সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/“বর্গী এল দেশে”

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


“বগী এল দেশে”।

 বাঙ্গালীর অন্নগত প্রাণ। সেই জন্য বাঙ্গালী কিছু অতিমাত্রায় শান্তিপ্রিয়। বর্ষা-সলিল-প্লাবিত অত্যুর্ব্বর সমতলক্ষেত্রে সময় বুঝিয়া একমুষ্টি ধান ছড়াইয়া দিতে পারিলে, যথাকালে পর্য্যাপ্ত শস্য-সম্পদে যাহার গৃহপ্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ হইয়া যায়, সে কখন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য “বায়ু উল্কাপাত বজ্রশিখা” ধরিয়া দেশে দেশে ছুটাছুটি করিতে শিখে না। আজকাল বাষ্পায়ানের কল্যাণে বাষ্পাকুললোচমে বাঙ্গালী যুবক হা অন্ন! হা অন্ন! মবে দেশ বিদেশে ভিক্ষাভণ্ড লইয়া মেদিনী-পর্য্য- টনে বাহির হইতেছেন; কিন্তু আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন পর্যন্তও বাঙ্গালীর মেরুদণ্ড অন্নাভাবে অবনত হইয়া পড়ে নাই। এই সকল কারণে পিতৃপিতামহের বাস্তু ভিটার সঙ্গে বাঙ্গালীর হৃদয় মন এমন মেহবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল যে, নিতান্ত দারে পড়িলেও লোকে সহসা বসতিগ্রামের চতুঃসীমা পরিত্যাগ করিতে চাহিত না। ষে বাস্তু ভিটার উপর দাঁড়াইয়া পূজনীয় পিতৃপিতামহেরা শৈশব, যৌবন, বার্দ্ধক্য অতিবাহিত করিয়া পুণ্যলোকে প্রস্থান করিয়া-ছেন, বাঙ্গালীর চক্ষে তাহার প্রতিধুলিমুষ্টিও পবিত্র বলিয়া পরিচিত ছিল। সেই জন্য মুসলমান বাদশাহেরা দ্বিগুণ, ত্রিগুণ,অথবা চতুগুণ মাত্রায় ভূমির কর বৃদ্ধি করিলেও লোকে পৈতৃক ভিটার মমতা ত্যাগ করিতে না পারিয়া তাহাতে সম্মত হইত।

 হিন্দু রাজত্বে যে পরিমাণে ভূমির কর নির্দিষ্ট ছিল সম্রাট আক, বরের সময়ে তাহা দ্বিগুণ হইয়া উঠিয়াছিল![১] মুর্শিদ কুলী খাঁ সেই রাজকর ক্রমশঃ বৃদ্ধি করিয়া, তাহার উপর আবার কতকগুলি “বাজে জমা” বার করিয়াছিলেন। সুজা খাঁর নবাবী আমলে সে জমার সংখ্যা এবং পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তিনি “নজরাণা মোকরির,” “জার মাথট,” “মাথট ফিলখানা,” এবং “আব- ওয়াব ফৌজদারী” নামে অনেকগুলি নূতন বাজে জমা সংস্থাপন করিয়া রাজস্ব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। আলিবর্দ্দীর শাসনসূচনাতে হীরাঝিলের ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য সিরাজদ্দৌলা কৌশল ক্রমে যে নজরানা আদায় করিয়া লইয়াছিলেন, তাহা ক্রমে “নজরাণা মরগঞ্জ” নামে বার্ষিক জমায় পরিণত হইয়া উঠিল।[২]

