অদ্ভুত ভিখারী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


 নরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রীর মাতুলালয় সহরের মধ্যে। নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাহির হইয়া যাইবার পর তিনি সংবাদ পান যে, তাহার মাতুল অতিশয় পীড়িত, এমন কি, কখন তাহার মৃত্যু হয়, তাহার স্থিরতা নাই। আরও জানিতে পারেন যে, মৃত্যুর পূর্ব্বে তাহার মাতুল তাহাকে একবার দেখিবার প্রার্থনা প্রকাশ করিয়াছেন, বিলম্ব হইলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা নিতান্তই অল্প। সুতরাং বাধ্য হইয়া স্বামীর বিনা অনুমতিতেই তাহাকে মতুল দর্শন নিমিত্ত গমন করিতে হয়। একজন পরিচিত গাড়োয়ানকে ডাকাইয়া ও তাহার একমাত্র পুত্রকে সঙ্গে লইয়া তিনি মাতুলালয় উদ্দেশে গমন করেন। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া মাতুলকে শেষ দর্শন দিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি পুনরায় আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিতে থাকেন। স্বামির বিনা অনুমতিতে তিনি গমন করিয়াছেন, সুতরাং সেই স্থানে রাত্রিবাস করিতে তাহার সাহস হয় না, বিশেষ যাইবার সময় বাড়ীর কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া যাইবারও সাবকাশ পান নাই, কাজেই তাহাকে প্রত্যাগমন করিতে হয়; ইচ্ছা ছিল, যদি তাহার মাতুল আরও দুই এক দিবস জীবিত থাকেন, তাহা হইলে তাহার স্বামীকে বলিয়া ও সুবিধা হইলে তাহার স্বামীকেও লইয়া যাইয়া পুনরায় মাতুলালয়ে গমন করিবেন।

 মাতুলালয় হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় নরেন্দ্র বাবুর স্ত্রী ও পুত্র ঐ গুলিখানার নিকট দিয়া আসিতেছিলেন। ঐ গুলির আড্ডার সম্মুখে ঘোড়াদিগের জলপান করাইবার একটী স্থান আছে। গাড়োয়ান ঘোড়াকে জলপান করাইবার জন্য সেইখানে দাঁড় করায়। গাড়ীর দরজা কিছু খোলা ছিল। নরেন্দ্রবাবুর স্ত্রী এই সময় হঠাৎ ঐ দ্বিতল গৃহের উপরের জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন; অমনি তিনি তাঁহার স্বামিকে জানালার নিকট দেখিতে পাইলেন। এরূপ সময়ে এরূপ স্থানে তাঁহার স্বামীকে দেখিয়া মনে করিলেন, কোন কার্য্যগতিকে হয় তো তাঁহার স্বামী সেইস্থানে আগমন করিয়াছেন, ও আরো মনে করিলেন, তিনি যদি জানিতে পারেন যে, তাঁহার স্ত্রী-পুত্র সেইসময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, ও তাঁহার কার্য্যও যদি শেষ হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে তিনি তাহাদিগের সহিত প্রত্যাগমন করিতে পারেন। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি সেই গাড়ির কোচম্যানকে তাঁহার পুত্রের দ্বারা বলাইলেন যে, সে ঐস্থানে গমন করিয়া তাঁহার স্বামীকে তাঁহার নিকট ডাকিয়া দেয়। কোচম্যান তাঁহার আদেশমত ঐ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সেই গুলিখানার আড্ডাধারী কোনমতেই তাহাকে উপরে উঠিতে দিল না। কোচম্যান প্রত্যাগমন করিয়া সমস্ত কথা তাঁহাকে কহিল, আরো কহিল, “আপনি বোধ হয় অবগত নহেন যে, এই স্থানটা কি? ইহা একটী গুলির আড্ডা। এই স্থানে কোন সম্ভ্রান্ত লোক আগমন করে না। ঐ প্রদেশের যত চোর বদ্‌মায়েসের ইহা একটী প্রধান আড্ডা, ইহাতে নিত্য নিত্য যে কতরূপ কুকার্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহার ইয়ত্তা নাই।”

 এই কথা শুনিয়া নরেন্দ্রবাবুর স্ত্রী আরও চিন্তিত হইলেন ও ভাবিলেন, তাহার স্বামী নিশ্চয়ই কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া ঐ স্থানে আগমন করিয়াছেন; সুতরাং এরূপ অবস্থায় তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া কখনই চলিয়া যাওয়া কর্ত্তব্য নহে।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তিনি তাহার পুত্রের সহিত ঐ কোচম্যানকে পুনরায় সেইস্থানে পাঠাইয়া দিলেন। তাহারা ঐ স্থানে প্রবেশ করিতে সমর্থ না হইয়া বিফল মনোরথের সহিত প্রত্যাগমন করিল।

 নরেন্দ্রবাবুর স্ত্রী এরূপ অবস্থায় কি কর্ত্তব্য তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না, অথচ ঐরূপ অবস্থায় তাহার স্বামীকে সেইস্থানে পরিত্যাগ করিয়া যাইতেও সাহসী হইলেন না।

