বিষয়বস্তুতে চলুন

জাপান-যাত্রী/৪

উইকিসংকলন থেকে

 ২৪শে বৈশাখ অপরাহ্ণে রেঙ্গুনে পৌঁছন গেল।

 চোখের পিছনে চেয়ে দেখার একটা পাকযন্ত্র আছে, সেইখানে দেখাগুলাে বেশ করে’ হজম হয়ে না গেলে সেটাকে নিজের করে’ দেখানাে যায় না। তা’ নাইবা দেখানাে গেল—এমন কথা কেউ বল্‌তে পারেন। যেখানে যাওয়া গেছে সেখান্‌কার মােটামুটি বিবরণ দিতে দোষ কি?

 দোষ না থাক্‌তে পারে,― কিন্তু আমার অভ্যাস অন্যরকম। আমি টুঁকে যেতে টেঁকে যেতে পারিনে। কখনো কখনাে নােট নিতে ও রিপাের্ট দিতে অনুরুদ্ধ হয়েছি, কিন্তু সে সমস্ত টুক্‌রাে কথা আমার মনের মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে ছড়িয়ে পড়ে যায়। প্রত্যক্ষটা একবার আমার মনের নেপথ্যে অপ্রত্যক্ষ হয়ে গিয়ে তার পরে যখন প্রকাশের মঞ্চে এসে দাঁড়ায় তখনই তার সঙ্গে আমার ব্যবহার।

 ছুটতে ছুটতে তাড়াতাড়ি দেখে দেখে বেড়ানাে আমার পক্ষে ক্লান্তিকর এবং নিষ্ফল। অতএব আমার কাছ থেকে বেশ ভ্রমণ বৃত্তান্ত তােমরা পাবে না। আদালতে সত্যপাঠ করে’ আমি সাক্ষী দিতে পারি যে, রেঙ্গুন নামক এক সহরে আমি এসেছিলুম; কিন্তু যে আদালতে আরো বড় রকমের সত্যপাঠ করতে হয়, সেখানে আমাকে বলতেই হবে রেঙ্গুনে এসে পৌঁছই নি।

 এমন হতেও পারে রেঙ্গুন সহরটা খুব একটা সত্য বস্তু নয়। রাস্তাগুলি সোজা, চওড়া, পরিষ্কার, বাড়িগুলি তক্‌তক্‌ করছে, রাস্তায় ঘাটে মাদ্রাজি, পাঞ্জাবী, গুজরাটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার মধ্যে হঠাৎ কোথাও যখন রঙীন রেশমের কাপড়-পরা ব্রহ্মদেশের পুরুষ বা মেয়ে দেখ্‌তে পাই, তখন মনে হয় এরাই বুঝি বিদেশী। আসল কথা গঙ্গার পুলটা যেমন গঙ্গার নয়, বরঞ্চ সেটা গঙ্গার গলার ফাঁসি―রেঙ্গুন সহরটা তেমনি ব্রহ্মদেশের সহর নয়, ওটা যেন সমস্ত দেশের প্রতিবাদের মত।

 প্রথমত ইরাবতী নদী দিয়ে সহরের কাছাকাছি যখন আসচি, তখন ব্রহ্মদেশের প্রথম পরিচয়টা কি? দেখি তীরে বড় বড় সব কেরোসিন তেলের কারখানা লম্বা লম্বা চিমনি আকাশে তুলে দিয়ে ঠিক যেন চিৎ হয়ে পড়ে বর্ম্মা চুরুট খাচ্চে। তার পরে যত এগোতে থাকি, দেশ বিদেশের জাহাজের ভিড়। তারপর যখন ঘাটে এসে পৌঁচই, তখন তট বলে পদার্থ দেখা যায় না—সারি সারি জেটিগুলো যেন বিকটাকার লোহার জোঁকের মত ব্রহ্মদেশের গায়ে একবারে ছেঁকে ধরেচে। তারপরে আপিস, আদালত, দোকান, বাজারের মধ্যে দিয়ে আমার বাঙালী বন্ধুদের বাড়ীতে গিয়ে উঠলুম, কোনো ফাঁক দিয়ে ব্রহ্মদেশের কোনো চেহারাই দেখ্‌তে পেলুম না। মনে হল রেঙ্গুন ব্রহ্মদেশের ম্যাপে আছে, কিন্তু দেশে নেই। অর্থাৎ এ সহর দেশের মাটি থেকে গাছের মত ওঠে নি, এ সহর কালের স্রোতে ফেনার মত ভেসেছে,― সুতরাং এর পক্ষে এ চায়গাও যেমন অন্য জায়গাও তেমনি।