 এই সকল বাজে জমা আদায় করিয়াও লোকে কথঞ্চিৎ সুথসম্পদে জীবন যাপন করিতেছিল। কিন্তু নবাব আলিবর্দী সিংহাসনে আরোহণ করিতে না করিতেই এক নূতন উপদ্রবের সূত্রপাত হইল। বহুদিন হইতে আরাকান প্রদেশের মগ[৩] এবং সুন্দরবন বিহারী ফিরিঙ্গিদিগের[৪] অত্যাচারে দক্ষিণ ও পূৰ্বাঞ্চল বিপর্যস্ত হইতেছিল; কালক্রমে সেই উৎপীড়নে দক্ষিণ বঙ্গের সমৃদ্ধ জনপদ সুন্দরবনে পরিণত হইয়াছিল; সুতরাং মগ এবং ফিরিঙ্গি দমন করিবার জন্য নবাবসরকার হইতে ঢাকাপ্রদেশে ৭৬৮ খানি রণতরি সর্ব্বদা প্রস্তুত থাকিত এবং “জায়গীর নৌয়ারা”[৫] মহালের সমুদায় রাজস্ব তাহার জন্য ব্যয় করা হইত। এই সকল অত্যাচারে লোকে দক্ষিণ ও পূর্ব বাঙ্গালায় নিঃশঙ্কচিত্তে বসতি করিতে সাহস করিত না। সুতরাং মধ্য বাঙ্গালার উর্ব্বর ভূমিই কালক্রমে বহুজনাকীর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। নবাগত ইউরোপীয় বণি: কেরাও এই অঞ্চলেই অধিকাংশ বাণিজ্যালয় স্থাপন করিয়া ছিলেন। এ দিকে দস্যুতস্করের বিশেষ উপদ্রব ছিল না, মগ ফিরিঙ্গির দৌরাত্ম্যও শুনা যাইত না,লোকে একপ্রকার নিরুদ্বেগে নিঃশঙ্কমনেই সংসার- যাত্রা নির্বাহ করিত।

 সহসা সেই সুখের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের শালবন অতিক্রম করিয়া, উড়িষ্যার গিরিনদী পার হইয়া, নানা পথে সহস্র সহ মহারাষ্ট্রীয় অশ্বারোহী পঙ্গপালের মত বাঙ্গলাদেশের বুকের উপর ছুটিয়া আসিতে লাগিল। বাদশাহ আরঙ্গজীব একদিন যাহা দিগকে “পার্বত্য-মূষিক’ বলিয়া উপহাস করিতেন, তোষামোদপরায়ণ পারিষদগণ যাহাদিগকে পিপীলিকাবৎ নখাগ্রে টিপিয়া মারিবেন বলিয়া আস্ফালন করিতেন, সেই মহারাষ্ট্রবল কঙ্কণ প্রদেশের গিরিগহবরে অধিকদিন লুকাইয়া রহিল না; মোগলের অধঃপনকাল নিকট বুঝিয়া বাহুবলে হিন্দুরাজত্ব সংস্থাপন করিবার আশায়, তাহারা দলে দলে অসি-হস্তে দেশবিদেশে ছুটিয়া বাহির হইল। দিল্লীর বাদশাহ তাহা দের হস্তে ক্রীড়াঙ্কন্দুক হইয়া উঠিলেন, তাহারা ভারতবর্ষের বিবিধ প্রদেশে রাজকরের চতুর্থাংশ “চৌথ আদায়ের “ফরমাণ” পাইয়া বাহুবলে ন্যায্যগণ্ডা বুঝিয়া লইবার জন্য বাঙ্গালাদেশেও পদার্পণ করিল;—বাঙ্গালার ইতিহাসে ইহারই নাম “বৰ্গীর হাঙ্গামা"।

 বৰ্গীর হাঙ্গামার কথা এখন ইতিহাসের জীর্ণস্তরে মিশিয়া গিয়াছে। লোকে আর তাহার কথা আলোচনা করিবার সময়ে বিষাদের দীর্থ- নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে না। কিন্তু সে কালে বর্গীর হাঙ্গামাই বাঙ্গালীর সর্বনাশের সূত্রপাত করিয়াছিল। চতুর মহারাষ্ট্রীয়গণ জানিত যে, বাঙ্গালীর অনুগত, প্রাণ; বাঙ্গালার সমতলক্ষেত্রে একবার পদার্পণ করিতে পারিলে, অন্নজীবি-বাঙ্গালী সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর হইতে পারিবে না। দেশে দুর্গ নাই; রাজধানী হইতে গণ্ডগ্রাম পর্যন্ত সমুদয় দেশ অরক্ষিত; সুতরাং বাঙ্গালাদেশে পদার্পণ করিয়া তাহারা একেবারে কাটোয়া পর্যন্ত আসিয়া পড়িল![৬] সেকালে কাটোয়ায় একটি ছোট খাট রকমের দুর্গ ছিল; চারিদিকে মাটির দেওয়াল, তাহার মধ্যে খান- কতক খড়ের চালা, ইহাই সে দুর্গের সম্বল। সুতরাং গিরিদুর্গবিজয়ী মহারাষ্ট্র-সেনার পক্ষে কাটোয়া-দুর্গ জয় করিতে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হইল না।

