্‌ব[৪১] কি।
মায়ের বুকের লৌ[৪২] পুত্র আর ঝি॥
দুই না ছেউরা ছাওয়ালে বুকেতে করিয়া।
সোনাফর মিঞা কান্দে মাথা থাপাইয়া[৪৩]

“দুখের ছাওয়ালে কেমনে বাঁচাই পরাণে।
অনাধারে[৪৪] মরে কেমনে দেখিব নয়ানে॥
মা মা বল্যা যখন আরে আলাল দুলাল কান্দে।
বুকেতে আমার হয়রে ছেল যেমন বিন্ধে॥
কি দিয়া বুঝাইয়া রাখি ছেউড়া পুত্রেরে।
কেবা খাওন দেয় আরে পড়িলাম ফেরে[৪৫]
মর‍্যাত না গেছ আওরাত গিয়াছ মারিয়া।
তিনলা পরানি মার‍্যা গেছ পলাইয়া॥[৪৬]
কি দুষ্‌মনি কইরাছিলাম আর জনমে আমি।
তার পর্‌তিশোধ লইলা এই না জর্ম্মে[৪৭] তুমি॥
বান্যাচঙ্গের দেওয়ান আমি নাহি মোর সমান।
অনুন্যাই[৪৮] ধন-দৌলত গোলাভর। ধান॥
পন্থের ফকীর অইল আরে আমার থাক্যা সুখী।
দুনিয়াতে নাই আর আমার মতন দুখী॥
কি করিব ধন-দৌলতে আর কি ছার দেওয়ানি।
দিলের দুঃখেতে যদি চক্ষে ঝরে পানি॥
কেবা খাইব[৪৯] আমার যে এই ধন-দৌলত।
শূন্য অইল ঘর মোর মরিয়া আওরাত॥
বুকে ছেল দিয়া গেল। তুমি কোন্ পরাণে।
দুনিয়া যে দেখি আমি আন্ধাইর নয়ানে॥
তুমি যে আছিলা আন্ধাইর ঘরের বাতি।
তুমি যে আছিলা আমার হৃদ্-পিঞ্জরার পংখী॥
তোমারে ছাড়িয়া আমি বাঁচি কোন্ পরাণে।
তেজিতাম[৫০] পরাণি আমি তোমার কারণে॥

তোমার পিছ লইতাম[৫১] আমি এই আছিল মনে।
দুধের বাচ্ছা রাখ্যা গিয়া ফালাইলা[৫২] বে-নালে[৫৩]॥”

এইনা কালে দেওয়ান আরে বুক না কুটিয়া[৫৪]
পাড়া পড়শী পরা’ব[৫৫] পাইল তারে না বোঝাইয়া॥
ঘর খালি অইল আর গুরজান[৫৬] না চলে।
সোনার সংসার বের্ত্তা[৫৭] হায়রে যায় যে বিফলে॥
ঘরের লক্ষ্মী জননা আরে তার যে লাগিয়া।
বান্ধা[৫৮] সংসার মিয়ার যায় যে ভাসিয়া॥
দিবানিশি চিত্তে মিয়ার দুঃখু অইল দিলে।
দরবার বিচার হায়রে কিছু না চলে॥
কিসের সংসার কিসের বাস কেমনে সুখ মিলে।
মনসুর বয়াতি[৫৯] কয় সুখ না থাক্‌লে দিলে॥

উজীর নাজীর সবে আরে এইনা দেখিয়া।
মিয়ার নিকট কয় দরশন দিয়া॥
“শুন্‌খাইন্[৬০] দেওয়ান সাহেব শুন্‌খাইন্ আমার কথা।
সোনার সংসার আপনারে নষ্ট অইল বির্থা।
আর এক সংসার কর‍্যা রাখ্যুয়াইন্[৬১] দেওয়ানি বজায়।
এক জনের লাগ্যা কেন সগল[৬২] জলে যায়॥
কান্দিয়া দেওয়ান কয় আরে উজীরে নাজীরে।
“দুধের বাচ্ছা আলাল দুলাল আছে মোর ঘরে॥
তারার দুঃখু দেখ্যা আমার ফাট্যা যায় বুক।
সাদি করিলে অইব দুঃখের উপর দুখ॥

সতাই না বুঝে সতীন্-পুতের বেদন।
সতিন-পুতে দেখে সতাই কাঁটার সমান॥
সেই কাঁটা তুল্যা সতাই দূরেতে ফালায়।
এরে দেখ্যা মন নাই সে সাদি কর্‌তে চায়॥
কলিজার লৌ মোর আলাল দুলাল।
দুঃখের উপর দুঃখু দিয়া না বাড়াই জঞ্জাল॥
আলাল দুলালে বিবি আমায় সপ্যা দিয়া।
সাদি না করিতে গেল মানা যে করিয়া॥
বিয়া নাই সে কর্‌বাম আমি সংসারের লাগিয়া।
কিসের সংসার আলাল দুলালে মারিয়া॥
তারারতারার=তাদের। মুখ দেখ্যা আমি আরে বাঁচিয়া পরাণে।
রাক্ষসের হাতে নাই সে দিবাম জীবমানে[৬৩]॥”

এই কথা শুনিয়া উজীর কয় মিয়ার কাছে।
“কান্দিয়া কাটিয়া সাহেব ফয়দা[৬৪] নাই যে আছে।
সতাই সকল সাহেব আরে না হয় সমান।
সতিন্-পুতের লাগ্যা কেউ দেয় জান্ পরাণ॥
আলাল দুলালে যতন করিবাম সকলে।
দুঃখ নাই সে পাইব কিছু সতাই বাদী অইলে॥
দিলের দুঃখু দূর কইরা কর্‌খাইন[৬৫] এক বিয়া।
সোনার সংসার পাল্‌খাইন[৬৬] যতন করিয়া॥”

এই কথা শুনিয়া মিয়া চিন্তে মনে মনে।
কিছু ফয়দা নাই মোর সংসার ছাড়নে[৬৭]
সোনার কলি আলাল দুলাল রহিলে বাঁচিয়া।
সংসার না থাকলে তারা খাইব কি করিয়া॥
সংসার নষ্ট অইলে পরে অইব তারার দুখ।
চিরদিন দুঃখে হায় ফাটিব যে বুক॥

আমার বুকের ধন রাখবাম যতন করিয়া
কি সাধ্য সতাই নেয় তারারে[৬৮] কাড়িয়া॥
এইমতে দেওয়ান আরে চিন্তে মনে মনে।
উজীর নাজীর লাগা পাছে[৬৯] বিয়ার কারণে॥
মনস্থির কইর‍্যা দেওয়ান অইলা সম্মত।
সাদি অইয়া গেল পরে যেমন বিহিত॥১—৮৬


(৩)

সাদি না কর‍্যা সাহেব আরে নিজ পুত্রধনে।
নিজের নিকটে রাখে পরম যতনে॥
সতাইয়ের[৭০] কাছে তারারে না দেয় যাইতে।
আল্‌গা রাখিয়া পুত্রে পালে সুবিহিতে॥

দিশা:—আলালে দুলালে লইয়া করয়ে সোহাগ। 
এরে দেখ্যা সতাইয়ের মনে অইল রাগ॥
“সতীপুতেরারে করে কত না আদর।
ফিরিয়া না চায় মোর পানে এক নজর॥
আমার যদি ছাওয়াল হয় থাকব অনাদরে।
বুকের লউ[৭১] দেখ্‌ব কেবল সতীপুতরারে[৭২]
এরে দেখ্যা আর মোর সহন না যায়।
মনে মনে চিন্তি কেবল কি করি উপায়॥
সতীনের পুত্র মোর অইল গলার কাঁটা।
খাওন না সুজে[৭৩] মোর অইল বিষুম[৭৪] লেটা॥

যতদিন না পারি এই কাঁটা দূর করিতে।
ততদিন সুখ নাই মোর নছিবেতে[৭৫]
দেওয়ানেরে জানাই যুদি[৭৬] দিলের দুঃখু মোর।
ঝাঁটা না মারিয়া মোরে কইরা দিব দূর॥
এক হেতু[৭৭] আছে আরে ছলনা না কইরা।
যুদি দিতাম পারি দিবাম দূর না করিয়া॥”

চিন্তা না করিয়া বিবি আরে মন কর্‌ল স্থির।
একদিন তো না ডাকে দেওয়ানেরে অন্দর ভিতর॥
দেওয়ান আসিলে বিবি আরে জুড়িল ক্রন্দন।
দেওয়ান জিগায় “কেন কান্দ বিবিজান”॥
কান্দিয়া কান্দিয়া বিবি কয় দেওয়ানেরে।
“কোন্ দোষে দোষী অইলাম তোমার গোচরে॥
আলাল দুলাল মোর সতীন্-পুত বলিয়া।
আমার নজর ছাড়া রাখ্যাছ করিয়া॥[৭৮]
আলাল দুলাল কেবল তোমার বুকের ধন।
আমি অইলাম বৈরী তারার কি কারণ॥
সতাই বলিয়া মোরে বিশ্বাস না কর।
সগল[৭৯] সতায়েরে তুমি এক মতন ধর॥
অঙ্গ জ্বলিয়া যায় এই না কারণে।
বদ্‌নাম রটাইব আমার পাড়া পরশী জনে॥
সতাই যন্ত্রণা দেয় আরে বলিব সকলে।
আমার কাছেতে আলাল দুলাল না আসিলে॥
আমার সন্তান নাই আরে তুমি বিচার কর।
সতিপুতের মুখ দেখ্যা দুঃখু করি দূর॥
এইত না সাধে বাদ দেও কি কারণ।
দিলের দুঃখেতে আসে সদাই কান্দন॥

