সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/জমীদারদিগের আতঙ্ক

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

জমীদারদিগের আতঙ্ক।

 বর্গীর হাঙ্গামার গতিরোধ করিতে গিয়া আলিবর্দ্দীর রাজকোষ শূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্ব্বাহের জন্যও সময়ে সময়ে ঋণগ্রহণ করিতে হইত। আজ এখানে, কাল সেখানে, কখন হস্তিপৃষ্ঠে, কখন অশ্বারোহণে, কখন উড়িষ্যাপ্রান্তে, কখন বা বিহারের বন্ধুর ভূমিতে, অসিহস্তে শত্রুসেনার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া, আলিবর্দ্দী জরাপলিত-কলেবরে ব্যাধিজড়িত হইয়া পড়িলেন। কিন্তু এত করিয়াও মহারাষ্ট্র-লুণ্ঠন নিবারণ করিতে পারিলেন না! নিয়ত শিবিরে শিবিরে পরিভ্রমণ করিলে রাজকার্য্যে মনোনিবেশ করিবার সময় হয় না; আবার রাজধানীতে বসিয়া নিপুণভাবে রাজকার্য্যে মনোনিবেশ করিবার চেষ্টা করিলে বর্গীর হাঙ্গামায় গ্রাম নগর উৎসন্ন হইয়া যায়; অগত্যা আলিবর্দ্দী প্রজারক্ষার জন্য দেশে দেশে শত্রুসেনার পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটাছুটি করিয়া পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িলেন। কিন্তু যাহাদিগের ধন মান রক্ষার জন্য জীবনপাত করিলেন, এক বৎসরের জন্যেও তাহাদের দুঃখের হাহাকার নিবারণ করিতে পারিলেন না? এ দিকে মহারাষ্ট্র সেনাপতিও আলিবর্দ্দীর ন্যায় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সহিত নিয়ত যুদ্ধকলহে লিপ্ত হইয়া একদিনের জন্যও বিশ্রাম-সুখ লাভ করিবার অবসর পান নাই। সুতরাং ১৭৫১ খৃষ্টাব্দে সন্ধির প্রস্তাব উপস্থিত হইলে, উভয় পক্ষই সানন্দে সাগ্রহে সন্ধিসংস্থাপন করিতে স্বীকৃত হইলেন।

 বহু বৎসরের পর যুদ্ধকোলাহল শান্ত হইল। মহারাষ্ট্রীয়দিগের সহিত সন্ধি সংস্থাপিত হইয়া, সুবর্ণরেখা নদী উড়িষ্যা ও বাঙ্গলাদেশের সীমান্ত রেখা বলিয়া নির্দিষ্ট হইল। মহারাষ্ট্রসেনা আর সুবর্ণরেখা পার হইবার চেষ্টা না করিলে, নবাব তাহাদিগকে বৎসর বৎসর ১২ লক্ষ টাকা “চৌথ” প্রদান করিবেন, এইরূপ সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হইয়া গেল।[১]

 সন্ধি হইল বটে, কিন্তু চৌথ প্রদানের উপায় হইল না। অগত্যা আলিবর্দ্দী জমিদারদিগের সহিত মন্ত্রণা করিয়া, “চৌথ মারহাট্টা”[২] নামে এক নূতন বাজে জমা বার করিলেন; এবং নবাব-সরকারের ব্যয়-সংক্ষেপ করিবার জন্য, অধিকাংশ সৈন্যদলকে পদচ্যুত করিলেন। দেশে শান্তি সংস্থাপিত হইল।

 আলিবর্দ্দীর পূর্ব্ববর্তী নবাবদিগের আমলে বাঙ্গালী জমীদারদিগের বিশেষ আধিপত্য ছিল না। যথাসময়ে রাজকর পরিশোধ করিতে না পারিলে, সকলকেই সবিশেষ লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত। কেহ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইতেন, কাহারও জমীদায়ী অন্যের হস্তে সমর্পিত হইত, কাহারও বা “বৈকুণ্ঠবাসের” ব্যবস্থা হইত।[৩]

