বিষয়বস্তুতে চলুন

সুকুমার সমগ্র রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/নানা গল্প/কুকুরের মালিক

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২০৬-২০৯)

কুকুরের মালিক

 ভজহরি আর রামচরণের মধ্যে ভারি ভাব। অন্তত, দুই সপ্তাহ আগেও তাহাদের মধ্যে খুবই বন্ধুতা দেখা যাইত।

 সেদিন বাঁশপুকুরের মেলায় গিয়া তাহারা দুইজনে মিলিয়া একটা কুকুরছানা কিনিয়াছে। চমৎকার বিলাতি কুকুর—তাহার আড়াই টাকা দাম। ভজুর পাঁচসিকা আর রামার পাঁচসিকা—দুইজনের পয়সা মিলাইয়া কুকুর কেনা হইল। সুতরাং দুইজনেই কুকুরের মালিক।

 কুকুরটাকে বাড়িতে আনিয়াই ভজা বলিল,”অর্ধেকটা কুকুর আমার, অর্ধেকটা তোর।” রামা বলিল, “বেশ কথা! মাথার দিকটা আমার, ল্যাজের দিকটা তোর।” ভজু একটু ভাবিয়া দেখিল, মন্দ কি! মাথার দিকটা যাহার সেই তো কুকুরকে খাওয়াইবে, যত হাঙ্গাম সব তাহার। তাহা ছাড়া কুকুর যদি কাহাকেও কামড়ায়, তবে মাথার দিকের মালিকই দায়ী, ল্যাজের মালিকের কোন দোষ দেওয়া চলিবে না। সুতরাং সে বলিল, “আচ্ছা, ল্যাজের দিকটাই নিলাম।”

 দুইজনে দুপুরবেলায় বসিয়া কুকুরটার পিঠে হাত বুলাইয়া তোয়াজ করিত। রামা বলিত, “দেখিস, আমার দিকে হাত বোলাস নে।” ভজু বলিত, “খবরদার, এদিকে হাত আনিস নে। দুইজনে খুব সাবধানে নিজের নিজের ভাগ বাঁচাইয়া চলিত। যখন ভজুর দিকের পা তুলিয়া কুকুরটা রামার দিকে কান চুলকাইত, তখন ভজু খুব উৎসাহ করিয়া বলিত “খুব দে—আচ্ছা করে খামচে দে।” আবার ভজুর দিকে মাছি বসিলে রামার দিকের মুখটা যখন সেখানে কামড়াইতে যাইত, তখন রামা আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিত, “দে কামড়ে! একেবারে দাঁত বসিয়ে দে।”

 একদিন একটা মস্ত লাল পিঁপড়া কুকুরের পিঠে কামড়াইয়া ধরিল। কুকুরটা গা ঝাড়া দিল, পিঠে জিভ লাগাইবার চেষ্টা করিল। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করিয়া পিঠটাকে দেখিবার চেষ্টা করিল। তাহার পর কিছুতেই কৃতকার্য না হইয়া কেঁউ কেঁউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তখন দুইজনে বিষম তর্ক উঠিল, কার ভাগে কামড় পড়িয়াছে। এ বলে, “তোর দিকে পিঁপড়ে লেগেছে—তুই ফেলবি” ও বলে, “আমার বয়ে গেছে পিঁপড়ে ফেলতে—তোর দিকে কাঁদছে, সে তুই বুঝবি।” সেইদিন দুইজনে প্রায় কথাবার্তা বন্ধ হইবার জোগাড়।

 তাহার পর একদিন কুকুরের কি খেয়াল চাপিল, সে তাহার নিজের ল্যাজটা লইয়া খেলা আরম্ভ করিল। নেহাৎ ‘কুকুরে’ খেলা—তাহার না আছে অর্থ, না আছে কিছু। সে ধনুকের মতো একপাশে বাঁকা হইয়া ল্যাজটার দিকে তাকাইয়া দেখে আর একটু, একটু, ল্যাজ নাড়ে। সেটা যে তাহার নিজের লাজ, সে খেয়াল বোধহয় তাহার থাকে না তাই হঠাৎ অতর্কিতে ল্যাজ ধরিবার জন্য সে বোঁ করিয়া ঘুরিয়া যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটাও নড়িয়া যায়, কাজেই ল্যাজটা আর ধরা হয় না। ভজু আর রামা এই ব্যাপার দেখিয়া উৎসাহে পাল্লা দিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। রামার মহা স্ফুর্তি যে ভজুর ল্যাজকে তাড়া করা হইতেছে, আর ভজুর ভারি উৎসাহ যে তাহার ল্যাজ রামার মুখকে ফাঁকি দিয়া নাকাল করিতেছে।

 দুইজনের চিৎকারেই হউক কি নিজের ঢ্যাঁটামির জন্যই হউক, কুকুরটার জিদ চড়িয়া গেল। সমস্তদিন সে থাকিয়া থাকিয়া চরকিবাজির মতো নিজের ল্যাজকে তাড়া করিয়া ফিরিতে লাগিল। এই রকমে খামাখা পাক দিতে দিতে কুকরটা যখন হয়রান হইয়া হাঁফাইতে লাগিল, তখন রামা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ভজা বলিল, “আমার দিকটাই জিতেছে।”