 দেখিতে দেখিতে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরস্থিত সম্পন্ন জনপদগুলি জনশূন্য হইয়া গেল। লুণ্ঠন-পরায়ণ মহারাষ্ট্র-সেনা গ্রাম নগর লুণ্ঠন করিয়া চালে চালে আগুন ধরাইয়া দিল, অশ্বপদ তাড়নায় শস্যক্ষেত্র পদদলিত হইয়া গেল, লোকে স্ত্রীপুত্রের হাত ধরিয়া হাহাকার করিতে করিতে ভাগীরথী পার হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। আলি-বর্দ্দী স্বয়ং অসিহন্তে মহারাষ্ট্রদলনে বাহির হইলেন; কিন্তু ভাগীরথী পার হইয়াই বুঝিতে পারিলেন যে, মহারাষ্ট্রসেনা সম্মুখযুদ্ধে অগ্রসর হইবে না। দলে দলে বিভক্ত হইয়া যথেচ্ছ লুটপাট করাই তাহাদের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য তাহারা একদলে আলিবর্দ্দীর সঙ্গে হাতাহাতি করিতেছে, অথচ সেই অবসরে আর একদল গিয়া নবাবের পটমণ্ডপ পর্য্যন্তও লুটিয়া লইতেছে! কয়েক দিন এইরূপ অদ্ভুত যুদ্ধ বুঝিয়া আলিবর্দ্দী সংবাদ পাইলেন যে, মহারাষ্ট্র-সেনা রাজ- ধানী আক্রমণ করিয়া জগৎশেঠের রাজভাণ্ডার পর্যন্তও লুটিয়া লই- আছে;—মুর্শিদাবাদ জনশূন্য হইয়াছে!

 আলিবর্দ্দী তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগমন করিয়া নবাবপরিবার স্থানান্তরিত করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পদ্মা এবং মহা- নদার সম্মিলনস্থানের নিকটে সুলতানগঞ্জ নামে একটি গঞ্জ স্থাপিত হইল। মহানন্দার খরস্রোত এবং পদ্মার প্রবল তরঙ্গ উত্তীর্ণ হইয়া মহারাষ্ট্রীয় অশ্বসেনা সহজে সেখানে আসিয়া উপদ্রব করিতে পারিবে না; সেইজন্য সুলতানগঞ্জের নিকটবর্তী গোদাগাড়ি গ্রামে বাসভবন নির্দিষ্ট হইল।[৭] সেই স্থানে পরিবারবর্গকে রক্ষা করিবার জন্য নওয়া- জেস্ মোহম্মদ নিযুক্ত হইলেন। তাঁহাকে রাজধানী ছাড়িয়া গোদা- গাড়িতে আসিতে হইল। ঢাকার নবাব-সরকারে বৈদ্য-বংশোদ্ভব রাজ- বল্লভ নামে একজন পেস্‌কার[৮] ছিলেন; প্রতিভায় এবং কার্যদক্ষতায় তিনি বড়ই বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনিই প্রকৃতপক্ষে ঢাকার নবাব হইয়া মহারাজ রাজবল্লভ নামে পরিচিত হইয়া উঠিলেন।[৯]

