বিষয়বস্তুতে চলুন

আশাকানন/দ্বিতীয় কল্পনা

উইকিসংকলন থেকে

[কর্ম্মক্ষেত্র—ছয় দ্বার—ছয় জন প্রহরী কর্ত্তৃক রক্ষিত—পুরী-পরিক্রম—প্রতি দ্বারে প্রহরীর আকৃতি ও প্রকৃতি দর্শন। ১ম দ্বারে শক্তি, ২য় দ্বারে অধ্যবসায়, ৩য় দ্বারে সাহস, ৪র্থ ধারে ধৈর্য্য, ৫ম দ্বারে শ্রম, ৬ষ্ঠ দ্বারে উৎসাহ—পুরীমধ্যে প্রবেশ—পুরীদর্শন—পুরীর মধ্যভাগে যশঃশৈল।]

চৌদিকে প্রাচীর অপূর্ব্ব নগরী
পাষাণে রচিত কায়া,
নিরখি সম্মুখে বিশাল বিস্তৃত
প্রকাশিয়া আছে ছায়া;
প্রাচীর-শিখরে প্রাণী শত শত
নিরখি সেখানে কত
বিচিত্র সুন্দর সামগ্রী ধরিয়া
ভ্রমে সুখে অবিরত;
নিম্নদেশে প্রাণী করি উর্দ্ধ মুখ
কতই আকুল মন
চাহিয়া উচ্চেতে অধীর হইয়া
সদা করে নিরীক্ষণ—
রাজ-পরিচ্ছদ রাজ-সিংহাসন
সুবর্ণ রজত কায়,
প্রবাল মাণিক্য মণ্ডিত হীরক
কত দ্রব্য শোভা পায়।
আশা কহে “বংস, অপূর্ব্ব এ পুরী
আমার কাননে ইহা,
প্রবেশে ইহাতে প্রাণী নিত্য নিত্য
মিটাতে প্রাণের স্পৃহা,
এ পুরী পশিতে আছে ছয় দ্বার,
ছয় দ্বারী আছে দ্বারে।
কেহ সে ইহাতে আদেশ বিহনে
প্রবেশিতে নাহি পারে;

আ(ই)সে যত জন প্রবেশ-মানসে
সেই পথে করে গতি,
যে পথে যাহারে করিতে প্রবেশ
দ্বারী করে অনুমতি।
দ্বারে দ্বারে হের মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে
আ(ই)সে প্রাণী কত জন,
একে একে সবে প্রতি দ্বারে দ্বারে
ক্রমশঃ করে ভ্রমণ।
চল দেখাইব এ পুরী তোমারে
আগে দেখ যড়্‌ দ্বার,
কিরূপ আকৃতি প্রকৃতি প্রহরী
গতি মতি কিবা কার।”
এত কৈয়ে আশা লইয়া আমায়
চলিল প্রথম দ্বারে;
নিরখি সেখানে যুবা এক জন
দাঁড়ায়ে দ্বারের ধারে;
দ্বার-সন্নিধানে প্রকাণ্ড মূরতি,
অচলের এক পাশে
সে যুবা পুরুষ ভুরু দৃঢ় করি
দাঁড়ায়ে দেখে উল্লাসে;
হেলিয়া পড়েছে অচল শরীর,
সে যুবা ধরিয়া তায়
তুলিছে ফেলিছে অবলীলাক্রমে
ভুরূক্ষেপ নাহি কায়;
কতু সে অচলে ভ্রুকুটি করিয়া
যুবা হেরে মাঝে মাঝে,
নিহত কপোত নিক্ষেপি অন্তরে
নিরখে যেমন বাজে।
দেখিয়া যুবার বিচিত্র ব্যাপার
বিস্ময়ে নিস্পন্দ হই,