কলিজার লৌ মোর আলাল দুলাল।
কি খায় না খায় কিবা করয়ে কুয়াল[৮০]
কত বস্তু আন আরে আন্দর মহলে।
মনের দুঃখেতে সেই সব পেটে নাহি চলে॥
তারার আশায় রাখি ছিক্কাতে[৮১] তুলিয়া।
পচ্যা[৮২] গেলে নিরাশ অইয়া দেই ফালাইয়া॥
বুকের দুঃখ দর অইব তারারে দেখিলে।
আন্দরে আনিয়া দেও আইজ বিয়ালে[৮৩]
যদি মোর বাক্য তুমি আরে কর লঙ্ঘন।
তা অইলে জান্যা রাখ্যো আমার নির্চয় মরণ॥[৮৪]
অপমান পাইয়া না চাই বাঁচিতে সংসারে।
বিনা দোষে কেবা দুঃখে সদা জ্বলে পুড়ে॥”


এই কথ। না কইয়া বিবি লাগিল কান্দিতে।
দয়াতে ভরিল দেওয়ান সাহেবের চিতে॥[৮৫]
“তোমার কথায় বিবি দিলে পাইলাম সুখ।
বিনা কারণে তুমি চিতে পাও দুখ॥
আগের যে বিবি মোর আরে হস্তেতে ধরিয়া।
আলাল দুলালে আমায় দিয়াছে সঁপিয়া॥
রাখ্‌তাম[৮৬] তারারে ধর‍্যা আমার বুকেতে।
কিছুর লাগ্যা যেন কষ্ট না পায় মনেতে॥
সেই না কথা মনে জাগে তারার মুখ দেখিলে।
এক ডণ্ড[৮৭] না থাক্‌তাম পারি কাছছাড়া অইলে[৮৮]
সেই না কারণে রাখি সদা সাথে সাথে।
একেলা না দেই আমি বাইরি অইতে[৮৯] পথে॥

সংসারের কামে[৯০] তুমি ব্যস্ত অতিশয়।
সেই না কারণে বিবি আমার নাই সে মনে লয়॥
তারা যুদি মোর কাছে থাকয়ে সর্ব্বদা।
সুখেতে থাকিব কিছু না পাইব বেথা॥
তোমার জঞ্জাল বাড়ে এই না ভাবিয়া।
তোমার কাছেতে আমি দেইনা পাঠাইয়া॥”

এই কথা শুন্যা বিবি আরে দেওয়ান গোচরে।
মিডা বুলে[৯১] কয় বিবি অতি ধীরে ধীরে॥
“আমার গর্ভের পুত্র অইলে আলাল দুলাল
তারে যতন কর্‌লে কি মোর অইত জঞ্জাল॥
ছাওয়ালে যতন করে মায়ে সব কাম থইয়া।
কাম নাই সে সুজে ছাওয়ালের বেদন দেখিয়া॥
সংসারের কামের লাগ্যা না অইব তিরুডী[৯২]
ইতে আন্ না অইব[৯৩] ধরি পাও দুটী॥”

পায়েতে ধরিয়া বিবি জুড়িল কান্দন।
পাথর গলিয়া যায় শুনিয়া বেদন॥
চোখের পানি মুছি দেওয়ান পর্‌তিজ্ঞা করিল।
“দুই ছাওয়াল আন্যা দিবাম কালুকা সকাল॥”
মিঠা বুলিরস দেওয়ান বিবিরে বুঝাইয়া।
পান খাইয়া গেল দেওয়ান আন্দর ছাড়িয়া॥

হাসিতে হাসিতে বিবি কয় ধীরে ধীরে।
“মিডাবুলিতে কাম নিবাম আশিল কইরে॥[৯৪]

সতীনের কাঁটা আমি নিৰ্চয়[৯৫] ভাঙ্গবাম।
ছন কিম্বা জোরে পারি আর না ছাড়বাম॥
বল্যা গেছে দেওয়ান আরে কালুকা সকালে।
পাঠাইবান আলাল দুলাল আন্দর মহলে॥
নানা মতে সাজাই আমি আন্দর মহল।
তাই সে পর্‌কাশ করব[৯৬] আমার আদর কেবল॥
এমন করিবাম যাইতে[৯৭] সর্ব্ব লোকে বলে।
জান্ দিয়া ভালবাসি সতীপুত সগলে॥
নিজের হাতে ছিঁড়ি মুণ্ডু যুদি অগোচরে।
তেও[৯৮] যেন মোর কথা কেউ বিশ্বাস না করে॥”

এতেক কহিয়া বিবি আন্দর সাজায়।
যত মতে পারে নাইসে তিরুডী তাহায়॥
কত কত মিডাই[৯৯] বিবি যোগাড় করিয়া।
থরে থরে রাখে বিবি আন্দরে সাজাইয়া॥
আর যত খাদ্য জিনিস নিজ হাতে রান্ধিল।
রাত্র থাকিতে বিবি রান্ধন শেষ করিল॥
এই মত নানা ইতি দ্রব্য সাজাইয়া।
সতীপুতেরার লাগ্যা রইল বসিয়া॥
বগা যেমন চউখ বুজ্‌ঞ্যা পাগারের ধারে।
সাধু অইয়া বস্যা থাক্যা পুডী মাছ ধরে॥
মনসুর বয়াতী কয় সেই মতন রইয়া।
বিবি রইল যেমন খাপ ধরিয়া॥[১০০]

তারার বার চাইয়া[১০১] বিবি থাকিতে থাকিতে।
বান্দী আইস্যা খবর দিল দেওয়ান আইসে পথে॥
আগে যায় দেওয়ান মিঞা পাছে আলাল দুলাল।
তার পাছে পাইক প’রী তামেসগীর[১০২] সকল॥
নানা ইতি সাজে দেখ দেওয়ান-পুত্রগণ।
সাজন অইল কিবা জুড়ায় নয়ন॥
রূপ দেখ্যা পরীগণ চউখ ফিরাইয়া চায়।
এমন সুন্দর নাগর পাইলে পায়েতে লুডায়[১০৩]

দেখিতে দেখিতে তারা আন্দরে আসিল।
দুই হাতে বিবি দুই কুমারে ধরিল॥
দুই পুত্রে সতাইরে জানায় ছেলাম।
বুকেতে ধরিয়া সতাই করিল চুম্বন॥
আয়োজন করা যত রাখুছিল সাজাইয়া।
সগলি সাম্‌নে দিল হাজির করিয়া॥

খাইয়া আলাল দুলাল খুসী অইল মনে।
কত সুখে সতাইর পরম যতনে॥
আলুফা[১০৪] জিনিস যত বাছিয়া বাছিয়া।
সতাই রাখিয়া দেয় তারার লাগিয়া॥
নিজ হাতে বিবি খাওয়ায় সামনে খাড়া হইয়া।
একডণ্ড তারারে না থাকে পাশরিয়া॥
সতাইর আদরে তারা আন্দর না ছাড়ে।
বাপের আঙ্গুল ধইরা আর নাই সে ফিরে॥
সতাইর যতনে তুলে মায়ের যে দুখ।
আন্দরে থাকিয়া পায় যত রকম সুখ॥১—১৩২

(8)

এই মত সুখেতে আরে তারার দিন যায়।
গোপনে থাকিয়া বিবি চিন্তয়ে উপায়॥
দুষ্‌মন সতীন্-পুতে খেদাই কেমনে।
দিবা নিশি তার কেবল এই চিন্তা মনে॥
মনের গুমর ভাব কেউরে না কয়।
মিডা কথা দিয়া সকল করিয়াছে জয়॥
বলাবলি করে লোকে “এই কি অচরিত[১০৫]
সতাইয়ে না দেখ্‌ছি আর অত কর্‌তে ইত[১০৬]
সতাইয়ে পার্‌লে দেখি গলা টিপ্যা মারে।
সতীপুতের লাগ্যা কেবা অত যতন করে॥
মুখের গরাস দেয় যতনে তুলিয়া।
আলুফা জিনিস খাওয়ায় নিজে না খাইয়া॥”

বিবির যতনে দেওয়ান মোহিত অইল।
আলাল দুলালে রাখে অন্দর মহল॥
বিবির হাতেতে সপ্যা আলাল আর দুলালে।
দেওয়ান-গিরি করে দেওয়ান খুসী অইয়া দিলে[১০৭]
এই না মতে দিন যায় আরে বিবি ভাবে রইয়া।
কেমনে সতীন্‌কাঁটা দিবাম সাঙ্গ দিয়া॥
শাওনিয়া বষ্‌ষার[১০৮] পানি টলমল করে।
এরে দেখ্যা বিবি কিনা ফন্দী এক করে॥
“নয়া পানিতে আরে দৌড়ের নাও সাজাইয়া।[১০৯]
আরং জমিব[১১০] কত দেশ ভাসাইয়া॥

এই না আরংএর কথা বুঝাইলে দুষ্‌মনে।
যাইতে চাইব কত আনন্দিত মনে॥
এই না আরংএ দেই তারারে পাঠাইয়া।
মারিবাম জলেতে দিয়া চর পাঠাইয়া॥”

এই মতন মনে মনে কর‍্যা বিবেচনা।
জল্লাদে ডাকিয়া বিবি করয়ে মন্ত্রণা॥
নিরালা ডাকিয়া কয় জল্লাদের ঠাঁই।
“তোমার মতন সুহৃদ্ আমার দুনিয়াতে নাই॥
এক কাম মোর যদি কর তুমি ভালা।
বিশ পুড়া জমি বাড়ী দিবাম কইরা কাওলা[১১১]
সত্য কর জল্লাদরে রাখবা আমার কথা।
গোপন মতন করবা কাম না করবা অন্যথা॥”

