বিষয়বস্তুতে চলুন

হারানো খাতা/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে।
কহিল পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে?

—কথা।

হে অনন্ত জ্যোতির্ম্ময় বুঝিবে কি তুমি!
কি মহান্ দিব্য সুখে মগ্ন রহি আমি।
সাধকে কি সিদ্ধি তরে, ইষ্টদেবে পূজা করে,
শুধু কি পূজায় তৃপ্তি হয় নাক তার?
চির সাধনার সিদ্ধি পূজাতে আমার।

জান না আমায় আমি জানতে না চাই।
আমি যেন যুগে যুগে এই সুখ পাই।

৺ইন্দিরা দেবী।

 নীচের তলার একটা ঘরে সুষমা একাকিনী মেজের উপর নিতান্ত অবসন্ন হইয়া যেন একগাছি ছিন্ন লতিকার মতনই বসিয়া পড়িয়াছিল। রাজা নরেশচন্দ্রের এই সুবিপুল ও ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত প্রাসাদ ভবনে প্রবেশ করিয়াই তার সমস্ত মনটা যেন লজ্জায় অনুতাপে সঙ্কোচে ও ধিক্কারে গুটাইয়া অত্যন্ত ছোট হইয়া গিয়াছিল। আকস্মিক ও নিরুপায়তার ভয়ের তাড়নায় সে কানাই সিংয়ের প্রস্তাবিত এই কাজটা করিয়া ফেলিবার পরক্ষণ হইতেই তার মনের মধ্যে কিসের একটা অস্বস্তির ঝড়, তুফান তুলিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছিল। নিশ্চিন্তে নিদ্রিত গৃহস্থের সুখনিদ্রার অবসরে তাহাকে হৃতসর্ব্বস্ব করণোদ্দেশ্যে চৌর্য্যবৃত্তি করিতে আসিয়াছে এম্‌নি একটা দ্বিধা ও আতঙ্ক যেন তাহার লোভের মধ্য দিয়া উঁকি মারিয়া উঠিতেছে বলিয়া তার বোধ হইল। যতক্ষণ নরেশ তার স্ত্রীর সম্মতি নিতে গিয়াছিলেন, তার মধ্যে একটা অকথ্য লজ্জা ও অত্যন্ত তীর সঙ্কোচে সুষমার যেন উঠিয়া সে ঘর, সে বাড়ী ছাড়িয়া ছুটিয়া পলাইবার ইচ্ছা করিতেছিল। ছিছি, ছিছি কেন সে মরিতে এ বাড়ীর পবিত্রতার মধ্যে—উহাদের দাম্পত্য সুখের মাঝখানে নিজের এই কলঙ্কলাঞ্ছিত পাপছায়া ফেলিতে আসিয়া দাঁড়াইল? সে কি গৃহস্থ ঘরে পা রাখিবার যোগ্যা।—

 নরেশ আসিয়া সঙ্কোচে মৃদুচরণে গৃহে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার পায়ের শব্দ শুনিয়াই সুষমার মনের ক্ষীণ দীপশিখাটুকু নিমিষেই নিবিয়া গেল। সে মুখ তুলিল না, নরেশের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল না, কোন প্রশ্ন না করিয়াই যেমন ছিল তেমনি নিষ্ক্রিয় ও নিস্পন্দ হইয়া রহিল। শুধু এতক্ষণের পর একটা প্রবল রোদনোচ্ছাস ভিতরে ভিতরে তাহার বক্ষকে মথিত ও কণ্ঠকে পীড়িত করিয়া অতি তীব্র বিস্ফোরকের মতই বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টায় ঠেলিয়া উঠিতে লাগিল।

 বহুক্ষণ এম্‌নি ভাষাশূন্য অসহ নীরবতার মধ্য দিয়া নিজেদের বেদনাকে প্রশমিত হইয়া আসিবার অবসর দান করিয়া এবং তারপর নিজের মনের মধ্যের চক্রাকারে মথিত ক্রোধ ক্ষোভ ও নৈরাশ্যের জ্বালাকে কথঞ্চিৎ দমনে আনিয়া নরেশচন্দ্র যথাসাধ্য সৌম্যভাব অবলম্বনের চেষ্টা পূর্ব্বক বলিলেন “চলো সুষমা! তোমায় এখনকার মতন বেলগাছিয়ার বাগানে নিয়ে যাই।”