 জমীদারদিগের সহায়তায় এবং জগৎশেঠের অনুকম্পায় আলিবর্দ্দী সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুতরাং তাঁহার শাসনসময়ে জমীদারদলই প্রকৃতপ্রস্তাবে সিংহাসনের মালিক হইয়া উঠিয়াছিলেন। আলিবর্দ্দী তাঁহদের সহিত বাহুতে বাহুতে মিলিত হইয়া শত্রুদলন করিতেন, এবং জমীদারিদলের মতামত না লইয়া কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতেন না। সিরাজদ্দৌলার নিকট ইহা প্রীতিকর বলিয়া বোধ হইত না। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করিলে দুষ্টদল দমন করিবার জন্য যে স্বভাবতঃই আয়োজন করিবেন, তাহা সকলেই একরূপ আকারে ইঙ্গিতে বুঝিতে পারিলেন। সুতরাং আলিবর্দ্দীর রুগ্নদশায় সিরাজদ্দৌলাকে সাক্ষাৎসম্বন্ধে রাজকার্য্যে লিপ্ত হইতে দেখিয়া, জমীদারদল আতঙ্কিত হইলেন।

 এই সকল জমাদারদিগের মধ্যে সখ্যসংস্থাপন হইতে লাগিল। সকলেই ভবিষ্যতের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। সেকালে রাজসাহীর জমীদারীই এদেশে, এমনকি সমুদয় ভারতবর্ষে, সর্ব্বাপেক্ষা সুবৃহৎ জমীদারী বলিয়া পরিচিত ছিল। তাহার চতুঃসীমা ভ্রমণ করিয়া আসিতে ৩৫ দিন সময় লাগিত।[৪] এই বিস্তীর্ণ জনপদের শাসনভার গ্রহণ করিয়া, প্রাতঃস্মরণীয়া রাণী ভবানী, পুণ্যকীর্ত্তিতে ভারতবর্ষে আপন নাম চিরস্মরণীয় করিতেছিলেন। তাঁহার রাজ্যসীমার নিকটেই স্বনামখ্যাত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী। তাঁহার রাজ্য সমুদ্রকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।[৫] বিদ্যাবুদ্ধি ও যশোগৌরবে কৃষ্ণচন্দ্র ও বাঙ্গালীর নিকট চির স্মরণীয় হইয়া উঠিতেছিলেন। এই সকল প্রবল প্রতাপশালী হিন্দু জমীদারগণ বিদ্যাবুদ্ধি, শাসনকৌশল ও বাহুবলে যেরূপ পরাক্রান্ত হইয়া উঠিতেছিলেন, তাহাতে সহসা তাঁহাদিগকে উপেক্ষা করিবার চেষ্টা না করিলে, হয় ত সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হইত।

 সেকালে এই সকল জমীদারদিগের স্বার্থরক্ষার জন্য কোন সভা সমিতি ছিল না। তাঁহারা রাজকার্য্য উপলক্ষে রাজধানী মুর্শিদাবাদে শুভাগমন করিলে, অবসরসময়ে, শেঠভবনে সম্মিলিত হইতেন। সেখানে বসিয়াই দেশের সুখ দুঃখের কথার আলোচনা হইত। কাল ক্রমে শেঠভবন বাঙ্গালী জমীদারদিগের মন্ত্রভবন হইয়া উঠিয়াছিল। সে শেঠভবন এখন ভাগীরথীগর্ভে বিলীন হইয়াছে;[৬] যাহা কিছু ধ্বংসাবশেষ বর্ত্তমান আছে, তাহাও বন জঙ্গলে, লতাগুল্মে ঢাকিয়া পড়িয়াছে। চারি দিক হইতে কি যেন এক বিষাদের উষ্ণশ্বাস বহিতেছে যে, সেখানে পদার্পণ করিলে আর অশ্রুসংবরণ করা যায় না। সে ঐশ্বর্য্য কোন্ মন্ত্রবলে বেলাশায়িত ধূলিপটলের ন্যায় উড়িয়া গিয়াছে! মহিমাপুরের সে উজ্জ্বল মহিমা কোন্ অভিসম্পাতে যেন মসীমলিন বিকটমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে! সে রত্নদীপালোকিত রাজভবনে আর সায়াহ্নে প্রদীপশিখাও ভাল করিয়া আলোক বিস্তার করে না! চারি দিকে ভগ্নস্তুপ, তাহারই মধ্যে কয়েকটি জীর্ণকক্ষে ইতিহাস বিখ্যাত জগৎশেঠের বর্ত্তমান বংশধর ইংরাজদত্ত মাসিক বৃত্তির উপর নির্ভর করিয়া কোনরূপে জীবনধারণ করিতেন; এখন তাহাও রহিত হইয়া গিয়াছে![৭]