 আসল কথা পৃথিবীতে যে-সব সহর সত্য তা’ মানুষের মমতার দ্বারা তৈরি হয়ে উঠেচে। দিল্লি বল, আগ্রা বল, কাশী বল, মানুষের আনন্দ তাকে সৃষ্টি করে তুলেচে। কিন্তু বাণিজ্যলক্ষ্মী নির্ম্মম, তার পায়ের নীচে মানুষের মানস-সরোবরের সৌন্দর্য্য-শতদল ফোটে না। মানুষের দিকে সে তাকায় না, সে কেবল দ্রব্যকে চায়,——যন্ত্র তার বাহন। গঙ্গা দিয়ে যখন আমাদের জাহাজ আস্‌ছিল, তখন বাণিজ্যশ্রীর নির্লজ্জ নির্দ্দয়তা নদীর দুই ধারে দেখ্‌তে দেখ্‌তে এসেছি। ওর মনে প্রীতি নেই বলেই বাংলাদেশের এমন সুন্দর গঙ্গার ধারকে এত অনায়াসে নষ্ট করতে পেরেচে।

 আমি মনে করি আমার পরম সৌভাগ্য এই যে, কদর্য্যতার লৌহ-বন্যা যখন কলকাতার কাছাকাছি দুই তীরকে, মেটেবুরুজ থেকে হুগলি পর্য্যন্ত, গ্রাস করার জন্যে ছুটে আস্‌ছিল, আমি তার আগেই জন্মেছি। তখনো গঙ্গার ঘাটগুলি গ্রামের স্নিগ্ধ বাহুর মত গঙ্গাকে বুকের কাছে আপন করে’ ধরে রেখেছিল, কুঠির নৌকাগুলি তখনো সন্ধ্যাবেলায় তীর তীরে ঘাটে ঘাটে ঘরের লোকগুলিকে ঘরে ঘরে ফিরিয়ে আন্‌ত। একদিকে দেশের হৃদয়ের ধারা, আর একদিকে দেশের এই নদীর ধারা, এর মাঝখানে কোনো কঠিন কুৎসিৎ বিচ্ছেদ দাঁড়ায় নি।

 তখনো কলকাতার আশেপাশে বাংলাদেশের যথার্থ রূপটিকে দুই চোখ ভরে’ দেখবার কোনো বাধা ছিল না। সেই জন্যেই কলকাতা আধুনিক সহর হলেও, কোকিল শিশুর মত তার পালন-কর্ত্রীর নীড়কে একেবারে রিক্ত করে’ অধিকার করে নি। কিন্তু তারপরে বাণিজ্য-সভ্যতা যতই প্রবল হয়ে উঠ্‌তে লাগল, ততই দেশের রূপ আচ্ছন্ন হতে চল্‌ল। এখন কলকাতা বাংলা দেশকে আপনার চারিদিক থেকে নির্ব্বাসিত করে’ দিচ্চে,— দেশ ও কালের লড়াইয়ে দেশের শ্যামল শোভা পরাভূত হল, কালের করাল মূর্ত্তিই লোহার দাঁত নখ মেলে’ কালো নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল।