সত্য কইরা জল্লাদ যে কয় বিবির কাছে।
জল্‌দি কইরা কউখাইন[১১২] মোরে কিবা কাম আছে॥
বিশ পুড়া জমি দিলে জানবাইন[১১৩] মনে মনে।
না পারি মুই এমন কাম নাই তির্‌ভুবনে॥
তার পরে দুষ্টা বিবি কোন্ কাম করিল।
জল্লাদের কানে কানে সগল কহিল॥
বিবির কথায় জল্লাদ স্বীকার যে করি।
খুসী হইয়া ফির‍্যা গেল নিজের যে বাড়ী॥

সুতার ডাকিয়া বিবি ফরমাইস করিল।
“ময়ূরপংখী নায়ের এক করহ সিজিল[১১৪]

আলাল দুলাল সেই নায়ে আরংএ যাইব।
কিস্মত[১১৫] লাগিবে যাহা আমি তাই সে দিব।”

* * * *

ময়ূরপংখী নাও পরে ঘাটেতে আসিল।
নানারূপ আভরণে কুমারে সাজাইল॥
খাদ্যবস্তু যত কিছু নায়ে সাজাইয়া।
তুল্যা দিল পীরার বান্দী[১১৬] কথা বুঝাইয়া॥
সাজাইয়া কুমাররারে নায়ে দিল তুলি।
জল্লাদ অইল সেই নায়ের কাড়ালী[১১৭]

বাইতে বাইতে নাও পড়ল দরিয়ায়।
গেরাম নগর কিছু নাই সে দেখা যায়॥
পরেত জল্লাদ কয় কুমার দুইয়ের আগে।
“ইয়াদ কর[১১৮] আল্লার নাম মরণকালের আগে॥
তোমরার[১১৯] যম আমি দুয়ারেতে খাড়া।
আমার হাতেতে দুইজন যাইবা যে মারা॥
অখনই[১২০] মারিবাম পরে ডুবাইয়া দরিয়াতে।
সতাইয়ের বজ্‌জাতি কিচ্ছু না পার্‌লা বুঝিতে॥
বিবি ছায়বানীর[১২১] হুকুম জান্য মনে সার।
বিশ পুড়া জমি পাইবাম নাই তোমরার উদ্ধার॥”

আনচুক্‌[১২২] এই কথা শুন্যা মাঝির যে মুখে।
আলাল দুলাল কান্দে থাপাইয়া বুকে॥

“সতাইয়ের ছল কথা হায়রে আগে জানি নাই।
বেনালে[১২৩] পড়িয়া হায়রে পরাণ হারাই॥
আগে যদি জান্‌তাম সতাই এই তোমার মনে।
পলাইয়া দুই ভাই থাকতাম ফিরা বনে বনে॥
কোথায় রইলা মা জননী কোথায় বাপজান।
বেনালে পড়িয়া আমরা হারাই পরাণ॥
(জল্লাদরে) তুমিত মায়নার চাকর তোমার দোষ নাই।
যে কামেতে স্বার্থ অইব তোমরা করবা তাই॥
জনম হইতে আরে জল্লাদ কত পাইলাম দুখ।
এক কাম কর যুদি চাইয়া আমার মুখ॥
বাপের ভীডাৎ[১২৪] বাতি দিতে আমরা দুই ভাই।
দুঃখের দোসর বাপের আরত কেহ নাই॥
সতাই বলিয়া কিনা কর‍্যাছে দুষ্‌মনি।”
মনসুর বয়াতী কয় এই সতাইর গুণ বাখানি॥

“যুদি মায়ের বইন আরে মাসী অইত।
পরাণ দিয়া বইন-পুতে পাল্যা রাখিত॥
যুদি বাপের বইন আরে ফুফু[১২৫] না অইত।
টান দিয়া ছেউড়া ভাই-পুত কোলেতে লইত॥
যুদি মায়ের জা আরে চাচী না অইত।
আদর করিয়া ঘরের বাইরি না করিত॥”

আলাল কান্দিয়া কয় জল্লাদের পায় ধরি।
“আমারে মারিয়া দেও দুলালেরে ছাড়ি॥”
দুলাল কয় “শুন জল্লাদ, রাখ মোর কথা।
ভাইয়েরে না রাখ্যা আমারে মার দিয়া বেথা॥”
জল্লাদ কুদিয়া[১২৬] কয় “এই কি যন্ত্রণা।
দুইজনেরেই মারবাম নাই সে শুনিবাম মন্ত্রণা॥”

দুই ভাইয়ে না জল্লাদের ধর‍্যা দুই পায়।
পাথর গলয়ে এমন কান্দিয়া ভাষায়॥
কান্দন না শুন্যা জল্লাদ ভাবে মনে মনে।
“এই খান[১২৭] রাখ্যা গেলে বাঁচিব পরাণে॥
বাপের রাজ্যেতে নাই সে পারিব যাইতে।
বিনাদোষে মার‍্যা কেনে যাই পাপ করিতে॥”


বার ডিঙ্গা সাজাইয়া সাধু সদাগর।
উজান বাইয়া যায় ধান কিনিবার॥
জল্লাদ ডাকিয়া তার কাছে কয় গোপনে।
কুমাররারে[১২৮] নায়ে সাধু তুলিলা যতনে॥
আলাল দুলালে সাধু তুল্যা ভাষায় নাও।
জল্লাদ ফিরিয়া পরে দেশে চলা যায়॥

ধনুয়া নদীর পারে কাজলকান্দা বাড়ী।
তাইতেনা বসতি করে ইরাধর বেপারী[১২৯]
গিরস্থি[১৩০] করিয়া বেচে একশ পড়া ধান।
এমন গিরস্থ নাই তাহার সমান॥
ইরাধরের বাড়ীৎ সাধু ধান না কিনিয়া।
আলাল দুলালে কিস্মত দিল দাম ধরিয়া॥
আলাল দুলাল থাকে সেই না বাড়ীতে।
দেওয়ান পুত্ত্র তাইয়া কত কষ্ট কপালেতে॥
সারাদিন গরু রাখে দুই বেলা খাইয়া।
মনের দুঃখে আলাল আরে গেল পলাইয়া॥১—১১২

(৫)

বার জঙ্গল তের ভূঁই[১৩১] ধনুক দইরার[১৩২] পার।
তাহাতে বসতি করে দেওয়ান সেকেন্দার॥
সেকেন্দর দেওয়ানের বড় শিগাবে[১৩৩]-আউশ[১৩৪]
পংখী শিগার করবার যায় অইয়া বেউস্[১৩৫]
ধনে বনে ঘুর‍্যা মিয়া কত পংখী মারে।
বিক্ষের[১৩৬] নীচেতে দেখে এক ছেলিযারে[১৩৭]
সুন্দর ছেলিয়া দেখ্যা সঙ্গেতে লইল।
নিজের বাড়ীতে মিয়া ফিবিয়া যে গেল॥

কত কম করে ছেইলা মায়না নাই সে নেয়।
অসর্ম্মত হয় যুদি দেওয়ান যাচ্যা দেয়॥
দেওযান ভাবযে কোনো ভালা বাপের বেটা[১৩৮]
চিনা নাই সে দেয় এই হইল বড় লেঠা[১৩৯]
মায়নার কথা যখন দেওযান কয় ছেলিয়ারে।
ছেলিয়া কয় “নিবাম মায়না আমি একবারে॥
একদিন চাইবাম মায়না রাখবাইন মনেতে।
সেই দিন পাই যেন আমার যে হাতে॥”


জান দিয়া করে আলাল দেওয়ানের কাম।
তাহার কারণে অইল চৌদিকে খুসনাম[১৪০]
দেওয়ানে বাসয়ে ভালা[১৪১] পুত্ত্রের সমান।
খেসালা[১৪২] করিতে তার মনে অইল টান॥

দুই কইনা[১৪৩] আছে তার রূপে গুণে দড়।
মমিনা আমিনা নাম আছে বুদ্ধি বড়॥
দেওয়ান ভাবয়ে এক কইনা দিলাম তারে।
না জানিয়া বাপ-মায় পড়িল যে ফেরে॥[১৪৪]
আলালে জিগায়[১৪৫] যদি মুখ পুছ্যা রয়[১৪৬]
গিরস্থের পুত্ত্র আলাল নিজের মুখে কয়॥
এমন বেটা অইল কোন্ গিরস্থের ঘরে।
বিশ্বাস না করে দেওয়ান কেবল চিন্তা করে॥

বার না বছর পরে এই মতে যায়।
মায়নার লাগ্যা আলাল দেওয়ানেরে চায়॥
দেওয়ান ফুইদ করে[১৪৭] আলাল “কিবা মায়না নিবা।
দিবাম তোমারে তুমি যেমন চাহিবা॥”

আলাল কহে “সাহেব আরে শুনখাইন দিয়া মন।
সহর যে আছে এক তার নাম বান্যাচঙ্গ॥
সেই না সরের লাগা[১৪৮] সুন্দর কানলে[১৪৯]
বাড়ী না বান্ধিতে আমার লইয়াছে দিলে[১৫০]
পাচশ মানুষ দিবাইন কাম করিবার।
আর দিবাইন ফৌজ দুইশ লগে[১৫১] কইরা তার॥
সেই না ঘরের মালীক সোনাফর দেওয়ান।
জঙ্গে লড়্যা যেমনে বাড়ী করি যে নির্ম্মাণ॥”[১৫২]

এহাতে দেওয়ান সাহেব অইয়া সর্ম্মত।
আলালের মনের বাঞ্ছা করিল পূর্ণিত॥

* * * *

বান্যাচঙ্গ সরের কিছু শুনখাইন[১৫৩] বিবরণ।
পুত্রশোকে সোনাফর করিল কান্দন॥
আলাল দুলাল আছিল কলিজা তাহার।
“কোন্ না উছিলায়[১৫৪] তারা ছাড়িল সংসার॥
পরাণের পুত্ত্রেরা মোর অকালে মরিল।
মেহেরার[১৫৫] কিছু হায়রে চিহ্ন ত না রইল॥”

