বিষয়বস্তুতে চলুন

সমুদ্রজয়ী কলম্বাস/আঠারো বছরের চেষ্টার ফলে

উইকিসংকলন থেকে

আঠারো বছরের চেষ্টার ফলে

নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে কলম্বাস তখন এক রকম পর্ত্তুগালেই বসবাস করছিলেন, পর্ত্তুগালকেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি বলে ধরে নিয়েছিলেন। তাই তিনি স্থির করলেন যে, প্রথমে পর্ত্তুগালের রাজার শরণাপন্ন হবেন।

 তখন পর্ত্তুগালের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় জন। বহু চেষ্টাচরিত্র করে তিনি রাজা জনের সাক্ষাৎ পেলেন। তাঁর অন্তরের বাসনার কথা তিনি জনকে জানালেন— সমুদ্রের ওপারে সোণার দেশ আছে, যদি তিনি অভিযানের আয়োজন করে দেন, তাহলে কলম্বাস সাগর-তরঙ্গ পেরিয়ে সেই নতুন দেশ...পর্ত্তুগালের হয়ে অধিকার করেন।

 রাজা জন কলম্বাসের প্রস্তাব শুনলেন···কিন্তু নিজে কিছু মতামত জানালেন না। তিনি বল্লেন, আমার সভাসদ‍্দের সঙ্গে পরামর্শ না করে তোমাকে কোন কথা দিতে পারি না।

 কলম্বাসকে বিদায় দিয়ে রাজা জন তাঁর সভাসদ‍্দের ডেকে সমস্ত কথা বল্লেন। তাঁরা সেই প্রস্তাব শুনে ব্যঙ্গ করে উঠলেন; কেউ-কেউ বল্লেন যে, এত-এত টাকার প্রয়োজন হবে যে, একজন উন্মাদের কথা শুনে রাজকোষ থেকে অতখানি অর্থ ব্যয় করা ঠিক হবে না।

 কলম্বাস যখন আবার রাজা জনের সঙ্গে দেখা করলেন, তখন তিনি কলম্বাসকে জানালেন যে, তিনি এই প্রস্তাবকে কার্য্যকরী করতে অর্থব্যয় করতে প্রস্তুত নন্।

 কিন্তু কলম্বাসকে বিদায় দিয়ে রাজা জন গোপনে একদল নাবিককে কলম্বাসের পথ অনুসারে সমুদ্রে পাঠালেন। কারণ, কলম্বাসের কথায় রাজা জনের মনে দুরাকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল; যদি সত্য-সত্যই লোকটার কথা ঠিক হয়, তাহলে তিনি পর্ত্তুগালের রাজ্যের সীমানা অনায়াসে বাড়াতে পারেন। কলম্বাস কিন্তু এ-সব ব্যাপারের কিছুই জানলেন না।

 রাজা জন যে-সব নাবিককে পাঠালেন, তারা পশ্চিম মুখ ধরে কয়েকদিন যাত্রা করে দেখেন, কোথায় তীর, কোথায় নাটি! যতদূর অগ্রসর হয়, ততই সমূদ্র যেন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে! তারা হতাশ হয়ে ফিরে এসে রাজা জনকে জানালো যে, কোথায় তীর! লোকটা হয় ধাপ্পাবাজ, নয় উন্মাদ!

 কলম্বাস যখন জানতে পারলেন যে পর্ত্তুগালের রাজা তাঁকে গোপন করে তাঁর প্ল্যান অনুযায়ী এক অভিযান পাঠিয়েছিলেন, তখন রাগে ও ঘৃণায় তাঁর মন ভরে গেল। যে দেশের রাজা এমন প্রবঞ্চনার কাজ করতে পারে, সে দেশে তিনি বাস করতে চাইলেন না। চিরকালের মত প্রতিজ্ঞা করে তিনি পর্ত্তুগাল ত্যাগ করলেন। কিন্তু তাঁর মনে যে বিশ্বাস তিনি আজীবনের অনুশীলনে গড়ে তুলেছিলেন, সে বিশ্বাসকে আরো সবলে আঁকড়ে ধরলেন।