 এইরূপ বিপদে পড়িয়া, অনেক চিন্তার পর, তিনি মনে মনে স্থির করিলেন, ঐ স্থানে তিনি যদি কোন ভদ্রলোককে সেই সময় দেখিতে পান, তাহা হইলে তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিয়া দেখিবেন যে, যদি তাঁহার দ্বারা কোনরূপ উপকার হইতে পারে। তিনি মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এরূপ সময়ে সেইস্থান দিয়া একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্ম্মচারীকে গমন করিতে দেখিতে পাইলেন। তাহাকে দেখিয়াই তিনি তাহার পুত্রের দ্বারা ঐ কর্ম্মচারীকে ডাকিলেন ও ঐ পুত্রের দ্বারা সমস্ত কথা তাঁহাকে কহিলেন। তিনি সমস্ত অবস্থা শুনিয়া কহিলেন, “এই বাড়ীর নিম্নে একটী গুলির আড্ডা আছে, উপরে একখানি মাত্র ঘর, তাহাতে সময় সময় একজন মুসলমান ফকির বাস করিয়া থাকেন। এই বাড়ীর ভিতর গমনাগমন করিবার কেবল এই একটী মাত্র দরজা আছে।

যদি আপনি আপনার স্বামীকে নিশ্চয়ই দেখিয়া থাকেন ও তিনি তাহার পর যদি বাহিরে না গিয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই এই বাড়ীর ভিতর আছেন, ও বোধ হয়, গুলিটা আসটা খাইয়া থাকেন। যাহা হউক, আপনার পুত্র আমার সঙ্গে আসুক, যদি তিনি এই বাড়ীর ভিতর থাকেন, তাহা হইলে আমি এখনই তাঁহাকে আপনার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিব।” এই বলিয়া সেই পুলিস-কর্ম্মচারী বালককে সঙ্গে লইয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 প্রথমতঃ নিম্নের ঘরগুলি দেখিলেন, তাহাতে নরেন্দ্রবাবুর কোন সন্ধানই পাইলেন না। তাহার পর উপরের ঘরে গমন করিলেন। সেই স্থানে সেই মুসলমান ফকির ভিন্ন আর কাহাকেও দৃষ্টিগোচর হইল না। কিন্তু ঐ ঘরের এক পার্শ্বে একখানি কম্বল দ্বারা আবৃত একটা কাপড়ের গাঁট্‌রি দেখিতে পাইলেন। ঐ গাঁট্‌রিটা খুলিলে দেখিতে পাওয়া গেল, উহার মধ্যে একখানি ধুতি, একখানি চাদর, একটী পিরাণ, এক জোড়া জুতা ও এক জোড়া মোজা আছে। উহা দেখিবামাত্র নরেন্দ্রবাবুর পুত্র ও পরিশেষে নরেন্দ্রবাবুর স্ত্রী কহিলেন, “উহা তাহার স্বামীর। যে সমস্ত বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন, উহা তাহাই।”

 পুলিস-কর্মচারী এই অবস্থা দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন, অথচ মুসলমান ফকিরকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কোন রূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না, কেবল এইমাত্র বলিলেন, তিনি নরেন্দ্রবাবুক চিনেন না, কোন ব্যক্তি তাহার ঘরে আসে নাই, ও ঐ বস্ত্রাদি তাহার নয় ও কিরূপে উহা ঐ স্থানে আসিল, তাহা তিনি বলিতে পারেন না।

 এইরূপ অবস্থায় ঐ পুলিস-কর্ম্মচারীও বিপদে পড়িলেন, তাঁহার মনে ভয়ানক সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহারও মনে হইল, সেই কদাকার লোকই কি নরেন্দ্রবাবুকে হত্যা করিয়াছে, আর তাহাই যদি হয়, তাহা হইলে ঐ মৃতদেহটা কোথা গেল।

 সে যাহা হউক, ঐ পুলিস-কর্ম্মচারী এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমাকে সংবাদ প্রদান করেন, আমি আসিয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হই।

 আমি। আচ্ছা, সেই লোকটার কোন পরিচয় পাওয়া গিয়াছে কি?

 ডাক্তার। লোকটা সহরের একটা ভিখারী; কোম্পানীর বাগানের ধারে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। সকলেই তাহাকে নিরীহ লোক বলিয়াই জানে।

 আমি। সে চণ্ডুর আড্ডায় কি করে?

 ডাক্তার। কিছুই করে না। তবে সে এখানে সেই ঘরখানিতে বাস করে। আড্ডার অধ্যক্ষ বলে যে, তার মত শান্ত লোক সহরে নাই। ঘরের ভাড়ার স্বরূপ সে মাসে মাসে আড্ডাধারীকে পাঁচ টাকা করিয়া দিয়া থাকে।

 আমি। আচ্ছা, লোকটা দেখিতে কিরূপ?

 ডাক্তার। সে কথা আর জিজ্ঞাসা করো না। তাহার আকার প্রকার অতি বিশ্রী। লোকটা অল্প খোঁড়া। মুখে নানা প্রকার দাগ। ঠোঁট উল্টান। দেখিলে স্বতঃই মনে দয়ার উদ্রেক হয়।

 আমি। ঘরের ভিতর নরেন্দ্রবাবুর কাপড় পাওয়া ভিন্ন তাহার হত্যার আর কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নাই?

 ডাক্তার। হাঁ, নদীর ধারে যে জানালা আছে, সেই জানালার কপাটে ও সেই গৃহের দুই চারি জায়গায় রক্তচিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে।

 আমি। লোকটা তার কি উত্তর দেয়?

