১৯০৫ সালে বাংলা/প্রতিনিধিগণের প্রত্যাবর্ত্তন

উইকিসংকলন থেকে
সেবক সম্প্রদায়
প্রতিনিধিবর্গের প্রত্যাবর্তন।
সুরেন্দ্র বাবুর অভ্যর্থনা।
শিয়ালদহ স্টেশনে দশ সহস্র লােকের সমাগম।

 সেই সােমবার ও মঙ্গলবার কলিকাতায় যে সকল সভা হইয়াছিল, তাহাতে স্থির হয় যে প্রতিনিধিবর্গ যখন বরিশাল হইতে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিবেন, তখন তাঁহাদিগের অভ্যর্থনার জন্য সকলে শিয়ালদহ ষ্টেশনে সম্মিলিত হইবেন। তদনুসারে এই বৈশাখ বুধবার প্রাতঃকালে তাহারা কলিকাতায় প্রত্যাবৃত্ত হইলে অন্যূন দশ সহস্র হিন্দু ও মুসলমান তাহাদিগের অভ্যর্থনার জন্য ষ্টেশনে উপস্থিত হন। প্রথমে রাত্রি তিনটার সময় সকলে কলেজ স্কোয়ারে সম্মিলিত হইয়াছিলেন। চারিটার পর তাহারা শিয়ালদহ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। সেই বিশাল জনস্রোত মন্থর গতিতে যখন ষ্টেশনে উপস্থিত হইল, তখনও ট্রণ আসিতে বিলম্ব ছিল সকলে ট্রেণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 ট্রেণ শিয়ালদহ স্টেশনে উপস্থিত হইল, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ কলিকাতার প্রতিনিধিবর্গ ট্রেণ হইতে অবতরণ করিলেন। অমনি দশ সহস্র কণ্ঠ হইতে ভৈরব রবে বন্দে মাতরম” ধ্বনি সমুখিত হইল; সেই অভ্রভেদী ধ্বনিতে আপামর সকলেরই হৃদয়তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল। সকলেই পুনঃ পুনঃ বন্দে মাতরম্ ধ্বনি করিতে লাগিলেন। প্রতিনিধিবর্গ সেই স্বদেশভক্ত জন সমূহের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তাঁহাদিগকে পুষ্পমাল্যে সুশোভিত করা হইল। সর্ব্বাগ্রে দেশমান্য শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, তৎপার্শ্বে শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র, এণ্টী সার্কুলার সোসাইটির সভ্য স্বদেশভক্ত যুবকবৃন্দের সমভিব্যাহারে অগ্রসর হইতেছিলেন। এণ্টী সারকূলার সোসাইটির সভ্যগণ নিজ নিজ দ্রব্য সম্ভার মস্তকে বহন করিয়া “যায় যাবে জীবন চ’লে, মাগো, জগৎ মাঝে তোমার কাজে বন্দে মাতরম্ ব’লে” সঙ্গীতটী গাহিতে গাহিতে যখনষ্টেশন হইতে আসিতেছিলেন, তখন কার দৃশ্য প্রত্যক্ষ না করিলে অনুধাবন করা করা যায় না।

 প্রথমে একদল অতি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অগ্রসর হইয়া সুরেন্দ্র বাবুকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। শকটের অশ্ব খুলিয়া দেওয়া হইল। সুরেন্দ্র বাবু প্রভৃতি সেই শকটে আরোহণ করিলেন, উৎসাহী যুবকবৃন্দ সেই শকট টানিয়া আনিতে লাগিল। জনস্রোতের গতি ফিরিল, সকলে হ্যারিসন রোড দিয়া কলেজ স্কোয়ারে সমবেত হইলেন। সুরেন্দ্র বাবু শকটের উপর দণ্ডায়মান হইয়া সেই বিপুল জনসঙ্ঘকে লক্ষ্য করিয়া বক্তৃতা করিলেন। তিনি বলিলেন যে, ট্রেণে আসিবার সময় যে সকল ষ্টেশনে গাড়ী থামিয়াছিল, সেই সকল ষ্টেশনেই সমাগত ব্যক্তিবৃন্দকে দেশের বর্ত্তমান অবস্থা, এবং আমাদের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে তিনি উপদেশ দিয়া আসিয়াছেন—সমস্ত রাত্রি তাঁহার এই ভাবেই অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। প্রত্যেক ষ্টেশনেই শত শত লোক উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাঁহাদিগের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন—সকল স্থানের লোকেই সরকারি অত্যাচারের প্রতিকার-কল্পে বিলাতী দ্রব্য প্রাণান্তেও পরিগ্রহণ করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। সুরেন্দ্র বাবু সম্মিলিত জনসমুহকে বলিয়াছেন যে, কেবল নিজে বিলাতী দ্রব্য গ্রহণ না করিলেই চলিবে না, যাহাতে অপর কোন কখনও বিলাতী দ্রব্য স্পর্শ না করে, তাহারও চেষ্টাও করিতে হইবে। বিধিসঙ্গত যে কোন উপায়ে তাহাদিগের বিলাতী দ্রব্য ক্রয়ে বাধা দিতে হইবে। সকলেই সুরেন্দ্র বাবুর উপদেশানুরূপ কার্য্য করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।

