পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৯৭

একবার রবীন্দ্রনাথের কথা কয়টি স্মরণ করিয়া লওয়া যাক— “কবিতাগুলি আমি লিখব বলে লিখিনি—এ আমার জীবনের ভিতরের জিনিষ—এ আমার সত্যকার আত্মনিবেদন—এর মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ, সমস্ত সাধনা বিগলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে।”

 ‘গীতাঞ্জলি’ সম্পর্কে যে সব কথা বলা হইয়াছে, তাহার সমর্থনে এবং প্রমাণ হিসাবে মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্র হইতেই কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত হইবে, কারণ, অধিক উদ্ধৃতি বাহল্য।—

 গীতাঞ্জলিতে একটি গানে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—

হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।

 উপনিষদে ব্রহ্মকে বলা হইয়াছে জীব-হৃদয়ে অন্তর্যামী। এই অন্তর্যামীই রবীন্দ্রনাথের ‘হে মোর দেবতা’। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটি হইল যে, তাঁহার মধ্যেই তাঁহার অন্তর্যামীরূপে ভগবানের এই অবস্থিতি কেন? কি তিনি চাহেন?

 উপনিষদে পাওয়া যায় যে, তিনি অগ্রে একা ছিলেন, এই একাকিত্বে নিজেকে নিজে সঙ্গ দিবার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘বহুস্যাম’—বহু হইয়াছেন। অর্থাৎ আপন সৃষ্টিতে তিনি আপনিই ভোক্তা-ভর্তা-দ্রষ্টা-অনুমন্তা ইত্যাদিরূপে অনুপ্রবিষ্ট রহিয়াছেন। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের এই জিজ্ঞাসা ব্রহ্মের নিকটেই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা।

 জিজ্ঞাসাটিকে আরও স্পষ্ট করিয়া রবীন্দ্রনাথ রূপ দিয়াছেন—

আমার নয়নে তোমার বিশ্ব ছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি—
আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান?

 উপনিষদের একটি উপদেশে আছে,—

 “হৃদয় মধ্যে অধিষ্ঠিত সেই সম্ভজনীয় আত্মকে ইন্দ্রিয় সমুদয় উপঢৌকন প্রদান করে॥” প্রজারা যেমন রাজাকে ভেট দেয়, ইন্দ্রিয়বর্গও সেইরূপ অন্তর্যামী আত্মার আনন্দ বিধানে সর্বদা তৎপর—ইহাই হইল উপদেশটির অর্থ।

 উপনিষদের উপদিষ্ট এই সত্যটিই রবীন্দ্রনাথের আপন জীবনে একটি প্রশ্নে অপূর্ব সন্দর রূপান্তর গ্রহণ করিয়াছে—হে মোর দেবতা ইত্যাদি।”