 এক সময়ে মানুষ বলেছিল, “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ”। তখন মানুষ লক্ষ্মীর যে-পরিচয় পেয়েছিল সে ত কেবল ঐশ্বর্য্যে নয়, তার সৌন্দর্য্যে। তার কারণ, বাণিজ্যের সঙ্গে তখন মনুষ্যত্বের বিচ্ছেদ ঘটে নি। তাঁতের সঙ্গে তাঁতীর, কামারের হাতুড়ির সঙ্গে কামারের হাতের, কারিগরের সঙ্গে তার কারুকার্য্যের মনের মিল ছিল। এইজন্যে বাণিজ্যের ভিতর দিয়ে মানুষের হৃদয় আপনাকে ঐশ্বর্য্যে বিচিত্র করে সুন্দর করে ব্যক্ত করত। নইলে লক্ষ্মী তাঁর পদ্মাসন পেতেন কোথা থেকে? যখন থেকে কল হল বাণিজ্যের বাহন, তখন থেকে বাণিজ্য হল শ্রীহীন। প্রাচীন ভেনিসের সঙ্গে আধুনিক ম্যাঞ্চেস্টরের তুলনা করলেই তফাৎটা স্পষ্ট দেখ্‌তে পাওয়া যাবে। ভেনিসে সৌন্দর্য্যে এবং ঐশ্বর্য্যে মানুষ আপনারই পরিচয় দিয়েচে, ম্যাঞ্চেষ্টরে মানুষ সব দিকে আপনাকে খর্ব্ব করে আপনার কলের পরিচয় দিয়েচে। এই জন্য কল-বাহন বাণিজ্য যেখানেই গেছে সেখানেই আপনার কালিমায় কদর্য্যতায় নির্ম্মমতায় একটা লােলুপতার মহামারী সমস্ত পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ করে দিচ্চে। তাই নিয়ে কাটাকাটি হানাহানির আর অন্ত নেই; তাই নিয়ে অসত্যে লোকালয় কলঙ্কিত এবং রক্তপাতে ধরাতল পঙ্কিল হয়ে উঠল। অন্নপূর্ণা আজ হয়েচেন কালী; তাঁর অন্ন পরিবেষণের হাতা আজ হয়েচে রক্তপান করবার খর্পর। তাঁর স্মিতহাস্য আজ অট্টহাস্যে ভীষণ হল। যাই হোক্, আমার বলবার কথা এই যে, বাণিজ্য মানুষকে প্রকাশ করে না, মানুষকে প্রচ্ছন্ন করে।

 তাই বল্‌চি, রেঙ্গুন ত দেখলুম কিন্তু সে কেবল চোখের দেখা, সে দেখার মধ্যে কোন পরিচয় নেই;―সেখান থেকে আমার বাঙালী বন্ধুদের আতিথ্যের স্মৃতি নিয়ে এসেছি, কিন্তু ব্রহ্মদেশের হাত থেকে কোনো দক্ষিণা আন্‌তে পারি নি। কথাটা হয়ত একটু অত্যুক্তি হয়ে পড়ল। আধুনিকতার এই প্রাচীরের মধ্যে দেশের একটা গবাক্ষ হঠাৎ একটু খােলা পেয়েছিলুম। সােমবার দিনে সকালে আমার বন্ধুরা এখানকার বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে গেলেন।

 এতক্ষণে একটা কিছু দেখতে পেলুম। এতক্ষণ যার মধ্যে ছিলুম সে একটা এব্‌স্‌ট্রাক্‌শন সে একটা আচ্ছিন্ন পদার্থ। সে একটা সহর, কিন্তু কোনো-একটা সহরই নয়। এখন যা দেখচি, তার নিজেরই একটা বিশেষ চেহারা আছে। তাই সমস্ত মন খুসি হয়ে, সজাগ হয়ে উঠ্‌ল। আধুনিক বাঙালীর ঘরে মাঝে মাঝে খুব ফ্যাশানওয়ালা মেয়ে দেখতে পাই; তারা খুব গট্‌গট্‌ করে চলে, খুব চট্‌পট্‌ করে ইংরেজি কয় দেখে মস্ত একটা অভাব মনে বাজে,― মনে হয় ফ্যাশানটাকেই বড় করে দেখ্‌চি, বাঙালীর মেয়েটিকে নয়; এমন সময় হঠাৎ ফ্যাশানজালমুক্ত সরল সুন্দর স্নিগ্ধ বাঙালী-ঘরের কল্যাণীকে দেখ্‌লে তখনি বুঝিতে পারি এ ত মরীচিকা নয়, স্বচ্ছ গভীর সরোবরের মত এর মধ্যে একটি তৃষাহরণ পূর্ণতা আপন পদ্মবনের পাড়টি নিয়ে টলমল করচে। মন্দিরের মধ্যে ঢুকতেই আমার মনে তেমনি একটি আনন্দের চমক লাগল; মনে হল, যাই হোক কেন, এটা ফাঁকা নয়—যেটুকু চোখে পড়চে এ তার চেয়ে আরো অনেক বেশি। সমস্ত রেঙ্গুন সহরটা এর কাছে ছোট হয়ে গেল—বহুকালের বৃহুৎ ব্রহ্মদেশ এই মন্দিরটুকুর মধ্যে আপনাকে প্রকাশ করলে।