 ক্রমে বর্গীর হাঙ্গামা একটি বাষিক ঘটনায় পরিণত হইয়া উঠিল। নওয়াজেস গোদাগাড়ি ছাড়িতে পারিলেন না; আলিবর্দ্দী তরবারি ছাড়িয়া উষ্ণীষ নামাইয়া একবৎসরও বিশ্রাম লাভের সুযোগ পাইলেন না! অগত্যা মুর্শিদাবাদে সিরাজদ্দৌলা এবং ঢাকায় রাজবল্লভ সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া উঠিলেন। বর্গীর হাঙ্গামায় বঙ্গভূমি যখন হাহাকার করিয়া আর্ত্তনাদ করিতেছিল, সিরাজদ্দৌলা তখন প্রমোদনিদ্রায় সুখস্বপ্ন দেখিতেছিলেন -রাজবল্লভ সুযোগ পাইয়া শক্তিসঞ্চয় করিতেছিলেন। কালক্রমে সিরাজের মোহনিদ্রা ভাঙ্গিয়াছিল; কিন্তু রাজবল্লভ তখন এতই শক্তিশালী যে, সিরাজ আর ঠাহাকে ক্ষুদ্রশক্তিতে বশীভূত করিতে পারিলেন না। ইহাই সিরাজদ্দৌলার সর্বনাশের মূলসূত্র— ইহাই ইতিহাসের গূঢ়মর্ম্ম!

 ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দের সম-সময়ে বিপুল মহারাষ্ট্রবল দুইদলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। বেরার প্রদেশে রঘুজি ভোসলা এবং পুনা প্রদেশে বালাজি,—উভয়েই পেশোয়াপদ লাভ করিবার জন্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্ব আরম্ভ করিয়াছিলেন। রঘুজির আজ্ঞাবহ সেনানায়ক ভাস্কর পণ্ডিত বাঙ্গলাদেশে প্রথম পদার্পণ করেন। কিছুদিন পরে বালাজি বাহুবলে বাদশাহকে বশীভুত করিয়া ১১ লক্ষ টাকা চৌথ আদায়ের ফরমাণ কইয়া বিহার অঞ্চল লুণ্ঠন করিতে করিতে বাঙ্গালাদেশে উপনীত হইলেন।[১০]

 দুই দিক হইতে দুইটি প্রবল শক্ত এক সঙ্গে “যুদ্ধং দেহি” রবে সগর্ব্বে অগ্রসর হইতেছে; আলিবর্দ্দী একাকী কোন দিক্‌ রক্ষা করিবেন? অগত্যা একপক্ষকে হস্তগত করিয়া অপর পক্ষ আক্রমণ করাই স্থির হইল। পরামর্শ স্থির হইল বটে, কিন্তু বালাজিকে হস্তগত করিতে যে পরিমাণ উৎকোচ দিতে হইল, তাহাতে রাজকোষ শুন্য করিয়াও আলিবর্দ্দী কুলাইয়া উঠিতে পারলেন না। অবশেষে জমীদারদিগের নিকট ঋণ গ্রহণ করিয়া কোনরূপে লজ্জারক্ষা করিলেন, এবং বালাজির সাহায্যে সহজেই ভাস্করকে তাড়াইয়া দিলেন। একবার তাড়া খাইয়াই ভাস্কর পণ্ডিত পরাজিত হইলেন না;—একবৎসরও নিরুদ্বেগে অতি- বাহিত হইল না, বর্ষা শেষে আবার ভাস্করের রণভেরী বাজিয়া উঠিল।

 এবার ভাস্করসৈন্যের সহিত নবাব সৈন্যের মনকরার প্রান্তরে সম্মুখ- যুদ্ধের আয়োজন হইল। যুদ্ধ হইল না; আলিবর্দ্দী অর্থদানে তুষ্ট করিবার প্রলোভন দেখাইয়া ভাস্করকে আপন শিবিরে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন। অর্থলোভে ভাস্কর পণ্ডিত নিঃশঙ্কচিত্তে অল্প কয়েকজন অনুচর লইয়া নবাব-শিবিরে পদার্পণ করিলেন। ইঙ্গিতমাজে নবাব সৈন্য পিঞ্জরাবদ্ধ বনশার্দ্দলের মত ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করিয়া ফেলিল;—ভাস্কর কটিদে হইতে শাণিত খরশাণ কোষমুক্ত করিবারও অবসর পাইলেন না। মহারাষ্ট্র-সেনা পলায়ন করিল, নবাব-সৈন্য দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার পাইল;[১১] মনকরার শিবির আলিবর্দ্দীর কলঙ্কস্তম্ভে পরিণত হইল; কিন্তু মুসলমান ইতিহাসলেখক তাহার জন্য একবারও আলিবর্দ্দীর নিন্দা করিলেন না! [১২]