 জগৎশেঠ এবং প্রধান প্রধান জমীদারগণের যেরূপ ক্ষমতাবৃদ্ধি হইয়াছিল, তাহাতে সিরাজদ্দৌলা মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন;—তাহাতে জমীদারদলও তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। এই অসন্তোষ কালে বিলীন হইতে পারিত। জমীদারদলকে সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিলে কালে তাহাদিগের সাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করাও অসম্ভব হইত না।[৮] কিন্তু স্বভাব-দোষে সিরাজদ্দৌলা সেই সুযোগ হারাইলেন! দুইটি কারণে আলিবর্দ্দীর জীবনকালেই জমীদারদল সিরাজের শত্রুপক্ষের সহিত মিলিত হইলেন।

 রাণী ভবানী বিধবা হিন্দুরমণী,—গঙ্গাবাস উপলক্ষে মুর্শিদাবাদের নিকটবর্ত্তী বড়নগরের রাজবাটীতে অবস্থান করিতেন। বড়নগরের রাজবাটীর এখন জীর্ণাবস্থা। কিন্তু রাণী ভবানীর সযত্ন-নির্ম্মিত দেবমন্দিরগুলি এখনও পরিব্রাজকদিগের নিকট সমধিক গৌরবের বস্তু বলিয়া পরিচিত।[৯] রাণী ভবানীর পুণ্যনাম বাঙ্গালী হিন্দুমাত্রের নিকটই প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছে। শিক্ষাবিস্তারের জন্য, স্বদেশপ্রেমের জন্য, শাসনকৌশলের জন্য, পুণ্যকীর্তির জন্য, দরিদ্রপালনের জন্য, রাণী ভবানী স্বদেশীয়দিগের নিকট পুজনীয়া দেবী বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন।[১০] তারা নাম্নী তঁহার একমাত্র বিধবা কন্যাও তাঁহার সহিত বড়নগরের রাজবাটীতে থাকিয়া গঙ্গাবাস করিতেন। তারা বালবিধবা। অপরূপ রূপলাবণ্যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী বলিয়া সর্ব্বজন-প্রশংসিত। তিনি মাতার সাধু দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া, পরসেবাব্রতে জীবন উৎসর্গ করিয়া বাঙ্গালীর নিকট শুক্লাম্বরধারিণী ব্রহ্মচারিণী বলিয়া পুজনীয়া হইয়াছিলেন। বৈধব্যের কঠোর ব্রহ্মচর্য্যায় এই অনুপম রূপরাশি মলিন না হইয়া আরও যেন উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল। সিরাজদ্দৌলার নিকট তারার অনুপম রূপলাবণ্যের কথা অধিক দিন লুক্কায়িত রহিল না। একদিন প্রাসাদশিখরে পাদচারণ করিতে করিতে আজানুলম্বিত কেশপাশ উন্মুক্ত করিয়া রাজকুমারী তারা স্বচ্ছন্দভাবে বায়ুসেবন করিতেছিলেন। সেই ক্রোড়বাহিনী ভাগীরথী-জলে সিরাজদ্দৌলার বিলাসতরণী মন্থরগতিতে ভাসিয়া যাইতেছিল। কুক্ষণে সেই অতুলনীয় রূপের ফলিতজ্যোতি চকিতের ন্যায় সিরাজের পাপচক্ষে পতিত হইল! সিরাজ নবীন যুবক, চিত্ত দুর্দ্দমনীয়বেগে নিয়ত অসংযত, পারিষদবর্গের অপরাজিত উত্তেজনায় সর্ব্বদা মদ-দর্পিত; সুতরাং সিরাজ সেই রূপরাশি হস্তগত করিবার জন্য উন্মত্ত হৃদয়ে উপায় উদ্ভাবনে নিযুক্ত হইলেন। মুসলমান ইতিহাস-লেখক এই কুকীর্ত্তির কোন উল্লেখ করেন নাই, কিন্তু হিন্দু দিগের মধ্যে বংশানুক্রমে এই জনাপবাদ প্রচলিত হইয়া আসিতেছে।