কান্দিয়া কান্দিয়া মিয়ার অস্থি-চর্ম্ম সার।
শেষকাডাল[১৫৬] স্ত্রীরির পাইল যন্ত্রণা অপার॥[১৫৭]
এক পুত্ত্র অইল পরে সেই না বিবির।
তারে রাখ্যা সোনাফর গেল নিজের গির[১৫৮]
তার পরে অইল দেওয়ান সেই না ছেলিয়া।
চাড়া ডাঙ্গা[১৫৯] অইল সংসার দেখশুনের[১৬০] লাগিয়া॥
নয়া উজীর নয়া নাজীর পুরাণ যত থইয়া।
বিবির মনের মতন লইল বহাল করিয়া॥
নয়া যত উজীর নাজীর মুচ তাওয়াইয়া ফিরে।
গন্যা বাছ্যা মায়না নেয় কাম নাই সে করে॥[১৬১]

সেই না সময় আলাল বান্যাচঙ্গে আইল।
পাঁচশ মানুষ কামে লাগাইয়া দিল॥

দুইশ ফৌজে না রাখে কানল[১৬২] ঘেরিয়া।
নিরাবিলি হয় কাম বাধা না পাইয়া॥

এই না খবর গেল যখন বান্যাচঙ্গ সহর।
উজীর নাজীর যত রাগিল বিস্তর॥
চর পাঠাইল পরে খিরাজ[১৬৩] না চাইয়া।
আলাল করিল বিদায় কি কথা বলিয়া॥
“বাপের জাগাতে আমি আরে বাড়ী করি।
খিরাজের আমি কিবা ধার না ধারি॥”

বান্যাচঙ্গের ফৌজ যত এই কথা শুনিয়া।
আলালেরে বান্ধ্যা নিতে আইল ধাইয়া॥
দুই দলে অইল পরে আরে রণ না ভারী।
বানিয়াচঙ্গ সহর অইল ছারখারি॥
দখল করিয়া পরে সেই না সহর।
আলাল অইল দেওয়ান বাড়ীতে বাপের॥
সেকেন্দর সাহেবের যত লোক লস্কর।
ইনাম বকশিষ লইয়া গেল নিজ ঘর॥

সেকেন্দর সাহেব না এই কথা শুনিয়া।
এক কইনা তার কাছে দিতে চায় বিয়া॥
তারপরে সেকেন্দর মিঞা গেল বান্যাচঙ্গ সহরে।
সাদির কারণে কত কহিল বিস্তরে॥
বিয়ার কথা শুন্যা আলাল কয় দেওয়ানের কাছে।
“আমার আর এক ভাই দুনিয়াতে আছে॥
তার লাগ্যা দিলে আমি বড় দুঃখু পাই।
বিয়া করিবাম পরে তারে যুদি পাই॥
দুই ভাইয়ে সাদি করবাম দুই কইনা তোমার।
দেখ-শুন রাখ্য যাই খুইজে তাহার॥[১৬৪]

একেলা আলাল পরে ভাইয়ের তালাসে।
দরিদ্রের বেশে মিঞা চলিল বৈদেশে॥
নদী-নালা কত বন-জঙ্গল দিয়া পাড়ি।
ভাইয়েরে না পায় মিঞা অত দুঃখু করি॥

এক না হাওরে[১৬৫] বটগাছের তলাতে।
বিছরাম করয়ে মিঞা তাহার ছাওয়াতে॥
সেই না গাছের তলায় যত রাখুয়ালগণ[১৬৬]
গরু ছাড়িয়া করে সেইখানে খেলন॥
এই না খেলে এই না তারা বস্যা করে গান।
শুন্যা তারার গান মানুষের জুড়ায় কান॥[১৬৭]
পরেত মিল্যা সগলে গান জুড়িল।

গানের সারাংশ

“এক দেওয়ানের দেখ দুই বেটা ছিল॥
দুই বেটা রাখ্যা তার বিবি যায় মরিয়া।
বিবি মরিলে সাদি করল সেই মিঞা॥
সেই না দুষ্টু বিবি আরে কোন্ কাম করে।
বাইল[১৬৮] দিয়া জলে পাঠায় দেওয়ানের দুই বেটারে॥
জলেতে পাঠাইল বিধি মারিবার কারণ।
আল্লার ফজলে[১৬৯] তারার বাঁচিল জীবন॥
আশ্রা[১৭০] পাইল তারা গিরস্থের ঘরে।
বড় ভাই পলাইয়া গেল কোন্ না সরে॥
না পাইল ছোটু ভাই তারে বিচরাইয়া[১৭১]
রাইত দিন যায় তার কান্দিয়া কান্দিয়া॥

এই না গান আলাল আরে যখন শুনিল।
নয়ান হইতে দর্‌দর্ পানি পড়িল॥
তারপর জিগায় মিঞা রাখুয়ালগণে।
“এই গান শিখাইল তোমরারে কোন্ জনে॥”

“এই গান যেই জন শিখাইল আমরারে[১৭২]
সে আইজ না আসিল গরু রাখিবারে॥
সেই না থাকয়ে এই গিরস্থ বাড়ীতে।
তার কাছে গেলে[১৭৩] তুমি যাও এই পথে॥”

গিরস্থের বাড়ীতে আলাল দুলালে দেখিল।
সাম্‌নাসাম্‌নি পরে তারার পরিচয় অইল॥
আলাল কয় দুলালেরে “শুন পরাণের ভাই।
দেওযানগিরি করি গিয়া চল বাড়ী যাই॥
তোমার আমার সাদির দুলাইন[১৭৪] কর‍্যাছি থির[১৭৫]
ফির‍্যা দেশেতে চল আপনার ঘর॥”

কহেত দুলাল পরে এই কথা শুনিয়া।
“গিরস্থের কন্যারে যে করিয়াছি বিয়া॥
কন্যার যে ঘরে অইল[১৭৬] এক ছাওয়াল।
নাম রাখ্যাছি তার সুরুজ জামাল॥
গিরস্থের জমি কিছু দিয়া গেছে মোরে।
তারারে ছাড়িয়া যাই কও কেমন কইরে[১৭৭]
মদিনা পরানের স্ত্রীরি তাহারে ছাড়িয়া।
কেমনে যাইবাম আমি অধর্ম্ম করিয়া॥”

শুনিয়া আলাল কয় “শুন দুলাল ভাই।
তালাক্‌নামা[১৭৮] লেখ্যা গেলে অধর্ম্ম কিছু নাই॥

জাতি নাই সে থাকে আর এইখানে থাকিলে
কিসের সংসার কও জাতি না রহিলে॥[১৭৯]
* * * * 
এই সগলি কথা শুন্যা আরে দুলাল চিন্তা করিয়া।
মদিনার ভাইয়েরে আনে ডাক দিয়া॥
তার নিকট মিঞা সগল কহিল।
তালাক্‌নামা একখান লেখিয়া যে দিল॥
মদিনার সাথে আর দেখা না করিয়া।
আলালের সঙ্গে মিঞা গেল যে চলিয়া॥
অরষিত[১৮০] অইয়া দুই ভাই পন্থেতে চলিল।
বানিয়াচঙ্গের সরে তারা দাখিল অইল॥

সেকেন্দর দেওয়ান পরে এই কথা শুনিয়া।
বানিয়াচঙ্গের সরে আইল সাদির দিন দেখিয়া॥
আলাল দুলালে সাজায় নানান্ আভরণে।
মিছিল কর‍্যা চলে আরে যত লোকজনে॥
আত্তি[১৮১] চলে ঘোড়া চলে চলে উট আর।
তীরন্দাজ বরকন্দাজ লাঠ্যা[১৮২] চলে পাছে তার॥
তার মধ্যে চলে জামাই আলাল দুলাল।
সকলের পাছে ঢুলী বাজাইয়া ঢোল॥
এই না মতে আলাল দুলাল গিয়া শ্বশুরবাড়ী।
মমিনা-আমিনায় পরে লইল সাদি করি॥
মমিনারে আলাল আর দুলাল আমিনারে।
সরা[১৮৩] মতে বিয়া কইরা আইল নিজ ঘরে॥

দেওয়ানগিরি কর‍্যা তারার সুখে দিন যায়।
দিন ফির‍্যাছে[১৮৪] আল্লা কইরাছে উপায়॥১—৯৪


(৬)

তালাকনামা যখন পাইল মদিনা সুন্দরী।
হাসিয়া উড়াইল কথা বিশ্বাস না করি॥
“আমার খসম না ছাড়িব পরাণ থাকিতে।
চালাকি করিল মোরে পরখ করিতে॥
দুলালে তালাক দিব নাই সে লয় মনে।
মদিনারে ভালবাসে যেবা জান পরাণে॥
তারে ছাড়িয়া দুলাল রইতে না পারিব।
কতদিন পরে খসম নিয়ে আসিব॥”

আইজ আসে কাইল আসে এই না ভাবিয়া।
মদিনা সুন্দরী দিল কত রাইত গোঁয়াইয়া॥
আইজ বানায় তালের পিডা[১৮৫] কাইল বানায় খৈ।
ছিক্কাতে তুলিয়া রাখে গামছা-বান্ধা দৈ[১৮৬]
শাইল ধানের চিড়া কত যতন করিয়া।
হাঁড়ীতে ভরিয়া রাখে ছিক্কাতে তুলিয়া॥
এই মতন খাদ্য কত মদিনা বানায়।
হায়রে পরাণের খাম ফির‍্যা নাহি চায়॥
ভালা ভালা মাছ আর মোরগের ছালুন[১৮৭]
আইজ আইব বল্যা[১৮৮] রাখে খসমের কারণ॥
তেওতনা[১৮৯] পরাণের খসম দেশেতে ফিরিল।
অভাগীর কোন্ দোষ কেমনে ভুলিল॥