বাণীশূন্য হয়ে প্রমাদে ক্ষণেক
স্তম্ভিত ভাবেতে রই;
পরে কুতুহলে চাহি আশা-মুখ,
আশা বুঝি অভিপ্রায়
কহে “শক্তিরূপ প্রাণি-রঙ্গভূমে
এই দ্বারে হের তায়;
অসাধ্য ইহার নাহি এ ভবনে
যাহা ইচ্ছা তাহা করে;
জন্ম দৈত্যকুলে মানবমণ্ডলী
পুজে এরে সমাদরে।”
কহিয়া এতেক হৈয়ে অগ্রসর
আসিয়া দ্বিতীয় দ্বার
আশা কহে “বৎস, দেখ এ দুয়ারে
প্রাণী এক চমৎকার।”
দ্বিতীয় দ্বারেতে নিরখি বসিয়া
বৃদ্ধ প্রাণী একজন,
করি হেঁট মাথা বালুস্তৃপ পাশে
বালুকা করে গণন;
গুণিয়া গুণিয়া শিখর-সদৃশ
করিয়াছে বালুরাশি,
আবার গুণিয়া লয়ে ভার ভার
ঢালিছে তাহাতে আসি;
অন্ত কোন সাধ অন্য অভিলাষ
নাহি কিছু চিত্তে তার,
অনন্য মানসে বালি গুণি গুণি
করিছে শৈল-আকার;
অতি সাম্যভাব প্রকাশ বদনে
অণুমাত্র নাহি ক্লেশ,
অন্তরে শরীরে নহে বিকসিত
চাঞ্চল্য বিরক্তি লেশ।

আশা কহে “বৎস, ভুবনে প্রসিদ্ধ
ধরাতে সুখ্যাতি যার,
সে অধ্যবসায় প্রাণি-রঙ্গভূমে
চক্ষে দেখ এইবার।”
ক্রমে উপনীত তৃতীয় দুয়ারে
আসিয়া হেরি তখন,
দাঁড়ায়ে সে দ্বারে প্রাণী লক্ষ লক্ষ
করে দ্বারী-আরাধন;
মহা কোলাহল হয় সেই দ্বারে
শস্ত্রধারী সর্ব্বজন;
রবির আলোকে চমকে চমকে
অস্ত্রে অস্ত্র ঘরষণ;
নিরখি নির্ভীক পুরুষ জনেক
দ্বারেতে প্রহরী-বেশ,
অপাঙ্গ-ভঙ্গিতে বীর্য্য পরকাশি
চাহি দেখে অনিমেষ;
সম্মুখে উন্মত্ত কেশরী কুঞ্জর
করে ঘোরতর রণ,
নিমগ্ন ভাবেতে সেই বীর্য্যবান্‌
করে তাহ দরশন;
অটল শরীর আসি মধ্যস্থলে
দুই হাতে দোঁহে ধরে,
এক হাতে সিংহ, এক হাতে করী—
বেগ নিবারণ করে,
আবার উদ্রেক করিয়া উভয়ে
দেখে ঘোরতর রণ,
কেশরী কুঞ্জর লৈয়ে করে ক্রীড়া
মনসাধে অনুক্ষণ।
আশা কহে “দ্বারে দেখিছ যাহারে
সাহস তাহার নাম,

ইনি তুষ্ট যারে ধরা তুষ্ট তারে
মর্ত্যে ব্যক্ত গুণগ্রাম।”
চতুর্থ দুয়ারে আশা আ(ই)সে এবে
কহে “বৎস, ধৈর্য্য দেখ,
প্রাণি-রঙ্গভূমে এর তুল্য প্রাণী
হেরিতে না পাবে এক,
দেখ কিবা ছটা বদনে প্রদীপ্ত
কিবা সে প্রশান্ত ভাব,
এ মূর্ত্তি যে ভাবে পবিত্র হৃদয়ে
করে নিত্য সুখলাভ।”
বিস্ফারিত-নেত্র নিরখি সে দ্বারে
স্থিরদৃষ্টি এক জন
শূন্যে দৃষ্টি করি অন্তরের বেগ
সদা করে সম্বরণ;
ঘিরিয়া চৌদিকে ভুজঙ্গ তাহারে
দংশন করিছে কত,
এক(ই) ভাবে সদা তবু সে পুরুষ
গ্রীবাদেশ সমুন্নত,
মুখে নাহি স্বর নয়ন অপাঙ্গে
নাহি ঝরে অশ্রুকণা;
নাহি বহে ঘন শ্বাস নাসারন্ধ্রে,
নহেক চঞ্চলমনা।
কতিপয় মাত্র প্রাণী সেই দ্বারে
প্রবেশ করিছে হেরি,
দূরে দাঁড়াইয়া প্রাণী শত শত
আছয়ে সে দ্বার ঘেরি;
হেরি অপরূপ প্রাণী দ্বারদেশে
সন্ত্রমে সুধি আশায়,
সেরূপে সেখানে কেন সে বসিয়া
ফণী দংশে কেন গায়।