 পর্ত্তুগাল ত্যাগ করে ..য়ুরোপের এক রাজার দরজা থেকে আর-এক রাজার দরজায় তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। প্রত্যেকেই উন্মাদ বলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। ঘুরতে-ঘুরতে তিনি তাঁর জন্মভূমি জেনোয়া শহরে এলেন। সেখানেও কারুর কাছে কোন আশার বাণী তিনি পেলেন না।

 হতাশ হয়ে তিনি চিঠি লিখে ইংলণ্ডের রাজার কাছে আবেদন জানালেন। কেউ-কেউ বলেন, তিনি তাঁর ভাই বার্থলোমিউকে ইংলণ্ডের রাজার কাছে পাঠিয়েছিলেন, এবং ভাইকে জাহাজে করে ইংলণ্ডে পাঠাতে, তাঁর যথাসর্ব্বস্ব তাঁকে বেচতে হয়েছিল জলের দরে!

 ইংলণ্ডের সিংহাসনে তখন বসে ছিলেন রাজা সপ্তম হেনরীবার্থলোমিউ কিন্তু ইংলণ্ড পর্য্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না। পথে জলদস্যুর আক্রমণে তাঁদের জাহাজ বিপন্ন হয় এবং তিনি তাঁদের হাতে বন্দী হলেন। বহুদিন অজ়ানা দেশে বন্দাজীবন যাপন করার পর···তিনি কোনমতে প্রাণ নিয়ে শেষে পালিয়ে আসেন।

 ইত্যবসরে রাজা জনের মনে অনুশোচনা এলো। তিনি বুঝলেন যে, কলম্বাসের সঙ্গে তিনি রাজোচিত ব‍্যবহার করেন নি। তিনি কলম্বাসকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে লোক পাঠালেন, কিন্তু কলম্বাস আর ফিরলেন না। রাজা হয়ে যে লোক তাঁকে একবার এ-রকম প্রবঞ্চনা করেছে, তাঁর আশ্রয় নেওয়া তিনি যুক্তি-সঙ্গত বলে মনে করলেন না।

 কলম্বাস দরিদ্র ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর অন্তরে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ছিল নিজের বিশ্বাসের ওপর অটল শ্রদ্ধা; তাই সেদিন সমগ্র য়ুরোপের উপহাসের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর নিজের মনের ধারণাকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু এইভাবে য়ুরোপের এক রাজার দরজা থেকে আরএক রাজার দরজায় ধন্না দিতে-দিতে...তাঁর স্ত্রীর যা কিছু অর্থ ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে গেল। এই সময় দুর্ভাগ্যবশত তাঁর স্ত্রীও মারা গেলেন,—দিয়িগো নামে একটী ছোট্ট ছেলে রেখে।

 সেই ছোট্ট ছেলেটীর হাত ধরে তিনি য়ুরোপের রাজধানীর পথে-পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন...এত প্রত্যাখ্যানেও তাঁর মনের বিশ্বাস এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হলো না...অল্প বয়সে ভাবনায় তাঁর মাথার সমস্ত চুল একেবারে শাদা হয়ে গেল।

 সেই সময় তাঁর দৃষ্টি পড়লো স্পেনের ওপর। তবে প্রথমেই তিনি স্পেনের রাজদরবার পর্য্যন্ত এগুতে সাহস করলেন না। স্পেনের দুজন ডিউক——মেদিনা-সিদোনিয়ার ডিউক ও মেদিনা-সেলীর ডিউক সে সময় ঐশ্বর্য্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন···কলম্বাস তাঁদের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেখানেও কোন ফললাভ হলো না। তবে এইটুকু সুবিধা হলো যে মেদিনা-সেলীর ডিউক কলম্বাসকে রাণী ইসাবেলার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিলেন।