 ডাক্তার। সে বলে, তার হাত কেটে গিয়াছিল, সেই জন্যই ঐ সকল রক্তের চিহ্ন। বাস্তবিকই দেখিলাম যে, তাহার দক্ষিণ হস্তের মধ্যমাঙ্গুলির অগ্রভাগ কাটিয়া গিয়াছে এবং তখনও তাহা দিয়া রক্ত বাহির হইতেছিল।

 আমি। আচ্ছা ডাক্তার! একটা খোঁড়া লোক অমন তেজীয়ান লোককে কিরূপে খুন করিল।

 ডাক্তার। তোমার অনুমান সত্য বটে, কিন্তু লোকটা খোঁড়া হইলে তাহার শক্তি বেশ আছে। সে ইচ্ছা করিলে দুইজনকে একেবারে খুন করিতে পারে।

 আমি। আচ্ছা, আড্ডাধারী কি বলে?

 ডাক্তার। নরেন্দ্রবাবুর স্ত্রী যখন সেই বাটীতে তাঁহার স্বামীকে দেখেন, তখন আড্ডাধারী নিম্নে ছিল। সে কখনও স্বয়ং খুন করিতে পারে না। তবে সেও যে ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। তবে সে বলে যে, সে এ বিষয় কিছুই জানে না; এমন কি, সে ঐ ভাড়াটীয়ার গৃহে পর্য্যন্ত যায় না। কিন্তু কিরূপে যে নরেন্দ্রবাবুর পোষাক ঐ স্থানে আসিল, সে উহার কিছুই বলিতে পারে না।

 আমি। তার পর কি হইল?

ডাক্তার। সেই ভিক্ষুক নরেন্দ্রবাবুর হত্যাকারী ভাবিয়া তাহার স্ত্রী অবাক হইয়া পড়িলেন। তখন তাহাকে তথা হইতে স্থানান্তরিত করা হইল এবং সেই ভিক্ষুককে আপাততঃ সন্দেহ করিয়া হাজতে রাখা হইয়াছে।

 আমি। আর একটী কথা আমার জিজ্ঞাসা করিবার আছে, নরেন্দ্রবাবুর সকল পোষাকই কি ঐ স্থানে পাওয়া গিয়াছে?

 ডাক্তার। না, প্রথমে কেবল চাপকানটী পাওয়া যায় নাই, কিন্তু এখন পাওয়া গিয়াছে। কোথায় জান?

 আমি। না, কিরূপে জানিব?

 ডাক্তার। ঐ নদীগর্ভে। ঠিক ঐ জানালার নীচে। যখন ভাঁটা পড়ে, তখন সেই চাপকান দেখিতে পাওয়া যায়, উহাতে কি ছিল জান?

 আমি। না?

 ডাক্তার। পয়সা ও অধলায় পরিপূর্ণ। দুইটী পকেটে প্রায় পাঁচ টাকার পয়সা ও আধলা ছিল। সম্ভবতঃ, যখন নরেবাবুর পুত্র তাহার পিতার অন্বেষণে ঐ আড্ডায় প্রবেশ করে, তখন সেই ভিক্ষুক তাহার ভিক্ষালব্ধ সঞ্চিত পয়সা ও আধলায় তাহার চাপকানের পকেট পূর্ণ করিয়া জানালা দিয়া নদীগর্ভে নিক্ষেপ করে। বোধ হয়, অপর পোষাকগুলির সেই দশা করিত, যদি পুলিস শীঘ্র সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত না হইত।

 আমি। খুব সম্ভব।

 ডাক্তার। সে যাহা হউক, আপাতত সেই কদাকার হতভাগা ভিক্ষুকের উপরেই সন্দেহ হইয়াছে ও তাহাকে হাজতে রাখা হইয়াছে। তার নামে ইতিপূর্ব্বে কোন ঘটনা পুলিসের কর্ণগোচর হইয়াছে কি না, তাহা অনুসন্ধান করা হয় কিন্তু তাহাতে উহার ঠিকানা কিছুই অবগত হইতে পারা যায় নাই। অতএব এখন রহস্য এই যে, নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাবু গুলির আড্ডার উপর বসিয়া সে দিন কি করিতেছিলেন, এবং এই কদাকার ভিক্ষুকের সহিত তাহার কি সম্বন্ধ?

 ডাক্তারের এই কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গাড়ী একখানি বৃহৎ অট্টালিকার দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাকিবামাত্র ভিতর হইতে একজন চাকর তৎক্ষণাৎ বাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল। ডাক্তার গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম। বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া আমরা বাহিরের বৈঠকখানায় উপবেশন করিলাম ও পরিচারকের দ্বারা সংবাদ প্রদান করিলে, বাটীর গৃহিণী প্রায় বিংশ বৎসর বয়স্কা সুন্দরী এক রমণী অতি আগ্রহের সহিত আমরা যে স্থানে বসিয়াছিলাম, তাহার পার্শ্বের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও অন্তরাল হইতে তাহার সেই পুত্রের দ্বারা আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার স্বামীর কি আর কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গিয়াছে? তাঁহার মৃতদেহ কি বাহির হইয়াছে?