[১১] যদি রাজ্যবিনিময়েও সিরাজের মতিভ্রম দূর করা সম্ভব হইত, রাণী ভবানী হয় ত তাহাতেও ইতস্ততঃ করিতেন না। কিন্তু সিরাজের নামে সকলেই শিহরিয়া উঠিলেন অবশেষে বিচক্ষণ পরামর্শদাতৃগণ একদিন মহাসমারোহে গঙ্গাতীরে এক চিতাকুণ্ড প্রজ্বলিত করিলেন, ধূমপুঞ্জে ভাগীরথীতীর আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে চারি দিকে রাষ্ট্র হইল যে, রাজকুমারী তারা সহসা পরলোক গমন করিয়াছেন। ইহাতে তারা ঠাকুরাণীর ধর্ম্মরক্ষা হইল বটে, কিন্তু সিরাজের পাপলিপ্সা ভস্ম হইল কি না, কে বলিতে পারে? প্রকৃত ঘটনা কতদিন গোপনে থাকিবে?” সিরাজদ্দৌলা যখন শুনিবেন যে, তারা ঠাকুরাণী এখনও জীবিত রহিয়াছেন, তখন সে রাজরোষ কে নিবারণ করিবে? সুতরাং সময় থাকিতে জমীদারদল গোপনে গোপনে সিরাজদ্দৌলার সর্বনাশসাধনের চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বুঝিলেন যে, আর না,— ইহার পরেও যদি তাঁহারা সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনে আরোহণ করিবার অবসর দেন, তবে আর জাতিধর্ম্ম রক্ষা করিবার উপায় থাকিবে না! সিরাজ যে সত্য সত্যই কাহারও নিষ্কলঙ্ককুলে কালিমা ঢালিয়া দিয়াছিলেন, তাহা নহে; তিনি যে সিংহাসনে আরোহণ করিলেও শত্রুসঙ্কুল বাঙ্গলাদেশে এই সকল ঘৃণিত ব্যাপারে লিপ্ত হইবার অবসর পাইবেন, তাহাও নহে; পাছে সিরাজদ্দৌলা নবাব হইলে লোকের জাতিধর্ম্মে হস্তক্ষেপ করেন, এই আশঙ্কাতেই লোকে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। “ভবানীর ন্যায় অতুল ঐশ্বর্য্যশালিনী প্রতিভাময়ী বীররমণীও যাহার ভয়ে নগর ছাড়িয়া পলায়ন করিলেন, দুর্ব্বল জমীদারল যে তাঁহার ভয়ে জীবন্মৃত হইবেন, তাহাতে আর আশ্চর্যের কথা কি? সরফরাজ খাঁ যখন জগৎশেঠের পুত্রবধুর অপমান করিয়াছিলেন, তখন বাঙ্গালী জমীদারগণ জগৎশেঠের অপমানে অপমান বোধ করিয়া একপ্রাণ একমন হইয়া সরফরাজের সর্ব্বনাশসাধনের সহায়তা করিয়াছিলেন। এবারেও সকলে মিলিয়া সেই উদ্দেশ্যে জগৎশেঠের সহিত মন্ত্রণা করিতে আরম্ভ করিলেন। জগৎশেঠ জমীদারদিগের আশ্রয়বৃক্ষ, আবার জমীদারগণ অনেকেই জগৎশেঠের ধনগৌরব বর্জ্জন করিবার মূল কারণ; সুতরাং স্বার্থ রক্ষার জন্যই হউক, আর স্বদেশের কল্যাণ সাধনের জন্যই হউক, জগৎশেঠকে জমীদার দলের সহায়তা করিতে হইল, সিংহাসনে পদার্পণ করিবার পূর্ব্বেই সিরাজদ্দৌলার সমাধিগহ্বর খনন করিবার আয়োজন হইল।