 ১৭৪৫ খৃষ্টাব্দে এক অভাবনীয় নুতন বিপদ উপস্থিত হইল! সেনা- পতি মুস্তাফা খাঁ একজন বিশ্বাসী বীরপুরুষ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। সাহস ছিল, রণকৌশল ছিল, ইংরাজ তাড়াইবার জন্য উৎসাহ ছিল। আলিবর্দ্দী তাঁহার সকল পরামর্শে সম্মত না দিলেও তাঁহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করিতেন। সেই মুস্তাফা খাঁ সহসা আট সহস্র অনুচর লইয়া সিংহাসন আক্রমণের উদ্যোগ করিলেন। আলিবর্দ্দী বিদ্রোহদলন করিলেন, কিন্তু মুস্তাফাকে নির্ব্বাসিত করিয়াই নিরস্ত হইলেন; মুস্তাফা মুঙ্গের এবং রাজমহল লুণ্ঠন করিয়া মহারাষ্ট্রদলে মিশিয়া পড়িলেন।

 ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যাকাণ্ডের কথা মহারাষ্ট্রদেশে প্রচারিত হইবা- মাত্র রঘুজি স্বয়ং বাঙ্গালাদেশে পদার্পণ করিলেন। লোকে পৈতৃক ভিটার মায়া মমতা ছাড়িয়া প্রাণ লইয়া দূরস্থানে পলায়ন করিতে লাগিল, গ্রাম নগর জনশূন্য হইয়া গেল, শস্যক্ষেত্র কণ্টকবনে পরিণত হইল, শিল্পবাণিজ্য ক্রমেই বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল![১৩]

 চারিদিকে মহাবিপ্লব। আলিবর্দ্দী একাকী অসিহস্তে ছুটাছুটি করিয়া ক্রমেই অবসন্ন হইয়া পড়িতে লাগিলেন। অবশেষে একাকী আর পারিয়া উঠিলেন না; আপন আপন ধন প্রাণ রক্ষার অন্য সকলকেই যথাযোগ্য ক্ষমতা দিতে বাধ্য হইলেন। সেই ক্ষমতায় জমীদারগণ সৈন্যবল বৃদ্ধি করিলেন; ইংরাজগণ কাশিমবাজারে একটি ছোট খাট রকমের দুর্গ নির্ম্মাণ করিলেন; কলিকাতা রক্ষার জন্য মহারাষ্ট্রখাত খনন করিয়া কলিকাতা ও অন্যান্য বাণিজ্য স্থানে সৈন্য সমাবেশ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারাষ্ট্রবিপ্লবে নবাবের রাজকোষ শূন্য হইতে লাগিল বিদেশীয় বণিকদিগের পদোন্নতির সূত্রপাত হইল, দেশের লোকের সঙ্গে তাঁহাদের আত্মীয়তা ঘনীভূত হইয়া উঠিল। কালে ইহা হইতেই যে মুসলমান-শক্তি পদদলিত হইতে পারে, আলিবর্দ্দী তাহা অস্বীকার করিতেন না; কিন্তু কি করিবেন? নিতান্ত নিরুপায় হইয়াই তাঁহাকে এই পথ অবলম্বন করিতে হইল।

 ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দে নবাব আলিবর্দ্দী স্বয়ং মহারাষ্ট্র-দমনে বাহির হইতে পারিলেন না; ভগিনীপতি মীরজাফর খাঁকে সেনাপতি করিয়া পাঠাইয়া দিলেন। মীরজাফর “সিপাহসালার”[১৪] ছিলেন; তাঁহার অধীন সৈন্যদল যদিও নবাবের সৈন্য, তথাপি তাহারা সাক্ষাৎভাবে নবাব-সরকার হইতে বেতন পাইত না। নবাবী আমলে এখনকার মত রাজস্বনীতি প্রচলিত ছিল না। কেবল বাদশাহের প্রাপ্য রাজকর নবাব-দপ্তরে জমা হইত, তদ্ভিন্ন প্রত্যেক বিভাগের ব্যয় নির্বাহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মচারীর নামে ভিন্ন ভিন্ন জায়গীর নির্দিষ্ট থাকিত, সেই সকল জায়গীরের আয় হইতে তাঁহারা আপন আপন বিভাগের ব্যয় নিৰ্বাহ করিতেন।

