বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/দয়াশীলতা

উইকিসংকলন থেকে

দয়াশীলতা

ইংলণ্ডের অধীশ্বর তৃতীয় জর্জের জননী অত্যন্ত দয়াশীল ছিলেন, পরের দুরবস্থা শুনিলে সাধ্যানুসারে তদ্বিমোচনে যত্নবতী হইতেন। তিনি অবাধে সংবাদপত্র পাঠ করিতেন। ১৭৪২ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, এক ব্যক্তি এই মর্ম্মে বিজ্ঞাপন প্রচারিত করিয়াছিলেন যে, “আমি কিছুকাল সৈন্যসংক্রান্ত কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলাম, এক্ষণে দুর্ঘটনাক্রমে যার পর নাই দুরবস্থায় পড়িয়াছি, আমার পরিবার আছে, তাহাদেরও অত্যন্ত দুর্গতি ঘটিয়াছে। যাঁহাদের দয়া ও পরের দুঃখ দূর করিবার ক্ষমতা আছে, তাঁহাদের পক্ষে এই বিজ্ঞাপনই যথেষ্ট। তাদৃশ ব্যক্তিরা অমুকস্থানে আসিলে, আমার পূর্ব্বতন ও ইদানীন্তন অবস্থার সবিশেষ পরিচয় পাইতে পারিবেন।”

 বিজ্ঞাপন দৃষ্টিগোচর করিয়া, রাজজননী নির্দ্দিষ্ট স্থানে গিয়া স্বচক্ষে তাহার অবস্থা দেখিবেন, ও স্বকর্ণে তাহার দুঃখের কথা শুনিবেন, স্থির করিলেন। রাজপথে বহির্গত হইলে, কেহ তাঁহারে জানিতে না পারে, এজন্য তিনি সামান্য বেশে, সামান্য যানে আরোহণ করিয়া, এবং একমাত্র সহচরী সমভিব্যাহারে লইয়া প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি তাহার আলয়ে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, একটি স্ত্রীলোক শয়ন করিয়া আছে, রোগ, শোক ও দৈন্যবশতঃ, তাহার শরীর অত্যন্ত শীর্ণ ও বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, বক্ষঃস্থলে একটি অতি অল্পবয়স্কা বালিকা শয়ন করিয়া আছে, তাহার আকার জননীর অপেক্ষাও শীর্ণ ও বিবর্ণ, নয়ন দুটি মুদ্রিত, দেখিয়া বোধ হইল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে, গৃহের একপার্শ্বে একটি হীনবেশ ম্লানমুখ পুরুষ, শীর্ণকায় শিশু-সন্তান ক্রোড়ে লইয়া, স্নেহপূর্ণ ও শোকাকুললোচনে তাহার মুখনিবীক্ষণ করিতেছে।

 গৃহপ্রবেশপূর্ব্বক সেই নিতান্ত নিৰুপায় পরিবারের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করিবামাত্র রাজজননী এত দুঃখিত ও ব্যথিত হইলেন যে, আর অগ্রসর হইতে পারিলেন না, স্বীয় সহচরীর হস্তধারণ, করিয়া সেই স্থানেই দণ্ডায়মান রহিলেন। ইতঃপূর্ব্বে ঈদৃশ হৃদয়বিদারণ ব্যাপার কখনও তাঁহার নয়নগোচর হয় নাই। গৃহস্বামী তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র, চকিত হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন, শিশুসন্তানটাকে তাহার মৃতকল্পা জননীর পার্শ্বদেশে রাখিয়া দিলেন এবং তাঁহাদের সম্মুখবর্ত্তী হইয়া সাদরবচনে বসিবার অভ্যর্থনা করিলেন। রাজজননী, আমরা বসিতেছি, তুমি ব্যস্ত হইও না, এই বলিয়া আসনপবিগ্রহ করিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে, তাহার সহচরী আগমন-প্রয়োজন ব্যক্ত করিলেন। তিনি গৃহস্বামীকে বলিলেন, আমরা সংবাদপত্রে আপনকার বিজ্ঞাপন দেখিয়াছি, এবং বিজ্ঞাপনপত্রে যেরূপ লিখিত ছিল, তদনুসারে আপনকার অবস্থার সবিশেষ বিবরণ জানিবার নিমিত্ত আসিয়াছি। তিনি শুনিয়া বিনীতভাবে বলিলেন, আপনারা যে এই দীনের প্রতি দয়া করিয়া এ পর্যন্ত আগমন করিয়াছেন, ইহাতে আমি চরিতার্থ হইলাম, বোধ হয়, আজ আমার দুঃখের নিশার অবসান হইল। আমার দুরবস্থা আপনারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিলেন, তাহার আর পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই। কি কারণে আমি এই দুঃসহ দুরবস্থায় পড়িয়াছি, তাহার সবিশেষ বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন,—