 স্পেনের তখন বড় গৌরবের দিন। স্পেনের সিংহাসনে তখন বসে ছিলেন রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড এবং তাঁর সুযোগ্যা স্ত্রী রাণী ইসাবেলা। দয়াবতী এবং বুদ্ধিমতী বলে রাণী ইসাবেলার খ্যাতি তখন য়ুরোপের সর্ব্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ডিউকের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে কলম্বাস স্থির করলেন, তিনি একবার রাণী ইসাবেলার শরণাপন্ন হবেন।

 ছেলের হাত ধরে তিনি স্পেনে এলেন। রাণী ইসাবেলা তাঁর সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনলেন। কলম্বাস যেভাবে তাঁর আজীবন সঞ্চিত কল্পনার কথা রাণী ইসাবেলার সামনে বল্লেন, তাতে মনে হলো যে তিনি যেন চোখের সামনে সেই অজানা নতুন দেশের তীর দেখতে পাচ্ছেন! তাঁর কথা শুনে রাণী ইসাবেলা কতকটা বিশ্বাস করলেন এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে সম্মত হলেন।

 কিন্তু কলম্বাসের মনে এই প্রস্তাবের পেছনে এক বিরাট দুরাকাঙ্ক্ষা এতদিনে গড়ে উঠেছিল। কিসের জন্য তিনি এই অসাধ্যসাধন-ব্রতে জীবন উৎসর্গ করতে চলেছেন? তাই তিনি তাঁর পুরস্কার-স্বরূপ জানালেন যে, যদি আমি কৃতকার্য হই, তাহলে স্পেনের নামে যে-সব দেশ আমি অধিকার করবো, আমাকে সেই সব দেশের রাজপ্রতিনিধি করতে হবে...এবং পশ্চিম আটলাণ্টিকে আমি যতদূর যাব, ততদূর পর্য্যন্ত আপনার নৌ-বাহিনীর Admiral আমাকে করতে হবে...যে-সব অর্থ এবং ঐশ্বর্য্য আমি আহরণ করে আনবো, তার দশভাগের একভাগ আমার প্রাপ্য হবে... কারণ আমার পুত্রকে আমি এমন ঐশ্বর্য্য দিয়ে যেতে চাই, যাতে আমার নাম ও বংশের নাম সগৌরবে আমার মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে।

 কলম্বাসের পুরস্কারের কথা শুনে রাণী ইসাবেলা কোন উত্তর দিতে ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। তাঁর মনে হলো যে, কলম্বাস পুরস্কার-স্বরূপ খুব বেশী দাবী করছেন। তাঁর মন্ত্রীরাও সেই কথা জানালো। ইতিমধ্যে স্পেন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। কলম্বাসের আশা-তরু আবার অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। যুদ্ধের ব্যাপারে লিপ্ত হয়ে রাণী ইসাবেলা কলম্বাসের প্রস্তাবের কথা এক রকম ভুলেই গেলেন।

 উত্তরের আশায় অপেক্ষা করে থেকে-থেকে কলম্বাস যখন বুঝলেন যে কোন উত্তর আসবে না, তখন তিনি মাতৃহান সেই বালকের হাত ধরে...স্পেন ত্যাগ করে...ফ্রান্সে যাবার মনস্থ করলেন। ক্রান্সের রাজার দরবারে যাবার জন্যে তিনি স্পেনের প্যালোস্ বন্দরে এলেন। সেখান থেকে ফ্রান্সের জাহাজ ছাড়ে।

 প্যালোস্ শহরে যখন তিনি এসে পৌঁছলেন, তখন তিনি ক্ষুৎ-পিপাসায় একেবারে ভেঙে পড়েছেন, বিশেষ করে তাঁর পুত্র দিরিগো আর চলতে পারে না। শহর খুঁজে তিনি এক মঠের দ্বারে উপস্থিত হলেন। দরজায় করাঘাত করতেই ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এসে...দরজা খুলে তাঁদের ভেতরে ডেকে নিলেন। সন্ন্যাসী পথশ্রান্ত পথিকদের রুটী এবং জল খেতে দিলেন।