 জগৎশেঠের ঐশ্বর্য্যের কথা কাহারও নিকট অপরিচিত ছিল না। তাহা সত্য সত্যই “প্রবাদের মত” সমস্ত ভারতবর্ষে রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়া ছিল। সেই ঐশ্বর্য্যই জগৎশেঠের পদগৌরবের মূল। সিংহাসনে আরোহণ করিবার পূর্ব্বে, সম্রাট ফর্‌রোক্‌শায়ায় কিছুদিন বাঙ্গালাদেশের রাজপ্রতিনিধি হইয়াছিলেন। তখন তাঁহার একরূপ দৈন্যদশা। সেই সময়েই সিংহাসনলাভের জন্য আয়োজন করা আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল। সুতরাং তিনিও একদিন জগৎশেঠের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন। জগৎশেঠ শাহজাদার প্রার্থনা পূরণ করায়, সেই অর্থবলে বলীয়ান হইয়া, শাহজাদা ফর্‌রোক্‌শায়ার ভারতবর্ষের সিংহাসনে আরোহণ করেন, এবং শেঠবংশের উপকার স্মরণ করিয়া ‘জগৎশেঠ’ উপাধিযুক্ত এক রত্নমোহর ও ফরমাণ প্রদান করেন। তদনুসারে জগৎশেঠ বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বাহাদুরের বামপার্শে আসন প্রাপ্ত হন, এবং নবাবগণ তাঁহার কথা উপেক্ষা করিয়া কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ না করেন, তন্মর্ম্মে রাজাদেশ প্রচারিত হয়। নবাব মুর্শিদ-কুলীখাঁ প্রথমতঃ নবাবদেওয়ান ছিলেন। সম্রাট কিছুতেই তাঁহাকে নবাব-নাজিম পদ প্রদান করিতে সম্মত হন নাই। অবশেষে জগৎশেঠের অনুরোধে কুলীখাঁ নবাবীপদে আরূঢ় হইয়াছিলেন;—মুর্শিদ কুলী খাঁর নবাবী সনদেও এ কথার উল্লেখ আছে।[১২] এই সকল কারণে জগৎশেঠ পদগৌরবে প্রায় নবাবদিগের সমকক্ষ হইয়া উঠিয়া ছিলেন। রাজস্বসংগ্রহের ভার জগৎশেঠের উপরেই সমর্পিত হইয়াছিল। প্রতিবর্ষে “পুণ্যাহ” উপলক্ষে জমীদারগণকে তাঁহার প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে হইত। রাজস্ব পরিশোধ করিতে অশক্ত হইলে, তাঁহার নিকটেই ঋণগ্রহণ করিতে হইত। মূদ্রাযন্ত্র তাঁহারই প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সকল উপায়ে জগৎশেঠের প্রভূত অর্থাগম হইত, এবং পাছে কোন অত্যাচারী নবাব বলপুর্ব্বক সেই ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করেন, সেইজন্য জগৎশেঠের বেতনভোগী দুই সহস্র অশ্বারোহী তাঁহার পুরী রক্ষা করিত।[১৩]

 দেশ অরাজক হইলে, নবার অত্যাচারী হইলে, কিম্বা জমীদারদল বিদ্রোহোম্মুখ হইলে, সর্ব্বাগ্রে জগৎশেঠেরই সর্বনাশ! হয় তাঁহার সঞ্চিত ধন লুষ্ঠিত হইবে, না হয় তাঁর অর্থাগমের দ্বার রুদ্ধ হইবে। যে দিক দিয়াই হউক, তাঁহারই আশঙ্কা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। সুতরাং জমীদারদল অসন্তুষ্ট ও বিদ্রোহোম্মুখ হইতেছেন দেখিয়া, স্বার্থরক্ষারজন্যও জগৎশেঠকে তাঁহাদের দলে মিলিত হইতে হইল। তখন সকলে মিলিয়া সিরাজদ্দৌলার সিংহাসনলাতে বাধা দিবার জন্য নিপুণভাবে মন্ত্রণা করিতে আরম্ভ করিলেন।