 কিন্তু কুকুরটা এমন বেহায়া, পাঁচমিনিট যাইতে না যাইতেই সে আবার ল্যাজ তাড়ানো শুরু করিল। তখন রামা রাগিয়া বলিল, “এইও তোমার ল্যাজ সামলাও। দেখছ না কুকুরটা হাঁপিয়ে পড়েছে।” ভজু বলিল, “সামলাতে হয় তোমার দিক সামলাও—ল্যাজের দিকে তো আর হাঁপাচ্ছে না!” রামা ততক্ষণে রীতিমত চটিয়াছে। সে কুকুরের পিছন পিছন গিয়া ধাঁই করিয়া এক লাথি লাগাইয়া দিল। ভজু বলিল, “তবে রে! আমার দিকে লাথি মারলি কেন রে?” এই বলিয়াই সে কুকুরের মাথায় ঘাড়ে কানে চটাপট কয়েকটা চাঁটি লাগাইয়া দিল। দুইদিক হইতেই রেষারেষির চোটে কুকুরটা ছুটিয়া পালাইল। তখন দুইজনে বেশ একচোট হাতাহাতি হইয়া গেল।

 পরের দিন সকালে উঠিয়াই রামা দেখে, কুকুরটা আবার ল্যাজ তারা করিতেছে। তখন সে কোথা হইতে একখানা দা আনিয়া এক কোপে ক্যাঁচ করিয়া ল্যাজের খানিকটা এমন পরিপাটি—উড়াইয়া দিল যে কুকুরটার আর্তনাদে ভজু ঘুমের মধ্যে লাফ দিয়া একেবারে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত। সে আসিয়াই দেখিল কুকুরের ল্যাজ কাটা, রামার হাতে দা। ব্যাপারটা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না।

 তখন সে রামাকে মারিতে মারিতে মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপর কুকুর লেলাইয়া দিল। কুকুরটা ল্যাজ কাটার দরুন রামার উপর একটুও খুশি হয় নাই—সে নিমকহারাম হইয়া ‘রামার দিক’ দিয়াই রামার ঠ্যাঙে কামড়াইয়া দিল।

 এখন দুইজনে চায় থানায় নালিশ করিতে। রামা বলে, “ল্যাজটা ভারি বেয়াড়া, বারবার মুখের সঙ্গে ঝগড়া বাধাইতে চায়—তাই সে ল্যাজ কাটিয়াছে। ল্যাজ না কাটিলে কুকুর পাগল হইয়া যাইত, নাহয় সর্দিগর্মি হইয়া মরিত। মারা গেলে তো সমস্তটা কুকুরই মারা যাইত, সতরাং ল্যাজ কাটার দরুন গোটা কুকুরটারই উপকার হইয়াছে। মুখও বাঁচিয়াছে, ল্যাজও বাঁচিয়াছে; তাহাতে রামারও ভালো, ভজুরও ভালো। কিন্তু ভজুর এতবড় আস্পর্ধা যে সে রামার দিকের কুকুরকে রামার উপর লেলাইয়া দিল। মুখের দিকে ভজুর কোন দাবিদাওয়া নাই, সে দিকটা সম্পূর্ণভাবেই রামার—সুতরাং রামার অনুমতি ছাড়া ভজু কোন্‌ সাহসে এবং কোন্‌ শাস্ত্র বা আইনমতে তাহা লইয়া পরের ধনে পোদ্দারি করিতে যায়? ইহাতে অনধিকারচৰ্চা, চুরি, তছরুপ—সবরকম নালিশ চলে।

 ভজু কিন্তু বলে অন্যরকম। সে বলে রামার দিকের কুকুর রামাকে কামড়াইয়াছে, তাহাতে ভজুর কি দোষ? ভজু কেবল ‘লে লে লে’ বলিয়াছিল; তাহাতে কুকুর যদি রামাকে কামড়ায়, তবে সেটা তাঁহার শিক্ষার দোষ—রামা তাহাকে ভালো করিয়া শিক্ষা দেয় নাই কেন? তাহা ছাড়া ভজুর ল্যাজ খেলা করিতে চায়, রামার হিংসুটে মুখটা তাহাতে আপত্তি করে কেন? ভজর ল্যাজকে কামড়াইতে যাইবার তাহার কি অধিকার আছে? আর রামা তাহার কুকুরের চোখ বাঁধিয়া কিংবা মুখোস আঁটিয়া দিলেই পারিত—সে ল্যাজ কাটিতে গেল কাহার হুকুমে? একবার নালিশটি করিলে রামচরণ ‘বাপ বাপ’ বলিয়া ছয়টি মাস জেল খাটিয়া আসিবেন—তাহা না হইলে ভজুর নাম ভজহরিই নয়।

 এখন এ তর্কের আর মীমাংসাই হয় না। আমাদের হরীশখুড়ো বলিয়াছিলেন, “এক কাজ কর, কুকুরটার নাকের ডগা থেকে ল্যাজের আগা পর্যন্ত দাঁড়ি টেনে তার ডান দিকটা তুই নে, বাঁ দিকটা ওকে দে—তা হলেই ঠিকমত ভাগ হবে।” কিন্তু তাহারা ঐরকম “ছিলকা কুকুরের” মালিক হইতে রাজি নয়। কেউ কেউ বলিল, “তা কেন? ভাগাভাগির দরকার কি? গোটা কুকুরটাই রামার, আবার গোটা কুকুরটাই ভজুর।” কিন্তু এ কথায়ও তাহাদের খুব আপত্তি। একটা বই কুকুর নাই তার গোটা কুকুরটাই যদি রামার হয়, তবে ভজর আবার কুকুর আসে কোথা হইতে? আর গোটা কুকুরটাই যদি ভজুর হয়, তবে রামার আর থাকিল কি? কুকুর হইতে কুকুর বাদ দিলে বাকি রইল শূন্যি!

 এখন তোমরা যদি ইহার মীমাংসা করিয়া দাও।

সন্দেশ—১৩২৫