 “জায়গীর আমীরুল-উমরা বশী”[১৫] নামে ১৮ পরগণার এক জায়গীর প্রধান সেনাপতির “জিম্মা” ছিল, তাহার আয় হইতে তিনি ইচ্ছামত আপন বিশ্বস্ত অনুচরদিগকে সৈন্যদলে গ্রহণ করিয়া নবাব দরবারে কর্তৃত্ব করিতেন। এইরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় সেনাপতি দিগের পক্ষে সহসা বিদ্রোহী হওয়া সহজ ছিল। সেই জন্য নিতান্ত অনুগত ও অন্তরঙ্গ ভিন্ন আর কেহ এই সকল উচ্চ পদে নিযুক্ত হইতে পারিতেন না। আলিবর্দ্দী আপন ভগিনীপতি বলিয়া মীরজাফরকে যেমন স্নেহ করিতেন, সেইরূপ বিশ্বাস করিতেন; কেবল সেই জন্যই মীর জাফরকে এই উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

 মীরজাফর মহারাষ্ট্র-দমনের ভার পাইয়া মহাসমারোহে মেদিনী- পুর পর্যন্ত গমন করিলেন; কিন্তু মেদিনীপুর পর্যন্ত আসিয়াই বিলাস- তরঙ্গে ডুবিয়া পড়িলেন! তাঁহার চরিত্রে বীরোচিত সদগুণরাশি যতদূর বিকশিত হইবার সুযোগ পাইয়াছিল, তাহা অপেক্ষা যৌবনোচিত। বিলাসবাসনাই সমধিক স্ফূর্ত্তিলাভ করিয়াছিল! তিনি কোন দিনই সাহসী বীরপুরুষ বলিয়া পরিচিত হইতে আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই; ইংরাজের ইতিহাসেও মীরজাফর “ক্লাইবের গর্দ্দভ” বলিয়া পরিচিত! বল নবাবের অন্তরঙ্গ বলিয়া সেনাপতি-পদে আরোহণ করিয়াছিলেন। আলিবর্দ্দী কুটুম্বের সমভীতির সংবাদ পাইয়া আতাউল্লা নামক আর একজন বিশ্বস্ত রণকুশল সেনাপতিকে পাঠাইয়া দিলেন।

 মীরজাফরকে সাহায্য করা দূরে থাকুক, আতাউল্লা তাঁহার সাহায্যে লঙ্কাভাগ করিবার কল্পনা করিলেন। আতাউল্লা সিংহাসনে বসিবেন, মীরজাফর পাটনার নবাব হইবেন, এবং সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য উভয়ের সমবেত শক্তিতে আলিবর্দ্দীকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া কণ্টক দূর করিবেন! মীরজাফর বড় মৃদুস্বভাব, বিলাসপ্রিয়, স্বার্থপরায়ণ বলিয়া সকলের নিকটেই পরিচিত ছিলেন; সেই জন্য আতাউল্লা সহজেই তাঁহাকে স্বপক্ষে টানিয়া লইতে সুবিধা পাইলেন।

 আলিবর্দ্দীর কপালে বিশ্রাম সুখ ছিল না। তিনি কুটুম্বের কুপ্রবৃত্তির পরিচয় পাইয়া নিজেই যুদ্ধযাত্রা করিলেন। আলিবর্দ্দী যখন সসৈন্যে বিদ্রোহীদ্বয়ের সম্মুখীন হইলেন, তখন উভয় সেনাপতিই আত্মসমর্পণ করিলেন।আলিবর্দ্দী বৰ্গীর হাঙ্গামা দমন করিয়া সেনাপতিদ্বয়কে পদচ্যুত করিলেন, কিন্তু কাহাকেও কোনরূপ শাস্তি দিতে সম্মত হইলেন না। আলিবর্দ্দীর সদয় ব্যবহারে মীরজাফরের শিক্ষা হইল না। তিনি রাজধানীতে আসিয়া নবাবদরবারের আদেশ লঙ্ঘন করিয়া যথেচ্ছভাবে বিচরণ করিতে লাগিলেন। হিসাব নিকাশ তলপ করিয়া নবাব তাঁহাকে অনেকবার ডাকিয়া পাঠাইলেন, কিন্তু কুটুম্ব আর দরবারে হাজির হইলেন না!