 উত্তরে ডাক্তার কহিলেন, “না। এখনও পর্য্যন্ত তাঁহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই বা মৃতদেহেরও কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। সেই ফকির আর কোন কথা বলিতেছে না। আমরা আপনাকে আরও দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি।”

 উত্তরে রমণী কহিলেন, “আপনারা মুক্তকণ্ঠে আমাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। আমি যাহা কিছু অবগত আছি, তাহার সমস্তই অকপটে আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিব। আপনারা যেরূপ কষ্ট সহ্য করিয়া আমার কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন, তাহাতে ঈশ্বর আপনাদিগের মঙ্গল করিবেন।”

 উহার কথা শুনিয়া ডাক্তার বলিলেন, “আমাদের কথা বলিবেন না। এ কার্য্য আমাদের চির অভ্যন্ত। আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা প্রাণপণে আপনার সাহায্য করিব বলিয়া আমার বন্ধুর সহিত এখানে আসিয়াছি। যদি আমি কোন উপকার করিতে পারি, তাহা হইলেই আপনাকে কৃতার্থ মনে করিব।”

 ডাক্তার এই কথা বলিলে তিনি যেন কতকটা আশ্বস্ত হইয়া আমাদিগকে বলিলেন, “বাবা! আজ আমি আপনাদিগকে একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। আপনারা সত্য করিয়া উহার উত্তর দিন।”

 ডাক্তার। কি কথা বলুন? আমি তাহার উত্তর দিতেছি।

 রমণী। আপনাদিগের উত্তরে আমার অন্তর কাতর হইবে, এরূপ মনে করিয়া যেন সত্য কথা বলিতে বিচলিত হইবেন না। সত্য কথা অপ্রিয় হইলেও আমার নিকট বলিতে বিমুখ হইবেন না। ঠিক বলুন দেখি, অনুসন্ধানে আপনারা যতদূর অবগত হইয়াছেন, তাহাতে আমার স্বামী জীবিত আছেন কি মরিয়া গিয়াছেন? এ সম্বন্ধে আপনাদিগের অন্তরের অন্তরে কিরূপ ধারণা হইয়াছে তাহা আমাকে ঠিক করিয়া বলুন?

 ডাক্তার। সত্য কথা বলিতে গেলে, আমার মতে তিনি ইহলীলা সম্বরণ করিয়াছেন, ইহা আমাদের বিশ্বাস।

 রমণী। তবে কি আপনি মনে করেন যে, তিনি আর জীবিত নাই। তিনি আমায় একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছেন?

 এই বলিয়া রমণী এক সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি পুনরায় কহিলেন, “তাহা হইলে কি আমার স্বামী সেই মুসলমান ফকির কর্ত্তৃকই হত হইয়াছেন?”

 ডাক্তার। সে বিষয়ে আমি এখন নিশ্চয় করিয়া কোন কথা বলিতে পারিতেছি না; তবে বোধ হয়, কেহ তাহাকে খুন করিয়াছে। নতুবা এই কয় দিবস পর্য্যন্ত তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না কেন?

 রমণী। আমার মনে এখন কেমন একটু সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে, আজ আমি এই চিঠীখানি প্রাপ্ত হইয়াছি; যদি তিনি ইহজীবন পরিত্যাগ করিতেন, তাহা হইলে এই চিঠী কিরূপে আজ আমার হস্তগত হইত?

 আমার বন্ধু, রমণীর এই কথা শুনিয়া যেন বজ্রাহত হইলেন। তিনি কোনরূপ কথা কহিতে পারিলেন না। অনেকক্ষণ পর তিনি সহসা বলিয়া উঠিলেন, “আপনি কি বল্‌ছেন?”

 রমণী। হাঁ, আজই এই পত্র পেয়েছি, এই দেখনা বাবা?

 ডাক্তার। পত্রখানি আমি কি পড়্‌তে পারি?

 রমণী। নিশ্চয়ই! আপনাদিগকে উহা দেখাবার জন্যই ত আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিলাম।

 ডাক্তার পত্রখানি অতি ব্যগ্রভাবে গ্রহণ করিলেন। পরে একবার চারিদিক বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন যে, পত্রখানি সেই তারিখেরই। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক দেখিবার পর তিনি উহা আমার হস্তে প্রদান করিলেন, আমি, উহা পড়িয়া দেখিলাম। তখন তিনি কহিলেন, “আপনার স্বামীর লেখা আপনি চেনেন?

 “হাঁ, আমি তাঁর লেখা চিনি।”

 “এ লেখা কি তার?”

 “না, ওর ভিতর অপর কাগজে তার হাতের লেখা আছে।”

 ডাক্তার। দেখ্‌ছি, যে খামের উপর নাম লিখেছে, তাহাকে ঠিকানা জানিবার নিমিত্ত অপরের নিকট যাইতে হইয়াছিল, সে নিশ্চয়ই নিজে ঠিকানা জানিত না।

 রমণী ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন করিয়া আপনি উহা জানিতে পারিলেন?”

 “কেন? আপনি দেখুন, নামটী সম্পূর্ণ কাল কালীতে লেখা যাহা আপনিই শুকাইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ উহাতে ব্লটিং কাগজ ছাপা হয় নাই। আর অবশিষ্ট অংশ এক রকম ফিকে রংয়ের। দেখ্‌লেই বুঝ্‌তে পারবেন যে, উহার উপর ব্লটিং কাগজ দিয়া ছাপা হইয়াছে। ইহা দ্বারা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, লোকটী প্রথমে নাম লিখিয়া, ঠিকানা জানিবার জন্য অন্যত্র গিয়াছিল। নাম আপনিই শুকাইয়া যায়, পরে সে ঠিকানা জানিয়া আসিয়া উহা খামে লিখিয়া ব্লটিং কাগজ দিয়া ছাপিয়াছে।”

 “আপনি নিশ্চয় বলিতে পারেন না যে, ইহা আপনার স্বামীর হস্তাক্ষর?”