 আহারান্তে কলম্বাস সেই সহৃদয় সন্ন্যাসীকে তাঁর জীবনের করুণ কাহিনী সমস্ত বল্লেন। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সন্ন্যাসী সেই অতিথির অপূর্ব কথা সব শুনলেন। শুনতে-শুনতে তাঁর উৎসাহ জেগে উঠলো, তিনি বুঝলেন যে-লোক নিজের অন্তরের আদর্শের জন্যে এতখানি ক্লেশ সহ্য করতে পারে এবং যার এতখানি ধৈর্য্য, সে-লোক কখনই ভণ্ড বা উন্মাদ হতে পারে না। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝলেন যে, এই লোকই জগতে অসাধ্যসাধন করতে পারে। কলম্বাসের সৌভাগ্য যে, এই মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে রাণী ইসাবেলার বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তিনি এই সন্ন্যাসীকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। কলম্বাসের সমস্ত কথা শুনে তিনি তাঁকে বল্লেন, তুমি স্পেন ত্যাগ করে যেয়ে। না। তোমার হয়ে রাণীর কাছে আমি আবেদন নিয়ে যাব, দেখি কি হয়!

 এই বলে কলম্বাসকে আশ্বাস দিয়ে সেই মঠেই তিনি কলম্বাস আর তাঁর ছেলেকে কিছুদিনের জন্যে আশ্রয় দিলেন এবং নিজে রাণী ইসাবেলার কাছে কলম্বাসের আবেদন নিয়ে উপস্থিত হলেন।

 সন্ন্যাসীর কথায় রাণী ইসাবেলার মন ফিরে গেল। বিশেষ করে যখন তিনি শুনলেন যে কলম্বাস স্পেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসীরাজের দরবারে যাচ্ছেন, তখন তিনি সন্ন্যাসীকে বল্লেন, তাকে ফ্রান্সে যেতে আপনি বারণ করুন, আমার অলঙ্কার বেচেও যদি কলম্বাসকে পাঠাতে হয়, তাতেও আমি রাজী আছি।

 সন্ন্যাসীর কাছে কলম্বাসের দুর্দশার কথা শুনে... দয়াপরবশ হয়ে···তিনি কলম্বাসের জন্যে দরবারের উপযুক্ত পোষাক দিয়ে পাঠালেন এবং তাঁকে আনবার জন্যে নিজেদের অশ্বশালা থেকে অশ্ব পাঠালেন।

 সন্ন্যাসীর কাছে সেই সকল বার্ত্তা শুনে কলম্বাসের অন্তরাত্মা আনন্দে নৃত্য করে উঠলো···তাহলে এতদিন পরে তাঁর ধৈর্য্যের লতায় ফুল ফুটলে!! রাণীর দেওয়া পোষাক পরে আনন্দ-উজ্জ্বল মুখে কলম্বাস আবার রাজা ফার্ডিন্যাণ্ড এবং রাণী ইসাবেলার সম্মুখে উপস্থিত হলেন।

 স্পেনের রাজা ও রাণী তাঁর সমস্ত প্রস্তাবেই সম্মত হলেন এবং তাঁরা অঙ্গীকার করলেন যে, কলম্বাস যদি তাঁর কথামত সফল হতে পারেন, তাহলে তাঁকে তাঁরা তাঁর বাসনা অনুযায়ী সেই সব নূতন দেশের স্পেনের রাজপ্রতিনিধি করে দেবেন এবং তিনি পশ্চিম আটলাণ্টিকে স্পেনের নৌ-বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ হবেন এবং যে সমস্ত ঐশ্বর্য্য তিনি সংগ্রহ করে আনতে পারবেন, তার অংশও তাঁকে দেওয়া হবে। তা ছাড়া রাণী ইসাবেলা অনুগ্রহ করে তাঁর ছেলের ভারও নিজের হাতে তুলে নিলেন...বল্লেন, তাঁর অনুপস্থিতির সময় তাঁর ছেলে রাজপ্রাসাদে রাজকুমারের অনুচররূপে সসম্মানে থাকতে পারবে।