শুনিয়া বচন ধীর শাস্তমতি
ধৈর্য্য সে তখন কয়
"শুন বলি কেন হেন দশা মম
কিরূপে উদ্ভব হয়।
অদৃষ্ট সৃজন করিয়া বিধাতা
ভাবিয়া আকুল প্রাণ,—
অতি মধুময় মাধুরীতে তার
সর্ব্ব অঙ্গ নিরমাণ;
যা বলেন বিধি তখনি সে সাধে
যারে করে পরশন
দেব, দৈত্য, প্রাণী তখনি অমনি
বশীভূত সেই জন;
কিন্তু অঙ্গে তার ভুজঙ্গের মালা
পরাণী দেখিয়া ত্রাসে,
নিকটে তাহার আপন ইচ্ছাতে
কেহ না কখন আসে;
কি করেন বিধি ভাবিয়া অধীর
সৃজন বিফল হয়,
অদৃষ্টের কাছে প্রাণী কোন জন
সুস্থির নাহিক রয়।–
আমি দৈব-দোষে আসি হেন কালে
নিকটে করি গমন;
না জানি যে বিধি কি ভাবিলা মনে
আমারে হেরি তখন;
খুলি ফণিমালা অঙ্গ হৈতে তার
পরাইলা মম অঙ্গে,
কহিলা ভ্রমণ করিতে ভুবন
শরীরে বাঁধি ভুজঙ্গে;
বিধাতার বাক্য না পারি লঙ্ঘিতে
ত্রিলোক ভুবনে ফিরি

ফণিমালা গলে, অঙ্গ বিষে জ্বলে,
দিবা নিশি ধীরি ধীরি;
ব্রহ্মাণ্ড ভুবনে নাহি পাই স্থান
সুস্থির পরাণে থাকি,
শেষে আশা-পুরে আসি সুস্থ কিছু
এরূপে দুয়ার রাখি।
দেখি সুকুমার মানস তোমার
এ পুরী-ভ্রমণে তাপ
পাও যদি কভু, আসিও নিকটে,
ঘুচাইব সে সন্তাপ।”
শুনি ধৈর্য্য-বাণী হৈয়ে চমৎকৃত
চলিনু পঞ্চম দ্বার;
নিরখি সেখানে প্রহরী জনেক
প্রাণী অতি খর্ব্বাকার,
বামন আকৃতি সেই ক্ষুদ্র প্রাণী
কোদালি করিয়া হাতে,
করিছে খনন ধরণী-শরীর
নিত্য নিত্য অস্ত্রাঘাতে,
খনন করিয়া তুলিছে মৃত্তিকা
রাশিতে রাখিছে একা,
কলেবরে স্বেদ ঝরিছে সতত,
বদনে চিন্তার রেখা।
শুনি সেই দ্বারে প্রাণি-কোলাহল
নিবিড় জনতা তায়,
মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে প্রাণী প্রবেশিছে
পতঙ্গ কীটের প্রায়;
বসন-ভূষণ- বিহীন শরীর
ক্লেদ ঘর্ম্ম স্বেদ মলা,
অঙ্গে পরিপূর্ণ ক্ষুধা তৃষ্ণাতুর
কেশজাল তাম্রশলা।