 সুষমা এই কথাটুকুর মাঝখান দিয়া যেটুকু বা বাকি ছিল, সেটুকুও বুঝিয়া লইয়া এইবার তার নৈরাশ্য ভয় ও বেদনা বিহ্বল চক্ষু দুটি সুধীরে উঠাইয়া নরেশচন্দ্রের গম্ভীর ও স্থির সঙ্কল্পপূর্ণ দুই চোখের উপর স্থাপন করিয়া বলিল, “কানাই সিংয়ের দেশেই আমাকে পাঠিয়ে দিন, তার বুড়ি মা আছে, মেয়েরা বউয়েরা আছে, তাদের মধ্যে আমি বেশ থাকতে পারবো। আপনার বাগান বাড়ীতে আমি আর যাবো না।” সুষমার কণ্ঠে ভৎর্সনার ভাব প্রকাশ পাইল।

 সেকথা কানে না তুলিয়াই নরেশ কহিলেন—“বেদানা! আমার স্ত্রী হয়ত ঠিকই মনে করিয়ে দিয়েছেন, আজও হয়ত আমি তোমায় ভালবাসি। অথচ এই আমার জন্যই তুমি বিশ্বের ঘৃণা ও লাঞ্ছনার তরঙ্গে প’ড়ে, হাবুডুবু খেতে খেতে অসহায় অনাদৃত ভেসে ভেসে বেড়াচ্চো, আর আমি নিজেকে নিয়ে গৌরব ও সুখ সম্ভোগ করাচ্চি! না, আর তা হবে না। আজ রাত্রেই তোমায় আমি বিয়ে করবো। বলতে তো কেউ কিছুই বাকি রাখেনি, আরও তাদের যতখুসী নিন্দা করুক না। আমি কার কথাই আর শুনবো না, তুমি আমার স্ত্রী!”

 সুষমা নরেশের কথার ভঙ্গীতে ও তাঁহার দৃঢ় কণ্ঠশব্দে অবাক ও আশ্চর্য্য হইয়া গিয়া সভয়চক্ষে তাঁহার ক্রোধ ও আবেগোত্তেজিত মুখের দিকে বারেক চকিত কটাক্ষ করিল, তারপর তাঁর পায়ের কাছে পড়িয়া আকুল ক্রন্দনোচ্ছ্বাসের মধ্যে বলিল “না, না, সে আমি হতে দেব না। আমি এইবার জন্মের মতন চলে যাচ্চি, আর কক্ষনো আমার নামও আপনি শুনতে পাবেন না, এবারকার কথা শুধু ভুলে যাবেন।”—সে কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল।

 নরেশ তাহার কাছে একটুখানি অগ্রসর হইয়া দাঁড়াইলেন, স্থিরকণ্ঠে কহিলেন “তুমি ভুলে যাচ্চো বেদানা! তোমায় কখন ত্যাগ করবো না বলে যে তোমার মার কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলেম। বিবাহ ভিন্ন অন্য রকমে তোমায় আশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে ক্রমেই যে কত কঠিন হয়ে উঠছে সে তুমি দেখচোই তো? অতএব ভালমন্দ যাই হোক এই আমাদের পথ, এর পরিণাম যা হবার হবে—উপায় কি তার?”

 সুষমা তখন তাহার বিষাদসমাচ্ছন্ন অধৌত মুখখানি উন্নমিত করিল; দুঃখের অশনি প্রহারে ফাটিয়া পড়া অন্তরের ব্যথা চাপিয়া সেই অশ্রু প্রবাহের মধ্যেই অত্যন্ত করুণ একটুখানি হাসিয়া সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল “আরও একটা উপায় আমার আছে সেটা ভুলে যাবেন না। অপরের অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্যে সেটা আমি নির্ব্বাচন করতে ভরসা করিনি বটে; কিন্তু যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক হন, তা’হলে অগত্যাই সেই পথটাকেই আমায় বেছে নিতে হবে। আমি মরবো।”

 নিরতিশয় ব্যথা ও লজ্জানুভব করিয়া নরেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহলে তুমি কি করতে বলো? স্রোতের মুখে তোমায় ভাসিয়ে দেব?”