 প্রথমেই বাইরের প্রখর আলো থেকে একটি পুরাতন কালের পরিণত ছায়ার মধ্যে এসে প্রবেশ করলুম। থাকে থাকে প্রশস্ত সিঁড়ি উঠে চলেচে—তার উপরে আচ্ছাদন। এই সিঁড়ির দুই ধারে ফল, ফুল, বাতি, পূজার অর্ঘ্য বিক্রি চল্‌চে। যারা বেচ্‌চে তারা অধিকাংশই ব্রহ্মীয় মেয়ে। ফুলের রঙের সঙ্গে তাদের রেশমের কাপড়ের রঙের মিল হয়ে মন্দিরের ছায়টি সূর্য্যাস্তের আকাশের মত বিচিত্র হয়ে উঠেচে। কেনাবেচার কোন নিষেধ নেই, মুসলমান দোকানদারেরা বিলাতি মণিহারির দোকান খুলে বসে গেছে। মাছ মাংসেরও বিচার নেই, চারিদিকে খাওয়া দাওয়া ঘরকন্না চল্‌চে। সংসারের সঙ্গে মন্দিরের সঙ্গে ভেদমাত্র নেই—একেবারে মাখামাখি। কেবল, হাটবাজারে যেরকম গোলমাল, এখানে তা’ দেখা গেল না। চারিদিক নিরালা নয়, অথচ নিভৃত; স্তব্ধ নয়, শান্ত। আমাদের সঙ্গে ব্রহ্মদেশীয় একজন ব্যারিষ্টার ছিলেন, এই মন্দির সোপানে মাছ-মাংস কেনাবেচা এবং খাওয়া চল্‌চে, এর কারণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বল্লেন, বুদ্ধ আমাদের উপদেশ দিয়েচেন—তিনি বলে’ দিয়েচেন কিসে মানুষের কল্যাণ, কিসে তার বন্ধন; তিনি ত জোর করে কারো ভালো করতে চান নি; বাহিরের শাসনে কল্যাণ নেই, অন্তরের ইচ্ছাতেই মুক্তি; এই জন্যে আমাদের সমাজে বা মন্দিরে আচার সম্বন্ধে জবরদস্তি নেই।

 সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেখানে গেলুম সেখানে খোলা জায়গা, তারই নানাস্থানে নানারকমের মন্দির। সে মন্দিরে গাম্ভীর্য্য নেই, কারুকার্য্যের ঠেলাঠেসি ভিড়—সমস্ত যেন ছেলেমানুষের খেলনার মত। এমন অদ্ভুত পাঁচমিশালি ব্যাপার আর কোথাও দেখা যায় না—এ যেন ছেলে-ভুলোনো ছড়ার মত; তার ছন্দটা একটানা বটে, কিন্তু তার মধ্যে যা’-খুশি-তাই এসে পড়েচে, ভাবে পরস্পর-সামঞ্জস্যের কোনো দরকার নেই। বহুকালের পুরাতন শিল্পের সঙ্গে এখানকার নিতান্ত সস্তাদরের তুচ্ছতা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন। ভাবের অসঙ্গতি ব’লে যে কোনো পদার্থ আছে, এরা তা’ যেন একেবারে জানেই না। আমাদের কলকাতায় বড়মানুষের ছেলের বিবাহ-যাত্রায় রাস্তা দিয়ে যেমন সকল রকমের অদ্ভুত অসামঞ্জস্যের বন্যা বয়ে যায়— কেবলমাত্র পুঞ্জীকরণটাই তার লক্ষ্য, সজ্জীকরণ নয়,—এও সেই রকম। এক ঘরে অনেকগুলো ছেলে থাক্‌লে যেমন গোলমাল করে, সেই গোলমাল করাতেই তাদের আনন্দ—এই মন্দিরের সাজসজ্জা, প্রতিমা, নৈবেদ্য, সমস্ত যেন সেইরকম, ছেলেমানুষের উৎসব—তার মধ্যে অর্থ নেই, শব্দ আছে। মন্দিরের ঐ সোনা-বাঁধানো পিতল-বাঁধানো চূড়াগুলি ব্রহ্মদেশের ছেলেমেয়েদের আনন্দের উচ্চহাস্য মিশ্রিত হো হো শব্দ—আকাশে ঢেউ খেলিয়ে উঠ্‌চে। এদের যেন বিচার করবার, গম্ভীর হবার বয়স হয়নি। এখানকার এই রঙিন মেয়েরাই সব চেয়ে চোখে পড়ে। এদেশের শাখাপ্রশাখা ভরে এরা যেন ফুল ফুটে রয়েছে। ভুঁইচাঁপার মত এরাই দেশের সমস্ত—আর কিছু চোখে পড়ে না।