নিরখি তাদের আক্লিষ্ট বদন
আশারে জিজ্ঞাসা করি,
কেন বা সে সব প্রাণী সেই দ্বারে
সেরূপ আকার ধরি।
আশা কহে “বৎস, অন্য কোন পথ
যে প্রাণী নাহিক পায়,
কর্ম্মক্ষেত্র-মাঝে এই দ্বারে তারা
প্রবেশ করিতে চায়;
শ্রম নামে দুঃখী শুনিয়াছ তুমি
নরে তুচ্ছ যার নাম,
সেই শ্রম এই হের মূর্ত্তি তার
কষ্টে সিদ্ধ মনস্কাম।”
শুনি আশা-বাণী দুঃখিত অন্তরে
নিকটে তাহার যাই,
বিনয়ে নিবৃত্ত করিয়া শ্রমেরে
বারতা ধীরে সুধাই;
সান্ত্বনা-বাক্যেতে হৈয়ে সুশীতল
কহে দ্বারী খেদস্বরে,
বলিতে বলিতে বক্ষঃস্থলে নিত্য
ঘর্ম্মবিন্দু ঘন ঝরে;
কহে “চিরদিন আমি এইরূপে
এই সে কোদালি ধরি,
ধরণী খনন করি অহরহ,
না জানি দিবা শর্ব্বরী,
প্রভাত ফুরায় আ(ই)সে অপরাহ্ন
আবার প্রভাত হয়,
তবু ক্ষণকাল এ ক্ষিতি খননে
আমার বিরাম নয়,
দিবস যামিনী খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া
নিত্য যা সঞ্চয় করি,

যে মৃত্তিকা-রাশি পবনে উড়ায়
কিম্বা অন্যে লয় হরি;
দশ বর্ষে যাহা তুলি আকিঞ্চনে
এক বাত্যাঘাতে নাশে,
না জানি কেন বা অদৃষ্টে আমার
এতই দুর্দ্দৈব আসে;
আর আর দ্বারে দ্বারী হের যত
কেহ না বিত্ন পোহায়,
ধূলিমুঠি করে না করিতে তারা
সোনামুঠি হয়ে যায়;
আমি যদি সোনা রাখি কণ্ঠে গাঁথি,
তখনি সে হয় ভস্ম,
শ্রমের ভাগ্যেতে নাই নাই শুধু,
কিবা অদ্য কি পরশ্ব;
অই যে দেখিছ তব সঙ্গে আশা
কত কি করিবে দান,
বলিয়া আমারে আনিল এখানে
এবে সে দেখ বিধান।”
শুনি চাহি ফিরে আশার বদন
আশা ফিরাইয়া মুখ,
কহে “বৎস, চল যাই ষষ্ঠ দ্বারে,
অদৃষ্টে উহার দুখ।”
ফেলি দীর্ঘশ্বাস চলি আশা-সনে
অগ্রভাগে ষষ্ঠ দ্বার,
হেরি স্তম্ভপাশে ভীম মহাবল
প্রাণী সেথা চমৎকার;
দাঁড়ায়ে চুয়ারে অতুল বিক্রমে
শূন্য পদে আছে স্থির,
করতলে ধরি আকাশ-মণ্ডল,
হুঙ্কার করে গম্ভীর;

নিশ্বাস প্রশ্বাস বহিছে সঘনে
অপরূপ তেজ তায়,
নিমেষে পরশে শরীর যাহার,
দেবশক্তি যেন পায়;
প্রাণিগণ আসি দ্বারে উপনীত
হয় নিত্য যেই ক্ষণ,
সে নিশ্বাস-বেগে আবর্ত্ত আকারে
প্রবেশে পুরে তখন;
যথা নদীগর্ভে ঘুরিতে ঘুরিতে
সলিল যখন চলে,
পড়িলে তাহাতে ভগ্নতরী-কাষ্ঠ
মুহূর্ত্তে প্রবেশে তলে,
এথা সেইরূপে ঘুরিতে ঘুরিতে
প্রাণী প্রবেশিছে তায়,
ক্ষণকাল স্থির কেহ দৃঢ় পদে
সেখানে নাহি দাঁড়ায়;
প্রাণীর আবর্ত্তে পড়িতে পড়িতে
আশা দৃঢ় করে ধরি
রাখিল আমারে স্তম্ভ-বহির্দ্দেশে
যতনে সুস্থির করি।
বিস্ময়ে তখন কৌতুক প্রকাশি
আশার বদন চাই,
আশা কহে “বৎস, না হও চঞ্চল
আছি সঙ্গে ভয় নাই;
এ মহাপুরুষ এই ষষ্ঠ দ্বারে
ভুবনে বিখ্যাত যিনি
উৎসাহ নামেতে অসম সাহস,
সেই মহাপ্রাণী ইনি।”
আশার বাক্যেতে উৎসাহ তখন
আনন্দে আগ্রহে অতি