 রমণী। হাঁ, আমি যথার্থ বলিতেছি যে, এখানা আমার স্বামীর লেখা।

 ডাক্তার আর কোন কথা না জিজ্ঞাসা করিয়া পত্র পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। পত্রে লেখা এই:—  প্রিয়তম! আমার হঠাৎ অদর্শনে ভীত হইও না। শীঘ্রই সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া যাইবে। এক মহা সমস্যা ঘটিয়াছে, সেই জন্য এই ব্যাপার!

তোমারই নরেন।

 পত্র পাঠ করিয়া ডাক্তার আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আবার জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনি সত্য করিয়া বলুন, উহা আপনার স্বামীর হস্তাক্ষর কি না?”

 রমণী। হাঁ বাবা, আমি মিথ্যা বলিব কেন?

 ডাক্তার। আজই এই পত্র ডাকে ফেলা হইয়াছে। পোষ্ট অফিসের ষ্ট্যাম্পে আজিকার তারিখ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। মা, বিশেষ সন্দেহ হইতেছে। আজ আমার চিন্তা করিতে সময় দিন। বোধ হয় কালই আপনাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারিব।

 রমণী। আচ্ছা বাবা! একটী কথা জিজ্ঞাসা করি। এখন তোমার কি মত? তিনি জীবিত আছেন ত?

 ডাক্তার। যদি এই পত্র নকল না হয়, তবে তিনি নিশ্চয়ই জীবিত আছেন। তবে একটী কথা—পত্রখানি তিনি মৃত্যুর পূর্ব্বেও লিখিতে পারেন। এইরূপ হইতে পারে যে, হয় ত তিনি মরিবার পূর্ব্বে পত্রখানি লিখিয়া কোন লোককে ডাকে দিবার নিমিত্ত দিয়াছিলেন, লোকটী সে দিন ভুলিয়া গিয়াছিল, আজ দিয়াছে।

 এই কথা শুনিয়া রমণী হতাশ হইয়া বলিলেন, “হাঁ, তাহাও হইতে পারে। কিন্তু তা বলিয়া বাবা, আমায় এমন করিয়া হতাশ করিও না। আমার মন কিন্তু বলিতেছে, যে তাঁহার কিছুই হয় নাই। সে দিন তাঁর ছুরিতে হাত কাটিয়া যায়। আমি সে সময় নিকটে ছিলাম না। রন্ধনশালায় আহার করিতেছিলাম। সহসা মন কেমন বিচলিত হইয়া উঠিল। ভাবিলাম, যেন কাহার কি হইয়াছে। আর আহার করিতে ভাল লাগিল না। তখনই শয়নকক্ষে গিয়া দেখি, আমার স্বামীর হাত কাটিয়া রক্তে রক্তারক্তি হইয়াছে। সেই জন্যই বল্‌ছি যে, যাঁর একটা হাত কেটে গেলে আমার প্রাণ এত অস্থির হয়, তার মৃত্যু হইলে আমার প্রাণ কি স্থির থাক্‌তে পারে। তিনি নিশ্চয়ই জীবিত আছেন।”

 ডাক্তার। মা, আপনি যা বলিতেছেন, তাহা বাস্তবিকই সত্য কথা। কিন্তু মা, যদি আপনার স্বামী জীবিতই আছেন এবং চিঠি লিখ্‌তে পারেন, তবে তিনি কি কারণে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতেছেন না? এমন কি ব্যাপার ঘটিল, যাহাতে তিনি তোমায় দেখা দিতে পারিতেছেন না?

 রমণী। সেটা আমি বল্‌তে পারি না। ভাব্‌তেও পারি না। ওকথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।

 ডাক্তার। সোমবার দিন যখন তিনি যান, তখন কোন কথা বলে যান নাই?

 রমণী। না বাবা।

 ডাক্তার। আপনি নিশ্চয়ই তাঁকে গুলির আড়ায় দেখে আশ্চর্য্য হয়েছিলেন।

 রমণী। নিশ্চয়ই!

 ডাক্তার। আচ্ছা, জানালা কি খোলা ছিল।

 রমণী। হাঁ।

 ডাক্তার। তা হ’লে তিনি তোমায় ডাকতে পার্‌তেন।

 রমণী। হাঁ, নিশ্চয়ই পার্‌তেন।

 ডাক্তার। আপনি বলেছিলেন যে, তিনি কেবল একটা অস্পষ্ট শব্দ করেছিলেন।

 রমণী। হাঁ বাবা।

 ডাক্তার। সেটা কি আপনি ভেবেছিলেন যে, তিনি আপনাকে সাহায্যের জন্য ডাক্‌ছেন।

 রমণী। হাঁ বাবা। তিনি যে তাঁর হাতও তুলেছিলেন।

 ডাক্তার। কিন্তু মা, সে হাত তোলাটা আশ্চর্য্যও হতে পারে। লোকে আশ্চর্য্য হলেও হাত তুলে থাকে, আপনাকে হঠাৎ সেখানে দেখে আশ্চর্য্যান্বিত হয়েও তিনি হাত তুল্‌তেও পারেন।

 রমণী। সম্ভব বটে।

 ডাক্তার। আপনি সে গৃহে অপর কোন লোক ত দেখেন নাই?

 রমণী। না।

 ডাক্তার। আচ্ছা, আপনি যখন আপনার স্বামীকে দেখেন, তখন তাহাকে সজ্জিত দেখেছেন কি?