 সিরাজদ্দৌলা মোহান্ধ যুবক। মুসলমান গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া, মুসলমানসহবাসে বিলাসগৌরবে লালিতপালিত হইয়া এবং নিয়ত কুকীর্ত্তিপরায়ণ পারিষদবর্গে বেষ্টিত থাকিয়া, তিনি হিন্দুহৃদয়ের গূঢ়মর্ম্ম অধ্যয়ন করিবার অবসর পান নাই। হিন্দুদিগের মধ্যে যে বিধবাবিবাহ নাই;—মুসলমানের ছায়াস্পর্শেও যে তাহাদিগের জন্য গঙ্গাস্নানের ব্যবস্থা প্রচলিত রহিয়াছে;—বিধবার ব্রহ্মচর্য্য অক্ষরে অক্ষরে প্রতি পালিত হউক আর না হউক, বিধবাকে ধর্ম্মপথে রক্ষা করিবার জন্য শাস্ত্র, লোকাচার ও কর্ত্তব্যবুদ্ধি যে সকলকেই সমানভাবে অনুপ্রাণিত করিয়া রাখিয়াছে;—বিধবার অবগুণ্ঠন ভেদ করিয়া পাপদৃষ্টিতে তাহার অঙ্গে দৃষ্টিপাত করিলে নিতান্ত অসংষতচিত্ত পাপকর্ম্মনিরত নরাধম হিন্দুও যে মর্ম্মপীড়িত হইয়া লগুড় উত্তোলন করিবে বোধ হয় সিরাজদ্দৌলা ততটা বিশ্বাস করিতে শিক্ষা করেন নাই। স্বার্থসাধনের জন্য, অনেক হিন্দুসন্তান, কেহ কন্যা, কেহ বা ভগিনী দান করিয়া, মোগলের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সিরাজদ্দৌলার বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যখন সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী, তখন ভয়ে হউক আর ভক্তিতে হউক যাহা চাহিবেন, লোকে তাহাই আনিয়া চরণতলে উৎসর্গ করিয়া দিবে। কেবল এইরূপ অন্ধ বিশ্বাসেই তিনি সাহস করিয়া অতুল ঐশ্বর্য্যশালিনী রাণী ভবানীর নিকট অর্থবিনিময়ে তারার রূপরাশি ক্রয় করিবার প্রস্তাব করিতে সাহসী হইয়াছিলেন।[১৪] ইহাতে সিরাজদ্দৌলার দুর্দ্দমনীয় হৃদয়বেগের পরিচয় রহিয়া গিয়াছে। এই দুর্দ্দমনীয় হৃদয়বেগ না থাকিলে, তাঁহার এরূপ মতিভ্রম হইত কি না, কে বলিতে পারে?