 আনন্দে কলম্বাসের চিত্ত আপনা থেকে সকল বিধানের বিধায়কের নিকট কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হয়ে গেল। তিনি কালবিলম্ব না করে রাণীর সাহায্যে অভিযানের আয়োজন করতে লাগলেন।

 প্যালোসের বন্দর থেকে তিনখানি জাহাজ কেনা হলো। এখন প্রয়োজন—শুধু লোকের। বন্দরে-বন্দরে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু ঘোষণার ফলে দেখা গেল, কেহই সাড়া দেয় না। এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা শুনে অভিজ্ঞ নাবিকেরাও ভয়ে পিছিয়ে গেল। এই উন্মাদের সঙ্গে কে পাবে সেই মৃত্যু-সঙ্কুল অজানা তরঙ্গের রাজ্যের মধ্যে ডুব দিতে? বহু চেষ্টার পর, রাজ-আজ্ঞার চাপে অবশেষে লোকজন জোগাড় হলো। তিনখানি জাহাজের নামকরণ হলো যথাক্রমে ‘সাণ্টা মেরিয়া’, ‘পিন্‌টা’ এবং ‘নিনা’

 যে তিনখানি জাহাজে করে সেদিন কলম্বাস বিশাল আটলাণ্টিক মহাসাগর পার হবার জন্যে যাত্রা করেন, তার মধ্যে যেখানি সবচেয়ে বড়, তার দৈর্ঘ্য হলো মাত্র তেসটি ফিট...আজকে এই আয়তনের জাহাজে কেউ সাগরের ভেতরে বেড়াতে যেতেও সাহস করবেন না।

 জোর করে যে সব লোক জোগাড় করা হলো, টাকার লোভে এবং রাজ-আদেশের চাপে তারা প্রথমে সম্মত হয়েছিল; কিন্তু যাবার দিন যতই কাছে আসতে লাগলো, ততই তাদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মত বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়লো। কেউ বায়না ধরলো অসুখের, কারুর বাপ-মা বা স্ত্রী আহার-নিদ্রা ছেড়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিল, কেউ-কেউ বা পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো...

 কলম্বাস মহাবিপদে পড়লেন এই অনিচ্ছুক এবং ভীত লোকদের নিয়ে তিনি কি করে এই দুরূহ ব্রত উদ্‌যাপন করবেন? কিন্তু তিনি বিচলিত হলেন না। তিনি বুঝলেন যে, এই সব কাতরতায় কর্ণপাত করলে, তাঁর আর অভিযানে যাত্রা করা সম্ভব হবে না...তখন তিনি নির্ম্মম হয়ে উঠলেন এবং কৌশলে সব লোককে জাহাজে আটক করলেন··. তার মধ্যে থেকেও কতক লোক পালিয়ে গেল...

 সেই সময় কারাগার থেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েকজন বে-পরোয়া লোক তিলে তিলে কারাগারে মরার চেয়ে কলম্বাসের সঙ্গে যেতে সম্মত হলে।···কলম্বাস তাদের আদর করে সঙ্গে নিলেন...

 এইভাবে মোট একশো কুড়িজন লোক নিয়ে তিনি ১৪৯২ খৃষ্টাব্দের ৩রা আগণ্ট প্যালোস্ বন্দর থেকে যাত্রা করলেন। তীরে তখন তাঁর সহযাত্রীদের আত্মীয়-স্বজন তারস্বরে ক্রন্দন করছিল এবং প্রত্যেকেই তাঁর নাম ধরে তাঁকে অভিশাপ দিচ্ছিল।

 আঠারো বছরের চেষ্টার ফলে, সকলের অশ্রুজল আর অভিশাপের মধ্যে দিয়ে···জেনোয়ার সেই অখ্যাত তাঁর্তির ছেলে···মানব-ইতিহাসের অমর-ধামের দিকে এইভাবে সেদিন যাত্রা শুরু করলেন...