  1. R. C. Dutt. c. s.
  2. Grant's Analysis of the Finances of Bengal.
  3. The Mugs of those days were the desolators of the Sunder bans; they, in alliance of the Portuguese, helped to reduce the now waste Sunderbuns to a jungle though once fertile populous country. So great an apprehension was entertained of them that, as late as 1760, the Government threw a boom across the river below Calcutta to prevent their ships coming up."-Revd. Long.
  4. Holwell defines Feringy “as the black mustze Portuguese Christians, residing in the settlement as a people distinct from the natural and proper subjects of Bengal, sprung orginally from Hindus and Mussulmans.”- Long's Selections from the Records of the Government of India, vol. I.
  5. Grant's Analysis of Finances of Bengal.
  6. কাটোয়া অনেক দিনের পুরাতন স্থান। এরিয়ানের ইতিহাসেও ‘কাটদ্বীপ” বলিয়া ইহার উল্লেখ আছে। মুকুন্দরাম কবিকঙ্কণের চণ্ডীতে এবং ধর্মপুরাণেও কাটোয়ার নাম দেখিতে পাওয়া যায়। পথিকদিগের আশ্রয়ের জন্য নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ এখানে একটি প্রহরীমন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বর্গীর হাঙ্গামায় এই স্থান এমন শ্রীহীন হইয়া পড়িয়াছিল যে, লোকে পথ চলিবার সময়ে শ্বাপদ জন্তুর হাতে পড়িবার ভয়ে শিঙ্গা বাজাইয়া পথ চলিত। ইতিহাস-লেখকেরা বলেন, “Cutwa was formerly the military key of Moorshidabad.”
  7. গোদাগাড়ির নিকটে এখনও কতকগুলি ভগ্নস্তপ এবং কয়েকটি পুরাতন দীঘি বর্তমান আছে। এই স্থানের নাম “কেল্লা বারুইপাড়া”; ইহা রাজশাহী জেলায় অবস্থিত। একজন সেকালের ইংরাজ পরিব্রাজক রাজসাহী-পরিদর্শন উপলক্ষে লিখিয়া গিয়াছেন, “The District contains no forts, except one belonging to the Nawab of Moorshidabad, at Godagaree, which was built in former times as a place of refuge for the Nawab's household, and is now in a most ruinous condition.” Description of Hindoostan, vol. “I.-By Walter Hamilton.
  8. Hunter's Statistical Accounts, —Dacca.
  9. Mill's llistory of British India vol. III p. 161.
  10. Stewart's History of Bengal.
  11. Mutakherin,
  12. “Golam Hossein, the Mahomedan historian, has no word blame for this atrocity."-H. Beveridge, C. S. কিন্তু হোসেন কুলী খাঁ হত্যাকাণ্ডে এই ইতিহাস-লেখক সিরাজদ্দৌলাকে যথেষ্ট তিরস্কার করিতে করেন নাই।
  13. Despatch to the Court of Directors.
  14. Commandar-in-chief and Pay master-General of the Forces.' নবাবী আমলে এই পদের নাম ছিল,—“মীর বক্সী কুল” অথবা “সিপাহসালার অজম"; অনেকানেক পুরাতন জমীদারী-সমলে দেখা যায় যে, “সিপাহসালারকে” ঐ সকল সনদে স্বাক্ষর করিতে হইত। সামরিক বিষয়ে জমীদারগণ যে “সিপাহ সালায়ের” অধীন ছিলেন, ইহা তাহারই পরিচায়ক। সিপাহসালার ছিলেন বলিয়া মীরজাফর বাঙ্গালী জমীদারদিগের সহিত সুপরিচিত হইবার অবসর পাইয়াছিলেন।
  15. Grant's Analysis of Finarices of Bengal