 আমি এক রেজিমেণ্টে এনসাইনের পদে নিযুক্ত ছিলাম, আপন কার্য্যে যথোচিত যত্ন ও পবিশ্রম করাতে, অল্পদিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহভাজন হইলাম। তদ্দর্শনে আমার সমকক্ষ কতিপয় ব্যক্তির অন্তঃকরণে ঈর্ষার উদয় হইল। ঈর্ষার বশীভূত হইয়া, তাহারা আমার অনিষ্টচেষ্টা করিতে লাগিল। তাহাদের মধ্যে একজন অতি উদ্ধতস্বভাব ছিল। সে অকারণে অথবা অতি সামান্য কারণে, আমার নিকট দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তাব পাঠাইল। তাদৃশ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবার বিশিষ্ট হেতু না দেখিয়া, আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম না। এই উপলক্ষে তাহারা আর কতকগুলি লোক লইয়া চক্রান্ত করিল, এবং যাহাতে আমি অবমানিত ও পদচ্যুত হই, অনন্যকর্ম্মা হইয়া, কেবল সেই চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহারা একপরামর্শ হইয়া, সেনাপতির নিকটে আমার কুৎসা করিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলিল, আমি কাপুরুষ, কেহ বলিল, আমি পরনিন্দক, কেহ বলিল, আমি অকর্ম্মণ্য লোক। সেনাপতির আদেশ অনুসারে আমার চরিত্রবিষয়ে অনুসন্ধান আরব্ধ হইল। অনেকেই আমার বিপক্ষ, কৌশল করিয়া আমায় দোষী সপ্রমাণ করিয়া দিল। আমি পদচ্যুত হইলাম। জর্ম্মনিদেশে এই ঘটনা হয়। কর্ত্তৃপক্ষের নিকট বিচার প্রার্থনায় আমি অবিলম্বে ইংলণ্ডে প্রত্যাগমন করিলাম। কিন্তু, কেহ সহায় না থাকাতে, কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না। কর্তৃপক্ষ আমার প্রার্থনায় কর্ণপাত করিলেন না। সুতরাং এই স্থলেই আমার আশালতা নির্মূল হইল। সেই সময়েই আমার সহধর্ম্মিণী উৎকট রোগে আক্রান্ত হইলেন। নিতান্ত অসঙ্গতিপ্রযুক্ত তাঁহার চিকিৎসা করাইতে পারিলাম না। সতত জননীর নিকট থাকিয়া, ও আবশ্যকমত আহারাদি না পাইযা, পুত্ত্র ও কন্যাটিও ঐ রোগে আক্রান্ত হইয়াছে। যদিও বিষম বিপদে ও দুরবস্থায় পড়িয়াছি, কিন্তু নিতান্ত অপদার্থ হইয়া, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে প্রবৃত্তি হইল না। অবশেষে উপায়ান্তর দেখিতে না পাইয়া, নিতান্ত হতাশ, শোকাকুল ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারিত করিলাম।

 এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া, রাজজননীর অন্তঃকরণে অতিশয় দয়ার উদয় হইল। তিনি তৎক্ষণাৎ গৃহস্বামীর হস্তে দশটি গিনি দিলেন, এবং আত্মপরিচয় প্রদান করিয়া বলিলেন, যাহাতে তোমার পক্ষে যথার্থ বিচার হয়, তাহা আমি করিব, তুমি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকিবে। গৃহস্বামী তাঁহার পরিচয় শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং জানু পাতিয়া উপবিষ্ট ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, তদীয় দয়া, সৌজন্য ও অনুগ্রহ প্রদর্শনের নিমিত্ত ধন্যবাদ প্রদান করিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু রাজ জননী তৎক্ষণাৎ সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, স্বীয় সহচরী সমভিব্যাহারে যানারোহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।

 রাজজননী গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া, সৈন্যসংক্রান্ত কর্ম্মের অধ্যক্ষকে ডাকাইলেন, এবং পূর্ব্বোক্ত পদচ্যুত ব্যক্তির দুরবস্থার সবিশেষ বর্ণন করিয়া, তাঁহার পক্ষে যথার্থ বিচার করিবার নিমিত্ত বলিয়া দিলেন। সপ্তাহ অতীত না হইতেই, সে ব্যক্তি লেপ্টেনেণ্টপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। তিনি যে রেজিমেণ্ট কর্ম্ম পাইলেন, উহা অবিলম্বে ফ্রাণ্ডর্স প্রদেশে প্রস্থান করিবে, এজন্য রাজজননী তাঁহাকে বলিলেন, তুমি নিরুদ্বেগে প্রস্থান কর, আমি তোমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যার সমস্ত ভার লইলাম, যতদিন তুমি প্রত্যাগমন না কর, আমি তাহাদের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করিব। তদনুসারে সে ব্যক্তি নিশ্চিন্ত হইয়া, রেজিমেণ্ট সমভিব্যাহারে প্রস্থান করিলেন, এবং নিজ কার্য্যে বিলক্ষণ দক্ষতাপ্রদর্শন করাতে, কর্ত্তৃপক্ষের অনুগ্রহে অল্পকালমধ্যে মেজরপদে অধিরূঢ় হইযা, স্বদেশে প্রত্যাগত হইলেন।