বসায়ে নিকটে বলিতে লাগিল
সম্মুখে দেখায়ে পথি—
"এই পথে যাও কর্ম্মক্ষেত্র-মাঝে
না কর অন্তরে ভয়,
কে বলে ক্ষণিক মানব-জীবন?
জগতে প্রাণী অক্ষয়;
প্রাণি-রঙ্গভূমে ভ্রম তীব্র তেজে
শরীর অক্ষয় ভাব,
মৃত্যু তুচ্ছ করি জীবরঙ্গে মজি
দৈত্যের বিক্রমে ধাব;
শৈবালের জল স্বপন-প্রলাপ
নহে এ মানব-প্রাণ,
কীট কৃমি তুল্য আহার শয়ন
আত্মার নহে বিধান;
ব্রহ্মাণ্ড জিনিতে এ মহীমণ্ডলে
জীবাত্মা বিধির সৃষ্টি;
সেই ধন্য প্রাণী, নিত্য থাকে যার
সেই পথে দৃঢ় দৃষ্টি;
স্বকার্য্য সাধন নহে যত কাল
এ বিশ্ব-ভুবন মাঝে,
জ্ঞান বুদ্ধি বল ধন মান তেজ
দেহ প্রাণ কোন্‌ কাজে;
ধিক্‌ সে মানবে এখনও না পারে
প্রাণ সঞ্চারিতে জীবে,
এখন(ও) কৃতান্তে না পারে জিনিতে
সংহারি সর্ব্ব অশিবে;
কি কব এ তেজ সহিতে না পারে
নর-জাতি তেজোহীন,
নতুবা তাদের দেবতুল্য তেজ
করিতাম কত দিন।”

এত কৈয়ে ক্ষান্ত হইল উৎসাহ
নিশ্বাসে হুঙ্কার ছাড়ে;
কাঁপিতে কাঁপিতে প্রাণীর আবর্ত্ত
নিরখি আশার আড়ে;
মুহূর্ত্তে শতেক সহস্র পরাণী
ঘুরিতে ঘুরিতে যায়,
দ্বারদেশে পশি তিলার্দ্ধেক কাল
ভূমিতে নাহি দাঁড়ায়।
বিস্ময়ে তখন আশার সংহতি
নগরে প্রবিষ্ট হই,
প্রবেশি নগরে ক্ষণকাল যেন
স্তম্ভিত হইয়া রই;
পরে নিরীক্ষণ করি চারি দিকে
প্রাণী হেরি রঙ্গভূমে,
শত শত প্রাণী শত শত ভাবে
গতি করে মহা ধুমে;
নিরখি কোথাও কেতন সুন্দর
বহুমূল্য বিরচিত;
কোথাও চিত্রিত রঞ্জিত বসনে
ধরাতল সুসজ্জিত;
কোথা চন্দ্রাতপ অভ্র-শোভাকর
বিস্তৃত গগনভালে;
কোথা যবনিকা চিত্রিত দুকুল
আচ্ছাদিত হেমজালে;
মুকুতা-জড়িত বসনে আবৃত
তুরঙ্গ কুঞ্জর কত
পথে পথে পথে ক্ষিতি ক্ষুব্ধ করি
গতি করে অবিরত;
হীরক-মণ্ডিত যান শত শত
পথে পথে করে গতি;