 লোকের কাছে শুন্‌তে পাই, এখানকার পুরুষেরা অলস ও আরামপ্রিয়; অন্য দেশের পুরুষের কাজ প্রায় সমস্তই এখানে মেয়েরা করে’ থাকে। হঠাৎ মনে আসে এটা বুঝি মেয়েদের উপরে জুলুম করা হয়েচে। কিন্তু ফলে ত তার উল্টোই দেখ্‌তে পাচ্চি—এই কাজকর্ম্মের হিল্লোলে মেয়েরা আরো যেন বেশি করে’ বিকশিত হয়ে উঠেচে। কেবল বাইরে বেরতে পারাই যে মুক্তি তা’ নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তার চেয়ে বড় মুক্তি। পরাধীনতাই সব চেয়ে বড় বন্ধন নয়, কাজের সঙ্কীর্ণতাই হচ্ছে সব চেয়ে কঠোর খাঁচা।

 এখানকার মেয়েরা সেই খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে এমন পুর্ণ এবং আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেচে। তারা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজের কাছে সঙ্কুচিত হয়ে নেই। রমণীর লাবণ্যে যেমন তারা প্রেয়সী, শক্তির মুক্তিগৌরবে তেমনি তারা মহীয়সী। কাজেই যে মেয়েদের যথার্থ শ্রী দেয়, সাঁওতাল মেয়েদের দেখে তা’ আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। তারা কঠিন পশ্রিম করে—কিন্তু কারিগর যেমন কঠিন আঘাতে মূর্ত্তিটিকে সুব্যক্ত করে’ তোলে তেমনি এই পরিশ্রমের আঘাতেই এই সাঁওতাল মেয়েদের দেহ এমন নিটোল, এমন সুব্যক্ত হয়ে ওঠে, তাদের সকল প্রকার গতিভঙ্গীতে এমন একটা মুক্তির মহিমা প্রকাশ পায়। কবি কীট্‌স্‌ বলেছেন, সত্যই সুন্দর অর্থাৎ সত্যের বাধামুক্ত সুসম্পূর্ণতাতেই সৌন্দর্য্য। সত্য মুক্তি লাভ করলে আপনিই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়। প্রকাশের পূর্ণতাই সৌন্দর্য্য, এই কথাটাই আমি উপনিষদের এই বাণীতে অনুভব করি—আনন্দ-রূপমমৃতং যদ্বিভাতি; অনন্তস্বরূপ যেখানে প্রকাশ পাচ্চেন, সেইখানেই তাঁর অমৃতরূপ আনন্দরূপ। মানুষ ভয়ে, লোভে, ঈর্ষায় মুঢ়তায়, প্রয়োজনের সঙ্কীর্ণতায় এই প্রকাশকে আচ্ছন্ন করে, বিকৃত করে; এবং সেই বিকৃতিকেই অনেক সময় বড় নাম দিয়ে বিশেষ ভাবে আদর করে’ থাকে।

তোসা-মারু জাহাজ, ২৭শে বৈশাখ, ১৩২৩।