এই মতে গেল ছয় মাস ভাবিয়া চিন্তিয়া।
উপায় না দেখে বিবি ঘরেতে বসিয়া॥

শিশুপুত্র সুরুজ্ জামাল বাপের পরাণি।
তারে পাঠাইবাম যথায় করয়ে দেওয়ানি॥
সুখে থাউক[১৯০] দুঃখে থাউক মোরে না ভুলিব।
সময় পাইলে মোরে নির্‌চয় কাছে নিব॥
এই আ ভাবিয়া বিবি কোন্ কাম করে।
ভাইয়েরে ডাকিয়া পরে আনে নিজ ঘরে॥
ভাইয়েরে বুঝাইয়া কয় “তুমি সোদর ভাই।
তোমার কাছেতে মোর কিছুই গোপন নাই॥
তুমি যাও পরাণের পুত্ত্র সুরুজে লইয়া।
খসমের খবর এক আনহ জানিয়া॥
আমার সগল কথা তাহারে বলিবা।
তার মনের কথা যত সগল শুনিবা॥”
এই না বলিয়া বিবি পাঠায় তারারে।
যাইতে যাইতে গেল তারা বান্যাচঙ্গের সরে॥

বান্যাচঙ্গের সরে পরে দুলালের সাথে।
দেখা না অইল তারার বারবাঙ্গ্‌লার[১৯১] পথে॥
দুলাল দেখিয়া পরে তারারে চিনিল।
কানে কানে এই কথা তারারে বলিল॥
“নাই সে থাক এইখানে আর যাও ফিরিয়া।
অসম্মানি অইবাম আমি তোমরারে লইয়া॥[১৯২]
ক্ষেতখলা আছে তোমরা সেই সগল কর।
আর না আসিও ফির‍্যা বান্যাচঙ্গের সর॥
সেইখান থাক্‌লে তোমরার সুখে যাইব দিন।
এইখান আস্যা আমরারে[১৯৩] নাইসে কর হীন॥

জল্‌দি চলিয়া যাও মোর পানে চাইয়া।
সরম পাইবাম লোকে ফালাইলে জানিয়া॥”

দুলালের মুখে এই কথা না শুনিয়া।
দুঃখিত অইয়া তারা গেল যে চলিয়া॥
তারপরে দুইজনে পন্থে মেলা নিল।
কান্দিতে কান্দিতে সুরুজ বাড়ীতে ফিরিল॥
মায়ের নিকট যত কহিল খবর।
শুন্যা মদিনা বিবি দুঃখিত অন্তর॥
* * * *
মদিনা কান্দয়ে “আল্লা কি লেখ্‌ছ কপালে।
বনের পংখী অইয়া যেমন উইড়া গেলে চইলে॥[১৯৪]
পরাণের পংখী আমার পরাণ লইয়া গেলা।
পাষাণে বান্ধিয়া দিল্ রহিলা একেলা॥[১৯৫]
একদিন তো না দেখ্যা থাকিতে পারিত।
কোন্ পরাণে কর্‌লা ইতে[১৯৬] বিপরীত॥
লক্ষ্মী না আগণ মাসে বাওয়ার দাওয়া মারি[১৯৭]
খসম মোর আনে ধান আমি ধান লাড়ি[১৯৮]
দুইজনে বস্যা পরে ধান দেই উনা[১৯৯]
টাইল ভরা ধান খাই করি বেচা কিনা॥
হায়রে পরাণের খসম এমন করিয়া।
কোন্ পরাণে রইলা আমাকে ছাড়িয়া॥

পোষ না মাসেতে যখন ছাবে[২০০] সাইল ক্ষেত।
আমি না অভাগী পর দেই যত লেত খেত[২০১]
উক্কায় ভরিয়া পানী তামুক ভরিয়া।
খসমের লাগ্যা থাকি পন্থপানে চাইয়া॥
হায়রে পরাণের বন্ধু রইলা কোন্ দেশে।
অভাগী কান্দিয়া মরে তোমার উদ্দেশে॥
ক্ষেত না পেকিয়া[২০২] খসম যখন দেয় গুছি[২০৩]
ভাত না রান্ধিয়া তার লাগ্যা থাকি বসি॥
জালা[২০৪] আগু‍‌্যয়াইয়া[২০৫] দেই ক্ষেতের কাছেতে।
কত তারিপ[২০৬] করে খসম আসিয়া বাড়ীতে॥
কোন্ না পরাণে খসম রইলে ভুলিয়া।
মনের যে দুঃখে যায়রে অঙ্গ মোর জ্বলিয়া॥

“হায়রে দারুণ আল্লা যদি এই আছিল মনে।
কেনে বা নিদয় অইলে দেখাইয়া স্বপনে[২০৭]
দারুণ মাঘ না মাস শীতে কাঁপয়ে পরাণি।
পতাবর[২০৮] উঠ্যা খসম সাইল ক্ষেতে দেয় পানী॥
আগুণ লইয়া আমি যাই ক্ষেতের পানে।
পরাব অইলে[২০৯] আগুণ তাপাই দুইজনে॥
সাইলের দাওয়া মারি দুয়ে[২১০] যতনে তুলিয়া।
সুখে দিন যায়রে আমরার ঘরেতে বসিয়া॥”

সেই না সুখের কথা যখন হয় মনে।
মদিনার বয় পানী অজ্‌জর[২১১] নয়ানে॥
“এমন নিদয় খাম কেমনে অইলা৷
তোমার বিরয়ে[২১২] কান্দি বসিয়ে একেলা॥”
খসম কাটে চাড়ি[২১৩] আর আমি আমি পানী।
দুয়ে মিল্যা করি কাম আমি অভাগিনী॥
এমন না খসম গেল মোরে ফাঁকি দিয়া।
কেমনে থাকিবাম আমি পরাণে বাঁচিয়া॥

“আমার মতন নাই রে আর অভাগিনী।
ভরা ক্ষেতের মধ্যে আমার কে দিল আগুণি॥
কোন্ না পরাণে আমি থাকবাম বাঁচিয়া।
মন-পংখী মোর উড়্যা গেছে আছে কেবল কায়া॥”

কান্দিয়া কান্দিয়া বিবির দুঃখে দিন যায়।
খানাপিনা[২১৪] ছাড়্যা কেবল করে ‘হায় হায়’॥
তারপরে না চিন্তায় শেষে হইল পাগল।
যাইনা মুখে লয় তাই যে বকয়ে কেবল॥
ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে ক্ষণে দেয় গালি।
ক্ষণে গায় ক্ষণে জোকার[২১৫](দেয়) ক্ষণে করতালি॥
খাওন বেগর[২১৬] আর এই না আবেস্থায়[২১৭]
সোনার অঙ্গ মৈলান হইয়া হাড়েতে মিশায়॥
দিনে দিনে সর্ব্ব অঙ্গ হইল যে শেষ।
কালি কেশরতা[২১৮] মুখ অইল বিশেষ॥
তারপর না একদিন সগল চিন্তা রইয়া।
বেস্তের[২১৯] হুরী[২২০] না গেল বেস্তেতে চলিয়া॥

দুধের বাচ্ছা সুরুজ্ জামাল পইড়া মায়ের পর।
চক্ষের জলেতে ভাসে কান্দিয়া বিস্তর॥
পাড়াপরশী মিল্যা সবে কয়বর খুদিয়া।
মাটি দিল ফতুয়া মতন জনাজা[২২১] পড়িয়া॥১—১১২

(৭)

বিদায় দিয়া পরাণের পুতে চিন্তয়ে দুলাল।
“কলিজার লৌ আমার সুরুজ্ জামাল॥
নিদয় অইয়া তারে কেমনে দেই ছাড়ি।
কেমনে ছাড়িবাম আমি মদিনা সুন্দরী॥
কি কইব মদিনা বিবি শুনিয়া মোর কথা।
দুঃখ যে পাইল তার দিলে কত ব্যথা॥
যে নাকি পরাণ দিয়া কিন্যাছিল[২২২] মোরে।
ফাকি দিয়া কোন্ পরাণে আইলাম ছাইড়ে তারে॥
দুঃখের দোসর বিবি আমার যে জান।
তারে ছাড়্যাছি আমার কেমন পরাণ॥
তার বাপে দুঃখের দিনে আশ্রা দিল মোরে।
সুখের লাগিয়া বিয়া দিছিল যে তারে॥
আমার পানে চাইয়া দিছিল জমি বাড়ী যত।
ভাবছিল মনে আমি তারে সুখ দিবাম কত॥
সেই না মদিনার মনে দিলাম বড় দাগা।
মরিলে দুজকে[২২৩] হায়রে অইব আমার জাগা॥
অসার দুনিয়াই দুই দিন সুখের লাগিয়া।
জান্যা বুঝ্যা[২২৪] লইলাম আমি দুজক বাছিয়া॥
এমন কামের কাছে আমি নাই সে যাই।[২২৫]
পায়ে ধর‍্যা ক্ষেমা চাইবাম তারে যদি পাই॥”

এই না ভাবিয়া দুলাল কোন্ কাম করে।
না জানায় আলাল ভাইরে না জানায় স্ত্রীরিয়ে॥
ঘরতনে[২২৬] বাইরি অইয়া পন্থে দিল মেলা।
লোক লস্কর নাই সে চলিল একেলা॥
যাইবার কালে হাঁচির শব্দে বাধা যে পড়িল।
কতক্ষণ দুলাল মিঞা বার যে চাহিল[২২৭]
তার পরে মেলা দিয়া সামনে দেখে তেলী।
ডাইনেতে দেখিল এক গাভীন[২২৮] শিয়ালী॥
মাথার উপরে ডাকে কাউয়া[২২৯] চিল রইয়া[২৩০]
নানা অলক্ষণ দেখে পন্থে মেলা দিয়া॥