 সুষমা তাহার গম্ভীর ও শোকাহত মুখের দিকে চাহিয়া মৃদু ও শান্তভাবে জবাব দিল, “সামান্য কিছু টাকা দিন, কানাই সিংয়ের দেশেই আমি যাব।”

 নরেশ চলিয়া গেলেন, কিছু পরে আসিয়া দেখিলেন, সুষমা একা নাই, তার সঙ্গে নিরঞ্জন অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সহিত কি কথাবার্ত্তা কহিতেছে।

 নরেশকে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই নিরঞ্জন একঝলক আনন্দের হাসির সহিত তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল “এ যে আমার আনন্দময়ী—”

 সুষমা ত্রস্তে বাধা দিল “আমায় অমন কথা বলবেন না, আমি আপনার অতি দীন হীনা মেয়ে।”

 নরেশ নিরতিশয় বিস্ময়ের সহিত কহিলেন “তোমাদের দুজনে চেনাশোনা হলো কি করে?”

 শুনিয়া হঠাৎ নরেশ যেন গভীর অন্ধকারের মধ্যে এক ক্ষীণ আলোক রেখার সন্ধান পাইলেন। হাত ধরিয়া বলিলেন “নিরঞ্জন! যাকে তুমি মা বলে উল্লেখ করতে যাচ্ছিলে, একান্ত অসহায় জেনে অনেক মন্দলোকে তার সঙ্গে কুব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। তারই রক্ষার ভার তুমি যদি নাও, তা হলে আমি নিচিন্ত হতে পারি। আমি তোমায় চিনেছি, তুমি আমার চেয়েও এ কার্য্যের বেশী উপযুক্ত। আমার নিজের মধ্যেও একটা লােভের আগুণ, জ্বলন্ত হ’য়ে রয়েছে। কিন্তু তুমি ওকে ‘মা’ বলেছ—তুমিই ওকে আমার কাছ থেকেও রক্ষা করতে পারবে। আমি তো ও-চোক নিয়ে প্রথম থেকে ওকে দেখিনি!”

 নিরঞ্জন অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সহিত তার এ নূতন চাকরী এক মুহূর্ত্তেই স্বীকার করিয়া লইল। তখন স্থির বিজলীর মত চোকদুটী নরেশের সদ্যচিন্তাভারবিমুক্ত ঈষৎ প্রসন্নমুখে স্থাপন করিয়া সুষমা কহিল, “কিন্তু কার ভার ওঁকে নিতে হচ্ছে, সেটা আমার যাবার আগে থেকেই জেনে নেওয়া উচিত যে?”

 এই বলিয়া নরেশকে বাক্যবিমুখ দেখিয়া সে নিজেই নিরঞ্জনের দিকে ফিরিয়া অকম্পিত কণ্ঠে কহিতে লাগিল, “আমি একজন অতি হীনজীবী পতিতার মেয়ে, বাবা! সমাজে আমার জায়গা নেই বলে, অত্যন্ত ছােট বেলা থেকে রাজাবাহাদুর দয়া করে আমায় একটা স্বতন্ত্র বাড়ীতে রেখে লালন পালন করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষে যা হয়ে থাকে সেই ধরে বিচার করে, লােকে আমার জন্য ওঁর দেবচরিত্রেও কালি মাখাতে ছাড়ে নি। স্বাধীনভাবে কোন চাকরী নিয়ে থেকে ওঁর দেওয়া আশ্রয় ছাড়লে হয়ত কালে আমার ও ওঁর নাম স্বতন্ত্র হয়ে পড়বে, এই আশা করেছিলুম, হিতে বিপরীত হলাে! ভয় পেয়ে আজ এখান অবধি—আমার দুষ্প্রবেশ্য জেনেও জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এসেছিলেম। আমি হয়ত ওঁর সকল সুখের রাহু।— বলিতে বলিতে আকস্মিকোদিত বাস্পবেগে কণ্ঠরােধ হইয়া সুষমা চুপ করিয়া দৃষ্টি ভূমিলগ্ন করাতে তার চোখের জল গােপনেই সাদা পাথরের মেজের কঠিন বক্ষ আর্দ্র করিয়া নিঃশব্দে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।