 কালক্রমে সিরাজের এই দুষ্টাভিসন্ধির কথা লোকে ভুলিয়া যাইত। যে পাপকল্পনা কল্পনামাত্রেই পর্য্যবসিত হইয়াছিল, তাহা ইতিহাস হইতে বহুদূরে পড়িয়া থাকিত। কিন্তু যাহারা স্বার্থসাধনের জন্য ধীরে ধীরে সিরাজদ্দৌলার অধঃপতনসাধনচেষ্টায় তাহার বিরুদ্ধে লোকচিত্ত প্রধূমিত করিয়া তুলিতেছিলেন, তাঁহারা এমন সুযোগ ত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন না। ইহার জন্য রাণী ভবানী কোনদিনই উচ্চবাচ্য করেন নাই; বরং এ পাপকাহিনী বিলুপ্ত করিবার জন্যই চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু রাজবল্লভপ্রমুখ রাজকর্ম্মচারিগণ জানিতেন যে, সিরাজের বিরুদ্ধে হিন্দুহৃদয় বিদ্বেষবিষে পূর্ণ করিবার এমন সুযোগ আর ঘটিয়া উঠিবে না। রাণী ভবানী যে দেশের প্রাতঃস্মরণীয়া পূজনীয়া দেবী, যে দেশের নরনারী তাঁহার দানশীলতার কথা স্মরণ করিয়া প্রভাতে সায়াহ্নে দুই হাত তুলিয়া জয়ধ্বনি করিয়া থাকে, সে দেশে এই কাহিনীকে লতাপল্লবে সুশোভিত করিয়া তুলিতে পারিলে, জনশ্রুতি-লোলুপ জনসাধারণ যে সহজেই সিরাজদ্দৌলাকে নরপিশাচ বলিয়া বিশ্বাস করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজবল্লভ এবং জগৎশেঠ তাহা জানিতেন। সুতরাং সকলেই আগ্রহাতিশয্যে এই জনশ্রুতি দেশবিদেশে রটনা করিয়া দিলেন। সিরাজদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করিবার পূর্ব্বেই, লোকে তাঁহার নামে শিহরিয়া উঠিতে শিক্ষা করিল।

  1. Stewart's History of Bengal.
  2. Fifth Report, vol. I.
  3. মুর্শিদ কুলীখাঁর শাসনসময়ে মুর্শিদাবাদে একটি গর্ত্তের মধ্যে যাবদীয় পুতিগন্ধময় পদার্থ সঞ্চিত রাখিয়া রাজত্বদানে অশক্ত জমীদারদিগকে তার মধ্যে তানিয়া আনিয়া নির্য্যাতন করিবার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। ইহাকে সেকালের মুসলমানেরা ব্যঙ্গচ্ছলে “বৈকুণ্ঠ” বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন। মুসলমান ইতিহাসে এ কথার উল্লেখ নাই, কিন্তু সমসাময়িক ইংরাজের ইহা লিখিয়া গিয়াছেন। শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ইহার সুতীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন।
  4. Holwell.
  5. ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত।
  6. “In Mohimapore, north of Jaffraganj, and on the left-hand side of the road to Azimgunj, there may be seen the ruined house of Jagat Seth, “the Banker of the World.” The Morshidabad Min was here, and its foundations still exist. The only relic of forme magnificence is an impluvium or cistern, with a stone border. -H, Beveridge. C. S.
  7. ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদ প্রাদেশিক সমিতির সম্মিলনসময়ে, অনরেব্‌ল্‌ শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেক গণ্যমান্য বাঙ্গালী মহিমাপুরের ভগ্নাবশেষ দেখিতে গিয়াছিলেন; তখন অল্প অল্প বৃষ্টি হইতেছিল; জগৎশেঠের বর্ত্তমান বংশধর তাঁহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া বসিতে বলেন, এমন একটু স্থানও খুঁজিয়া পাইলেন না!}}
  8. প্রভুপুত্র সরফরাজকে নিহত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করায় লোকে আলিবর্দ্দীর নামে যেরূপ শিহরিয়া উঠিয়াছিল, কালে তাহা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হইয়া গিয়াছিল।
  9. Baranagar is famous as the place where Rani Bhawani spent the last years of her life, and where she died. She built some remarkable temples here. In size or shape, they are ordinary enough, but two of them are “richly ornamented with terra cotta tiles, each contaning a figure of Hindu Gods very excellently modelled and in perfect preservation.“-H. Beveridge. c. s.
  10. “Rani Bhawani is a heroine among the Bengalees."-Ibid.
  11. রাণী ভবানীর বংশধর বড়নগর রাজবাটীর স্বর্গীয় রাজ। উমেশচন্দ্রের নিকট এই কাহিনী সংগ্রহ করিয়া একজন সুলেখক নব্যভারত পত্রিকায় তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু রাজসাহী প্রদেশে এই জনশ্রুতি বহুবিধ আকারণ করিয়াছে।
  12. W. W. Hunter.
  13. Thornton's History of British India Vol. 1.
  14. দ্বাদশ নারী।