“না জানি আল্লাজী আমার কি লেখছুইন্‌[২৩১] কপালে।
কুলক্ষণ দেখ্‌লাম কত পন্থে মেলা দিয়া॥”
যাইতে না যাইতে আরে গেল বাড়ীর কাছেতে।
মদিনার আদরের গাই পড়িয়া পন্থেতে॥
ঘাস নাই পানি নাই ডাকে ঘন ঘন।
এরে দেখ্যা দুলাল মিঞার দুঃখু হইল মন[২৩২]

ছয় না বচ্ছরের মদিনা হাঁট্যা বেড়ায় পাড়া।
এক ডণ্ড নাহি থাকে দুলালের ছাড়া॥
এক দুই করি দেখ ছয় মাস গেল।
দুলালের লাগ্যা মদিনা পাগল হইল॥
বৈশাখে বুলবুল্যার বাচ্চা উড়াইয়া নেয় মায়।
দুলালে ডাকিয়া কন্যা ধরিবারে চায়॥
সেই ত বুলবুল্যার বাচচা জুলুঙ্গায়[২৩৩] রাখিয়া।
দুইজনে পালে তারে যতন করিয়া॥

শূন্যরে জুলুঙ্গা আজ উসারাতে[২৩৪] পড়ি।
ছোটু কালের[২৩৫] বুলবুল কান্দে ঘরের চালে পড়ি॥
বুলবুল্যারে ডাক্যা দেওয়ান কহিতে লাগিল।
“কি জন্য বুলবুল তোমার আঁখি দেখি লাল॥”
“পরাণের মদিনা বিবি কব্বর হিথানে[২৩৬]
তার লাগ্যা আঁখি লাল হইল কান্দনে॥”
“হায়রে বুলবুল পংখী কান্দ কি কারণে।
আমার মদিনা বিবি গিয়াছে কোন্ খানে॥”

“জ্যৈষ্ঠ মাসে আমের বড়া[২৩৭] দুইজনে লাগাইল।
মদিনারে লইয়া জল ঢাল্যা বাঁচাইল॥
সেই ত না আমের চারা গরুতে খাইল।
পরাণের পরাণ বিবি কোন্ দেশে গেল॥

“ঘরে কান্দে পালা বিলাই[২৩৮] গোয়ালে কান্দে গাই।
সকলিত আছে আমার পরাণের দোসর নাই॥”
মানুষের গন্ধ নাই বাড়ীর ভিতরে।
কাউয়ায় করে কা—কা চালের উপরে॥
মদিনারে ডাক্যা মিঞা উত্তর না পায়।
তাহার লাগিয়া পরে চাইর দিক বিচরায়[২৩৯]

সুরুজ্ জামাল এই না ডাক শুনিয়া।
দুলালে দেখিল ঘরের বাইরি অইয়া॥
দুলাল জিগায় “সুরুজ্, মদিনা কোথায়।”
চোখে হাত দিয়া সুরুজ্ কয়বর দেখায়॥

কবরের পার্শ্বে

“দুলাল জিগায় ‘সুরুজ্, মদিনা কোথায়।’
চোখে হাত দিয়া সুরুজ্ কয়বর দেখায়॥”

দেওয়ানা মদিনা, ৩৮৪ পৃঃ

কয়বর দেখাইয়া পরে জমিনে পড়িয়া।
কান্দিতে লাগিল পুত্র মায়ের লাগিয়া॥
দুলাল পড়িয়া কান্দে কয়বর উপরে।
“হায় গো আল্লাজী পড়্লাম কি পাপের ফেরে।
নিজ হাতে বধ কর্‌লাম জননার[২৪০] পরাণ।
এই দুনিয়াতে মোর নাই আর থান[২৪১]
দিশা— 
“পরাণের মদিনা বিবি উঠ্যা কও কথা।
আর নাই সে দিবাম আমি তোমার দিলে বেথা।
তুমি যদি দেও দেখা মোর পানে চাইয়া।
আর না রাখিবাম তোমায় বুকছাড়া কইরা॥
উঠ্যা কথা কও বিবি মোর মাথা খাও।
আনইলে[২৪২] যেখানে আছ মোরে লইয়া যাও॥”

“বিধির বিপাকে পইড়া কইরা হেন কাজ।
তোমার কাছেতে পাইলাম আমি বড় লাজ॥
আইসরে পরাণের বিবি কয়বর ছাড়িয়া।
কথা কও মোর পানে তাকাও ফিরিয়া॥
তোমারে ছাড়িয়া কও কোন্ পরাণে থাকি।
আমার কষ্টের আর কিবা আছে বাকি॥
ভালা যুদি বাস মোরে দয়া না করিয়া।
তোমার কাছেতে মোরে নেওরে টানিয়া॥
তিলেক না থাক্‌তা[২৪৩] তুমি ছাড়িয়া আমারে।
পায়ে ঠাঁই দিয়া রাখ তোমার কাছারে[২৪৪]
আর না সয় যে প্রাণে দারুণ যন্ত্রণা।
পায়ে ধরি বিবি আর সয় না যাতনা॥
আমি নয় কইরাছি পাপ রইছ[২৪৫] ছাড়িয়া।
পরাণের সুরুজে কেমনে রইলে ভুলিয়া॥

“তোমার লাগিয়া বাছা কান্দে রাইত দিন।
খানাপিনা ছাইড়া সে যে অইছে[২৪৬] উদাসীন॥”
দাওনা[২৪৭] অইয়া দেওয়ান কান্দ্যা ভিজায় মাটি।
“বুকের কলিজা মোর কেবা লইল কাটি॥
জমিনেতে গাছ বিরিখ আসমানের তারা।
আমার কাছেতে অইল রাইতের অন্ধারা[২৪৮]
দরিয়া শুকাইয়া যায় পাথর অইল পানী[২৪৯]
কোথায় গেলে পাইবাম আমার দোসর পরাণি॥
আর না যাইবাম আমি বান্যাচঙ্গের সরে।
এইখান থাকবাম আমি পড়্যা কয়বরে॥
দরদালান দেওয়ানগিরিতে কার্য্য নাই মোর।
আর না যাইবাম আমি বান্যাচঙ্গের সর॥
পরাণের ভাই আলালে মোর কইও এই খবর।
আভাগ্যা[২৫০] দুলাল আর না ফিরিবে ঘর॥
ফকীর আছিলাম আগে অইলাম ফকীর।
মদিনার লাগ্যা আমার বুক অইল চির[২৫১]
তালাকনামা নাই সে দিতাম না করিতাম বিয়া।
তবেত আমার মদিনা না যাইত ছাড়িয়া॥
দেওয়ানগিরির লোভে আমি করিলাম বেসাতি।
জমিনের ধূলার লাগ্যা ছাড়্লাম ইরামতি[২৫২]
ছোটুকাল অইতে মোর মদিনা পরাণি।
এক ডণ্ড না দেখ্‌লে সে যে অইত পাগলিনী॥
এক সাথে গোঁয়াইনু আরে কয়না বচ্ছর।
দোজকে রইলাম আমি মদিনা বেগর[২৫৩]

এইমতে কান্দ্যা মিঞা কোন্ কাম করে।
বান্ধিল ডেগুরা[২৫৪] এক কয়বর উপরে॥
এইরূপে থাকে মিঞা দাওনা অইয়া।
ফকীর সাজিল দুলাল দেওয়ানগিরি থুইয়া॥
আর নাই সে গেল মিঞা বান্যাচঙ্গের সরে।
আখের গণিয়া দেখে কয়বর উপরে॥[২৫৫]
দুলালের কান্দনেতে পাথর গল্যা পানি।
জালাল গাইনে গায় গীত দুঃখের কাইনী[২৫৬]

