শেষ সপ্তক/বত্রিশ

উইকিসংকলন থেকে

বত্রিশ

পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ,
খড়কে দিয়ে উসকে দিচ্ছে থেকে থেকে।
হাতির দাঁতের মতাে কোমল সাদা
পঙ্খের-কাজ-করা মেজে;
তার উপরে খান দুয়েক মাদুর পাতা।
ছােটো ছেলেরা জড়াে হয়েছি ঘরের কোণে
মিটমিটে আলােয়।
বুড়াে মােহনসর্দার-
কলপ-লাগানো চুল বাবরি-করা,
মিশ কালাে রঙ,
চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসছে,
শিথিল হয়েছে মাংস,
হাতের পায়ের হাড়গুলাে দীর্ঘ,
কণ্ঠস্বর সরু-মােটায় ভাঙা।
রােমাঞ্চ লাগবার মতাে তার পূর্ব ইতিহাস।
বসেছে আমাদের মাঝখানে,
বলছে রােঘাে ডাকাতের কথা।
আমরা সবাই গল্প আঁকড়ে বসে আছি।
দক্ষিণের-হাওয়া-লাগা ঝাউডালের মতাে
দুলছে মনের ভিতরটা।

খােলা জানলার সামনে দেখা যায় গলি,
একটা হলদে গ্যাসের আলাের খুঁটি
দাঁড়িয়ে আছে একচোখাে ভূতের মতাে।
পথের বাঁ ধারটাতে জমেছে ছায়া।
গলির মােড়ে সদর রাস্তায়
বেলফুলের মালা হেঁকে গেল মালী।
পাশের বাড়ি থেকে
কুকুর ডেকে উঠল অকারণে।
ন’টার ঘণ্টা বাজল দেউড়িতে।

অবাক হয়ে শুনছি রােঘাের চরিতকথা।

তত্ত্বরত্নের ছেলের পইতে,
রােঘাে ব'লে পাঠালে চরের মুখে,
‘নমাে-নমাে করে সারলে চলবে না ঠাকুর,
ভেবো না খরচের কথা।'
মােড়লের কাছে পত্র দেয়
পাঁচ হাজার টাকা দাবি ক'রে ব্রাহ্মণের জন্যে।
রাজার খাজনা-বাকির দায়ে
বিধবার বাড়ি যায় বিকিয়ে,
হঠাৎ দেওয়ানজির ঘরে হানা দিয়ে
দেনা শােধ করে দেয় রঘু।

বলে, 'অনেক গরিবকে দিয়েছ ফাঁকি,
কিছু হালকা হােক তার বােঝ।'

একদিন তখন মাঝরাত্তির,
ফিরছে রােঘাে লুঠের মাল নিয়ে,
নদীতে তার ছিপের নৌকো
অন্ধকারে বটের ছায়ায়।
পথের মধ্যে শােনে-
পাড়ায় বিয়েবাড়িতে কান্নার ধ্বনি,
বর ফিরে চলেছে বচসা ক'রে;
কনের বাপ পা আঁকড়ে ধরেছে বরকর্তার।
এমন সময়ে পথের ধারে
ঘন বাঁশবনের ভিতর থেকে
হাঁক উঠল, রে রে রে রে রে রে!
আকাশের তারাগুলাে
যেন উঠল থরথরিয়ে।
সবাই জানে রােঘাে ডাকাতের
পাঁজর-ফাটানাে ডাক।
বরসুদ্ধ পালকি পড়ল পথের মধ্যে;
বেহারা পালাবে কোথায় পায় না ভেবে।
ছুটে বেরিয়ে এল মেয়ের মা,
অন্ধকারের মধ্যে উঠল তার কান্না-

‘দোহাই বাবা, আমার মেয়ের জাত বাঁচাও।'
রোঘাে দাঁড়াল যমদুতের মতাে-
পালকি থেকে টেনে বের করলে বরকে,
বরকর্তার গালে মারল একটা প্রচণ্ড চড়,
পড়ল সে মাথা ঘুরে।

ঘরের প্রাঙ্গণে আবার শাঁখ উঠল বেজে,
জাগল হুলুধ্বনি;
দলবল নিয়ে রােঘাে দাঁড়াল সভায়,
শিবের বিয়ের রাতে ভূত-প্রেতের দল যেন।
উলঙ্গপ্রায় দেহ সবার, তেল-মাখা সর্বাঙ্গ,
মুখে ভুসাের কালি।
বিয়ে হল সারা।
তিন পহর রাতে
যাবার সময় কনেকে বললে ডাকাত,
‘তুমি আমার মা,
দুঃখ যদি পাও কখনো
স্মরণ কোরো রঘুকে।'


তার পরে এসেছে যুগান্তর।
বিদ্যুতের প্রখর আলােতে

ছেলেরা আজ খবরের কাগজে
পড়ে ডাকাতির খবর।
রূপকথা-শােনা নিভৃত সন্ধেবেলাগুলাে
সংসার থেকে গেল চলে,
আমাদের স্মৃতি
আর নিবে-যাওয়া তেলের প্রদীপের সঙ্গে সঙ্গে।