 রমণী। না, বোধ হয় তিনি তখন কাপড় ছাড়্‌ছিলেন।

 ডাক্তার। আপনার স্বামীকে ইতিপূর্ব্বে ঐ গুলির আড্ডার কথা বলিতে শুনিয়াছেন কি?

 রমণী। না।

 ডাক্তার। কখনও কি তিনি আফিং খান। ইহা আপনি জান্‌তে পেরেছেন?

 রমণী। না, কখনও না।

 এইরূপ কথাবার্ত্তা হইবার পর আমি ও আমার বন্ধু সেই সময় সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

 এখন কিরূপে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান আবশ্যক তাহারই চিন্তা করিবার নিমিত্ত আমরা আপনাপন স্থানে গমন করিলাম। আপন বাসায় উপনীত হইয়া আহারাদি সমাপনান্তে একটু নিদ্রা যাইবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু কোনরূপেই নিদ্রা-সুখ অনুভব করিতে পারিলাম না, এই অনুসন্ধান সম্বন্ধীয় নানারূপ চিন্তায় প্রায় সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। প্রত্যুষে অতি সামান্য মাত্র নিদ্রা আসিয়া আমাকে আশ্রয় করিল, কিন্তু তাহাও অধিকক্ষণ স্থায়ী হইতে পারিল না।

 প্রত্যুষে ডাক্তারের কণ্ঠস্বর আমার কর্ণগোচর হইল। তিনি আমাকে ডাকিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন, “ভোর হয়েছে, উঠ, আর কেন?”

 ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। আমি উঠিলাম ও ডাক্তারের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম; ডাক্তারকে কহিলাম, “আমার সঙ্গে এক যায়গায় যাইতে রাজী আছ?”

 ডাক্তার। নিশ্চয়ই! সে কথা আবার জিজ্ঞাসা কচ্ছো।

 আমি। তবে আমি শীঘ্র প্রস্তুত হইয়া আসিতেছি। এই বলিয়া ডাক্তারকে সেই স্থানে বসিতে বলিয়া আমি ভিতরে গমন করিলাম ও অতি অল্পকাল মধ্যেই প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া একটী ব্যাগ হস্তে ডাক্তারের নিকট আগমন করিলাম। ডাক্তার যে গাড়ীতে আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন, সেই গাড়ীতে তাহার সহিত উঠিলাম। শীঘ্রই গাড়ী চলিতে লাগিল। যাইতে যাইতে পথে ডাক্তার আমায় বলিলেন, “এখন কোথায় গমন করিতে ইচ্ছা করিতেছ?”

 আমি। তুমি একজন গণ্ডমূর্খের ন্যায় কার্য করিয়াছ বলিয়া

আমার বোধ হইতেছে। আমার বোধ হয়, তুমি প্রথমত বিষম ভ্রমে পতিত হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছ। যেরূপ অনুমান হইতেছে তাহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার সমস্ত গোলযোগ এখনই শেষ হইয়া যাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা।

 আমার কথায় ডাক্তার কোন উত্তর করিলেন না। আমি যে কেন এরূপ মতামত প্রকাশ করিতেছি, তাহাও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিলেন না। কথায় কথায় আমরা হাজত-গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে আমরা উভয়েই বিশেষ পরিচিত। উপস্থিত হইবামাত্র একজন কর্ম্মচারী আসিয়া আমাদিগের নিকটে উপস্থিত হইলেন ও আমাদিগকে সম্ভাষণ করিয়া আমাদিগের সেই সময়ে সেই স্থানে উপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

 আমি। একবার গোপনে আপনাকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

 কর্ম্ম। আসুন, আমার কামরায় আসুন। সেখানে আপনার যাহা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন।

 আমি আমার বন্ধুর সহিত সেই কর্ম্মচারীর অফিস-কামরায় যাইলাম। ঘরটী বেশ পরিষ্কার, একটী ছোট টেবিল, তাহার উপর দোয়াত, কলম, একটা কাগজ রাখা বাক্স এবং আরও দুই একটী আবশ্যকীয় জিনিষ রহিয়াছে। আমরা গিয়া এক একখানি আসন অধিকার করিয়া বসিলাম।

 সকলে উপবেশন করিলে হাজত-গৃহের সেই কর্ম্মচারী আমাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এখন বলুন, আমি আপনার কি উপকার করিতে পারি?”

 আমি। সেই কদাকার ভিক্ষুককে দেখিতে আসিয়াছি, যে ব্যক্তি নরেন্দ্র বাবুকে খুন করিয়াছে বলিয়া আপনার নিকট হাজতে রহিয়াছে।

 কর্ম্ম। হাঁ হাঁ, সে ত এখানেই আছে।

 আমি। কোথায়?

 কর্ম্ম। একটী ঘরে।

 আমি। সে কি শান্ত প্রকৃতির লোক? না কোনরূপ উৎপাত করে?

 কর্ম্ম। সে বড় শান্ত। এ পর্য্যন্ত আমাদের কোন কষ্ট দেয় নাই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তার মত অপরিষ্কার জীব বোধ হয় পৃথিবীতে আর নাই।

 আমি। বলেন কি! সে কি এতই অপরিষ্কার!

