শান্তিনিকেতন (প্রথম খণ্ড)/তিন

উইকিসংকলন থেকে

তিন

প্রকৃতির দিকে নিয়ম, আর আমাদের আত্মার দিকে আনন্দ। নিয়মের দ্বারাই নিয়মের সঙ্গে এবং আনন্দের দ্বারাই আনন্দের সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে।

 এইজন্যে যে দিকে আমি সর্বসাধারণের, যে দিকে আমি বিশ্বপ্রকৃতির, যে দিকে আমি মানবপ্রকৃতির, সে দিকে যদি আমি নিজেকে নিয়মের অনুগত না করি তা হলে আমি কেবলই ব্যর্থ হই এবং অশাস্তির সৃষ্টি করি। একটি ধূলিকণার কাছ থেকেও আমি ভুলিয়ে কাজ আদায় করতে পারি নে; তার নিয়ম আমি মানলে তবেই সে আমার নিয়ম মানে।

 এইজন্যে আমাদের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম-শিক্ষা এবং নিজেকে নিয়মের অনুগত করতে শেখা। এই শিক্ষার দ্বারাই আমরা সত্যের পরিচয় লাভ করি।

 এই শিক্ষাটির পরিণাম যিনি তিনিই হচ্ছেন ‘শান্তম্’। যেখানেই নিয়মের ভ্রষ্টতা, যেখানেই নিয়মের সঙ্গে নিয়মের যোগ হয় নি, সেইখানেই অশান্তি। যেখানেই পরিপূর্ণ যোগ হয়েছে সেখানেই শাস্তম্ যিনি তাঁর পরিপূর্ণ উপলব্ধি।

 প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের কোন্ স্বরূপ দেখতে পাই? তাঁর শাস্তস্বরূপ। সেখানে, যারা ক্ষুদ্র করে দেখে তারা প্রয়াসকে দেখে, যারা বৃহৎ করে দেখে তারা শান্তিকেই দেখতে পায়। যদি নিয়ম ছিন্ন হত, যদি নিয়ম শাশ্বত এবং যথাতথ না হত, তা হলে মুহূর্তের মধ্যে এই বিপুল বিশ্বশান্তি ধ্বংস হয়ে একটি অর্থহীন পরিণামহীন প্রলয়ের প্রচণ্ড নৃত্য আরম্ভ হত; তা হলে বিশ্বসংসারে বিরোধই জয়ী হয়ে তার নখদন্ত দিয়ে সমস্ত ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। কিন্তু, চেয়ে দেখো, সূর্যনক্ষত্রলোকের প্রবল উত্তেজনার মধ্যে অটল নিয়মাসনে মহাশাস্তি বিরাজ করছেন। সত্যের স্বরূপই হচ্ছে শান্তম্।

 সত্য শান্তম্ ব’লেই শিবম্। শান্তম্ ব’লেই তিনি সকলকে ধারণ করেন, রক্ষা করেন, সকলেই তাঁতে ধ্রুব আশ্রয় পেয়েছে। আমরাও যেখানে সংযত না হয়েছি, অর্থাৎ যেখানে সত্যকে জানি নি এবং সত্যের সঙ্গে সত্যরক্ষা করে চলি নি, সেখানে আমাদের অন্তরে বাহিরে অশান্তি এবং সেই অশাস্তিই অমঙ্গল—নিয়মের সঙ্গে নিয়মের বিচ্ছেদই অশিব।

 যিনি শিবম্ তাঁর মধ্যেই অদ্বৈতম্ প্রকাশমান। সত্য যেখানে শিবস্বরূপ সেইখানেই তিনি আনন্দময়, প্রেমময়; সেইখানেই তাঁর সকলের সঙ্গে মিলন। মঙ্গলের মধ্যে ছাড়া মিলন নেই; অমঙ্গলই হচ্ছে বিরোধ-বিচ্ছেদের অপদেবতা।

 এক দিকে সত্য, অন্য দিকে আনন্দ, মাঝখানে মঙ্গল। তাই এই মঙ্গলের মধ্যে দিয়েই আমাদের আনন্দলোকে যেতে হয়।

 আমাদের দেশে যে তিন আশ্রম ছিল— ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ, তা ঈশ্বরের এই তিন স্বরূপের উপর প্রতিষ্ঠিত। শাস্তস্বরূপ, শিবস্বরূপ, অদ্বৈতস্বরূপ।

 ব্রহ্মচর্যের দ্বারা জীবনে শান্তস্বরূপকে লাভ করলে তবে গৃহধর্মের মধ্যে শিবস্বরূপকে উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়; নতুবা গার্হস্থ্য অকল্যাণের আকর হয়ে ওঠে। সংসারে সেই মঙ্গলের প্রতিষ্ঠা করতে হলেই স্বার্থবৃত্তিসকল সম্পূর্ণ পরাহত হয় এবং যথার্থ মিলনের ধর্ম যে কিরূপ নির্মল আত্মবিসর্জনের উপরে স্থাপিত তা আমরা বুঝতে পারি। যখন তা সম্পূর্ণ বুঝি তখনই যিনি অদ্বৈতম্ সেই ঐক্যরূপী পরমাত্মার সঙ্গে সর্বপ্রকার বাধাহীন প্রেমের মিলন সম্ভবপর হয়। আরম্ভে সত্যের পরিচয়, মধ্যে মঙ্গলের পরিচয়, পরিণামে আনন্দের পরিচয়। প্রথমে জ্ঞান, পরে কর্ম, পরে প্রেম।

 এইজন্যে যেমন আমাদের ধ্যানের মন্ত্র ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’ তেমনি আমাদের প্রার্থনার মন্ত্র: অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়। অসত্য হতে সত্যে, পাপ হতে পুণ্যে এবং আসক্তি হতে প্রেমে নিয়ে যাও। তবেই হে প্রকাশ, তুমি আমার প্রকাশ হবে; তবেই হে রুদ্র, আমার জীবনে তুমি প্রসন্ন হয়ে উঠবে।;

 সত্যে শেষ নয়, মঙ্গলে শেষ নয়, অদ্বৈতেই শেষ। জগৎপ্রকৃতিতে শেষ নয়, সমাজপ্রকৃতিতেও শেষ নয়, পরমাত্মাতেই শেষ, এই হচ্ছে আমাদের ভারতবর্ষের বাণী— এই বাণীটিকে জীবনে যেন সার্থক করতে পারি, এই আমাদের প্রার্থনা হোক।

 ২১ পৌষ