 সুরেন্দ্র বাবু তাঁহাদিগকে আরও বলিলেন যে, বরিশালে যে তাঁহাকেই নিগৃহীত করা হইয়াছে, এমন নয়—অন্যান্য সকল প্রতিনিধি এবং এণ্টিসার্কুলার সোসাইটীর যুবকবৃন্দেরও নিগ্রহ হইয়াছে। এই অবমাননার, এই নিগ্রহের জন্য প্রতিহিংসা চাই—এই পাশবিক অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে হইবে। বিদেশী দ্রব্য, বিশেষতঃ বিলাতী দ্রব্য কেহ ভ্রমক্রমেও স্পর্শ না করিলেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ হইবে, তাহা হইলে এই সার্ব্বজনিক অবমাননায় চূড়ান্ত প্রতিশোধ লওয়া হইবে।

 এ পর্য্যন্ত সুরেন্দ্র বাবু ইংরাজীতেই বক্তৃতা করিতেছিলেন; অতঃপর তিনি বঙ্গভাষাতেও কিছুকাল বক্তৃতা করেন। তিনি এবং তাহার সহযোগী ও সহচরবৃন্দকে পথশ্রমে পরিম্লান বোধ হইলেও তাঁহাদের হৃদয়ে যে এক প্রবল উৎসাহের সঞ্চার হইয়াছে, বরিশালের পাশবিক অত্যাচারের ফলে তাঁহাদের যে মানসিক বল বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহা প্রতীত হইতেছিল। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারের কার্য্য দেখিয়া মূসলমানগণের হৃদয়ে কিরূপ ঘৃণার সঞ্চার হইয়াছে, মৌলভী মজম্মদ রহমান ও মৌলভী লিয়াকৎ হোসেন মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ হইতে তাহা ব্যক্ত করেন।

 অতঃপর গোলদীঘির উত্তরপূর্ব্ব কোণে এণ্টিসার্কুলার সোসাইটির আফিসের সম্মূখে একটি বিরাট সভা হয়। তথায় সমবেত ব্যক্তিবৃন্দের মধ্যে অনেকেই উৎফুল্ল অন্তঃকবণে প্রতিনিধিবর্গের সহিত আলিঙ্গন পাশে বদ্ধ হন। তাঁহারা প্রতিনিধিগণকে যেরূপ প্রীতিভরে বিদায় দিয়াছিলেন, এক্ষণে তদধিক প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে পরস্পর বিশ্রম্ভালাপ করিলেন। এ দৃশ্য অতি মনোরম, ও তৃপ্তিপ্রদ। সমবেত জনমণ্ডলী এই দৃশ্য দেখিয়া অশ্রুসংবরণ করিতে পারেন্ নাই। এই সময়ে শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয় একটি হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করেন। সকলে একাগ্রচিত্ত হইয়া তাঁহার কথা শুনিতে লাগিলেন। তিনি বলেন যে, এণ্টিসার্কুলার সোসাইটির সভ্যগণ ধীরভাবে আপনাদের কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন। সুবক্তা শ্রীযুক্ত মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতার পুত্র শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা পুলিশের হস্তে গুরুতররূপে প্রহৃত হইলেও “বন্দেমাতরম্” বলিতে বিরত হয় নাই। সোসাইটির সভ্যগণ নেতৃবর্গের ইঙ্গিতে পরিচালিত হইয়াছিলেন। পুলিশ তাঁহাদিগকে ক্রমাগত প্রহার করিতে থাকে, তথাপি তাঁহারা কেবল মাত্র “বন্দেমাতরম্” ব্যতীত আর কিছুই বলেন নাই। কৃষ্ণকুমার বাবু বরিশালের প্রথম দিবসের ঘটনা বিবৃত করিলে শ্রীযুক্তকালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ অসুস্থতাসত্ত্বেও কিয়ৎকাল বক্তৃতা করেন। তিনি বরিশালে পুলিশ ঘটিত অত্যাচারকাহিনী বিবৃত করেন এবং পুলিশ যে আবশ্যক হইলে কিরূপ পণ্ডবল প্রকাশ করিতে উদ্যত হইতে পারে, তাহা বুঝাইয়া দেন। বরিশালের ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ইমার্সন দেশমান্য শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কিরূপ অসদ্ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাও তিনি প্রকাশ করেন। ইহাতে সমাগত জনসমূহ ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠেন এবং প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধই তাঁহাদের বীজমন্ত্র হইবে বলিয়া স্বীকার করেন। তাঁহারা কখনও আর বিলাতী দ্রব্য স্পর্শ করিবেন না, তাহাতেই বরিশালের অত্যাচারে প্রতিশোধ লইবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন।

 তদনন্তর পণ্ডিত শ্রীযুক্ত গীস্পতি রায়চৌধুরী কাব্যতীর্থ, দণ্ডায় মান হইয়া নূতন বঙ্গের ছোটলাট ফুলার সাহেব ও তাঁহার উপযুক্ত পাশ্বচর, অনুচর প্রভৃতির পাশবিক গুণের কথা একে একে ব্যক্ত করিলেন। বক্তৃতান্তে সভা ভঙ্গ হয়। সকলেই বন্দেমাতরম্ ধ্বনি সহকারে স্বস্থানে প্রস্থান করেন।