পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
১০১

যাজ্ঞবল্ক্যই বলিয়াছেন, ‘মূর্তানন্দ’। রবীন্দ্রনাথের মুখে সেই পরম বাণীই শোনা গিয়াছে যে, এই সৃষ্টিই আনন্দ, এই সৃষ্টি আর কিছ, নহে—‘মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ।’

 ইহার পরের উক্তিতে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের পরিপূর্ণ প্রকাশ ও প্রণাম এক সঙ্গেই পাওয়া যায়—

চেতনা আমার কল্যাণ-রস-সরসে
শতদল সম ফুটিল পরম হরষে
সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া।

 উপনিষদের ঋষির প্রার্থনা ছিল—হিরন্ময় জ্যোতিতে সত্যের মুখে আবৃত, সেই আবরণ অপসৃত হউক, যত্তে রূপং কল্যাণতম তত্তে পশ্যামি। আর সত্যের কল্যাণতম দক্ষিণ মুখটি এখানে অনাবৃত, তাই সত্যের মুখ দেখিবার প্রার্থনা নাই, আছে শুধু চরণে পরিপূর্ণ একটি প্রণামে আত্মনিবেদনে।

 অধিক উদ্ধৃতির প্রয়োজন নাই, আর উদ্ধৃতির শেষও যে অসম্ভব। পূর্বেই বলিয়াছি যে, গীতাঞ্জলি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের হৃদয় রস। এ রস অন্তহীন অশেষ, এ রস গভীর অতল। ভক্ত ও ভগবানের বাসর-ঘরের এই নিভৃত লীলা, সীমা ও অসীমের এই অনন্ত রস কৌতুক, আত্মা ও পরমাত্মার এই মিলন-বিরহ—ইহার আদিই বা কোথায়? ইহার অন্তই বা কোথায়?

 আর তাহাকেই ব্রহ্মের লীলাসঙ্গী রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির শুভ্র অঞ্জলিতে ভরিয়া রাখিয়াছেন, যেমন শিবের দুই নেত্রের কমণ্ডলুতে নিখিল ভাস্বর জ্ঞান জ্যোতি এবং নিখিল আনন্দ প্রেম কল্যাণ বিধৃত। এই কারণেই গীতাকে বলিয়াছি,—শুধু তত্ত্ব, আর গীতাঞ্জলিকে বলিয়াছি—রসো বৈ সঃ।—উদ্ধৃতি অনন্তকালেও যে শেষ হইবার নহে।

 উপনিষদে অঙ্কিত ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের রেখাচিত্র দেখিয়াছি—অহো-অহো-অহো বিস্ময় উন্মাদ। আর ভক্তিশাস্ত্রের বেদগ্রন্থ ভাগবতে মহাব্রহ্মজ্ঞের ভক্তরাজরূপ-চিত্রটি পাই দৈত্যরাজ প্রহ্লাদের চরিত্রে। সে চিত্রটি এই—

কবচিদ্ রূদতি বৈকুণ্ঠ-চিন্তা-শবল চেতনঃ।
কবচিদ্ধসতি তচ্চিন্তাহলাদ উদ্গায়তি ক্বচিৎ॥
············ইত্যাদি॥

 —প্রহলাদ কখন ভগবানের চিন্তায় আকুল চিত্তে রোদন করিত, কখন তাঁহার মিলনানন্দে হাস্য করিত, কখন গান করিত, কখন মক্তকণ্ঠে চীৎকার করিত, কখন