 কর্ম্ম। হাঁ, আমার ইচ্ছা এই যে, তাহার বিচার হয়ে গেলে একবার তাহাকে আচ্ছা করে স্নান করিয়ে দিতে হবে। আপনি যদি এখন তাহাকে একবার দেখেন, তাহলে আপনিও আমার মতে মত দিবেন।

 আমি। আমারও বড় ইচ্ছা যে, এখন একবার তাহাকে দেখি।

 কর্ম্ম। সত্য না কি? ইহা অতি সহজ কার্য্য। আমার সহিত আসুন, আমি তাহাকে দেখাইয়া দিতেছি।

 কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া, আমি আমার যে ব্যাগটী সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই ব্যাগটী হস্তে লইয়া গাত্রোত্থান করিলাম। উহা দেখিয়া, হাজত-গৃহের সেই কর্ম্মচারী কহিলেন, “ও কি! ও ব্যাগ লইয়া আস্‌বার দরকার নাই। আমার ঘরে চোর থাক্‌বার সম্ভাবনা নাই। আপনি আপনার ব্যাগটীকে আমার ঘরে রেখে আসুন। মিছামিছি কষ্টভোগ করিবার প্রয়োজন কি?”

 আমি। এই ব্যাগটায় আমার বিশেষ দরকার আছে। এটাকে নিয়েই তার কাছে যাওয়া যাক চল।

 কর্ম্ম। ভাল! আপনার যাহা ইচ্ছা। আসুন, আপনি আমার সহিত এদিকে আসুন, আমি আপনাকে তাহার কাছে লইয়া যাইতেছি। এই কথা বলিয়া সেই হাজতের কর্ম্মচারী আমাদিগকে কয়েদীয় গৃহে লইয়া গেলেন।

 আমরা নিকটে গিয়ে দেখিলাম লোকটী নিদ্রিত। কামরা বাহির হইতে আবদ্ধ। কর্ম্মচারী উহাকে নিদ্রিত দেখিয়া আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “আপনার আসামী গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। এই সুযোগে আপনি ভাল করিয়া দেখিয়া লউন।”

 কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া আমিও ডাক্তারের সহিত রেলের ভিতর দিয়া উহাকে দেখিতে লাগিলাম। কয়েদী আমাদের দিকেই মুখ ফিরাইয়া নিদ্রা যাইতেছিল। ভাবভঙ্গী, অঙ্গের সৌষ্টব ও নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কার্য্য দেখিয়া তাহাকে দোষী বলিয়া বোধ হয় না। আমার বন্ধুর সহিত অনেক দোষী ও কয়েদীর আকৃতি অনেকবার দেখিয়াছি ও উহাদিগের আকৃতি দেখিয়া উহাদিগের মনের ভাব অনুমান করিবার কেমন একটু ক্ষমতাও জন্মিয়াছে বলিয়া আমাদিগের বিশ্বাস। সেইজন্যই দেখিবামাত্র তাহাকে যেন কেমন নির্দ্দোষী বলিয়া বোধ হইল।

 লোকটী অধিক দীর্ঘ বা খর্ব্ব নহে। সাধারণত ভিক্ষুকের যেরূপ বেশভূষা হইয়া থাকে, ইহার বেশভূষা তদপেক্ষাও অনেক অংশে হীন। গাত্রে একটী শতগ্রন্থি অতি পুরাতন জামা রহিয়াছে। গাত্র অত্যন্ত মলিন। দেখিলেই বোধ হয়, যেন একপুরু ময়লা জমিয়া গিয়াছে। মুখে যেন একটী কাটার দাগ, তাহার উপর আবার ঠোঁট উল্টান থাকায় তাহার বিশ্রী আকৃতি আরও কুৎসিত হইয়াছে।

 যখন আমরা আসামীকে এইরূপে দেখিতেছিলাম, তখন সেই কর্ম্মচারী আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কেমন? আমি যাহা বলিতেছিলাম, তাহা সত্য নয় কি? এমন সুপুরুষ আর কোথাও দেখেছেন কি? অনেক অনেক কদাকার পুরুষ দেখিয়াছি কিন্তু এরূপ কদাকার ব্যক্তিকে আমি যে কখন দেখিয়াছি তাহা আমার অনুমান হয় না।” এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি সেই কর্ম্মচারীকে কহিলাম, “আমি ইচ্ছা করি, লোকটাকে একবার পরিষ্কার করিয়া দিয়া দেখি যে, উহাকে কিরূপ দেখায়, আমি মনে মনে এই অভিপ্রায় করিয়াছি। এই ব্যাগে স্নানের আবশ্যকীয় সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি, এখন আপনি যদি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া এই কামরার দরজা খুলিয়া দেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ বাধিত হই।” এই বলিয়া আমি একখানি স্পঞ্জ বাহির করিলাম, সেই স্পঞ্জখানা এবং সেই ব্যাগের মধ্যে অন্যান্য দ্রব্যগুলি দেখিয়া কর্ম্মচারী সহসা হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। মুখে বলিলেন, “আপনার চিরকালই সমান গেল। আসুন, আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই। আপনি ত অনেক দেখিয়াছেন, বলুন দেখি, এই হাজতগৃহে এমন কুৎসিত আসামী ইতিপূর্ব্বে আর কখন আসিয়াছে কি? ওরূপ কদাকার লোক আমার হাজতের কলঙ্ক-স্বরূপ।”