  1. রইয়া=রহিয়া, অর্থাৎ স্বিরবুদ্ধি হইয়া।
  2. আভাগী=অভাগী।
  3. পিয়া=প্রিয়া।
  4. খাড়াইয়া=খাড়া হইয়া, গাঁড়াইয়া।
  5. শরীল=শরীর।
  6. কালা ধরে=কালিমা পড়িয়াছে।
  7. কুয়ার কয়বরে=কূপতুল্য গভীর সমাধিগহ্বরে।
  8. কোনি=কোন।
  9. পুত=পুত্রের অপভ্রংশ।
  10. সপলাম=সমর্পণ করিলাম।
  11. সপ্যা=সমৰ্পণ করিয়া।
  12. থাক্য=থাকিও।
  13. অইয়ো=হইও।
  14. পাহাড়ী=পাহাড়।
  15. এতিম=নিরাশ্রয়; অনাথ।
  16. সগল=সকল।
  17. দারাক=হিজলজাতীয় একপ্রকার জলীয় বৃক্ষ।
  18. কইতরা কইতরী=কবুতর ও কবুতরী।
  19. খোরলে=কোটরে।
  20. তারার=তাদের
  21. অনাধারে=বিনা (আধারে) খাদ্যে।
  22. দেয় উম=তাপ দেয়।
  23. পর=পাহারা।
  24. খুটিয়া=ঠোঁট দিয়া ঠোকরাইয়া।
  25. জোরী=সাথী।
  26. যাইতে=যাহাতে।
  27. অইব=হইবে।
  28. দন=রণ, বাগড়া।
  29. রাখ্‌তাম=রাখিতে, রাখিব।
  30. এরারে=ইহাদিগকে, এদের।
  31. উইড়া——কর্‌ত=অনাহুত ভাবে এরা আমার বাদ সাধিতে আসিয়াছে, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
  32. জিগায়=জিজ্ঞাসা করে।
  33. গিরধনী=গৃধিনী।
  34. ছেউরা=মাতৃহীন; নিঃসহায় শিশু।
  35. ছেল=শেল।
  36. বেথা=ব্যথা।
  37. সতীপুত্রের=সতীনের ছেলের।
  38. অন্তৃম=অন্তিম।
  39. পুতেরার=পুত্রদের।
  40. গেলা নিজ বাড়ী=স্বর্গে চলিয়া গেল।
  41. জান্‌ব=জানিবে।
  42. লৌ=(লহু হইতে) রক্ত।
  43. থাপাইয়া=চাপড়াইয়া।
  44. অনাধারে=অনাহারে।
  45. ফেরে=বিপদে।
  46. মর‍্যাত—পলাইয়া=আমার স্ত্রী শুধু মরিয়া যান নাই, মারিয়াও গিয়াছেন। তিনটি জীবন নষ্ট করিয়া পলাইয়া গিয়াছেন।
  47. জর্ম্মে=জন্মে।
  48. অধুন্যাই=প্রভূত, অপর্যাপ্ত।
  49. খাইব=ভোগ করিবে।
  50. তেজিতাম=ত্যাগ করিতাম।
  51. পিছ লইতাম=অনুসরণ করিতাম; তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমি জীবন ত্যাগ করিতাম।
  52. ফালাইলা=ফেলিলে।
  53. বে-নালে=বিপদে।
  54. বুক না কুটিয়া=বুকে করাঘাত করিয়া।
  55. পরা’ব=পরাভব।
  56. গুরজান=গুজরান; নির্ব্বাহ; সংসার চালান।
  57. বের্ত্তা (বির্থা, ব্রেথা) বৃথা।
  58. বান্ধা=যে সংসার সুশৃঙ্খল ও নিয়মাবদ্ধ ছিল।
  59. বয়াতি=বয়াৎ (পদ) রচনা করে যে; পদ-রচক।
  60. শুন্‌খাইন্=শুনুন।
  61. রাখ্যুয়াইন=রাখুন।
  62. সগল=সকল।
  63. জীবমানে=জীবন থাকিতে।
  64. ফয়দা=ফল; লাভ।
  65. কর্‌খাইন=করুন।
  66. পাল্‌খাইন=পালন করুন।
  67. ছাড়নে=ছাড়িয়া দেওয়ায়।
  68. তারারে=তাহাদিগের।
  69. লাগা পাছে=পাছে পাছে লাগিয়াই আছে।
  70. সতাইয়ের=বিমাতার, যথা কৃত্তিবাসী রামায়ণে আয়বিবরণে “আর এক ভাই হল সতাইয়ের উদরে”।
  71. লউ=লোহ, রক্ত। বুকের রক্তের মত দেখিবে।
  72. সতীপুতরারে=সতীনের পুত্রদিগকে।
  73. খাওন না সুজে=খাওয়া-লওয়ার আর প্রবৃত্তি হয় না।
  74. বিষুম=বিষম।
  75. নছিবেতে=কপালে।
  76. যুদি=যদি।
  77. হেতু=উপায়।
  78. আমার—করিয়া=আমার দৃষ্টির বহির্ভূত করিয়া রাখিয়াছ।
  79. সগল=সকল।
  80. কুয়াল=কু-হালের অপভ্রংশ; দুরবস্থা।
  81. ছিক্কা=শিকা।
  82. পচ্যা=পচিয়া
  83. আইজ বিয়ালে=অদ্য বিকালে।
  84. তা অইলে—মরণ=তবে জানিয়া রাখিয়ো যে আমার নিশ্চয় মরণ।
  85. দয়াতে—চিতে=দয়ায় দেওয়ান সাহেবের চিত্ত পূর্ণ হইয়া গেল।
  86. রাখ্‌তাম=রাখিতে।
  87. ডণ্ড=দণ্ড
  88. কাছছাড়া অইলে=নিকটে না থাকিলে
  89. অইতে=হইতে।
  90. কামে=কাজকর্ম্মে।
  91. মিডা বুলে=মিঠা বোলে; মিষ্ট কথায়।
  92. তিরুডী=ত্রুটী; অন্যথা।
  93. ইতে আন্ না অইব=হিতে অন্যখা হইবে না। আন্=অন্যথা।
  94. মিডা—কইরে=মিষ্ট কথায় কার্যোদ্ধার করিয়া লইব। (আশিল=হাশিল=সাধন করা।)
  95. নির্চয়, নির্ছয়=নিশ্চয়।
  96. পরকাশ কর্‌ব=প্রকাশ করিব।
  97. যাইতে=যাহাতে।
  98. তেও=তবু।
  99. মিডাই=মিঠাই।
  100. বগা—খাপ ধরিয়া। বগা=বক; বুজ্‌ঞ্যা=বুজিয়া; বস্যা থাক্যা=বসিয়া থাকিয়া; পুডী=পুঁটী (মাছ)। খাপ ধরিয়া=শিকার-প্রত্যাশায় প্রস্তুত থাকিয়া!
    মনসুর বয়াতী বলিতেছে, “বক যেমন নিরতিশয় নিরীহতার ভান করিয়া পগারের ধারে চোখ বুজিয়া বসিয়া সুবিধামত পুঁটী মাছ ধরে, তদ্রূপ ‘বকধার্মিক-প্রকৃতি’ দেওয়ান-গৃহিণী আলাল দুলালের আগমন-প্রতীক্ষায় প্রস্তুত হইয়া বসিয়া রহিল।
  101. বার চাইয়া=প্রতীক্ষায়।
  102. পাইক প’রী তামেসগীর=পাইক, প্রহরী ও যাহারা তামাসা দেখিতে জড় হইয়াছে।
  103. লুডায়=লুঠায় বা লুটায়।
  104. আলুফা=দুর্লভ, আশ্চর্য্য।
  105. আচরিত=আশ্চর্য্য।
  106. ইত=হিত।
  107. দিলে=অন্তঃকরণে।
  108. শাওনিয়া বষ্‌ষার=শ্রাবণ বৰ্ষার।
  109. নয়া—ভাসাইয়া=শ্রাবণের মূতন জলে দেশ ভাসিয়া গিয়াছে। এখন সংখ্যাতীত সুদৃশ্য বা’ছের নৌকা একত্রিত হইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার সহিত জলের উপর ভাসিবে।
  110. আরং জমা=পূর্ববঙ্গে (বিশেষতঃ পূর্ব্ব ময়মনসিংহে) বর্ষাকালে যখন মাঠ-ঘাট, খাল-বিল জলে একাকার হইয়া যায়, তখন কোনো নির্দ্দিষ্ট স্থানে বহু সুসজ্‌জিত দৌড়ের নৌকা বাইচ্ খেলার জন্য একত্র হয়। তাহাকেই আরং বলা হয়। এই উৎসবটি মনসা দেবীর পূজার দিন সম্পূর্ণতা লাভ করে। সহস্র সহস্র দর্শক উত্সুক নয়নে প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকাসমূহের অভিযান লক্ষ্য করিয়া থাকে। নৌকা বাওয়ার তালে তালে বাহকেরা বাদ্যসহযোগে পদ্মাপুরাণ ও কৃষ্ণলীলার করুণ গীতি গাহিয়া থাকে।
  111. কাওলা=কবুলতি করিয়া, লিখিয়া পড়িয়া।
  112. কউখাইন=বলুন।
  113. জানবাইন=জানিবেন।
  114. সিজিল=ব্যবস্থা।
  115. কিস্মত=মূল্য
  116. পীরার বান্দী=দ্বার-প্রহরী।
  117. কাড়ালী=কাণ্ডারীর অপভ্রংশ।
  118. ইয়াদ কর=স্মরণ কর।
  119. তোমরার=তোমাদের।
  120. অখনই=এখনই।
  121. ছায়বানী=সাহেবানী।
  122. আনচুক্=অকস্মাৎ
  123. বেনালে=সঙ্কটে, বিপাকে।
  124. ভীডাৎ=ভিটায়।
  125. ফুফু=পিসী।
  126. কুদিয়া=ক্রুদ্ধ হইয়া।
  127. এই খান=এইখানে, এস্থানে।
  128. কুমাররারে=কুমারগণকে।
  129. ইরাধর বেপারী=হীরাধর ব্যাপারী। ব্যাপারী=বণিক্।
  130. গিরস্থি=গৃহস্থি=কৃষিকর্ম্ম ইত্যাদি।
  131. তের ভুঁই=তেরটি ভূমিখণ্ড।
  132. দইরা=দরিয়ার অপভ্রংশ।
  133. শিগারে=শিকারে।
  134. আউশ=হাউস্, প্রবল ইচ্ছা।
  135. বেউস্=বেহুস্, অজ্ঞান।
  136. বিক্ষের=বৃক্ষের।
  137. ছেলিয়ারে=ছেলেকে।
  138. ভাল বাপের বেটা=সম্ভ্রান্ত লোকের ছেলে।
  139. লেঠা=মুস্কিল। নিজের পরিচয় দেয় না, এইটা বড় মুস্কিলের কথা।
  140. খুসনাম=প্রশংসা।
  141. ভালা=ভাল।