জনতার স্রোতে নগর প্লাবিত
রজঃপরিপূর্ণ পথি;
কোথা বা সুন্দর হেম মণিময়
আসন সজ্জিত আছে;
প্রাণী লক্ষ লক্ষ করি কর যোড়
দাঁড়ায়ে তাহার কাছে;
বসিয়া আসনে প্রাণী কোন জন
হেমদণ্ড করতলে,
আকাশ বিদীর্ণ, ঘন জয়ধ্বনি,
প্রাণিবৃন্দ কোলাহলে;
হেরি স্থানে স্থানে বসি কত জন,
শিরস্ত্রাণে জ্বলে মণি,
ইঙ্গিতে কটাক্ষ হেলায় যে দিকে
সেই দিকে স্তবধ্বনি;
কোথা বা সুসজ্জ তুরঙ্গম-পৃষ্ঠে
কেহ করে আরোহণ,
বান্ধিয়া কটিতে হিরণ্য-মণ্ডিত
আসি লগ্ন সারসন;
কোটি কোটি প্রাণী ইঙ্গিত-কটাক্ষে
চৌদিকে ছুটিছে তার,
করিছে গর্জ্জন, অসি নিষ্কাসন,
ভীষণ ঘন চীৎকার;
কোন দিকে পুনঃ হেরি কত বামা
অন্তরে ভাবিয়া সুখ
বাঁধিছে কবরী বিননী বিনায়ে,
হাসিরাশি মাখা মুখ;—
কেহ বা কুসুমে পাতিছে আসন
কোমল ধরণীতলে,
বসিছে তাহাতে অন্তরে সুখিনী
সিঞ্চিয়া সুগন্ধি জলে;

কেহ বা চিকণ পরিয়া বসন
করতলে মণিমালা
দুলাইছে ধীরে, বাজুতে ঘুংঘুর,
বাহুতে বাজিছে বালা;
চলে কোন ধনী ধীরে ধীরে ধীরে
চারু কলা যেন শশী,
যুবা কোন জন আঁকে রূপ তার
ধীরে ধরাতলে বসি;
চলে কোন বামা রাঙ্গা পদতল
পড়ে ধরণীর বুকে,
যুবা কোন জন কোমল বসন
সম্মুখে পাতিছে সুখে,
নিরখি কোথাও নারী কোন জন
বসিয়া ধরণীতলে,
কোলে সুকুমার হেরে শিশুমুখ
ব্যজন করি অঞ্চলে;
প্রসন্ন-বদন দাঁড়ায়ে নিকটে
হৃদয়বল্লভ তার,
হেরে প্রিয়ামুখে, কতু শিশুমুখে
মৃদু হাসি অনিবার;
হেরি কোনখানে প্রণয়ীর ক্রোড়ে
প্রমদা সোহাগে দোলে;
শশচিহ্ন যথা পূর্ণ ষোল কলা
শোভে শশাঙ্কের কোলে;
কোথাও দাঁড়ায়ে প্রাণী কোন জন,
ঘেরে তার চারি পাশ
চাতক যেমন আছে শত জন
বদনে প্রকাশ আশ;
আনন্দে মগন সেই সুখী প্রাণী
ধরিয়া কাঞ্চনডালা,

পুরি করতল করে বিতরণ
বিবিধ রতন-মালা;
তনয় তনয়া নিকটে যাহারা
বান্ধব যতেক জন,
বদন তাঁহার ভাবি শশধর
সুখে করে নিরীক্ষণ;
কোথাও আবার ধূলি-ধূসরিত
সহস্র সহস্র প্রাণী
করিছে ক্রন্দন ভার-ভগ্ন দেহ
শিরে করাঘাত হানি;
যুবা, বৃদ্ধ, শিশু স্বেদ-আর্দ্র বপু,
বসনবিহীন কায়,
অনশনে ক্ষীণ, শিরে কক্ষে ভার,
কত কোটি প্রাণী যায়;
হাসে খেলে কত কাঁদে কত প্রাণী
ভাবে বসি কত জন,
কেহ অন্ধকারে, কেহ বা মাণিক-
কিরণে করে ভ্রমণ;
কত অপরূপ, কত কি অদ্ভুত,
রহস্য এরূপ কত
দেখি চক্ষু মেলি প্রাণি-রঙ্গভূমে
চলিতে চলিতে পথ।