 আমরা আর সময় নষ্ট না করিয়া ধীরে ধীরে সেই কামরায় প্রবেশ করিলাম। আসামী প্রথমে আমাদিগকে দেখিয়া পার্শ্বপরিবর্ত্তন করিল, পরে আবার নিদ্রা যাইবার জন্য মুখ ফিরাইয়া কম্বলের উপর মস্তক ন্যস্ত করিল। আমি তাহাকে উঠাইয়া তাহাকে একবারে বিবস্ত্র করিয়া ফেলিলাম ও একখানি বড় স্পঞ্জ জলসিক্ত করিয়া তাহাকে উত্তমরূপে ঘর্ষণ করিতে লাগিলাম। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ ঘর্ষণ করিতে করিতে ঐ ফকিরের অঙ্গস্থিত সমস্ত ময়লা ইত্যাদি দূর হইয়া গেল, সে তখন অপর রূপ ধারণ করিল। ডাক্তার এই অবস্থা দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিতের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আমার বোধ হইতেছে, ইনিই নরেন্দ্রকৃষ্ণ।” যতবার আমি স্পঞ্জ দিয়া আসামীর গাত্র ঘর্ষণ করিতে লাগিলাম, ততবারই যেন গাত্র হইতে এক এক পুরু ছাল উঠিয়া আসিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই কদাকার দেহের সমুদায় ময়লা উঠিয়া গেল, সেই উল্টান ঠোঁট কোথায় অদৃশ্য হইল। চুলের লাল দাগ তখনই যেন কোথায় চলিয়া গেল এবং তাহার পরিবর্ত্তে অতি সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ শোভা পাইতে লাগিল, অমন মলিন মুখ সুন্দর হইল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেমন কদাকার লোক যেন সুন্দর যুবকে পরিণত হইল। আসামী এতক্ষণ কোন কথা কহে নাই। কিন্তু যখন দেখিল, যে তাহার ছদ্মবেশ একেবারে অদৃশ্য হইল, তখন সে চীৎকার করিতে করিতে সেই স্থানের কম্বলের মধ্যে তাহার মস্তক লুকাইবার চেষ্টা করিল।

 এই সকল ব্যাপার দেখিয়া ডাক্তার আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিল, “কি আশ্চর্য্য! এই লোককেই পাওয়া যাইতেছে না। আমি ইহার আকৃতি ছবিতে দেখিয়াছি। এমন কি, উহার ফটো এখনও আমার নিকট আছে। এই সেই নরেন্দ্রকৃষ্ণ?” আসামী তখন সাহসী হইয়া বলিল, “আচ্ছা, যদি তাই হয়, যদি আমিই সেই লোক বলিয়া সাব্যস্ত হই, তবে আর কেন আমায় কষ্ট দেন। কিজন্য আমায় কয়েদ করা হইয়াছে বলুন?”

 ডাক্তার। নরেন্দ্র বাবুকে খুন করিবার জন্য। কিন্তু যখন তুমিই সেই নরেন্দ্রবাবু, তখন তোমাকে আর সে দোষে দোষী কয়া যাইতে পারে না। যাহা হউক, আমি প্রায় সাতাশ বৎসর পুলিসের কার্য্য করিতেছি, কিন্তু এরূপ আশ্চর্য্য ঘটনা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।

 নরেন্দ্র। এখন সে সকল কথা ছাড়িয়া দিন। এখন আমি বলিতেছি যে, যদি আমিই নরেন্দ্রবাবু হই, তাহা হইলে নরেন্দ্র বাবুকে খুন করিয়াছি বলিয়া আমাকে যে কয়েদ করা হইয়াছে, তাহা ন্যায়সঙ্গত হইয়াছে কি?

 আসামীর কথা শুনিয়া আমার বন্ধু বলিল, “তুমি কোন দোষ কর নাই সত্য বটে কিন্তু এক মহা ভ্রম করিয়াছ। তোমার এ কার্য্য তোমার স্ত্রীকে বলিয়া রাখ নাই কেন? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এরূপ গোপনীয় কার্য্য থাকিতে পারে তাহা আমিও জানিতাম না।

 নরেন্দ্র। আপনি যথার্থ বলিয়াছেন; কিন্তু আমি আমার সন্তানগণকে আমার এই অবস্থা জানাব না বলিয়াই একার্য্য ঘটিয়াছে। হা ভগবান! কি পাপ বশতঃ আজ আমার এতাদৃশ অপমানিত করিলে? এখন আমি কি করিব? এবার যে সকলেই জানিতে পারিবে। আর যে আমার স্ত্রী বা পুত্রকন্যাগণের মধ্যে কেহই বিশ্বাস করিবে না।

 আসামীর খেদোক্তি শ্রবণ করিয়া আমার বন্ধুর দয়া হইল। তিনি বলিলেন, “যদি এই ব্যাপার আদালতে যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই এ সকল সংবাদ সকলেরই শ্রুতিগোচর হইবে। কিন্তু যদি এরূপ বলিতে পার যে, তোমার বিরুদ্ধে পুলিসের আর কোন আধিপত্য নাই অর্থাৎ তুমি যদি এরূপ প্রমাণ করিতে পার যে, তুমি আর কোন দোষে দূষিত নহ, তাহা হইলে এসকল সমাচার সংবাদ পত্রে বাহির না হইলেও হইতে পারে। আমি জানি, এই কর্ম্মচারীও অতি ভদ্র, ইনি কখনই অন্যায়রূপে কাহারও প্রতি অত্যাচার করেন না। আজ যদি তুমি তোমার এই ভ্রমের বিষয় বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলিতে পার, তাহা হইলে হয়ত ইনি তোমায় মুক্তি দিতে পারেন।”