  142. খেসালা=আত্মীয়তা।
  143. কইনা=কন্যা।
  144. না—ফেরে=আলালের বংশপরিচয় না জানিতে পারায় দেওয়ান মুস্কিলে পড়িল।
  145. জিগায়=জিজ্ঞাসা করে।
  146. মুখ পুছ্যা রয়=মুখ বুজিয়া রহে, কোন কথা বলে না।
  147. ফুইদ করে=জিজ্ঞাসা করে।
  148. সরের লাগা=সহরের লাগা, নগরোপণ্ঠস্থ।
  149. কানল=কানন, এখানে বাগান অর্থে।
  150. দিলে=অন্তঃকরণে।
  151. লগে=সঙ্গে।
  152. অঙ্গে নির্ম্মাণ=যাহাতে তাঁহার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া বাড়ী তৈয়ার করিতে পারি তেমন সংখ্যক লোক আমাকে দিতে আজ্ঞা হয়।
  153. শুনখাইন=শুনুন।
  154. উছিলা, অছিলা=ওজর, হেতু।
  155. মেহেরার=আমার জন্য।
  156. শেষকাডাল=শেষ কালে, এখনও পূর্ব্ববঙ্গে প্রচলিত।
  157. শেষকাডাল—অপার=বার্দ্ধক্যে দেওয়ান সোনাফর স্ত্রীর হাতে অশেষ দুর্ব্ব্যবহার পাইতে লাগিলেন।
  158. গির=গৃহ।
  159. চাড়া ভাঙ্গা=ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন।
  160. দেখগুনের=তত্ত্বাবধানের।
  161. নয়া—করে=নূতন উজীর নাজিরগণ বিষয়-সংক্রান্ত কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। তাহাদের কোনো কাজকর্ম্ম নাই, কিন্তু বেতন নেওয়ার সময় তাহারা শৈথিল্য প্রকাশ করে না। তাহারা গোফে তা দিয়া ঘুরিতে লাগিল।
  162. কানল=কানন।
  163. খিরাজ=খাজনা।
  164. দেখ——তাহার—দেখ-শুন রাখ্য=দেখিয়া শুনিয়া রাখিও। এই রাজ্যের তত্ত্বাবধান করিয়ো, আমি তাহার অনুসন্ধানে চলি।
  165. হাওর=বিস্তীর্ণ মাঠ।
  166. রাখুয়ালগণ=রাখালগণ।
  167. এই—কান=রাখাল বালকেরা কখন খেলায় মত্ত হয় আবার কখন বা বসিয়া সমস্বরে গান করে। বালক-কণ্ঠ-নিঃসৃত মধুর সঙ্গীতে শান্ত পথিকের কর্ণ জুড়াইয়া যায়।
  168. বাইল=ছলনা।
  169. ফজলে=দয়ায়।
  170. আশ্রা=আশ্রয়।
  171. বিচরাইয়া=অনুসন্ধান করিয়া।
  172. আমরারে=আমাদেরে।
  173. গেলে=যদি যাইতে চাও।
  174. দুলাইন=বিবাহের পাত্রী।
  175. থির=স্থির।
  176. ঘরে অইল=গর্ভে হইল।
  177. কইরে=করিয়া।
  178. তালাক্‌নামা=ত্যাগ-পত্র।
  179. কিসের—রহিলে=দেওয়ানের পুত্র হইয়া চাষার ঘরে থাকিলে আর জাতি কি করিয়া থাকে? আর জাতিই যদি যায়, তবে জীবনে দরকার কি?
  180. অরষিত=হরষিত, আহ্লাদিত।
  181. আত্তি=হাতী।
  182. লাঠ্যা=লাঠিয়াল।
  183. সরা মতে=মুসলমানদের প্রথানুযায়ী, বিধানানুসারে।
  184. দিন ফির‍্যাছে=সুদিন দেখা দিয়াছে।
  185. পিডা=পিঠা; পিষ্টক।
  186. গামছা-বান্ধা দৈ=এক প্রকার অত্যুৎকৃষ্ট দৈ। ইহা এত ঘন যে, গামছায় স্বচ্ছন্দে বান্ধিয়া রাখা যায়। পূর্ববঙ্গের স্থানে স্থানে অদ্যাপি এই প্রকারের দৈ পাওয়া যায়।
  187. ছালুন=ব্যঞ্জন।
  188. আইজ আইব বল্যা=আজ আসিবে বলিয়া।
  189. তেওতনা=তবুতো না।
  190. থাউক=থাকুক।
  191. বারবাঙ্গ্‌লা=বারদুয়ারী বাঙ্গালা ঘর।
  192. অসর্ম্মানি——লইয়া=তোমাদিগকে নিয়া আমাকে অসম্মানিত হইতে হইবে।
  193. আমরারে=আমাদিগকে। আমাদিগের মাথা হেঁট করাইও না।
  194. বনের—চইলে= বনের পাখী যেমন অপ্রত্যাশিতভাবে উড়িয়া চলিয়া যায়, তদ্রূপ আমার স্বামীও কি আমাকে না বলিয়াই হঠাৎ চলিয়া গেল।
  195. পাষাণে—একেলা=বুক পাষাণে বাঁধিয়া একলা রহিলাম।
  196. ইতে=হীতে।
  197. বাওয়ার দাওয়া মারি=বাওয়া এক প্রকার হৈমন্তিক ধান্য। তাড়াতাড়ি ও নিরতিশয় ব্যস্ততার সহিত কোনো কাজ সম্পন্ন করাকে গ্রাম্য ভাষায় ‘দাওয়া মারি’তে কাজ সারা বলে। ঝড়জলে পক্ক বাওয়া ধানগুলি নষ্ট হইয়া যাইবে ভয়ে কৃষকেরা ‘দাওয়া মারি’ করিয়া শস্য ঘরে ভুলিয়া আনে।
  198. লাড়ি=বিছাইয়া দেই।
  199. উনা দেওয়া=কলা দিয়া ঝাড়িয়া কিংবা বাতাসে ধান উড়াইয়া দিয়া খড়কুটার টুকরা ও সারহীন ধানগুলি দূর করিয়া দেওয়াকে ‘উনা দেওয়া’ বলে।
  200. ছাবে=ছাইয়া যাইবে; সাইল ক্ষেত ধানগাছে পুরিয়া যাইবে।
  201. পর দেই যত লেত খেত=(পর দেই=প্রহরা দেই। লেত খেত=জঞ্জাল, আবর্জনা, যাহাতে কাহাকেও ত্যক্ত-বিরক্ত করিয়া দেয়।) আমি সকল জঞ্জাল-বিরক্তি ভোগ করিয়াও শস্যক্ষেত্রে পাহারা দেই।
  202. পেকিয়া=পঙ্কময় করিয়া, কর্দমাক্ত করিয়া।
  203. গুছি=গুচ্ছ হইতে, কদমাক্ত জমিতে চারাধানের গাছ পুঁতিয়া দেওয়াকে গুছি দেওয়া বলা হয়।
  204. জালা=ধানের চারাগাছ, জমি কর্দমাক্ত করিয়া তাহাতে পুতিয়া দেওয়া হয়।
  205. আগু‍্যয়াইয়া=এগিয়ে।
  206. তারিপ=প্রশংসা।
  207. দেখাইয়া স্বপনে=স্বপ্নের যত ক্ষণিক সুখের দৃশ্য দেখাইয়া।
  208. পতাবর=প্রত্যুষ
  209. পরাব অইলে=শীতে কষ্ট পাইতে থাকিলে।
  210. দুয়ে=দুইজনে।
  211. অজ্‌জর=অঝোরে।
  212. বিরয়ে=বিরহে।
  213. চাড়ি কাটা=খড়কাটা।
  214. খানাপিনা=খাওয়া ও পরা।
  215. জোকার দেয়=জয়-জয়কারসূচক উলুধ্বনি করে।
  216. বেগর=বিনা, ব্যতীত।
  217. আবেস্থা=অবস্থা
  218. কালি কেশরতা=একপ্রকার গাঢ় কাল রং-এর ঘাস, তাহার ন্যায়।
  219. বেস্তের=বেহেস্তের, স্বর্গের।
  220. হুরী=একশ্রেণীর পরীবিশেষ।
  221. ফতুয়া মতন জনাজা=মুসলমানের ধর্ম্মশাস্ত্রসঙ্গত স্বর্গগত আত্মার শান্তিলাভার্থ প্রার্থনা।
  222. কিন্যাছিল=ক্রয় করিয়াছিল।
  223. দুজকে=নরকে।
  224. জান্যা বুঝ্যা=জানিয়া বুঝিয়া।
  225. এমন—সে যাই=এমন কাজ আমি করিব না।
  226. ঘরতনে=ঘর হইতে।
  227. বার চাহা=অপেক্ষা করা।
  228. গাভীন=গর্ভবতী।
  229. কাউয়া=কাক।
  230. রইয়া=রহিয়া রহিয়া।
  231. লেখছুইন্‌=লিখিয়াছেন।
  232. মন=অধিকরণ ‘মনে’।
  233. জুলুঙ্গা=খাঁচা।
  234. উসারা=বারান্দা।
  235. ছোটু কালের=শৈশবের।
  236. হিথানে=শীথানে, শিয়রে। পরাণের....কান্দনে—প্রাণের মদিনা সমাধি-শয়নে শায়িতা। তাহার দুঃখে কান্দিতে কান্দিতে পোষা বুলবুলের চক্ষুদুটি লাল হইয়া গিয়াছে।
  237. আমের বড়া=আমের খাঁটি।
  238. পালা বিলাই=গৃহপালিত বিড়াল।
  239. বিচরায়=খোঁজ করে।
  240. জননা=স্ত্রী; (জেনেনা হইতে)।
  241. থান=স্থান।
  242. আনইলে=আর যদি তাহা না হয়; অন্যথায়।
  243. থাক্‌তা=থাকিতে।
  244. কাছারে=কাছে।
  245. রইছ=রহিয়াছ।
  246. অইছে=হইরাছে।
  247. দাওনা=পাগল, কাঙ্গাল।
  248. রাইতের আন্ধারা=রাত্রির অন্ধকার।
  249. পাথর—পানী=পাথর দ্রব হইয়া জল হইল।
  250. অভাগ্যা=হতভাগ্য।
  251. চির=বিদীর্ণ।
  252. ইরামতি=হীরামতি।
  253. বেগর=নিকট, সম্বন্ধে, মদিনার সঙ্গে অপব্যবহারের দরুন আমি নরকে রহিলাম।
  254. ডেগুরা=কুঁড়ে ঘর।
  255. আখের—উপরে=কব্বরের উপর থাকিয়া দুলাল মরণের দিন গণিতেছিল।
  256. কাইনী=কাহিনী। এই গানের রচয়িতা মনসুর বাইতি; জালাল গায়েন আসরে গান করিত।