 নিরঞ্জন সব কথা শুনিয়া একটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস পরিত্যাগ করিল, বলিল “মা! সমাজ বন্ধনের মধ্যে জাতি নীতি কুল গোত্র এ সমুদয়ের নিশ্চয়ই দরকার আছে। কিন্তু তার বাইরে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ে শুধু চাই চরিত্র ও ত্যাগ। তোমার ক্ষুদ্র ইতিহাসে ও-দুটি জিনিষই প্রভূতপরিমাণে দেখতে পেলুম। আমরা মায়ে ছেলেতে যদি কোন সেবাশ্রমে, যদি কোন পুণ্যক্ষেত্রের সন্ন্যাসীপরিচালিত কর্ম্মশালায় সন্ন্যাসগ্রহণ করে কাজ নিই, তা হলে তোমার মা কি ছিল, সে প্রশ্নও যেমন অনাবশ্যক হয়ে যাবে এবং তোমার”—

 নরেশ গভীর আবেগ ও আনন্দোত্তেজনায় নিরঞ্জনকে একেবারে জড়াইয়া ধরিয়া কহিয়া উঠিল “ঠিক বলেছ নিরঞ্জন! সুষমার মত মেয়েরা যখন সমাজের জন্য নয়, তখন ওদের জন্য কোন সামাজিক জীবের আশ্রয়ও সুসঙ্গত নহে। এ সম্বন্ধে আমরা পরে কথাবার্ত্তা কইবো। ওদের মতন মেয়েদের জন্য একটি সন্ন্যাসিনী পরিচালিত আশ্রম করতে পারার বোধ হয় খুবই দরকার আছে।”

 নিরঞ্জন উৎফুল্লকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, “এক সময় আমার মনের এটা একটা মস্তবড় কল্পনাই ছিল। মিসনরীরা যেমন পথে কুড়নো (ফাউণ্ডলিং) ছেলে মেয়েদের জন্য আশ্রম করে রাখে, ঠিক তেমনি হিন্দুসমাজ থেকে কেন করা হবে না? যে সব পতিতা নারী, বা পতিতার মেয়ে, সুপথে ফিরতে চায়, তাদের আশ্রয় কোথায়? এই সুষমা-মায়ের মতন নিস্পাপ হয়েও যারা মায়ের পাপের ফলে এ জন্মটা সমাজের বাইরে, অথচ সৎপথে থেকে দৃঢ় তপস্যায় ক্ষয় করতে সমর্থ, তারা কেন সে সুযোগটুকু পাবে না? বৈষ্ণবের আখড়া বা মঠধারীদের আড্ডা যথার্থ রক্ষামন্দির যে নয়, সে জ্ঞান সকলের নেই। এদের দ্বারাও কত কাজ যে করিয়ে নেবার আছে। যে কাজ মিসনরী মেয়েরা এবং তাদের আশ্রিতা পালিতারা করছে, সে সবই এরা পারে; আর সুতোকাটা তাঁতবোনা সেবাশ্রম করে দুস্থের যত্ন সেবা ইত্যাদি আরও কি কিছু কম করবার আছে? তবে কেন এত শক্তি অনর্থক অপব্যয় হয়ে যাচ্ছে। পথভ্রষ্টের জন্য কি পথ সহজ করে কেউ দেবে না?”

 সুষমা দুজনকার পায়ের গোড়াতেই প্রণাম করিয়া উঠিয়া আনন্দসজলচক্ষু কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ করিয়া নিরঞ্জনের কদাকার মুখের দিকে চাহিল গাঢ়স্বরে কহিল “বাবা! আমায় ওই রকম করেই তুমি এইবার সার্থক করে তোল। এখন মনে হচ্ছে, তা হলে আমার মতন হতভাগ্য জীবনেরও দরকার ত কোথাও আছে?”

 নিরঞ্জনের সঙ্গে গাড়ীতে উঠিয়া সুষমা চলিয়া গেল। একদিক দিয়া অতুল শান্তিতে এবং আর একদিক হইতে একটা তীব্র ব্যথায় নরেশচন্দ্রের প্রাণটা যেন হাহা করিয়া উঠিল। এতদিন পরে সুষমা যে তার প্রকৃত পথের সন্ধান ও সে পথের যথার্থ আশ্রয় লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে তাহারই আনন্দ,আর তার সঙ্গেই এতদিনের পর সুষমার সকল সম্বন্ধ হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়ার ব্যথা একটু তীক্ষ্ণ হইয়াই মনে বাজিতেছিল। কিন্তু তথাপি তাঁহারা দুজনেই যে মস্ত বড় প্রলোভনকে জয় করিয়া অম্লান ও অপ্রতিহত রহিলেন, ইহার গৌরবও তাঁহার সেই ক্লিষ্ট চিত্তকে কম সান্ত্বনা দিল না।